চর্যাপদ-বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। এর অন্য নাম হলো চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি । এর ভাষা ও বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য এবং এর কবিরা ছিলেন বৌদ্ধ সাধক। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। এ সময়ের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা ও ধর্মনির্ভরতা। ধর্মের বিষয়টি সমাজজীবনের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, তাই সাহিত্যে ধর্মের কথা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের সময়কাল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, ৬৫০-১২০০ খ্রি.। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, ৯৫০-১২০০ খ্রি.। ড. সুকুমার সেনের মতে, ৯০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ।

চর্যাপদ কী?

চর্যাপদ গানের সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা এ গানের সংকলন বা সাধন দোহা' নামে প্রকাশিত হয়। সংগীতের সাহায্যে কোনটি চর্য (আচরণীয়) আর কোনটি অ- চর্য (অনাচরণীয়) তা বিনিশ্চয় (নির্ণয়) করা যেতে পারে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর 'Buddhist Mystic Songs' গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫০টি এবং প্রাপ্ত পদ সাড়ে ছেচল্লিশটি। ড. সুকুমার সেনের 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫১টি। চর্যাপদের ২৩ নং এর অর্ধেক, ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ পাওয়া যায়নি।. যেসব পদ পাওয়া যায়নি সেগুলোর রচয়িতা যথাক্রমে-

২৩ নং- ভুসুকুপা, ২৪নং- কাহ্নপা, ২৫নং- তান্তীপা, ৪৮নং- কুক্কুরীপা। চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদের রচয়িতা কাহ্নপা। তিনি ১৩টি পদ রচনা করেন। যথা: ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪ (পাওয়া যায় নি), ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫। চর্যার পদকর্তাদের নামের শেষে সম্মানসূচক 'পা' যুক্ত হয়েছে। চর্যায় যারা পদ রচনা করেছেন তাদের প্রত্যেককে ‘মহাসিদ্ধ' বলা হয়ে থাকে। চর্যাপদের প্রথম পদের রচয়িতা লুইপা। তিনি ২টি পদ রচনা করেন। যথা: ১, ২৯। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, তিনি শবরপার শিষ্য ছিলেন। লুইপাকে আদি চর্যাকার হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এর প্রথম পদ হচ্ছে কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল / চঞ্চল চীএ পইঠো কাল । এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। মুনিদত্ত চর্যাপদের পদগুলোকে টীকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন । [মুনিদত্ত ১১ নং পদের ব্যাখ্যা প্রদান করেননি] ১৯৩৮ সালে এর তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী । চর্যাপদ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন কীর্তিচন্দ্র।

চর্যাপদ আবিষ্কারের ইতিহাস

১৮৮২ সালে ‘বিবিধার্থ পত্রিকার সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্র Sanskrit Buddhist Literature in Nepal E নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা, বিহার ও আসাম অঞ্চলের পুঁথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর। তিনি তৃতীয়বারের (প্রথমবার ১৮৯৭, দ্বিতীয়বার-১৮৯৮) প্রচেষ্টায় ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে নতুন কিছু পুঁথির সন্ধান পান যা'চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়', 'ডাকার্ণব', 'সরহপাদের দোহা' ও'কৃষ্ণপাদের দোহা' নামে পরিচিত। এর মধ্যে 'চর্যাপদ' বাংলা ভাষায় এবং বাকী তিনটি অপভ্রংশ ভাষায় রচিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) মহামহোপাধ্যায় ( মহামহোপাধ্যায় তাঁর উপাধি ) ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে ‘চর্যাপদ' আবিষ্কারের পর ১৯১৫ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপাল থেকে প্রাপ্ত তালপাতার পুঁথির একটি তালিকা A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS belonging to the Durbar Library, Nepal প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এটি তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ ব.) কলকাতার 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়', 'ডাকার্ণব', 'সরহপাদের দোহা' ও ‘কৃষ্ণপাদের দোহা' গ্রন্থের সম্মিলনে 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে প্রকাশিত হয়। চর্যাপদ রচনার সময়কাল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রি.। ড. সুকুমার সেনের মতে- ৯০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ।

চর্যাপদ নেপালে পাওয়ার কারণ

চর্যাপদ রচনার সময়কালে বাংলায় পাল রাজারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা প্রায় চারশত বছর বাংলা শাসন করেছে। এর পরবর্তীতে আসে সেন বংশ। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেন রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত সেন সময়কালের কতিপয় হিন্দু ব্রাহ্মণ বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন চালায়। আবার, ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলায় আগমন ঘটলে মুসলিম তুর্কিদের আক্রমণের ভয়ে বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ প্রাণের ভয়ে পুঁথিপত্র নিয়ে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে পালিয়ে যায়। এ কারণেই চর্যাপদ নেপালে পাওয়া যায়।

চর্যাপদের কবিদের পরিচয়

চর্যাপদের কবি/পদকর্তা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে- ২৩ জন। ড. সুকুমার সেনের মতে- ২৪ জন। কবি / পদকর্তাদের নাম যথা: আর্যদেবপা, কঙ্কণপা, কম্বলাম্বরপা, কাহ্নপা, কুক্কুরীপা, গুগুরীপা, চাটিলপা, জয়নন্দীপা, ঢেগুণপা, ডোম্বীপা, তান্তীপা, তাড়কপা, দারিকপা, ধৰ্ম্মপা, বিরূপা, বীণাপা, ভাদেপা, ভুসুকুপা, মহীণ্ডাপা, লাড়িডোম্বীপা, লুইপা, শবরপা, শান্তিপা, সরহপা। নিচে কয়েকজন পদকর্তার পরিচয় তুলে ধরা হলো।

লুইপা

সাধারণত লুইপাকে আদি চর্যাকার বা আদি সিদ্ধাচার্য বিবেচনা করা হয় । ‘লুই' শব্দটি ‘রোহিত' শব্দ হতে উদ্ভূত। লুইপা বাঙালি বলে অনুমিত । তিনি চর্যাপদের ১ নং ও ২৯ নং পদের চর্যাকার। তার জন্মস্থান উড়িষ্যায় । তারানাথের মতে, তিনি গঙ্গার ধারে বাস করতেন । তিনি ছিলেন উড়িষ্যার রাজা ও মন্ত্রীর গুরু। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, তাঁর জীবনকাল ৭৩০- ৮১০ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি সংস্কৃত ভাষায় ৪/৫টি গ্রন্থ রচনা করেন । তার লিখিত চর্যাপদের ১ নং পদের প্রথম দুটি চরণ হলো -

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল ৷৷
চরণদ্বয়ের আধুনিক বাংলা হলো : দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল । চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করে।

কাহ্নপা

চর্যাদের কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পদ রচয়িতা হলেন কাহ্নপা । চর্যাপদে তাঁর পদের সংখ্যা ১৩টি। তিনি কাহ্নপা, কৃষ্ণবজ্রপাদ, কাহ্ন, কানু, কাহ্নিল, কৃষ্ণচর্য প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিলেন। এ নামগুলো তার রচিত পদগুলোর ভূমিকায় পাওয়া গিয়েছে। কাহ্নপার জীবনকালের শেষ সীমা ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর জন্ম উড়িষ্যায় হলেও তিনি বিহারে বসবাস করতেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যোগী ছিলেন। তিনি ধর্মশাস্ত্র ও সঙ্গীতশাস্ত্র উভয়দিকেই দক্ষ ছিলেন । তিনি ডোম্বীর প্রেমে পড়ে নিজের সাধনা জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন বলে তার রচনা হতে জানা যায় (১০ নং পদ)। চর্যাপদের ১৩নং ও ১৮নং পদে তার বিবাহের সংবাদ রয়েছে। চর্যাপদ ছাড়া তিনি অপভ্রংশ ভাষায় দোহাকোষ রচনা করেন । তিনি দেবপালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন ।

ভুসুকুপা

চর্যাপদের পদ রচনার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় হচ্ছেন ভুসুকুপা। তিনি মোট ৮টি পদ রচনা করেন। ভুসুকুপার প্রকৃত নাম শান্তিদেব। পদ রচনায় তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। ভূক্তি (ভু) সুপ্তি (সু) কুটিরে (কু) অবস্থান করতেন বলে তাকে ভুসুকু বলা হয়। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ভুসুকুপার জীবনকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। ভুসুকুপা সৌরাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে অবস্থান করেন। তাকে বাঙালি কবি হিসেবে অনুমান করেছেন পণ্ডিতগণ। কারণ, তাঁর পদে পদ্মা (পউয়া) খালের নাম আছে, বঙ্গাল দেশ ও বঙ্গালীর কথা আছে।

কুক্কুরীপা

কুক্কুরীপা তিব্বত অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তিনি আনুমানিক অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। কুক্কুরীপা নামটি সংস্কৃত শব্দ 'কুক্কুট পাদ' এর বিকৃতরূপ। যে সব পণ্ডিত নানা রকম শাস্ত্র নিয়ে আলোচনায় মত্ত থাকতেন তাদের উপহাস করে কুক্কুটপাদ বলা হত। চর্যাপদের তিনটি পদের রচয়িতা কুক্কুরীপা। তার পদের ভাষা গ্রাম্য, ভাব ইতর । তিব্বতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি একটি নেড়ি কুকুর পুষতেন । তাকে মহিলা কবি মনে করা হয়। তিনি ইন্দ্রভূতির অন্যতম গুরু ।

মৎস্যেন্দ্রনাথ

চর্যাপদের প্রথম বাঙালি কবি মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথ বলে ধরা হয়। তিনি নাথ ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু । তিনি আনুমানিক সপ্তম শতকে বর্তমান ছিলেন। চর্যাপদে মীননাথের কোন পূর্ণাঙ্গ পদ পাওয়া যায়নি। তবে ২১নং পদের টীকায় তার চারটি পদের উল্লেখ রয়েছে।

বীরুআপা

তিনি ত্রিপুরার অধিবাসী ছিলেন। বিরুআপা নামটির মূল সংস্কৃত হচ্ছে - 'বিরুপাক'। টীকাকার কর্তৃক বিরুআপার নাম বলা হয়েছে বিরুপবজ্র । তার জীবনকালের শেষ সীমা ৮৩০ সাল। চর্যাপদে তার পদ মাত্র ১টি যাতে শুঁড়িবাড়ির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ভিক্ষুকরূপে সোমপুর বিহারে বাস করতেন তিনি ।

শবরপা

তিনি চর্যার আদি পদকর্তা। তাঁর জীবনকাল অষ্টম শতকের প্রথমার্ধ - (৬৮০ থেকে ৭৬০)। তিনি ছিলেন বাঙালি ও ব্যাধ এবং লুইপার শুরু। তিনি চর্যাপদের ২৮ ও ৫০ নং পদের রচয়িতা। তাকে চর্যার শ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হয় । তার রচিত চর্যার বিষয়বস্তু হলো শবর শবরীর প্রেমকাহিনী । ২৮ নং পদের প্রথম দুটি লাইন হলো -

উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহান সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী॥

এর আধুনিক বাংলা হলো : উঁচু পর্বতে সবরী বালিকা বাস করে। তার পরিধানে ময়ূরের পুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা ।

সরহপা

সরহপার জন্মস্থান ছিল রাজ্ঞীদেশ সম্ভবত উত্তরবঙ্গ কামরূপ । কামরূপের রাজা রত্মপাল ছিলেন তাঁর শিষ্য। চর্যাপদে তার পদসংখ্যা ৪টি । তার রচিত পদে শবর-শবরীর প্রেম ভালোবাসার বর্ণনা ছাড়াও সরল তত্ত্বকথা বর্ণিত হয়েছে। তার রচিত চর্যার ৩৮নং পদে খেয়া নৌকায় এপার ওপার যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। তাঁর পদাবলির ভাষা বঙ্গ-কামরূপী । তিনি চর্যাপদ ছাড়াও অবহটঠ ভাষায় দোহাকোষ রচনা করেন। তিনি আনুমানিক দশম-একাদশ শতকের কবি।

ঢেগুণপা

ঢেগুণ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঢেঁড়ি অর্থাৎ ডুগডুগি বাজিয়ে ভিক্ষা মাগে যে । ঢেগুণপা'র জন্মস্থান অবন্তিনগর-উজ্জয়িনী। তাঁর জীবৎকালের ঊর্ধ্বসীমা ৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি চর্যাপদের ৩৩নং পদের রচয়িতা। তার পদের বিষয় লোকপরিচিতি ও প্রহেলিকামালা। তার পদে বাঙালির চিরায়ত জীবনচিত্র ও দারিদ্র্যের ভয়ঙ্কর রুপ অতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তার পদটির প্রথম দুটি পঙতি-

টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়িত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী॥

এর আধুনিক বাংলা হলো : টিলাতে আমার বাস প্রতিবেশী নেই,হাঁড়িতে ভাত নেই প্রতিদিন অতিথি এসে ভীড় করে।

চর্যাপদের পদকর্তাগণ কে কতটি পদ রচনা করেন?

পদকর্তার নাম পদের সংখ্যা





অবশিষ্ট পদকর্তাগণ ১টি করে পদ রচনা করেন। লাড়ীডোম্বী পা'র নাম পাওয়া গেলেও তাঁর কোন পদ পাওয়া যায়নি।
কাহ্নপা ১৩ টি (৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪ (পাওয়া যায় নি), ৩৬, ৪০, ৪২, ও ৪৫ নং পদ )
ভুসুকু পা (বাঙালি কবি) ৮ টি ( ৬,২১,২৩,২৭,৩০,৪১,৪৩ ও ৪৯ নং পদ)
সরহ পা ৪ টি ( ২২,৩২,৩৮ ও ৩৯ নং পদ )
কুক্কুরী পা (মহিলা কবি) ৩ টি ( ২,২০ ও ৪৮ নং পদ )
লুই পা, শবর পা,শান্তি পা ২ টি করে

চর্যাপদের প্রবাদ বাক্য কয়টি ও কী কী?

চর্যাপদের প্রবাদ বাক্য ৬টি । যথা:
অপণা মাংসে হরিণা বৈরী (৬নং পদ- ভুসুকুপা)। অর্থ: হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু।
হাথে রে কাঙ্কাণ মা লোউ দাপণ (৩২নং পদ- সরহপা)। অর্থ: হাতের কাঁকন দেখার জন্য দর্পণ প্রয়োজন হয় না।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী (৩৩নং পদ- ঢেণ্ডণপা)। অর্থ: হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকরা এসে ভীড় করে।
দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায় (৩৩নং পদ- ঢেণ্ডণপা)। অর্থ: দোহন করা দুধ কি বাটে প্রবেশ করানো যায়?
বর সুণ গোহালী কিমো দুঠ বলন্দে (৩৯নং পদ- সরহপা)। অর্থ: দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।
অণ চাহন্তে আণ বিণঠা (৪৪নং পদ- কঙ্কণপা)। অর্থ: অন্য চাহিতে, অন্য বিনষ্ট।

প্রাচীনতম ও আধুনিকতম চর্যাকার কে?

উত্তর: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, প্রাচীনতম শবর পা (৬৮০-৭৬০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আধুনিকতম ভুসুকুপা। শবরপা, ভুসুকুপা ও লুইপা বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত।

চর্যাপদের ভাষা কোনটি?

উত্তর: মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষা। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এর ভাষার নাম ‘বঙ্গকামরূপী'। এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।

সন্ধ্যা ভাষা কী?

যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায় নি, যে ভাষার অর্থ একাধিক অর্থাৎ আলো-আঁধারের মতো, সে ভাষাকে পণ্ডিতগণ সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন ‘চর্যাগীতি' বা 'চর্যাপদ' এ ভাষায় রচিত। ‘চর্যাগীতি' বা ‘চর্যাপদ' গানের সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। সন্ধ্যা ভাষা সম্পর্কে চর্যাপদের আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ‘আলো-আঁধারির ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না'। চর্যাপদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে ।

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে ধারণা

১৯২৭ সালে এর ধর্মমত নিয়ে আলোচনা করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘Buddhist Mystic Songs' গ্রন্থে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। চর্যাগীতি বা চর্যাপদ গানের/কবিতার সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। এগুলো মূলত মহাজ্ঞান ধর্মশাখার অন্তর্গত সহজযান ধর্মশাখার সাধনসংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা কালক্রমে যেসব উপশাখায় বিভক্ত হয়েছিল তারই বজ্রযানের সাধনপ্রণালী ও তত্ত্ব চর্যাপদে বিধৃত। ‘মহাসুখরূপ নির্বাণ লাভ' হলো চর্যার প্রধান তত্ত্ব। এ সম্পর্কে চর্যাকার ভুসুকুপা বলেছেন, 'সহজানন্দ মহাসুহ লীলে'। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের মূলগত ভাবনার অনুসারী হলেও এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম।

চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের ব্যাখ্যা

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন 'চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়' বা 'চর্যাগীতিকোষ' বা 'চর্যাগীতি' বা 'চর্যাপদ'। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে এটি আবিষ্কার করেন। শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ ব.) কলকাতার 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে ‘চৰ্যাচর্য্যবিনিশ্চয়', 'ডাকার্ণব' ও 'সরহপাদের দোহা' ও ‘কৃষ্ণপাদের দোহা' গ্রন্থের সম্মিলন 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে প্রকাশিত হয়।এটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক শুরু হয় এর ভাষা নিয়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী 'চর্যাপদ' গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ তাঁর এ দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার History of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষাকে প্রাচীন বাংলা বলতে অস্বীকার করেন। এছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, উড়িষ্যা প্রভৃতি ভাষাবিদরা নিজ নিজ ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবি করেন।১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ এবং চর্যার কবিদের নাম, পদ্মা নদীর নামের উল্লেখ (ভুসুকুপার ৪৯ নং পদে 'পউয়া খাল') বিশ্লেষণ করে এর ভাষাকে প্রাচীন বাংলার আদি নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত 'Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha' গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে, এর ভাষার নাম বঙ্গকামরূপী। তারপরও সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি যে, এটি সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষায় এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।

নবচর্যাপদ কী?

‘নবচর্যাপদ' চর্যাপদের অনুরূপ রচনা। শশীভূষণ দাশগুপ্ত ১৯৬৩ সালে নেপাল ও তরাইভূমি থেকে ২৫০টি পদ আবিষ্কার ও সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ১০০টি পদ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নবচর্যাপদ' নামে সেগুলোর মধ্য থেকে ৯৮টি পদ সংকলন করে প্রকাশ করেন। এ পদগুলোর রচনাকাল বারো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুন চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা নিরন্তর চলমান। প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ প্রকাশের ১০০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও ফোকলোর বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ চর্যাপদ গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত চর্যাপদের নাম ‘নতুন চর্যাপদ”। নতুন চর্যাপদ মূলত বজ্রযানী দেবদেবীর আরাধনার গীত। এর পদগুলোতে তান্ত্রিক নানা দেবদেবীর রূপসৌন্দর্য, মুখ ও বাহুর বর্ণনা, তাঁদের আসন, মুদ্রা ও দেহভঙ্গি, তাঁদের আভরণ ও আয়ুধ ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য ও বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। এটি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রকাশিত হয় এবং উৎসর্গ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। ২০০৮ সালে ড. শাহেদ কাঠমুন্ডু ও আশেপাশের বিভিন্ন বজ্রযানী মন্দিরে পুঁথি সংগ্রহ করতে গিয়ে রত্নকাজী বজ্রাচার্যের নিকট থেকে নতুন চর্যাপদের দুটি সংকলিত পুস্তক সংগ্রহ করেন। এ পুস্তক দুটির পদগুলো ছিলো নেওয়ারিমিশ্রিত দেবনাগরী অক্ষরে মুদ্রিত। নতুন চর্যাপদে যেসব পদ সংকলিত হয়েছে সেগুলোর রচনাকাল অষ্টম থেকে বিশ শতক পর্যন্ত। সুতরাং নতুন এই চর্যাপদ প্রমাণ করে যে, চর্যাপদ কেবল প্রাচীন সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, মধ্যযুগেও এগুলোর রচনা অব্যাহত ছিল। এমনকি বিশ শতকেও চর্যাপদ রচিত হয়েছে। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ সংকলিত ও সম্পাদিত নতুন চর্যাপদে ৩৩৫টি পদ সংকলিত হয়েছে। এছাড়া পরিশিষ্ট অংশে রাহুল সাংকৃত্যায়ন সংগৃহীত ২০টি, শশিভূষণ দাশগুপ্ত সংগৃহীত ২১টি এবং জগন্নাথ উপাধ্যায় সংগৃহীত ৩৭টি পদ সংকলিত হয়েছে। সে হিসেবে এ গ্রন্থে সংকলিত নতুন চর্যাপদের মোট সংখ্যা ৪১৩টি। নতুন চর্যাপদের ভূমিকা অংশটি চার ভাগে বিভক্ত।

প্রথম অংশ → ‘নতুন চর্যার সংগ্রহ ও চর্যাকার পরিচয়।’
দ্বিতীয় অংশ → ‘নতুন চর্যায় বজ্রযানী দেবদেবী।'
তৃতীয় অংশ → ‘নতুন চর্যার আঙ্গিক, ভাষা ও ভূগোল ।'
চতুর্থ অংশ → ‘চর্যাপদ ও নতুন চর্যা'।

নবীনতর পূর্বতন