মীর মশাররফ হোসেন

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যিক বা গদ্য লেখক, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন এবং ছদ্মনাম গাজী মিয়াঁ । তাঁর সাহিত্য গুরু কাঙাল হরিনাথ । তিনি কাব্য, নাটক, প্রহসন, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম রচিত সমৃদ্ধ ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কারবালার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত বিষাদ সিন্ধু তার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম এবং শ্রেষ্ঠ রচনা । তার স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭৮ সালে তার নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয় যা দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরীকৃত দ্বিতীয় বৃহত্তম আবাসিক হল।

জন্ম ও পরিচয়

মীর মশাররফ হোসেন ১৩ নভেম্বর, ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর দাবি করলে ও ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়।। তার পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকন্দি উপজেলার পদমদি গ্রামে। তার পিতা নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, তৎকালীন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনী পাড়ার জমিদার) এবং মাতা দৌলতুন্নেছা ।

শিক্ষাজীবন

সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেনের লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে বর্তমান রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদী গ্রামে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। জগমোহন নন্দীর পাঠশালা, কুমারখালির ইংলিশ স্কুল, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল এ পড়ার কথা লেখকের আত্নজীবনীতে লেখা আছে। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন । আলীপুর আদালতের আমীন নাদির হোসেনের আশ্রয়ে কলকাতায় কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন , কিন্তু তাঁর লেখাপড়ায় তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেন নি ।

কর্মজীবন

তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার হয়ে টাঙ্গাইল আগমন করেন । অতঃপর বিভিন্ন ঘটনার শিকার হয়ে সেখানে থেকে লাহিনী পাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন । ১৯০৩ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত কলকাতায় অবস্থান করেন ।

বিবাহ

মাত্র আঠারো বছরে বয়সে ১৯ মে, ১৮৬৫ সালে পিতার বন্ধু নাদির হোসেনের সুন্দরী কন্যা লতিফুন্নেছার সঙ্গে মশাররফ হোসেনের বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠানকালে কন্যা বদল করে নাদির হোসেন তাঁর কুরুপা ও বুদ্ধিহীনা কন্যা আজিজুন্নেসাকে মশাররফ হোসেনের সঙ্গে বিবাহ প্রদান করেন । এ দাম্পত্য জীবনে মশাররফ হোসেন সুখী হন নি । তাই বিবি কুলসুমকে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী রুপে গ্রহণ করেন ।

সাহিত্যকর্ম

মীর মশাররফ হোসেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন । এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি বিভিন্ন বিষয়ে মোট ৩৬ টি গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক । তিনি বাংলা সাহিত্যে গাজী মিয়া নামে পরিচিত । আধুনিক বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ হলেন মীর মশাররফ হোসেন । নিচে তার সাহিত্যকর্মসমূহ তুলে ধরা হল :

উপন্যাস

এখন পর্যন্ত মীর মশাররফের ৪টি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায় নিচে তা দেওয়া হল :

  • রত্নবতী (১৮৬৯): এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এটি বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম উপন্যাস। এটি কোন মুসলিম রচিত প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান । এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২রা সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে, কলিকাতা থেকে । লেখক নাম-পৃষ্ঠায় গ্রন্থটিকে ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস' হিসেবে উল্লেখ করেছেন । প্রকৃতপক্ষে এটি রূপকথা৷ জাতীয় শিক্ষামূলক একটি দীর্ঘ গল্প । রাজপুত্র সুকুমার ও মন্ত্রীপুত্র সুমন্তের মধ্যে ‘ধন বড় না বিদ্যা বড়'-এ বিতর্ক এবং বিতর্কের সমাধানই ‘রত্নবতী’র মূল বিষয় ৷
  • বিষাদসিন্ধু (১৮৮৫-৯১): এটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস যা তিন খণ্ডে বিভক্ত। যথা: মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব, এজিদবধ পর্ব। এতে উপসংহারসহ ৬৩টি অধ্যায় রয়েছে। মশাররফ হোসেনের খ্যাতি মূলত এ গ্রন্থটির জন্যেই । হাসান হোসেনের সঙ্গে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালা প্রান্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ইমাম হাসান-হোসেনের করুণ মৃত্যুকাহিনি ‘বিষাদ-সিন্ধু' গ্রন্থে বর্ণিত মূল বিষয় । মূল ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও গ্রন্থটিতে ইতিহাসের অন্ধ অনুসরণ করা হয় নি। 'বিষাদ-সিন্ধু' উপন্যাসটি ‘মহরম পর্ব্ব' (১৮৮৫), ‘উদ্ধার পর্ব' (১৮৮৭) ও ‘এজিদ-বধ পৰ্ব্ব' (১৮৯১) এই তিনটি পর্বে সম্পন্ন হয়েছে । গ্রন্থটি উপক্রমণিকা ও উপসংহারসহ মোট তেষট্টিটি ‘প্রবাহ' অর্থাৎ অধ্যায় নিয়ে লিখিত। তন্মধ্যে ‘মহরম পর্ব্বে’ উপক্রমণিকা ও ছাব্বিশটি প্রবাহ, ‘উদ্ধার পর্ব্বে' ত্রিশটি প্রবাহ, ‘এজিদ-বধ পর্ব্বে' পাঁচটি প্রবাহ ও উপসংহার-অংশ রয়েছে । প্রথমত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত স্পর্শকাতর কাহিনি সাধারণ মুসলিম পাঠকের কাছে এর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত “বিষাদ-সিন্ধু’র জাদুকরী রচনাগুণের জন্যে সাহিত্যরসিকজনের কাছেও গ্রন্থটি আদরণীয় । জয়নাবের রূপে বিমোহিত এজিদ এবং এই রূপতৃষ্ণার পরিণামে বহু মানুষের বিপর্যয় ও ধ্বংসের যে কথকতা বর্ণিত হয়েছে তা গ্রন্থটিকে সর্বজনীন করে তুলেছে । ‘বিষাদ-সিন্ধু'র কাহিনিতে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট চেতনা মূলত মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য' থেকেই মশাররফ হোসেন গ্রহণ করেছেন ।
  • উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০) : এটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। ‘উদাসীন পথিক' এই ছদ্মনামে মশাররফ হোসেন ব্যক্তিগত জীবনের পটভূমিতে স্বীয় পারিবারিক ইতিহাস ও সমসাময়িক বাস্তব ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে । উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০) কে প্রকৃতপক্ষে উপন্যাস কিংবা আত্মজীবনীমূলক রচনা এর কোনোটাই বলা যায় না। বরং বলতে হয়, গ্রন্থটি লেখকের আত্মজীবননির্ভর কতিপয় বাস্তব ও কাল্পনিক ঘটনার মিশেল উপন্যাসসুলভ সাহিত্যিক উপস্থাপনা। এতে লেখকের পারিবারিক ইতিবৃত্ত বর্ণনা এবং নিজের মাতা-পিতাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত হতে দেখা যায় । উদাসীন পথিকের মনের কথায় হিন্দু-মুসলমানের যে মিলন-কামনা আছে, তার গভীর তাৎপর্য স্বীকার করতে হয় ।
  • তহমিনা (১৮৯৭) : উপন্যাসটি নিয়ে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি । যতদূর জানা যায় জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ-এপ্রিল (একত্রে) এই তিন সংখ্যা মাসিক 'হাফেজ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছিল কি না বা এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল কি না তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় নি ।

নাটক

মীর মশাররফের নাটক সমূহ:

  • বসন্তকুমারী (১৮৭৩): এটি বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম নাটক। মীর মশাররফের 'বসন্তকুমারী নাটক' এর বিষয়বস্তু এরকম : বৃদ্ধ রাজা বীরেন্দ্র সিংহের যুবতী স্ত্রী রেবতী সপত্নী-পুত্র নরেন্দ্র সিংহকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং ষড়যন্ত্র শুরু করে । এর পরিণামে সমগ্র রাজপরিবারটি ধ্বংস হয়ে যায় । তিনটি অঙ্ক, নটনটীর প্রস্তাবনাসহ তেরটি দৃশ্য; প্রস্তাবনার একটিসহ সর্বমোট আটটি গান রয়েছে নাটকটিতে । নামকরণে মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’-এর প্রভাব আছে । মশাররফ এটি নওয়াব আব্দুল লতিফ কে উৎসর্গ করেন।
  • জমীদার দর্পণ (১৮৭৩) : মীর মশাররফ হোসেন রচিত মুসলিম চরিত্র অবলম্বনে বিখ্যাত নাটক জমীদার দর্পণ । অত্যাচারী ও চরিত্রহীন জমিদার হায়ওয়ান আলীর অত্যাচার এবং অধীনস্থ প্রজা আবু মোল্লার গর্ভবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনি ‘জমীদার দর্পণ' - এর মূল ঘটনা। মশাররফ হোসেন লিখেছেন, নাটকটির ‘কিছুই সাজানো নয়, অবিকল ছবি' তুলে ধরা হয়েছে প্রচলিত সমাজের । ওই সময় মুসলিমগণ বাংলা চর্চায় এগিয়ে এসেছে কমই । এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্ৰ 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় নাটকটির প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ'। নামকরণে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল-দর্পণে'র প্রভাব যেমন প্রবল, নাটকটির ঘটনাবিন্যাসেও এর কম ছায়া পড়ে নি ৷
  • বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৮৯): এটি গদ্যে পদ্যে রচিত । এতে ইংরেজ শাসকদের প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচন করে তাদের প্রতিরোধ করার আহবান জানিয়েছেন।
  • নিয়তি কি অবনতি (১৮৮৯) : ১৮৯৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যা (১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা) এবং ১৮৯৯ সালের জুন সংখ্যার (২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা) 'কোহিনুর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নাটকটি সম্পূর্ণ হয়েছিল কি না বা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়েছিল কি না তার কোন তথ্য পাওয়া যায় নি ।

আত্মজীবনী

মীর মশাররফের আত্মজীবনীসমূহ:

  • গাজী মিয়াঁর বস্তানী (১৮৯৯): গাজী মিয়াঁর বস্তানী মশাররফ হোসেনের কর্মজীবন নির্ভর আত্মজীবনীমূলক ব্যঙ্গাত্মক রচনা । লেখক ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়, অনাচার, সামাজিক দুর্নীতি এবং সেই সমাজভুক্ত মানুষগুলোর নৈতিক অধঃপতন, মনুষ্যত্ব ও হৃদয়হীন আচরণ তুলে ধরেছে এ গ্রন্থে । লেখক নিজেকে ‘ভেড়াকান্ত' নামে উল্লেখ করেছেন । তাছাড়া আলকাতরা সান্যাল, কটা পেস্কার, জয়ঢাক, ছিড়িয়া খাতুন, অরাজকপুর, নচ্ছারপুর, জমদ্বারগ্রাম ইত্যাদি নামচয়নের মধ্যেও লেখকের ব্যঙ্গের তীব্রতা লক্ষ করা যায় । এই ব্যঙ্গ সম্প্রদায় নির্বিশেষে, সকল কলুষ ও মালিন্যের বিরুদ্ধে। গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের 'কমলাকান্তের দপ্তর'-এর প্রভাব লক্ষ করা যায় ।
  • আমার জীবনী (১৯১০): ‘আমার জীবনী' বারো খণ্ডে সমাপ্ত ৷ খণ্ডগুলো পৃথক পৃথকভাবে ১৯০৮ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয় । মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনমূলক রচনা ‘আমার জীবনী' । কিন্তু গ্রন্থটিতে তাঁর পরিপূর্ণ জীবন কাহিনি বর্ণিত হয় নি । লেখকের জীবনের মাত্র আঠার বছরের ঘটনা ও কার্যক্রম এতে তুলে ধরা হয়েছে । সে বিচারে আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত ।
  • কুলসুম জীবনী (১৯১০): কুলসুম জীবনী' গ্রন্থটিকে লেখক ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম জীবনী' নামে অভিহিত করেছেন । এটি মশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমকে কেন্দ্র করে লিখিত । গ্রন্থটিতে লেখক বিবি কুলসুম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন । যেহেতু বিবি কুলসুম ও লেখক একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, সেহেতু বিবি কুলসুম প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক স্বাভাবিকভাবেই নিজের কথা বলেছেন । এদিক থেকে ‘কুলসুম জীবনী’ 'আমার জীবনী' গ্রন্থের পরিপূরক বলা চলে । এ কারণে ‘আত্মজীবনী' না হয়েও গ্রন্থটি মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনী নির্ভর রচনার অন্তর্ভুক্ত ।

কাব্য

মীর মশাররফের কাব্যসমূহ:

  • গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু (১৮৭৩)
  • পঞ্চনারী পদ্য (১৮৯৯)
  • প্রেম পারিজাত (১৮৯৯)
  • মদিনার গৌরব (১৯০৬)
  • মোসলেম বীরত্ব (১৯০৭)
  • বাজীমাৎ (১৯০৮) : এটি কবিতায় রচিত নক্সা ।
  • বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫)
  • হযরত ওমরের ধর্ম্মজীবন লাভ (১৯০৫)
  • হযরত বেলালের জীবনী (১৯০৫)
  • হযরত আমীর হামজার ধর্ম্মজীবন লাভ (১৯০৫)

প্রহসন

মীর মশাররফের প্রহসনসমূহ:

  • এর উপায় কি (১৮৭৫): বাংলা সাহিত্যে মুসলমান রচিত প্রথম প্রহসন। উনিশ শতকে এক শ্রেণির লোক স্ত্রীর প্রতি অবহেলা দেখিয়ে মদ ও পতিতাবৃত্তিতে আকৃষ্ট হয়ে নানা ধরনের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়েছিল, তারই চিত্র এ প্রহসন ।
  • টালা অভিনয় (১৮৯৭)
  • ভাই ভাই এইতো চাই (১৮৯৯)
  • ফাঁস কাগজ (১৮৯৯)
  • বাঁধা খাতা (১৮৯৯)
  • এ কি? (১৮৯৯)

প্রবন্ধ

কোন বিষয়ে নয়, মূলত বঙ্কিম সমকালে ভিন্ন গদ্যশৈলীর জন্যই তিনি বিশিষ্ট । নিচে তা দেওয়া হল :

  • গো-জীবন (১৮৮৯): মীর মশাররফ হোসেনের গো-জীবন একটি প্রবন্ধ পুস্তিকা । প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য হলো, কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে যে কোনো কারণেই হোক গো-হত্যা অনুচিত । স্বীয় বক্তব্যের সমর্থনে লেখক ধর্মগ্রন্থ এবং প্রাত্যহিক-বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নানা যুক্তি ও তথ্য পরিবেশন করেছেন। হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ করার মানসেই মশাররফ হোসেন এ প্রবন্ধ রচনা করেন । প্রবন্ধটি তৎকালে মুসলিম ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় ৷ এ কারণে ‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) পত্রিকা প্রতিবাদ প্রকাশ করে । মুসলিম ধর্মীয় নেতৃস্থানীয়রা তাঁর নামে ফতোয়া জারি করে । ধর্মসভা ডেকে তাঁকে কাফের এবং তাঁর স্ত্রীকে হারাম জারি করা হয়। তাঁকে বলা হয় 'তওবা' করতে। ক্ষুব্ধ লেখক প্রথমে একটি মামলা দায়ের করলেও পরে মৌলবাদী মুসলিমদের প্রবল চাপের মুখে তিনি ‘গো-জীবন’ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন । তাই গো-জীবন এর পরবর্তীকালে আর ছাপা হয়নি।
  • প্রেম পারিজাত ( ১৮৯৯ ) : এটি ও একটি গদ্য রচনা ।
  • রাজিয়া খাতুন ( ১৮৯৯ ) : এটি ও একটি গদ্য রচনা ।
  • এসলামের জয় ( ১৯০৮ ) : এটি ও একটি গদ্য রচনা ।
  • খোতবা : এটি ও একটি গদ্য রচনা । ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য সাধক চরিত মালা পুস্তকে বইটির কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু কোন বিবরন দেননি। তাই এর আর কোন তথ্য পাওয়া যায় নি ।

অন্যান্য গ্রন্থ

মীর মশাররফের গানের সংকলনের নাম সংগীত লহরী (১৮৮৭)। মীর মশাররফের গদ্যে-পদ্যে রচিত ধর্ম্মোপদেশের নাম মৌলুদ শরীফ ( ১৯০৩) । তাঁর রচিত গল্প হজরত ইউসোফ ( ১৯০৮ ) । তাঁর স্কুল পাঠ্য হচ্ছে মুসলমানের বাংলা শিক্ষা, ১ম ভাগ ( ১৯০৩ ) ও মুসলমানের বাংলা শিক্ষা, ২য় ভাগ ( ১৯০৮ )

সম্পাদনা

তিনি কলকাতার সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) ও কুমারখালির গ্রামবার্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩) পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন ।

মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত মাসিক 'আজীজন নেহার' এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে । মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার জন্য পত্রিকা প্রকাশ ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হলেও মুসলমান পরিচালিত পত্রিকার লেখক ও পাঠকের অভাব সহ বিভিন্ন কারণে পত্রিকাটি বেশি দিন চলে নি ৷ মনে করা হয়, মশাররফ হোসেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর নামে এই পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি বিলুপ্ত হলে তিনি ‘হিতকরী’ (১৮৯০) নামে অন্য একটি স্বল্পায়ু পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন ।

মৃত্যু

তিনি ১৯ ডিসেম্বর, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দেলদুয়ার জমিদার এস্টেটে নায়েব বা ম্যানেজার থাকাকালেই সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়। এখানেই 'মীর মশাররফ হোসেন ’স্মৃতি কমপ্লেক্স' অবস্থিত। ( সূত্র: ১৯১১- উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা), (১৯১২- বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান)।

নবীনতর পূর্বতন