ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)

বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ৮ম স্থান প্রাপ্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতকের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, গদ্যকার, মানবতাবাদ, কর্মবাদ ও ইহলৌকিক চিন্তা-চেতনার প্রতি আস্থাশীল একজন ক্ষণজন্মা বাঙালি। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে অর্থবহ করে তোলেন। বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার তিনিই ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ।
পিতা ও মাতা তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবী।
উপাধি ঈশ্বরচন্দ্রের পারিবারিক উপাধি- ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর ছদ্মনাম- কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য । তিনি ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা' নামে স্বাক্ষর করতেন।

সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে ‘বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন।
কর্মজীবন তিনি ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৪১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সম্পাদনা তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘সর্বশুভকরী' (১৮৫০)।
বাংলা গদ্যে অবদান তিনি বাংলা গদ্যে যতি বা বিরাম চিহ্নের প্রথম ব্যবহার করেন। বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বাংলা গদ্যকে গতিশীল করে প্রাণদান করেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ ও রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্য রচনার প্রয়াস প্রশংসনীয়, কিন্তু তা ছিল অপূর্ণ। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সুললিত শব্দবিন্যাস, পদবিভাগ ও যতি সন্নিবেশে সুবোধ্য ও শিল্প গুণান্বিত করে তোলেন। বাংলা গদ্যের অন্তর্নিহিত ধ্বনিঝংকার ও সুরবিন্যাস তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন, বাংলা গদ্যপ্রবাহ সমৃদ্ধির জন্য তিনি তাঁর গদ্যে ‘উচ্চবচ ধ্বনিতরঙ্গ' ও ‘অনতিলক্ষ্য ছন্দস্রোত' সৃষ্টি করেন এবং বাংলা গদ্যের শ্বাসপর্ব ও অর্থপর্ব অনুসারে ভাগ করে, সেখানে যতি চিহ্ন প্রয়োগ করে বাংলা গদ্যেকে তিনি সাহিত্যগুণ সম্পন্ন ও সর্বভাব প্রকাশক্ষম করেছিলেন বলেই তাকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বাংলা গদ্যের ‘প্রথম শিল্পী' বলে অভিহিত করেন।
আন্দোলন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার' (১৮৭১, ৭৩) প্রভৃতি গ্রন্থের মাধ্যমে বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয়তা এবং বহুবিবাহ প্রথার অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ‘বিধবা বিবাহ আইন' পাশ হয় ২৬ জুলাই, ১৮৫৬ সালে। এ বছরই ৭ ডিসেম্বর প্রথম কলকাতায় বিধবা বিবাহ হয় সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্বের সাথে কালীমতী দেবীর। তিনি এ বিয়ের যাবতীয় খরচ বহন করেন। ১৮৭০ সালে তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সাথে ভবসুন্দরী দেবী নামে এক বিধবার বিবাহ দেন ।
বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গ্রন্থের নাম ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ' (১৮৬৩): এটি একটি শোঁকগাথা। বন্ধুর বালিকা কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুশোকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এটি রচনা করেন। .
প্রথম গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘বেতালপঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭): এটি তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ এবং এটির প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এটি হিন্দি ভাষায় লাল্লুজি রচিত ‘বৈতাল পচ্চীসী' থেকে অনূদিত। এতে তিনি যতি/বিরাম চিহ্নের সফল প্রয়োগ ঘটান।
অনুবাদ গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুবাদ গ্রন্থগুলোর নাম:

‘জীবনচরিত' (১৮৪৯): এটি চেম্বার্সের বায়োগ্রাফির বঙ্গানুবাদ ।
‘শকুন্তলা' (১৮৫৪): এটি কালিদাসের সংস্কৃত ভাষার নাটক ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম' এর উপাখ্যান ভাগের বাংলা অনুবাদ ।
‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০): এটি ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটকের প্রথম অঙ্ক ও রামায়ণের উত্তর কাণ্ডের অনুবাদ ।
‘ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬৯) : শেক্সপিয়রের “Commedy of Errors' এর বাংলা রূপ।
‘বাঙালার ইতিহাস' (১৮৭৮): গ্রন্থটি তিনি মার্সম্যানের ‘History of Bengal' অবলম্বনে রচনা করেন।
মেীলিক গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থগুলোর নাম:

‘আত্মচরিত' (১৮৯১): বাংলা গদ্যে প্রথম আত্মজীবনী ।
‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৩): বাঙালির লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস ।
‘অতি অল্প হইল' (১৮৭৩): এটি ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো- সহচরস্য' ছদ্মনামে লেখেন ।
‘আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩): এটি ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো- সহচরস্য' ছদ্মনামে লেখেন ।
‘ব্রজবিলাস' (১৮৮৫): এটি 'কবিকুল তিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনামে লেখেন।
“বিধবা বিবাহ ও যশোরের হিন্দু ধর্মরক্ষিণী সভা’ (১৮৮৪): এটি তিনি ‘কস্যচিৎ তত্ত্বান্বেষিণ' ছদ্মনামে রচনা করেন।
‘রত্ন পরীক্ষা' (১৮৮৬): এটি ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো- সহচরস্য' ছদ্মনামে লেখেন ।
বিধবা বিবাহ বিষয়ক গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ বিষয়ক গ্রন্থের নাম:

‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৫),
‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার' (১৮৭১,৭৩)।
ব্যাকরণ গ্রন্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ গ্রন্থের নাম:

‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা'
(১৮৫১), ‘ব্যাকরণ কৌমুদী' (১ম ভাগ ও ২য় ভাগ- ১৮৫৩, ৩য় ভাগ- ১৮৫৪, ৪র্থ ভাগ- ১৮৬২)।
শিশুদের পাঠ্য বই ঈশ্বরচন্দ্র রচিত শিশুদের জন্য পাঠ্য বই গুলোর নাম:

‘বর্ণপরিচয়' (১ম ও ২য় ভাগ- ১৮৫৫): এটি ক্ল্যাসিকের মর্যাদা লাভ করে।
‘বোধোদয়' (১৮৫১): এটি চেম্বার্সের Rudiments of Knowledge অবলম্বনে রচিত।
‘কথামালা' (১৮৫৬): এটি ঈশপের Fables অবলম্বনে রচিত।
‘ঋজুপাঠ' ১৮৫১), ‘আখ্যানমঞ্জরী' (১৮৬৩), ‘শব্দমঞ্জরী’ (১৮৬৪), ‘শ্লোকমঞ্জরী’ (১৮৯০)।
মৃত্যু ২৯ জুলাই, ১৮৯১ সালে কলকাতায় মারা যান ।
নবীনতর পূর্বতন