মুনীর চৌধুরী

মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১)

বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, অসাধারণ বক্তা, সৃজনশীল নাট্যকার, তীক্ষ্ণধী সমালোচক ও সফল অনুবাদক মুনীর চৌধুরী। সাহিত্য, ধ্বনিতত্ত্বের গবেষণা ও তুলনামূলক সমালোচনায় তিনি রেখে গেছেন অনন্য পাণ্ডিত্য ও উৎকর্ষের ছাপ। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক নাটক ও নাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ।

মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম মুনীর চৌধুরী ২৭ নভেম্বর, ১৯২৫ সালে মানিকগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন । পৈতৃক নিবাস- নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার গোপাইরবাগ গ্রামে।
পুরো নাম পুরো নাম আবু নায়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী । অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তার ভাই এবং ফেরদৌসী মজুমদার তার বোন।
রবীন্দ্রসংগীত প্রচার ২২ জুন, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে এক বিবৃতিতে রেডিও ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
বর্ণমালা সংস্কার ১৯৬৮ সালে বাংলা বর্ণমালা সংস্কার পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), . দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫) পান। তিনি ১৯৬৬ সালে 'সিতারা- ই-ইমতিয়াজ' খেতাব লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আহূত অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে এ খেতাব বর্জন করেন ।
বাংলা টাইপ রাইটার প্রথম বাংলা টাইপ রাইটার নির্মাণ করেন মুনীর চৌধুরী। এটি ‘মুনীর অপটিমা’ নামে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে এটি উদ্ভাবন করেন ।
নাটক তাঁর রচিত নাটকগুলো:

‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (১৯৬২): এটি তাঁর রচিত প্রথম নাটক। ১৭৬১ সালের পানিপথের ৩য় যুদ্ধের কাহিনি এর উপজীব্য। নাট্যকার ইতিহাস থেকে এর কাহিনি গ্রহণ করেননি, কায়কোবাদ রচিত ‘মহাশ্মশান’ থেকে এর কাহিনি গ্রহণ করেছেন। এই নাটকটির জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। চরিত্র: জোহরা, ইব্রাহীম কার্দি।

‘কবর' (১৯৬৬): এটি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। মুনীর চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার কারণে ১৯৫২-৫৪ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন। বামপন্থী লেখক রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে মুনীর চৌধুরী এ নাটকটি ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় রচনা করেন। ১৯৫৩ সালে কারাগারেই ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় ফণী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় রাজবন্দীদের দ্বারা এটি প্রথম মঞ্চায়ন করা হয় কারাভ্যন্তরেই। এটি একুশের পটভূমিতে রচিত প্রথম নাটক। ১৯৫৬ সালে প্রথম প্রকাশ্যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের একুশ উদযাপন উপলক্ষে । ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে ‘দৈনিক সংবাদ' পত্রিকার ‘আজাদী সংখ্যায় প্রথম ছাপা হয়। পরবর্তীতে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণে নাটকটি পুনর্মুদ্রিত হয়।

'মানুষ' (১৯৪৭): ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত। নাট্যকার এখানে ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিকতাকে স্থান দিয়েছেন।

‘নষ্ট ছেলে' (১৯৫০): এটি রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ নাটক ।

‘দণ্ডকারণ্য' (১৯৬৬): এতে তিনটি নাটক আছে। যথা: দণ্ড,দণ্ডধর, দণ্ডকারণ্য।

‘রাজার জন্মদিন' (১৯৪৬),

'চিঠি' (১৯৬৬),

“পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য' (১৯৬৯)।
অনূদিত নাটক তাঁর অনূদিত নাটকগুলো:

‘কেউ কিছু বলতে পারে না' (১৯৬৭): এটি জর্জ বার্নাড শ'র You never can tell এর অনুবাদ ।

‘রূপার কৌটা' (১৯৬৯): এটি গলস ওয়ার্দির The Silver Box থেকে অনূদিত ।

‘মুখরা রমণী বশীকরণ' (১৯৭০): এটি শেক্সপিয়রের Taming of the Shrew এর অনুবাদ ।
প্রবন্ধ তাঁর রচিত প্রবন্ধগুলো:

‘মীর মানস' (১৯৬৫): এর জন্য তিনি ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার লাভ করেন।

‘তুলনামূলক সমালোচনা' (১৯৬৯),

‘বাংলা গদ্যরীতি' (১৯৭০)।’
মৃত্যু ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।

বিয়োগান্তক নাটক হিসেবে ‘রক্তাক্ত প্রান্তর' এর পরিচয়

সাহিত্যকর্মে, বিশেষভাবে নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ যখন তার পরিণতিতে প্রধান চরিত্রের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনে তখন তাকে সাধারণভাবে বিয়োগান্তক নাটক বলে । ১৭৬১ সালের পানিপথের (বর্তমান ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের অন্তর্গত প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্র) ৩য় যুদ্ধের কাহিনি এর উপজীব্য। প্রশিক্ষিত মুসলিম যোদ্ধা ইব্রাহীম কার্দি মুসলিম শিবিরে চাকরি না পেয়ে মারাঠা কর্তৃক চাকরি পায় এবং সমাদৃত হয়। যুদ্ধ শুরু হলে ইব্রাহীম কার্দির স্ত্রী জোহরা মন্নুবেগ ছদ্মনাম ধারণ করে এসে স্বামীকে মুসলিম শিবিরে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। ইব্রাহীম কার্দি বিশ্বাসঘাতকতা না করে মারাঠাদের জন্য যুদ্ধে জীবন দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। নায়ক ইব্রাহীম কার্দির মৃত্যু নাটকটিকে ট্র্যাজিক করে তোলে। এটি ঐতিহাসিক নাটক নয়, ইতিহাস-আশ্রিত ট্র্যাজিক নাটক। এ নাটকের বিখ্যাত উক্তি- ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়।'

'কবর' নাটক এর পরিচয়

মার্কিন নাট্যকার Irwin Shaw রচিত Bury The Dead (১৯৩৬) নাটকের অনুসরণে মুনীর চৌধুরী এদেশীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘কবর' নাটকটি রচনা করেন। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে পাকিস্তান সরকার মুনীর চৌধুরীকে ১৯৫২ সালে আটক করে জেলে প্রেরণ করে। জেলে থাকা অবস্থায় বামপন্থী লেখক রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি ১৭ জানুয়ারি, ১৯৫৩ সালে এ নাটকটি রচনা করেন। ১৯৫৩ সালে কারাগারেই রাজবন্দীদের দ্বারা এটি প্রথম মঞ্চায়ন করা হয়। ‘কবর' নাটকে দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীর মিছিলে পুলিশ গুলি করে এবং কারফিউ জারি করে। রাতের আঁধারে বাংলার দামাল ছেলেদের গুলিবিদ্ধ লাশ গুম করার দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজ ও নেতাকে। ছিন্নভিন্ন লাশ কবরস্থ না করে মাটিচাপা দেয়ার সিদ্ধান্তে বাধা দেয় গোর-খোদক ও মুর্দা ফকির। পরবর্তীতে লাশগুলো জিন্দা হয়ে কবরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্লেখ্য, এতে কোনো নারী চরিত্র নেই।

নবীনতর পূর্বতন