দীনবন্ধু মিত্র

দীনবন্ধু মিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। ১৮৫৫ সালে দীনবন্ধু মিত্র পোস্টমাস্টার চাকরিতে যোগ দেন। ১৮৭১ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক 'রায় বাহাদুর' উপাধি লাভ করেন। দীনবন্ধু মিত্র পরের দুঃখে নিতান্ত কাতর হইতেন , যার বহিঃপ্রকাশ তিনি নাটকে করেছিলেন । তিনি গণমানুষের আর্তনাদ গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যার ফলস্বরুপ আমরা দেখতে পাই তার নীলদর্পণ নাটকটি । তিনিই সর্বপ্রথম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নাটক লেখেন । ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রেরণায় কবিতা রচনা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করলে ও তিনি বাস্তবধর্মী সামাজিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন । এই ধারায় তিনিই হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালের নাট্যকারদের আদর্শস্থানীয় এবং বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।

জন্ম ও পরিচয়

দীনবন্ধু মিত্র ১৮৩০ সালের ( বাংলা ১২৩৮ সাল ) ১০ই এপ্রিল উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম কালাচাদ মিত্র। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। দীনবন্ধু মিত্রের বাল্যনাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। যে সময় দীনবন্ধু মিত্র চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সে সময় এই স্থানটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অংশ ছিল না, এটি নদীয়া জেলার অংশ ছিল। যমুনা নামে ক্ষুদ্র নদী এই গ্রামকে প্রায় চার দিকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়েছে, এজন্য এই গ্রামের নাম চৌবেড়িয়া। দীনবন্ধু মিত্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ভাবশিষ্য ছিলেন । সে কারণেই তিনি কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন।

শিক্ষাজীবন

দরিদ্র পরিবারের সন্তান দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য পাঠশালায়। সেখানে কিছুদিন পাঠগ্রহণের পর তার পিতা তাকে জমিদারের সেরেস্তার কাজে নিযুক্ত করে দেন। কিন্তু দীনবন্ধু মিত্রের শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল । তাই তিনি অল্পবয়সে কলকাতায় পালিয়ে আসেন এবং জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এ সময় তিনি দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন । পরে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ করেন। হেয়ার স্কুলে থাকাকালীন সময়েই তিনি বাংলা রচনা আরম্ভ করেন। যতদূর জানা যায় দীনবন্ধুর প্রথম রচনা “মানব-চরিত্র” নামক একটি কবিতা। হেয়ার স্কুল থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলের শেষ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করে হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৫১ সালে আবার উচ্চতর পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করেন এবং ১৮৫২ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকে সিনিয়র বৃত্তিলাভ করেন। প্রত্যেক পরীক্ষায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনিই সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর সম্ভবত কোথাও শিক্ষকতা করেছিলেন দীনবন্ধু, কারণ ১৮৫৩ সালে তিনি টিচারশিপ একজামিনেশনে কৃতকার্য হয়েছিলেন। কলেজের সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাথে পরিচয়

হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা চলাকালীন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাথে দীনবন্ধুর পরিচয় হয় । সে সময় বাংলা সাহিত্যের বড় আকাল ছিল । তখন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত প্রভাকর ছিল সর্ব্বোৎকৃষ্ট সংবাদপত্র। ঈশ্বরগুপ্ত বাংলা সাহিত্যের উপর একাধিপত্য করিতেন। উল্লেখযোগ্য লেখক বলতে তখন শুধু ঈশ্বরগুপ্ত ছিল । এজন্যই ঈশ্বরগুপ্তকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয় । তিনি মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের শুরুতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বালকগণ তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকত । ঈশ্বরগুপ্ত তৰুণবয়স্ক লেখকদিগকে উৎসাহ দিতে বিশেষ সমুৎসুক ছিলেন। এজন্যই আধুনিক লেখকদিগের মধ্যে অনেকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য। এর মধ্যে অন্যতম দীনবন্ধু মিত্র । কিন্তু ঈশ্বরগুপ্তের প্রদত্ত শিক্ষার ফল খুব বেশি দূর স্থায়ী বা বাঞ্ছনীয় হয়েছে তা ও বলা যায় না। তাঁর শিষ্যেরা অনেকেই তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা বিস্মৃত হইয়া অন্য পথে গমন করিয়াছেন। যেমন-দীনবন্ধু মিত্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিক্ষার প্রভাবে কবিতা দিয়ে সাহিত্যিক জীবন শুরু করেছিলেন ঠিকই কিন্তু পরে তিনি ভিন্ন পথে হাঁটেন। দীনবন্ধু মিত্র মাইকেল প্রবর্তিত পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক নাট্যরচনার পথে না গিয়ে বাস্তবধর্মী আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। আর এ ধারায়ই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে গেছেন এক ভিন্ন উচ্চতায় ।

কর্মজীবন

দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫৫ সালে কলেজ পরিত্যাগ করে ১৫০ টাকা বেতনে পাটনার পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। ঐ পোস্টমাস্টার পদে তিনি ছয় মাস নিযুক্ত থেকে সুখ্যাতি লাভ করেন এবং দেড় বছর পরেই তাঁর পদোন্নতি হয়েছিল। তিনি উড়িষ্যা বিভাগের ইন্স্পেক্টিং পোষ্টমাষ্টার নিযুক্ত হন । পদোন্নতি হলে ও কিন্তু তখন বেতন বৃদ্ধি হল না; পরে হয়েছিল। দীনবন্ধু চিরদিন দেড়শত টাকার পোষ্টমাষ্টার থাকিতেন সেও ভাল ছিল কারণ পদোন্নতির ফলে উপুর্যপরি দায়িত্ব এসে বর্তায় তার কাঁধে । শুধু তাই নয় এ পদের কাজের নিয়ম এই ছিল যে, তাদেরকে অবিরত নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া পোষ্ট অফিসের সকলের কাজ তত্ত্বাবধাণ করতে হবে। সারাবছরই ভ্রমণ করতে হত । কোন স্থানে এক দিন, কোন স্থানে দুই দিন, কোন স্থানে তিন দিন—এরূপ কাল মাত্র অবস্থিতি। ক্রমাগত এই ভ্রমণের পরিশ্রম দীনবন্ধুর শরীরে আর সহিল না । তবে দীনবন্ধু নানা দেশ ভ্রমণ করে নানাবিধ চরিত্রের মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন যা একজন উপহাসনিপুণ লেখকের এই বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন ছিল । উড়িষ্যা বিভাগ হতে দীনবন্ধু নদীয়া বিভাগে প্রেরিত হন, এবং তথা হতে ঢাকা বিভাগে গমন করেন। এবং পরে কলকাতায় সুপারিনটেন্ডেন্ট পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। লুসাই যুদ্ধের সময় ডাকবিভাগের কাজে তিনি কাছাড়ে প্রেরিত হন। এই সময় তার তদারকি কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার তাকে রায়বাহাদুর উপাধি দান করেন। যদিও ডাকবিভাগের উচ্চস্তরের কর্মচারী হয়েও উপযুক্ত বেতন তিনি পাননি। এ সময়েই নীলবিষয়ক গোলযোগ উপস্থিত হয়। দীনবন্ধু নানা স্থানে ভ্রমণ করে নীলকরদের দৌরাত্ম্য বিশেষরূপে অবগত হয়েছিলেন। তিনি এ সময়ে “নীল-দর্পণ” নাটক প্রণয়ন করে , বঙ্গীয় প্রজাগণকে অপরিশোধনীয় ঋণে বদ্ধ করলেন। দীনবন্ধু জানতেন যে, তিনি যে নীল-দর্পণের প্রণেতা এ কথা প্রকাশ হলে, তাঁর অনিষ্ট ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। যে সকল ইংরেজের অধীন হয়ে তিনি চাকরি করতেন, তাঁরা সকলেই নীলকরের সুহৃদ। তাই নীল-দর্পণে গ্রন্থকারের নাম ছিল না । তবে নীল-দৰ্পণ-প্রচারের পরেই বঙ্গদেশের সকল লোকেই কোন প্রকারে না কোন প্রকারে জেনে গিয়েছিল যে, দীনবন্ধুই এর প্রণেতা। তিনি বঙ্গদেশের প্রজাগণের দুঃখ সহৃদয়তার সাথে সম্পূর্ণরূপে অনুভব করেছিলেন বলেই নীল-দৰ্পণ প্রণয়ন ও প্রচার হয়েছিল।

সাহিত্য কর্ম

ঈশ্বর গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' (১৮৩১) পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্য দিয়েই তাঁর সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত ঘটে। পরে 'সংবাদ সাধুরঞ্জন' (১৮৪৭) পত্রিকাতেও লিখতে শুরু করেন তিনি। দীনবন্ধুর প্রথম রচনা “মানব-চরিত্র” নামক একটি কবিতা।

নাটক

দীনবন্ধু মিত্রের রচিত নাটকগুলো হল :

  • নীলদর্পণ (১৮৬০): নীল-দর্পণ নাটকটির ঘটনা , বিষয়চিন্তা, রচনাস্থান, প্রকাশস্থান, মুদ্রণালয়, প্রথম মঞ্চায়ন সবই বাংলাদেশে। প্রথম প্রকাশের সময় দীনবন্ধুর নাম ছিল না। 'নীলকর-বিষধর- দংশন-কাতর-প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ- কেনচিৎ পথিকেনাভি প্রণীতম' এইভাবে গ্রন্থাকারের নাম গুপ্ত রাখা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নীলকরদের অত্যাচারে পীড়িত সাধারণ কৃষক-জীবনের মর্মন্ত্রদ ছবি নাটকটিতে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন মধুসূদন দত্ত এবং তা প্রকাশ করেন রেভারেন্ড জেমস্ লঙ। নাটকের বাস্তবতা এবং চরিত্রগুলির স্বাভাবিকতার গুণের জন্য অনেকেই নীল- দর্পণকে Uncle Tom's Cabin-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। নীল-দর্পণ নাটকের কাহিনিসূত্র বাস্তব ঘটনাকেন্দ্রিক। নাটকটির কাহিনি মেহেরপুর অঞ্চলের, দীনবন্ধু ঢাকায় অবস্থানকালে তা রচনা করেন। তোরাপ চরিত্রটি এই নাটকের অত্যন্ত শক্তিশালী এক চরিত্র; বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা খুব কমই আছে। নাটকটি প্রথম প্রকাশ হয় ঢাকার বাংলা প্রেস থেকে এবং প্রথম মঞ্চস্থও হয় ঢাকাতে। এ নাটকের অভিনয় দেখতে এসে রোগ সাহেবের চরিত্রের অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফীর উপর ক্রোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মঞ্চে তাকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন। নাটকটির ঘটনা, রচনা, মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রথম মঞ্চায়ন সব কিছুই বাংলাদেশে বলে, একে ‘বাংলাদেশের নাটক' বলা হয়। নীল-দর্পণ নাটক সেই অর্থে ট্রাজেডি নয়। কারণ এই নাটকে কোনো নায়ক চরিত্র ভুল-ভ্রান্তি হেতু দুঃখবহ পরিণতির জন্য দায়ী নয়। দর্শকচিত্তে ট্রাজেডিসুলভ Pity-জাগায় না নাট্যকার ট্রাজিক করুণরস সৃষ্টি করতে মৃত্যুর ঘটনার বাহুল্য সৃষ্টি করে ভয়ানক রস সৃষ্টি করেছেন। একে বরং মেলোড্রামা বলা যায়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : গোলক বসু, নবীন মাধব, রাইচরণ, তোরাপ, সাবিত্রী, সরলতা, ক্ষেত্রমণি ইত্যাদি।
  • নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩) : লেখকের দ্বিতীয় নাটক নবীন তপস্বিনী। নাটকের কাহিনীতে দেখা যায় এটি বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে রচনা করা হয় নি । খুবই অপরিণত একটি নাটক । নাটকের বিষয়বস্তু কতকটা রূপকথার তুল্য। রাজা রমণীমোহন তার মাতা ও দ্বিতীয়া পত্নীর প্ররোচনায় জ্যেষ্ঠা অর্থাৎ প্রথম পত্নীকে মহিষীকে পরিত্যাগ করলে গর্ভবতী রানি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসিনীর জীবন অবলম্বন করেন। এ অবস্থায় রানি মহিষী এক পুত্রসন্তান জন্মদান করেন । যার নাম রাখেন বিজয় । উপযুক্ত বয়সে বিজয় সভাপণ্ডিত বিদ্যাভূষণের কন্যা কামিনীর প্রেমে পড়ে। কিন্তু এদিকে কামিনীর সহিত রাজা রমণীমোহনের বিবাহ স্থির হয় । ঘটনাচক্রে বিজয়ের পিতৃপরিচয় প্রকাশ হল। তখন রাজা রমণীমোহন বিজয়ের মাতা জ্যেষ্ঠা মহিষীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন এবং বিজয় ও কামিনীর বিবাহ দিলেন । কাহিনীর উপযুক্ত পরিবেশ এবং বাস্তবতা বর্জিত কাহিনীই সমগ্র বিষয়টিকে কৃত্রিমতায় পর্যবসিত করেছে ।
  • লীলাবতী (১৮৬৭) : লীলাবতী একটি সামাজিক নাটক। এর কাহিনী অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির । কলকাতার সম্পন্ন গৃহস্থ হরিবিলাস চট্টোপাধ্যায় ও তার সন্তানদের দ্বন্দ্ব কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই জটিল কাহিনী। ললিত ও লীলাবতীর প্রণয়ই নাটকের মূল বিষয়বস্তু। তবে সাধারণ নাগরিকের এমন রোম্যান্টিক জীবন বাস্তবে পাওয়া দুষ্কর । যে কারণে নাটকটি উপস্থাপনায় নাটকের বাস্তবতা আদৌ রক্ষা করা হয়নি। যদিও এই নাটকে বিষয়বস্তুর রহস্যঘনতা আছে, সংঘাত ও আকস্মিকতা আছে, এমনকি শেষের দিকে যথেষ্ট গতিও সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু আদিরসভিত্তিক কাহিনী ও রসসৃষ্টির ব্যর্থতাই শেষ পর্যন্ত কাহিনীকে স্বার্থকতাদান থেকে বঞ্চিত করেছে।
  • জামাই বারিক (১৮৭২): জামাইবারিক হাস্যরসাত্মক নাটক। ১৮৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। বিন্দুবাসিনী ও বগলার কলহ এবং দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত এ নাটকের মূল বিষয়। এ নাটকে দেখা যায়, সে সময়কালে দিনের বেলায় স্ত্রীর সাথে জামাইদের দেখা করার কোনো সুযোগ ছিলো না, ফলে রাতে জামাইদের ডাক পড়ত অন্তঃপুরে। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: বিজাবল্লভ, অভয়কুমার, কামিনী, বগলা, বিন্দুবাসিনী । বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, 'জামাই বারিকের দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত প্রকৃত।' নাটকটির ঘটনা সংস্থান, চরিত্রসৃষ্টি এবং সংলাপ রচনা বহু প্রশংসিত। এই নাটকের অন্তর্গত বিন্দুবাসিনী ও বগলার কলহ দৃশ্যটি ১৯২৬ সালে 'জেনানাযুদ্ধ' নামে প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : বিজাবল্লভ, অভয়কুমার, কামিনী, বগলা, বিন্দুবাসিনী ইত্যাদি।
  • কমলে কামিনী (১৮৭৩): কমলেকামিনী দীনবন্ধু মিত্রের সর্বশেষ নাটক। এই নাটকের পটভূমি কাছাড় অঞ্চল। চরিত্রগুলি সবই অভিজাত বংশীয় তবে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে দুর্বল মানুষদের আখ্যান । ২০ শে ডিসেম্বর ১৮৭৩ তারিখে নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে সর্বপ্রথম অভিনীত হয়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : রাজা, সমরকেতু, শশাঙ্কশেখর, গান্ধারী, সুশীলা, সরবালা।

কাব্যগ্রন্থ

নাটক ছাড়া দুখানি কাব্যগ্রন্থও দীনবন্ধু রচনা করেছিলেন যথাঃ

  • সুরধুনী কাব্য (১ম ভাগ- ১৮৭১, ২য় ভাগ- ১৮৭৬) : এর প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে এবং ২য় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে ।
  • দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২) : এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে । কাব্যটিতে হিমালয় থেকে গঙ্গাদেবীর সাগরসঙ্গমে যাত্রার ছন্দবদ্ধ বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রহসন

  • সধবার একাদশী (১৮৬৬): 'সধবার একাদশী' একটি প্রহসন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সুরাপান ও বেশ্যাসক্তি একশ্রেণির যুবকের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। 'সধবার একাদশী' সেই সামাজিক বিপর্যয়ের কাহিনি। নায়ক নিমচাঁদের জীবনে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতা, অধঃপতন বোধ ও আত্মগ্লানি নাটকটিতে এক গভীর মাত্রা যোজনা করেছে। চরিত্রসৃষ্টি, সংলাপ, ঘটনাপ্রবাহ, কৌতুক সবকিছুর মিলিতরূপে 'সধবার একাদশী' বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় রচনা। এই নাটকের নায়ক নিমে দত্ত বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় চরিত্র। বলা হয়, কেনারাম চরিত্রের মধ্য দিয়ে তৎকালীন শিক্ষিত শ্রেণির নৈতিক অবস্থান এবং বিচার ব্যবস্থার হাস্যকর পরিচয় ফুটে উঠেছে। এতে তিনটি অঙ্ক আছে। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: জীবনচন্দ্র, অটলবিহারী, নিমচাঁদ, কেনারাম, সৌদামিনী, গিন্নী, কাঞ্চন ইত্যাদি।
  • বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬): 'বিয়ে পাগলা বুড়ো' হাস্যরসাত্মক নাটক। নাটকটি ১৮৭২ সালে প্রথম অভিনীত হয়। এটি সমাজের প্রাচীনপন্থীদের ব্যঙ্গ করে রচিত। এ প্রহসনে বিবাহবাতিকগ্রস্ত এক বৃদ্ধের নকল বিয়ের আয়োজন করে স্কুলের অপরিপক্ব ছেলেরা কিভাবে তাকে নাস্তানুবাদ করে, সে কাহিনিই এ প্রহসনের বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন যে এই নাটক কোনো 'জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছিল।' চরিত্রঃ নসিরাম, রতা, রাজীব, রাজমণি, কেশব, বৈকুণ্ঠ।

গল্প

দীনবন্ধু মিত্রের গল্প দুটি যথা:

  • যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১২৭৯) : এটি বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৭৯ বঙ্গাব্দে কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে ।
  • পোড়া মহেশ্বর (১২৭৯) : এটি ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৭৯ বঙ্গাব্দে কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

উপাধি

১৮৭১ সালে লুসাই যুদ্ধের সময় কাছাড়ে সফলভাবে ডাক বিভাগ পরিচালনা করেন, এজন্য সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে।

পিতৃপ্রদত্ত নাম

তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল ‘গন্ধর্ব নারায়ণ’ । তিনি নিজে পরিবর্তন করে রাখেন ‘দীনবন্ধু’

মৃত্যু

দীনবন্ধু মিত্র অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং দীর্ঘদিন বহুমুত্র রোগে ভুগে স্বাস্থ্যহানিজনিত কারণে ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

নবীনতর পূর্বতন