বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এবং শ্রেণীবিভাগ


নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ ঢং বা রীতি। নাটক বাংলা সাহিত্যতত্ত্বের একটি পারিভাষিক শব্দ । যেটি ইংরেজি Drama/Play শব্দের পরিভাষা হিসেবে বাংলায় গৃহীত হয়েছে। সাধারণত একটি লিখিত ডকুমেন্ট অনুসরণ করে অভিনয় করে নাটক পরিবেশন করা হয়ে থাকে।যেহেতু নাটক অভিনয়ের জন্যই লেখা হয় সেহেতু তাকে অভিনয় করার যোগ্য হতে হয়।লেখার পূর্বেই অভিনয়ের স্থান,কাল, পাত্র ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।নতুবা একটি সার্থক নাটক লেখা সম্ভব নয়। নাটক প্রদর্শনের মূল হাতিয়ার সংলাপ। কাহিনি, চরিত্র, ঘটনাসমাবেশ ও সংলাপ হলো নাটকের মূল অঙ্গ । সংলাপবিহীন অভিনয়ও নাটকে প্রদর্শিত হয়। এই বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বা শুরুটা জানতে হলে আমাদেরকে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বেকার সময়ে ফিরে যেতে হবে।কারণ তখন থেকেই বাংলা নাটকের উৎপত্তি।শুরতে আমরা নাটক কাকে বলে জেনে আসি।

নাটক কাকে বলে

রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে মানুষের সুখ-দুঃখকে স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে নাটক বলে। নাটক সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। নাটকে রস উপলদ্ধির বিষয়টি জড়িত বলে ,এর অপর নাম ‘দৃশ্যকাব্য’। মূলত দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্যের সমন্বয়ে নাটক মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের কাছে মূর্ত্ত করে তোলে।অন্য কথায় কোনো দ্বন্দ্বমূলক আখ্যান যদি চরিত্রসমূহের সংলাপের মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠে তাহলে তাকে নাটক বলে । নাটকের উপাদান চারটি যথা ১.মূল ভাবনা বা প্রেমিজ ২.কাহিনি বা প্লট ৩.চরিত্র ৪. সংলাপ। গদ্যরীতির উৎকর্ষের পরেই নাটকের যাত্রা। বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এর প্রথম পর্যায়ে আমরা নাট্যমঞ্চের উৎপত্তি সম্পর্কে জানব।

বাংলা নাট্যমঞ্চের উৎপত্তি

১৭৫৩ সালে ইংরেজরা কলকাতার লালবাজারে “প্লে হাউস” নামে প্রথম রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করেন।বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৭৯৫ সালে। প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী হেরাসিম লেবেদেফ। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) তিনি ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ নামক একটি নাট্যমঞ্চ স্থাপন করেন। এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল, যেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই অভিনীত হতো। হেরাসিম লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন, যেমন: হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায়ও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি (১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ (১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার (১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০৫), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ( টাঙ্গাইল, ১৯১১) ইত্যাদি। এ সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষ, এলেংগা, শিবপুর, আলোয়া ও করটিয়ার জমিদাররা বেশ কয়েকটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়।

পরিপূর্ণভাবে বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ জানার জন্য আমাদেরকে বাংলা নাটকের বিকাশ সম্পর্কেও জানতে হবে।

বাংলা নাটকের বিকাশ

১৭৯৫ সালে হেরাসিম লেবেডেফ প্রথম The Disguise ও Love is the best Doctor নামে দুটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে এদেশীয় পাত্র-পাত্রীর দ্বারা অভিনয় করান। ’The Disguise ও Love is the best Doctor’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম নাটক।তবে এগুলো অনুবাদ নাটক। তখনো বাংলা ভাষায় কোন নাটক লেখা হয় নি।বাংলা নাটক প্রথম মঞ্চে অভিনীত হয় ১৮৩১ সালে।

প্রথম বাংলা মৌলিক নাটক তারাচরণ শিকদার কর্তৃক ১৮৫২ সালে রচিত ‘ভদ্রার্জুন' । এ নাটকের মূল বিষয় অর্জুন কর্তৃক সুভদ্রা হরণের কাহিনি। মহাভারত থেকে কাহিনি সংগ্রহ করা হলেও বাঙালি সমাজের বাস্তব পরিবেশ এতে অঙ্কিত হয়েছে। এটি বাঙালি কর্তৃক এবং বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কমেডি নাটক ।

১৮৫২ সালে যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত রচিত ‘কীর্তিবিলাস' বাংলা ভাষার প্রথম বিয়োগান্তক বা ট্র্যাজেডি নাটক। সপত্নীপুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচারের কাহিনি অবলম্বনে এটি রচিত। বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যুর মাধ্যমে ট্রাজেডির রূপায়ণ এ নাটকের বৈশিষ্ট্য।

১৮৫৯ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘শর্মিষ্ঠা’ বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ও আধুনিক নাটক। এটি রচিত হয়েছে পুরাণের কাহিনি অবলম্বনে ।এজন্য তাঁকে বাংলা নাটকের পথিকৃত বলা হয়।মূলত মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা নাটক প্রতিষ্ঠিত রুপ পায়।

১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘পদ্মাবতী' বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক কমেডি নাটক। এ নাটকের ২য় অঙ্কের ২য় গর্ভাঙ্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করেন। এটি গ্রিক পুরাণের Apple of Discord অবলম্বনে রচিত।

১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘কৃষ্ণকুমারী' বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক বিয়োগান্তক বা ট্রাজেডি নাটক। উইলিয়াম টডের ‘রাজস্থান' নামক গ্রন্থ থেকে মধুসূদন এ নাটকের কাহিনি সংগ্রহ করেন। চরিত্র: কৃষ্ণকুমারী, মদনিকা, ভীমসিং, বিলাসবতী।

বাংলা ভাষার মুসলমান রচিত প্রথম নাটক ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বসন্ত কুমারী'। বৃদ্ধ রাজা বীরেন্দ্র সিংহের যুবতী স্ত্রী রেবতী সপত্নী পুত্র নরেন্দ্র সিংহকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখাত হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পরিণামে সমগ্র রাজ পরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায়, এটিই এ নাটকের মূল বিষয়।

বাংলা ভাষায় মুসলমান চরিত্র অবলম্বনে প্রথম নাটক ১৮৭৩ সালে মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘জমীদার দর্পণ'। অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদার হায়ওয়ান আলীর অত্যাচার এবং অধীনস্ত প্রজা আবু মোল্লার গর্ভবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনি এর মূল বিষয়।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম নাটক ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ'। এতে মেহেরপুরের কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঢাকায়। এ নাটকের অভিনয় দেখতে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মঞ্চের অভিনেতাদের লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন A Native ছদ্মনামে ইংরেজিতে The Indigo Planting Mirror নামে অনুবাদ করেন। চরিত্র: নবীন মাধব, তোরাপ।

নাটকের শ্রেণীবিভাগ

নাটকের শ্রেণীবিভাগ কোনো বিশেষ বিষয়কে ভিত্তি করে করা হয়নি। নানারকম বিষয়বস্তু অনুসারে নাটককে নানাভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। নাটকের শ্রেণীবিভাগগুলো এরকম—

বিষয়বস্তুর দিক থেকে --------

১. পৌরাণিক ২. ঐতিহাসিক ৩. সামাজিক ৪. পারিবারিক ৫. উপকথাশ্রয়ী ও ৬. কাল্পনিক

রসের দিক থেকে ------

১. নাটক ২.প্রহসন

অভিনয়ের দিক থেকে -----

১. নাটক ২.যাত্রাপালা

আয়তন/আকার বা অঙ্কসংখ্যা অনুসারে----

১. মহানাটক ২. নাটক ৩. নাটিকা ৪. একাঙ্কিকা

রচনা রীতি অনুসারে-------

১. পদ্যনাটক ২. গদ্যনাটক ৩. গদ্য-পদ্যময় নাটক

ইংরেজি আদর্শের দিক থেকে-------

১. ট্র্যাজেডি ২. কমেডি ৩. মেলোড্রামা ৪. ট্র্যাজি-কমেডি ৫. ফার্স

ভাবের দিক থেকে-------

১. ক্লাসিকাল ২. নিও-ক্লাসিক্যাল ৩. রোমান্টিক

প্রকৃতপক্ষে নাটকের শ্রেণীবিভাগের সুনির্দিষ্ট কোন কাঠামো বা ভিত্তি নেই। যে কোন আঙ্গিকেই নাটকের শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে:

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন