বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ

আজ থেকে হাজার বছরের বেশি সময় আগে সূচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের পথচলা। এই দীর্ঘ সময়ে সাহিত্যের গতি ও বৈশিষ্ট্য সমভাবে অগ্রসর হয়নি। অন্য যে কোনো ইতিহাসের মত বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ কে ও তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণভাবে দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হলো ১২০৪ সালে সংঘটিত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়; অপরটি হলো ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং এর মধ্য দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত ও বাংলা গদ্যের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সূচনা। প্রথমটি মধ্যযুগের, অপরটি আধুনিক যুগের প্রারম্ভকাল হিসেবে বিবেচিত। সাহিত্যের রস বিচারে প্রাচীন যুগমধ্যযুগের ভেতর তেমন একটা পার্থক্য নেই, ভাষার পার্থক্য ছাড়া।

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ সম্পর্কে কয়েকজন ঐতিহাসিকের মত

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোপাল হালদার, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দীনেশচন্দ্র সেনের 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস। তিনি বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাগ করেছেন এভাবে :

  1. হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ (৮০০ খ্রি. থেকে ১২০০ খ্রি.),
  2. গৌড়ীয় যুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ,
  3. চৈতন্য সাহিত্য বা নবদ্বীপের প্রথম যুগ,
  4. সংস্কার যুগ এবং
  5. কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ বা নবদ্বীপের দ্বিতীয় যুগ।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সুবিখ্যাত গ্রন্থটির নাম Origin and Development of Bengali Language (সংক্ষেপে ODBL)। তাঁর যুগ বিভাগটি নিম্নরূপ :

  1. প্রাচীন বা মুসলমানপূর্ব যুগ (৯৫০-১২০০ খ্রি.),
  2. তুর্কি বিজয়ের যুগ (১২০০-১৩০০ খ্রি.),
  3. আদি মধ্যযুগ বা প্রাকচৈতন্য যুগ (১৩০০-১৫০০ খ্রি.),
  4. অন্ত্য মধ্যযুগ (১৫০০-১৮০০ খ্রি.) [চৈতন্যযুগ বা বৈষ্ণব সাহিত্য (১৫০০ - ১৭০০ খ্রি.) ও নবাবী আমল (১৭০০ - ১৮০০ খ্রি.)] এবং
  5. আধুনিক যুগ (১৮০০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত)।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মধ্যযুগকে পাঠান আমল (১২০১ - ১৫৭৬ খ্রি.) এবং মুঘল আমল (১৫৭৭ - ১৮০০ খ্রি.) এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন ।

বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেব মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান নির্ধারক, যাঁর প্রভাবের কথা সব পণ্ডিতই গ্রাহ্য করেছেন। তাঁর প্রভাবে বিশেষত বৈষ্ণব গীতিকা আর জীবনীসাহিত্যের (চৈতন্যদেবের জীবন অবলম্বনে রচিত) বিরাট ধারা তৈরি হয়েছিল ।

ভাষাতাত্ত্বিকদের পর্যালোচনা অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ কে তিনটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পর্যায়ে বিভক্ত করা যায় –

যুগের নাম সময়কাল
প্রাচীন যুগ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
মধ্যযুগ ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
আধুনিক যুগ ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান ।

১. প্রাচীন যুগ

এ যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ । এর ভাষা ও বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য। এর কবিরা ছিলেন বৌদ্ধ সাধক। তাঁদের সাধনার গূঢ় তত্ত্ব কবিতার চরণে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবুও মনের ছোঁয়ায় তাতে লেগেছে সাহিত্যের নানা রঙ ও সৌরভ। এ সময়ের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা, ধর্ম নির্ভরতা প্রভৃতি। ধর্মের বিষয়টি সমাজজীবনের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, তাই সাহিত্যে ধর্মের কথা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এছাড়া লোকজীবনের কথাস্বরূপ ডাক ও খনার বচন, রূপকথা প্রভৃতি উপকরণ পাওয়া গেছে।
চর্যাপদের নমুনা-
কা আ তরুবর পাঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল॥
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভনই গুরু পুচ্ছি অ জাণ॥

২. মধ্য যুগ

মধ্যযুগের শুরুতে ১২০১-১৩৫০ সালের মধ্যে তেমন কোন সাহিত্য পাওয়া যায়নি। এ সময়কে ‘অন্ধকার যুগ' বলা হয়। মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ফলে প্রচলিত সংস্কৃতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে তাতে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচিত হয়নি বলে মনে করা হয়। ১৩৫০ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলা কাব্যের দুটি প্রধান ধারা পরিলক্ষিত হয় -কাহিনী কাব্য ও গীতি কাব্য । প্রথম ধারার কাহিনী কাঠামোর মধ্যে সঙ্গীত- ধর্মিতা লক্ষণীয়। দ্বিতীয় ধারার প্রধান লক্ষণ সঙ্গীত-ধর্মিতা ও ভাব-ধর্মিতা। মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য যা চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত। এ ভাষার নমুনা :
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে॥
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন ।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রন্ধন ॥

মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবে বাঙালি জাতির মধ্যে স্পন্দিত হয়েছে মানবপ্রেমের শোণিত ধারা, নব ভাববোধের উদ্দীপনা, নব জাগরণের বাণীমন্ত্র। আর তাই শ্রীচৈতন্যের নামে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের যুগবিভাগকে চিহ্নিত করা হয়। এ যুগবিভাগ হলো –

যুগের নাম সময়কাল
প্ৰাকচৈতন্য যুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ)
চৈতন্য যুগ (১৫০১-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ)
চৈতন্য পরবর্তী যুগ (১৬০১-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)

৩. আধুনিক যুগ

আঠারো শতকের শেষার্ধে এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতে রাষ্ট্রিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া সাহিত্যে দৃষ্ট হয় এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন রাগিণীর সূচনা ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল আধুনিক যুগে। এ যুগের প্রতিভূ হলো গদ্য সাহিত্য। এ সময়ে মানবতাবোধ, যুক্তিবাদ, সমাজসচেতনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, গদ্যের প্রতিষ্ঠা, স্বদেশপ্রেম, রোমান্টিক দৃষ্টি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য সাহিত্যে মূর্ত হয়ে উঠে ।

বিষয় ও সাহিত্যিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে আধুনিক যুগকে আবার দু ভাগে ভাগ করা যায় যথা:

১. উন্মেষ পর্ব (১৮০১-১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ)
২. বিকাশ পর্ব (১৮৬১ - বর্তমান)।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয় উইলিয়াম কেরী ও তার সহযোগী পন্ডিতদের হাত ধরে। তারপর একে একে আসেন রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মতো প্রতিথযশা সকল সাহিত্যিক। আধুনিক যুগেই নির্মিত হয় সাহিত্যের সকল শাখা যেমন প্রবন্ধ,নাটক,উপন্যাস,ছোটগল্প,প্রহসন প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,মাইকেল মধুসুদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলামের মত সৃষ্টিশীল সকল মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে বাংলা সাহিত্য হয় সমৃদ্ধ। যার ফলস্বরুপ আজ বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠেছে সুবিখ্যাত ও সমাদৃত।

নবীনতর পূর্বতন