জসীমউদ্দীন

জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)

সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমর্থক, বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে ছাত্রাবস্থায়। তাঁর রচিত কাব্যগুলোতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র যে কুশলতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে তাতে আধুনিক শিল্প- চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট । বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজ-সরল প্রাকৃতিক রূপ উপযুক্ত শব্দ, উপমা ও চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাব্যে এক অনন্যসাধারণ মাত্রায় মূর্ত হয়ে উঠে। ষাটের দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের পদক্ষেপ নিলে তিনি এর তীব্র বিরোধিতা করেন।

জসীমউদ্দীনের সাহিত্যকর্ম

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম জসীমউদ্দীন ১ জানুয়ারি, ১৯০৩ সালে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে (মাতুলালয়) জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস- ফরিদপুরের গোবিন্দপুর (বর্তমান- আম্বিকাপুর)।
প্রকৃত ও ছদ্মনাম প্রকৃত নাম- মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন মোল্লা। ছদ্মনাম- জমীরউদ্দিন মোল্লা ।
উপাধি পল্লীকবি
তাঁর জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর জামাতা।
প্রথম কবিতা ১৯২১ সালে ‘মোসলেম ভারত' পত্রিকায় ‘মিলন গান’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ।
বাংলা একাডেমির পুরস্কার বাংলা একাডেমি ২০১৯ সাল থেকে ‘কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার' প্রদান করে। প্রথম এ পুরস্কার পান কবি নির্মলেন্দু গুণ ।
পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি ডি.লিট (১৯৬৯) ও একুশে পদক (১৯৭৬) পান ।
কর্মপরিধি জসীমউদ্দীনকে পল্লীকবি বলা হয় । তিনি এম.এ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ড. দীনেশচন্দ্ৰ সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লীগীতি সংগ্রাহক পদে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ১৯৩১-১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করেন। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে প্রচার বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টরের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কবি জসীমউদ্দীন হল' আছে।
কাব্যগ্রন্থ তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ :

রাখালী ' (১৯২৭): এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যের ১৮টি কবিতার মধ্যে অন্যতম কবিতা ‘কবর’। এটি কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জসীমউদ্দীন কলেজে অধ্যয়নকালে [সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান] ‘কবর' কবিতা রচনা করে অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। যা তাঁর ছাত্রাবস্থায় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

‘নক্সীকাঁথার মাঠ' (১৯২৯): এটি কবির শ্রেষ্ঠ কাহিনিকাব্য/গাথাকাব্য। এ গ্রন্থের প্রথম অংশে আছে চাষার ছেলে রূপাই ও পাশের গ্রামের মেয়ে সাজুর প্রথম পরিচয় থেকে অনুরাগের বিকাশ ও বিবাহ এবং কয়েক মাসের সুখময় জীবনের গল্প এবং দ্বিতীয় ভাগে তাদের বিচ্ছেদ। গ্রামীণ জীবনের মাধুর্য ও কারুণ্য, বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তিকরতা এবং মানুষের অসহায়তা এ কাব্যের উপকরণ। ১৯২৮ সালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে জসীমউদ্দীন ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করতে আসলে রূপাই নামক এক ব্যক্তির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। এ ব্যক্তির বাস্তব জীবনীকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন ‘নক্সীকাঁথার মাঠ'। চরিত্র: সাজু, রূপাই। E. M Milford af Field of the Embroidery Quilt নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

‘সুচয়নী' (১৯৬১): এটি তাঁর নির্বাচিত কবিতার সংকলন ।

‘সোজন বাদিয়ার ঘাট' (১৯৩৪) : এ কাহিনিকাব্য/ গাথাকাব্যটি ইউনেস্কোর উদ্যোগে ‘Gypsy Wharf’(১৯৬৯) নামে অনূদিত হয়। চরিত্র: সোজন, দুলী।

‘এক পয়সার বাঁশি' (১৯৫৬): এ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘ আসমানী ’। আসমানী একটি বাস্তব চরিত্র। ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে জসীমউদ্দীনের বড় ভাই রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে তিনি আসমানীর দেখা পান এবং এখানেই বসে তিনি ‘আসমানী’ কবিতাটি রচনা করেন । ৯৭ বছর বয়সে ১৮ আগস্ট, ২০১২ সালে আসমানী মারা যান ।

‘বালুচর' (১৯৩০),
ধানক্ষেত’ ( ১৯৩৩),
রূপবতী ’ (১৯৪৬),
‘মা যে জননী কান্দে' (১৯৬৩),
‘মাটির কান্না’ (১৯৫৮),
‘সকিনা’ (১৯৫৯)।
নাটক তাঁর রচিত নাটকসমূহ:

‘বেদের মেয়ে' (১৯৫১): এটি গীতিনাট্য।
‘পদ্মাপাড়’ (১৯৫০),
‘মধুমালা’ (১৯৫১),
‘পল্লীবধূ’ (১৯৫৬),
‘গ্রামের মায়া’ (১৯৫৯),
বাঁশের বাঁশি
ভ্রমণকাহিনি তাঁর রচিত ভ্রমণকাহিনিসমূহ:

‘চলে মুসাফির' (১৯৫২),
‘‘হলদে পরীর দেশ” (১৯৬৭),
‘যে দেশে মানুষ বড়' (১৯৬৮),
'জার্মানির শহরে ও বন্দরে’ (১৯৭৬)।
অন্যান্য রচনাবলি জসীমউদ্দীনের অন্যান্য রচনাবলি:

উপন্যাস:

বোবাকাহিনি ' (১৯৬৪): এ উপন্যাসে মহাজনী শোষণের কারণে গ্রামের প্রান্তিক চাষি আজহারের ভূমিহীন হওয়া, শহরের সুবিধাবাদী উকিল ও ভণ্ড ধার্মিক কর্তৃক মেধাবী বছির নিগ্রহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত। চরিত্র: বছির, আজহার, আরজান, রহিমুদ্দিন।

‘বউটুবানির ফুল’ (১৯৯০): এটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত উপন্যাস ।

শিশুতোষ গ্রন্থ: ‘হাসু' (১৯৩৮), ‘এক পয়সার বাঁশী' (১৯৪৯), ‘ডালিমকুমার' (১৯৫১)।

আত্মজীবনী : ‘জীবনকথা' (১৯৬৪)।

স্মৃতিকথা : ‘যাদের দেখেছি' (১৯৫২), ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়' (১৯৬১)।

গল্পগ্রন্থ: ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প' (১ম খণ্ড- ১৯৬০, ২য় খণ্ড-১৯৬৪)। এ গ্রন্থটি ইউনেস্কোর উদ্যোগে ‘Folk Tales of Bangladesh' নামে অনূদিত হয়।

গানের সংকলন: ‘রঙ্গিলা নায়ের মাঝি' (১৯৩৫), ‘গাঙ্গের পাড়’ (১৯৬৪), ‘জারিগান' (১৯৬৮)।

বিখ্যাত কবিতা:

‘কবর’: এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল' পত্রিকায়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতাটিতে ১১৮টি পঙ্ক্তি আছে। প্রিয়জন হারানোর মর্মান্তিক স্মৃতিচারণ ‘কবর’ কবিতার মূল বিষয়।

‘আসমানী’: কবিতাটি ‘এক পয়সার বাঁশি' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কবির বড় ভাই রাজেন্দ্র সরকারি কলেজের অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদের শ্বশুরবাড়ি ছিল বর্তমান ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে। সেখানে কবি বেড়াতে গিয়ে আসমানীর দেখা পান এবং সেখানে বসেই তিনি ‘আসমানী' কবিতাটি রচনা করেন। ৯৭ বছর বয়সে আসমানী মৃত্যুবরণ করেন ১৮ আগস্ট, ২০১২ সালে ।

‘রাখাল ছেলে’ (রাখালী),
নিমন্ত্রণ ' (ধানক্ষেত),
মুসাফির ’ (বালুচর),
‘চাষার ছেলে’ ,
‘পল্লীজননী’
বিখ্যাত পক্তি ১. এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। (কবর)

২. এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। (কবর)

৩. বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা,
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ। (কবর)

৪. এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাঠির তলে,
গড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে। (কবর)

৫. কাচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া ।
জালি লাউয়ের ডগার মতোন বাহু দু’খান সরু। (রুপাই )

৬. যে মোরে করিল পথের বিবাগী,
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি । (প্রতিদান )
মৃত্যু তিনি ১৩ মার্চ, ১৯৭৬ সালে মারা যান। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুসারে ১৪ মার্চ ফরিদপুরের আম্বিকাপুরে দাদীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয় ।
নবীনতর পূর্বতন