উইলিয়াম কেরি

উইলিয়াম কেরি ছিলেন মিশনারি ও বাংলায় গদ্যপাঠ্য পুস্তকের প্রবর্তক। তিনি আধুনিক মিশনসমূহের জনক নামে পরিচিত। তিনি ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, প্রথম ডিগ্রী প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর কলেজ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাংলা গদ্যের সূচনাকালীন অবদান, বাংলা লিপির সংস্কার এবং এদেশীয় কৃষ্টি, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন । ভারতে আসার আগে তাঁর মূল পেশা ছিল পাদুকা নির্মাণ ।

উইলিয়াম কেরি

জন্ম ও বংশ পরিচয়

১৭৬১ সালের গ্রীষ্মাবসানে, আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে ইংল্যান্ডের নর্দানটন শায়ার, টাউসেস্টারের পলার্সপিউরী নামক এক অখ্যাত গ্রামে উইলিয়াম কেরি একটি দরিদ্র তাঁতী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কেরি তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কোন তথ্য জানাতে পারেন নি । তার পিতামহ পিটার কেরী পলার্সপিউরীর স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না । প্রথম জীবনে তিনি কোন এক অজানা কারণে এ গ্রামে এসেছিলেন । পিটার কেরী পেশায় তাঁতী ছিলেন । তবে তিনি পলার্সপিউরীতে যখন প্রথম স্কুল স্থাপন করা হয় সেটার প্রথম শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন । তিনি একই সাথে দুটি পেশা ১৮ বছর ধরে সম্মানের সহিত করতে পেরেছিলেন । কারণ তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ । পিটার কেরীর পাঁচটি সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম কেরির পিতার নাম ছিল এডমন্ড । এডমন্ড তার পিতৃবিয়োগের সময় মাত্র সাত বছরের বালক । তখন এডমন্ড ও তার মা অ্যান চরম বিপাকে । স্থানীয়রা এডমন্ডকে স্কুলে ভর্তি করালে ও তিনি মূলত তার পিতৃপেশা তাঁত বোনা রপ্ত করেছিলেন । তিনি ধরলেন সংসারের হাল । ছব্বিশ বছর বয়সে এডমন্ড বিয়ে করেন এলিজাবেথ উইলকে । এডমন্ড ও এলিজাবেথ দম্পতির পাঁচটি সন্তান । তাদের জেষ্ঠ্য সন্তানের নাম ছিল উইলিয়াম । আর তিনিই হলেন সেই উইলিয়াম কেরি । উল্লেখ্য পিটার কেরী ও অ্যান দম্পতির প্রথম সন্তান অর্থাৎ উইলিয়াম কেরির বড় চাচার নাম ও ছিল উইলিয়াম । তার ঠাকুরমা অ্যান তার নামেই কেরির নাম রাখেন । এলিজাবেথ নামে তাঁর একজন ভাই ও ছিল যে শৈশব অবস্থাতেই মারা যায় ।

ছেলেবেলা

ঠাকুরমার বুকেই লালিত হয়েছিলেন কেরী; ভালোবাসা ও স্নেহের উত্তাপে ভরা তাঁর শৈশব। পলার্সপিউরীর যে বাড়িতে তাঁর শৈশব অতি- বাহিত হচ্ছিল, তার পরিবেশটিও ছিল আকর্ষণীয়। বাড়ির পিছনদিক থেকে গ্রামের উদার নিসর্গশোভা দেখা যেত। তবু, এডমণ্ডের দরিদ্র সংসারেরই সন্তান তিনি। মোটামটিভাবে সুন্দর ছেলেবেলা তাঁর, হয়তো সমতল ও নিস্তরঙ্গ একটু, তবু, এই সময়েরই পর পর দুটো ঘটনা তাঁর বাল্যস্মৃতিতে উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ, দীর্ঘ প্রবাসযাপন শেষে চাচা পিটার কেরীর ( তার পিতামহের দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল পিটার যিনি কৈশোরেই দেশ- ত্যাগী হন, তিনি কানাডায় পাড়ি দিয়েছিলেন এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে। সেখান থেকে তাঁর কোন সংবাদও পাওয়া যাচ্ছিল না। ) প্রত্যাবর্তন; দ্বিতীয়তঃ, স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকতায় পিতা এডমণ্ডের নির্বাচন ও তাঁর বাসস্থান পরিবর্তন। প্রায় কুড়ি বছর পর কানাডা থেকে এই সময় ফিরে আসেন পিটার কেরী। তিনি ফিরে আসবার পরই ঠাকুরমা অ্যান মারা গেলেন। পিটার নিঃসন্তান ছিলেন, বালক উইলিয়মকে তিনি সহজেই স্নেহের বন্ধনে বেধে নিলেন। ক্রমে ক্রমে উভয়ের ঘনিষ্ঠতা অচ্ছেদ্য হয়ে দাঁড়ালো। পিটার বাগান করতে ভালোবাসতেন, বিভিন্ন উদ্ভিদ তিনি চিনতেন ও তাদের চাষ করতে জানতেন। অনেকদিন পর তিনি ফিরেছেন ইংল্যাণ্ডে, ইংল্যাণ্ড তাঁর এই মধ্যবয়সের হৃৎপিণ্ডকেও স্বাভাবিকভাবে স্পর্শ করল দীর্ঘদিনের ব্যবধানে। এবং তিনি স্বদেশের প্রকৃতি-সৌন্দর্যের দুয়ার একে একে খুলে দিলেন বালক উইলিয়মের কাছে। শুধু, তাই নয়, বালক উইলিয়মের কাছে তিনি প্রায়ই কানাডার গল্প বলতেন; সেখানকার প্রবাসী জনসাধারণের কথা, সেখানকার জল-জঙ্গল, বন্য জন্তু, গাছপালা বা ফল, পাখির কথা সেখানকার তীব্র শীতের কথাও হয়তো। এই থেকেই উইলিয়মের শিশু- চিত্তে দেশান্তরের প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে প্রথম আগ্রহের সূচনা, এই আগ্রহ থেকেই সম্ভবতঃ তাঁর দূর সমুদ্র-যাত্রার প্রেরণা রক্তের মধ্যে গোপনে সঞ্চারিত হতে থাকে। উইলিয়মের যখন মাত্র ছ'বছর বয়স, পলার্সপিউরীর স্কুলে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দিল। যে-ব্যক্তি এডমণ্ডের পিতা পিটার কেরীর ( উইলিয়াম কেরির পিতামহ ) মৃত্যুর পর স্কুলে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি সহসা মারা গেলে, গ্রামের লোকেদের ইচ্ছানুযায়ী এডমণ্ড এই শিক্ষকতার পদে বৃত হলেন, সঙ্গে প্যারিশের কেরানীগিরির কাজও তাঁর ওপর এসে বর্তালো। এই চাকরীর সঙ্গে 'পলার্সপিউরীর '-এর খড়ের বাড়ি থেকে স্কুল বাড়িতে উঠে এলেন এডমণ্ড। উইলিয়মের জীবনে এ এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা। বাবাকে তিনি দেখতে শুরু, করলেন গণ্যমান্য-রূপে, যাঁকে সবাই সম্মান করে ও যাঁর কথা সবাই শোনে। এবং পিতার অনুশাসনে ধীরে ধীরে তাঁর চরিত্রে বিনম্রতা দেখা দিল। এইখানে এসে উইলিয়মের জীবন- ভিত্তি সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে শুর করল। পিতা নিজে প্রচুর পড়তেন : তাঁর এই বিশেষ বৃত্তিটি তিনি উইলিয়মের মধ্যে সঞ্চারিত করেন, মনোযোগের সহিত পড়াশোনার অভ্যাস উইলিয়ামের এই সময় গড়ে ওঠে। বস্তুতঃ পিতা এডমণ্ডের এই নতুন পেশা উইলিয়মের জ্ঞানচর্চার উন্মেষের ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। আর এভাবেই তিনি পিতা ও চাচার সান্নিধ্যে বাল্যকাল থেকেই কেরি হয়ে উঠেছিলেন জ্ঞানপিপাসু। তখন থেকেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষত উদ্ভিদবিদ্যায় কেরির গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও ভাষাশিক্ষার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন বিশেষ মেধাসম্পন্ন। স্বচেষ্টায় তিনি লাতিন ভাষা শিখতে সামর্থ হয়েছিলেন। ছেলেবেলায় তার শিক্ষা বলতে পিতা এডমন্ডের স্কুলই ছিল প্রাথমিক শিক্ষা । যদি ও পিতা শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অধিক জানা এবং জ্ঞান অন্বেষণের সুযোগ হয়েছিল । কারণ তাঁদের ঘরে বিভিন্ন শাস্ত্র ছিল যে গুলো কেরি নিয়মিতই পড়তেন । তাছাড়া তখনকার নর্দাম্পটন মার্কারির সাপ্তাহিক কপি আসা ছিল তাঁর পিতার কাছে স্বাভাবিক । সেই কাগজের সুবাদেও তিনি বাইরের জগৎ সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার সুযোগ পান ।

জীবিকার সন্ধানে কেরি

প্রায় ১৪ বছরকাল পলার্সপিউরীর জীবন উইলিয়াম কেরির । এর মধ্যে বার বছর বয়স পর্যন্ত তাকে জীবিকার তাগিদে কিছু করতে হয় নি । তবে বার বছর বয়সে তার পিতা এডমন্ড তাকে কৃষিকাজ শেখাবার উদ্যোগ নেন । প্রায় দুই বছরকাল চাষ আর বাগানের কাজে আত্ননিয়োগ করেছিলেন উইলিয়াম কেরি । কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন । কারণ কেরির বিশেষ ধরনের এক চর্মরোগ ছিল যে কারণে তিনি রোদ্রতাপ সহ্য করতে পারতেন না । ফলে এই কাজ তাঁকে ত্যাগ করতে হয়। বলা যেতে পারে, বারো বৎসর থেকেই উইলিয়মের জীবনে জীবিকাসন্ধানের আয়োজন সূচিত হয়েছিল ; চাষের কাজে যখন অসুখের জন্য তিনি অনুপযক্ত বিবেচিত হলেন, তখন এডমণ্ড তাঁকে পলাস পিউরীর নয়-দশমাইল পূর্বে, হ্যাকেল্টনের সম্ভ্রান্ত এক ভদ্রলোক ক্লার্ক' নিকলস, পেশায় জুতা প্রস্তুতকারক, উইলিয়ামকে তার সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অধীনে তিনি জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখতেন; কিন্তু বছর দুইয়ের মধ্যেই নিকলসের মৃত্যু হয়। এই সময় উইলিয়মের বয়স ষোল বৎসরের মত। এর কিছুকাল পর তিনি মনিব বদল করেন। কিন্তু নিকলসের সহযোগী হিসাবে কাজ শেখবার সময়, তাঁর দোকানে, যে সামান্য গ্রন্থাদি ছিল, সেগুলি তিনি আগ্রহে পড়েছিলেন। এইসব গ্রন্থাবলীর অনেকগুলিই ধর্মগ্রন্থ, যেমন নিউ টেস্টামেন্ট ছিল একখানি। গ্রন্থভাষ্যে তিনি অপরিচিত গ্রীক শব্দাদির প্রচুর ব্যবহার দেখেছিলেন। কিন্তু গ্রীক তাঁর অজানা, ফলে প্রতি রবিবার যখন তিনি নিজ গ্রাম পলাস পিউরীতে যেতেন, সেখানকার টমাস জোন্সের কাছে তিনি তখন এসে উপস্থিত হতেন, এবং অপরিচিত গ্রীক শব্দগুলির ইংরেজি তর্জমা করে নিতেন। এই টমাস জোন্সের কাছেই ল্যাটিনে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তিনি, এবং গ্রীক শব্দের অর্থান্বেষণে তাঁর কাছেই এইভাবে আবার তাঁর গ্রীক শিক্ষার সূচনা। নিকলসের মৃত্যুর পর, তাঁরই আত্মীয় হ্যাকুল টনের টি. ওলডের অধীনে তিনি শিক্ষানবিশীর কাজ গ্রহণ করেন। এখন পর্যন্ত তিনি জুতা নির্মাণে দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন নি, কাজেই পারিশ্রমিক তাঁর খুবই কম ছিল। তদুপরি ওলডের ব্যবহার ছিল অত্যত কর্কশ; তিনি মদ্যপ, বদমেজাজী, রঢ়ভাষী ও ধর্মবাতিকগ্রস্তও ছিলেন।

১৭৮১ সালে হ্যাকেল্টনে নতুন গির্জা স্থাপনের ব্যাপারে কেরী টমাস চ্যাটারের সঙ্গে তাঁর ভাবী শ্বশুর ড্যানিয়েল প্ল্যাকার্ড ও শ্যালকেরও সহযোগী হয়েছিলেন। ঐ বৎসরই ১০ই জুন, তাঁর মাত্র কুড়ি বৎসর বয়সে, মনিব ওডের শ্যালিকা ডরোথি প্ল্যাকার্ডের সঙ্গে কেরীর বিবাহ হয়। ডরোথি নিরক্ষরা ছিলেন। তাই বিবাহের স্বাক্ষরের স্থানে ক্রস চিহ্ন দিয়েছিলেন। বয়সেও কেরী অপেক্ষা তিনি বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন। এঁদের মোট ৪টি পুত্র ও ২টি কন্যা সন্তান জন্মেছিল। মেয়ে দুটি অল্পবয়সেই মারা যায়। তাদের পুত্র পিটারও মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা যায়। এর কিছুদিনের ভিতরে ওলডের মৃত্যু হলে তিনি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে থাকেন। নিজের ছোট্ট পরিচ্ছন্ন গৃহে তাঁর জুতো সেলাইয়ের কাজ চলে, সঙ্গে লেখাপড়া আর বাগান রচনার কাজ। এই সময় তিনি হিব্রু, ইতালীয়, ডাচ ও ফরাসি ভাষা শেখেন। জুতা প্রস্তুত করার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়শই তিনি পড়াশোনা করতেন। ধর্মবিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসার শেষ ছিল না, কপর্দকহীন অবস্থায় ওলনিতে ছুটে গিয়েছেন ডক্টর রাইল্যান্ডের অভিভাষণ শুনবার জন্য। এই সময় টাউসেস্টারের জনৈক মিঃ স্কিনারের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ হন, এবং তিনি তাঁকে Hall-এর "Help to Zion's Travellers" নামক গ্রন্থখানি উপহার দেন। এই গ্রন্থখানি কেরীকে ধর্মানুসন্ধানে বিশেষ সহায়তা করে। ধীরে ধীরে ব্যাপ্টিস্ট মতবাদের দিকে তিনি ঝুকে পড়েন, এবং ১৭৮৩ সালের ৫ই অক্টোবর তারিখে নর্দাম্পটন গির্জার অনতিদূরে জন রাইল্যান্ড তাঁকে ব্যাপ্টিস্ট মতে দীক্ষিত করেন।

কেরীর জীবিকাসন্ধান কখনোই সন্ধানের সীমা অতিক্রম করে তাঁকে স্থির নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, মেরী কেরী ও ভাই টমাস কেরীর বিবরণে তাঁর চরিত্রের এই দিকটির প্রসঙ্গ অতি নিশ্চিতরূপে নিরূপিত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপক পদে বৃত হওয়া পর্যন্ত জীবিকাসন্ধান ও জীবনানুসন্ধানের অতি কঠিন পরীক্ষায় তিনি অগ্রসর হয়েছেন। দারিদ্র্য সত্ত্বেও অদমনীয় প্রাণশক্তি ও পরিশ্রম করবার শক্তি তাঁকে কখনোই স্তব্ধ হতে দেয়নি। হ্যাকলটনের জীবনেও তাঁর জীবিকা ছিল অনিশ্চিত ও পরিশ্রমসাধ্য, দারিদ্র্য অতি ঘনিষ্ঠ সহচর।

ভারতে আগমন

কেরির ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার । স্বশিক্ষিত হয়ে উঠার কারণে ইংল্যান্ডের স্থানীয় মিশনারীদের সাথে একটি শখ্যতা গড়ে উঠে কেরির, মাঝে মাঝে তাঁকে স্থানীয় গির্জায় ভাষণ দেওয়ার জন্যও আমন্ত্রণ জানানো হতো। অনেক চড়াই - উৎরাইয়ের পর ১৭৯২ সালের অক্টোবরে কেরি, অ্যান্ড্রু ফিলার, জন রিল্যান্ড, জন সাটক্লিফকে সনদ সদস্য করে গঠিত হয় পারটিকুলার ব্যাপ্টিস্ট সোসাইটি ফর পোপাগেটিং দ্য গসপেল অ্যামোং দ্য হিদেনস (বর্তমানে বিএমএস ওয়ার্ল্ড মিশন)। যা ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি নামে পরিচিতি । উল্লেখ্য কেরি ভারতে আসার আগে ড. জন টমাস নামে এক মেডিক্যাল মিশনারি কলকাতায় এই ধর্ম প্রচারের কাজ করছিলেন। সেই সময় তিনি অর্থসংগ্রহের কাজে ইংল্যান্ডে আসেন। তারা তাকেই সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঠিক হয় কেরি তার সঙ্গে ভারতে যাবেন। আর এভাবেই তার ভারতে আসা ।

১৭৯৩ সালের ১৩ জুন কেরী সপরিবারে একটি ইংরেজ জাহাজে করে লন্ডন ছেড়ে উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে কেরীর স্ত্রী ডরোথি আসতে অস্বীকার করেছিলেন । কারণ সেই সময় কেরির চতুর্থ পুত্র ডরোথির গর্ভে। পরে ডরোথির বোন কেটি তাদের সঙ্গে আসবেন জেনে তিনি আসতে রাজি হন। যাত্রাপথে অনেক বিরম্বনার স্বীকার ও হতে হয় । যেমন- আইল অফ ওয়েইট-এ তাদের যাত্রা বিলম্বিত হয়। এর কারণ ছিল একটি বার্তার মাধ্যমে তাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন জানতে পারেন এই অননুমোদিত মিশনারিদের কলকাতায় নিয়ে গেলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক একচেটিয়া নীতি লঙ্ঘিত হবে। তাই তিনি তাদের জাহাজে স্থান দিতে অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য তিনি এক ড্যানিশ ক্যাপ্টেনের সন্ধ্যান পান যিনি কেরির দলটিকে জাহাজে স্থান দিতে রাজি হন । কেরির স্ত্রী ততদিনে তাদের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অবশেষে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি ও তার সহযাত্রীগণ কলকাতায় উপনীত হন। তখন তার বয়স মাত্র ৩১ বছর। কলকাতায় এসে স্থানীয় লোকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য, রামরাম বসুর কাছে বাংলা শিখতে আরম্ভ করেন। এই জন্যই রামরাম বসুকে কেরি সাহেবের মুন্সী বলা হয় ।

শ্রীরামপুর মিশন

১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশন স্থাপিত হয়। কিন্তু শ্রীরামপুরের কাছে মিশনারীর অভিজ্ঞতা এই প্রথম ছিল না। ১৭৭৭ সালে কার্ল ফ্রেডরিখ স্মিড ও জোহানেস গ্র্যাসম্যানের নেতৃত্বে মোরেভিয়ান মিশনারীদের একটি দল শ্রীরামপরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। এরা বাংলা ভাষা শেখেন এবং বাংলা-মোরেডিয়ান শব্দকোষ প্রস্তুত করে প্রচারকার্যে ব্যাপ্ত হন। অনতিকালের মধ্যে তাঁদের কর্মোদ্যোগের বিশালতা ও ক্ষমতার সীমার মধ্যে ব্যবধানটি উপলব্ধি করে তাঁরা অসহায় বোধ করেন। ১৭৯২ সালে এই ব্যর্থ মিশনটির অবলুপ্তি ঘটে। ওই ১৭৯২ সালেই বিলাতে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটির পত্তন হয়, ১৭৯৩-এ কেরী ভারতবর্ষে আসেন, এবং ১৮০০ সালের জানুয়ারীতে, মোরেভিয়ান মিশনের অবলুপ্তির আট বৎসর কাল পরে, শ্রীরামপুরে নতুন উদ্যমে নতুন মিশনের কার্যক্রমের সূচনা হয়। কিন্তু সূচনায় মিশনের অস্তিত্ব খুব নিরাপদ ছিল না। কথাটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই সত্য। মাত্র তিনশ পচাত্তর পাউণ্ড বা তিন হাজার টাকার মূলধন নিয়ে ছ'জন মিশনারী ও তাঁদের পরিবারবর্গের এই সূচনাকালকে সুস্থির ও সন্তোষজনক বলা যায় না। কাজেই প্রথম থেকেই পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ব্যাপারে তাঁদের বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হয়। মালদহে থাকাকালে মোরেভিয়ান জীবনযাত্রার আদর্শ কেরী খুব কাছের থেকে দেখেছিলেন; বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ওই আদর্শ কেরীর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ায় শ্রীরামপুরেও তা প্রবর্তন করা হয়। ওই আদর্শ অনুসারে স্থির হয়ঃ মিশনারীদের জীবন- যাত্রার মান একই রকম হবে, তাঁদের ভবিষ্যতের উপার্জন মিশনের সাধারণ তহবিলে জমা দেওয়া হবে ও তা থেকে তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা হবে; কেউ কোন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত হতে পারবেন না । জীবনযাত্রার ধারা ও অর্থনৈতিক মীমাংসার সঙ্গে কর্তব্যকর্মের সুষ্ঠু বণ্টনেরও ব্যবস্থা করা হয়। কেরী মিশনের অর্থ ও ঔষধাদি রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেন, ফাউন্টেন হলেন প্রথম গ্রন্থাগারিক, মার্শম্যান ও তাঁর স্ত্রী হানা মার্শম্যান স্কুল খুললেন মিশনের আয়ের কথা ভেবে, ওয়ার্ড প্রেস বসালেন ও ছাপার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন ব্রান্সডন ও ফেলিক্স কেরীকে সঙ্গে নিয়ে। ১১ই জানুয়ারি, ১৮০০ সাল থেকে একটি ভাড়া বাড়িতে মিশনের কাজ শুরু হয়। ঐদিন কেরী শ্রীরামপুরের গভর্ণর বীর সঙ্গে পরিচিত হন, এবং বিকেলেই দেশীয়দের মধ্যে প্রচারকার্যে উদ্যোগী হন। কিন্তু ভাড়া বাড়িতে মিশনের কাজ বেশিদিন চলল না। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটির নামে একটি বড় পাকা বাড়ি কেনা হলো ছ'হাজার টাকায়। মিশনারীরা সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে উঠে এলেন, এবং পাশের একটি ঘরে ছাপাখানা স্থাপন করলেন।

মিশন প্রেস

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস বাংলাদেশের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি গুরত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। শতাব্দীর প্রথমার্ধে, জোশুয়া মার্শম্যানের মৃত্যুর পর ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত, এই প্রেসটি বাংলাদেশের মদ্রণের ইতিহাসকে মর্যাদাসম্পন্ন করেছে। ডার্বির মুদ্রাকর উইলিয়াম ওয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে নতুন বাড়ির পাশে এই প্রেস স্থাপিত হলো, তাঁকে সহায়তা করবার জন্য নিযুক্ত করা হলো ব্রান্সডন ও ফেলিক্‌স কেরীকে। উডনীর বদান্যতায় কেরী যে কাঠের মুদ্রণযন্ত্রটি ক্রয় করেছিলেন, সেইটিকে নিয়েই মিশন প্রেসের প্রথম কার্যক্রমের সূচনা। কলকাতা থেকে কেনা কিছু, টাইপ আর বিলেত থেকে আনা কাগজ নিয়ে ওয়ার্ড অচিরেই পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করে দিলেন। এই সময় দেশীয় সহায়তার পরিমাণ নগণ্য ছিল, ওয়ার্ডই প্রধানতঃ তাঁর মিশন সহকারীদের সঙ্গে মিলিত চেষ্টায় মাত্র তিন মাসের মধ্যে কেরীর নিউ টেস্টামেন্টের ছাপার কাজে অগ্রগতি দেখালেন। এই সময় প্রেসের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়; এর কারণ প্রধানতঃ (ক) কাঠের মুদ্রণযন্ত্রে একবারে এক পৃষ্ঠার বেশি ছাপা সম্ভব ছিল না, (খ) কেনা টাইপের পরিমাণের স্বল্পতা। মার্চের গোড়ায় বিখ্যাত টাইপ নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুরে এলেন। শ্রীরামপুর প্রেসে পঞ্চাননের যোগদান অবশ্যই কেরীর পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছিল বলে মনে করা যায়। বাইরে থেকে টাইপ কিনে প্রেসের কাজ চালানো অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ বিবেচনায় কেরী প্রেস স্থাপনের সঙ্গে প্রেসের কাজ সহজ করবার জন্য তার পরিপুরক হরফ ঢালাইয়ের একটি বিভাগ স্থাপন করবার কথা ভেবেছিলেন। উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলা টাইপের সন্ধানে কলকাতা এসে তিনি পঞ্চানন কর্মকারের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি উইলকিন্সের সঙ্গে বাংলা হরফ নির্মাণে ইতিপূর্বে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, এবং উইলকিন্স বিলেতে চলে গেলে কলকাতার হরফ ঢালাইয়ের কারখানার তত্ত্বাবধায়করূপে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। কেরী শ্রীরামপুরে হরফ ঢালাইয়ের কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করবার পর থেকেই এই কাজে বার বার পঞ্চাননকে শ্রীরামপুরে যোগ দিতে অনুরোধ জানান এবং অবশেষে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিকে পঞ্চানন শ্রীরামপুরে যোগ দেন। অবশ্য শ্রীরামপরে আসবার তিন বৎসর কালের মধ্যেই পঞ্চাননের মৃত্যু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে টাইপ কাটা ও ঢালাইয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ অর্জন করেন মনোহর কর্মকার । পঞ্চাননের পর মনোহর শ্রীরামপুর ফাউন্ড্রির ভারপ্রাপ্ত হন। পঞ্চানন বাংলা ছাড়াও দেবনাগরী, ওড়িয়া টাইপ তৈরী করেছিলেন, মৃত্যুর আগে মারাঠি টাইপ তৈরীর কাজেও হাত দিয়েছিলেন। মনোহর টাইপ কাটার কাজে পঞ্চাননের কৃতিত্বকে অতিক্রম করে যান। চীনা ভাষার টাইপ প্রস্তুত করে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি বাংলা, দেবনাগরী, হিন্দী, পাঞ্জাবী, মারাঠি, ওড়িয়া প্রভৃতি প্রায় পনেবোটি ভাষার টাইপ প্রস্তুত করেন। মনোহরের পুত্র কৃষ্ণ কর্মকারও একই বৃত্তিতে শ্রীরামপুর প্রেসে আমৃত্যু নৈপুণ্যের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। পঞ্চানন যে কাজের সুচনা করেন, মনোহরের তত্ত্বাবধানে সেই কাজ অগ্রসর হয় এবং শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ও ফাউন্ড্রি ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের রূপ পায়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও কেরি

১৮০০ সালের ০৯ জুলাই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে এই কলেজ স্থাপিত হলে ও মূলত এর Regulation অনুমোদন হয় ১০ ই জুলাই । অনুমোদন করেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের ভারতীয় ভাষায় শিক্ষিত করে তোলা। রেগুলেশন অনুযায়ী ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষণীয় বিষয়কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে - (১) Oriental Langueges ( ২ ) Oriental Laws and Ethics ( ৩ ) Government Regulations ( ৪ ) European Studies( ৫ ) Science . এর প্রথম চারটি ভাগের শিক্ষাক্রম কলেজে প্রথমাবধিই চালু হয়েছিল। কলেজের পরিকল্পনাটি ছিল বিরাট ও উচ্চাশা পরিপূর্ণ। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ওয়েলেসলির নির্ধারিত পাঠ্যসাচী দীর্ঘ ও ভারবাহী; একে হয়তো অধিকতর বিবেচনা দ্বারা আরও সংহত ও বিশেষ প্রয়োজনের লক্ষ্যে অধিকতর উপযোগী করে তোলা যেত। যে সামান্য সময়কাল একজন সিভিলিয়ন কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করবেন, তার মধ্যে তাঁর পক্ষে এতগুলি ও এত বিচিত্র বিষয়ের সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হওয়া দুঃসাধ্য। রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন ও রেভারেড ক্লডিয়াস বুকানন যথাক্রমে কলেজের প্রোভোস্ট ও ভাইস-প্রোভোস্ট নিযুক্ত হন । ভিজিটর হন গভর্ণর জেনারেল স্বয়ং।

ওয়েলেসলির ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কম্পানীর কোর্ট অব ডিরেক্টস' কখনোই সুনজরে দেখেন নি। এই কলেজের অস্তিত্ব লুপ্ত করবার জন্য তাঁরা প্রথমাবধি সঙ্ঘবদ্ধভাবে তৎপর ছিলেন। এর কারণ ইতিহাসে নানাভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে, কিন্তু প্রধান কারণ সম্ভবতঃ এই যে, প্রতিষ্ঠা বিষয়ক প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল। তথাপি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে আপন অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল; কোর্টের কৃপাবশতঃই তা সম্ভবপর হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবু ওয়েলেসলির উচ্চাদর্শ ও ব্যাপক পরিকল্পনাকে তাঁরা কার্যতঃ বানচাল করে দিতে পেরেছিলেন হেইলিবেরীতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কলেজ ও এ্যাডিসকম্বে মিলিটারী সেমিনারী স্থাপন করে। কিন্তু বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাসে ট্যাঙ্ক স্কোয়ারে ওয়েলেসলির এই কলেজ এরই মধ্যে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছে।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপকরূপে কেরির নিয়োগের প্রস্তাব যখন এলো, তখন মানসিক- ভাবে তিনি খুবই উদ্দীপ্ত বোধ করেছিলেন। এই উদ্দীপনার মধ্যে উত্তেজনার অংশ কম ছিল না। উত্তেজনার প্রধান কারণ দুইঃ প্রথমতঃ, এই প্রস্তাবে তাঁর যোগ্যতা ও কৃতিত্বের যে স্বীকৃতি আছে, কলেজের অধ্যাপনায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ কেরীর পক্ষে তার সম্মান রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা, এই সম্পর্কে দ্বিধা; দ্বিতীয়তঃ তিনি নিজেকে প্রধানতঃ মিশনারী রূপে মনে করতেন; এই কাজ গ্রহণ করলে মিশনের কাজ ক্ষতি- গ্রস্ত হবে কিনা অথবা মিশনারী কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর অংশগ্রহণ করায় কোন বাধা সৃষ্টি হবে কিনা, এই ধরনের কতগুলি সংশয়। অবশ্য সাধারণভাবে মনে হয় যে, ১৮০১ সালের ৮ই এপ্রিল কলেজের প্রোভোস্ট ডেভিড ব্রাউনের কাছ থেকে তিনি যখন নিয়োগের প্রস্তাব পান, তখন তার আকস্মিকতা দ্বারাই তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। প্রস্তাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের সঙ্গে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার সমীচীনতা সম্পর্কে আলোচনা করে সর্বসম্মতিতে তিনি ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করলেন। ব্রাউন ও বুকানন তাঁর দুরকম সংশয়ই নিরসন করেন। তাঁরা বোঝান যে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কেরীর যোগ- দান মিশনের উদ্দেশ্যকে অধিকতর সফল হতে সহায়তা করবে, এবং কলেজে কেরীর অধীনে দেশীয় পণ্ডিত নিযুক্ত করা হবে যাতে তাঁর কাজ সহজতর হতে পারে। কেরী আশ্বস্ত হয়ে ব্রাউনের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। কিন্তু কলেজের নিয়োগবিধি অনুযায়ী কেরীকে প্রোফেসর রূপে নিয়োগ করার অসুবিধা ছিল। ব্রাউনের কাছ থেকে ওয়েলেসলি কেরীর বাংলা নিউ টেস্টামেন্টের একটি খণ্ড গ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষা শিক্ষাদানে তাঁর যোগ্যতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হন। অবশেষে কলেজের নিয়োগবিধির সাথে সামঞ্জস্য করে কেরীকে 'শিক্ষক' রূপে নিয়োগ করার কথা স্থির হয়। ফলে তাঁর মাসিক বেতন হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচশ টাকা হয়ে যায়। নিয়োগপত্র ১২ই এপ্রিল তারিখে তাঁর হাতে আসে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার শিক্ষক রূপে কেরী যোগদান করেন ১৮০১ সালের ৪ঠা মে তারিখে। প্রথম দিকে তিনি সপ্তাহে দুদিন ক্লাশ নিতেন, পরে তিনদিন। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি কলকাতা যেতেন ও শুক্রবার বিকেলে শ্রীরামপুরে ফিরে আসতেন। যেতেন ও শক্রবার বিকেলে শ্রীরামপুরে ফিরে আসতেন। অর্থাৎ বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার তিনি কলেজে উপস্থিত থাকতেন বলে মনে হয় । ১৮০১ সালের এপ্রিল-মে কেরীর জীবনের এক স্মরণীয় সময় বলে উল্লেখ করা উচিত। কলেজে তাঁর এই পদাধিকার তাঁর ব্যক্তিগত দিক ও মিশনের দিক থেকে ভবিষ্যৎ চরিতার্থতার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এরই ফলে বাইবেল অনুবাদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়; ভাষা সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর ব্যক্তিগত যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব হয়, ভারতবর্ষীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নিজের নামকে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত করে দেবার সুযোগ আসে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তাঁর যে সর্বব্যাপক কর্মোদ্যমের সূচনা হয়, তারই আলোকে শ্রীরামপরের পাদ্রী কেরী উইলিয়াম কেরীতে উত্তীর্ণ হয়ে যান। ধর্ম-সংকীর্ণতার গণ্ডীকে অতিক্রম করে ধর্ম-নিরপেক্ষ জ্ঞান- বিজ্ঞান-মানবতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপ্রকাশ করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটি ১৮৩০ সালে বন্ধ হয়ে যায়, যেখানে কেরি প্রায় ৩১ বছর বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।

উইলিয়াম কেরির অবদান

  • ১৭৯৮ সালে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর ছাত্রাবাস স্থাপন করেন।
  • ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দেশীয় পণ্ডিতদের নিয়ে কেরি শ্রেণি ভিত্তিক কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেন। রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রথম দু বছরে তিনটি গ্রন্থ এবং কেরি একটি বাংলা ব্যাকরণ ও আদর্শ সংলাপের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
  • ১৮০৩ সালে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের মত করে একটি মিশনারি স্থাপন করেন।
  • ১৮০৫ সালে তার মারাঠী ব্যাকরণ (Marathi grammar) প্রকাশিত হয়।
  • ১৮০৭ সালে তাকে বাউন ইউনিভার্সিটি সম্মান সূচক ডক্টর অফ ডিভিনিটি ডিগ্রি প্রদান করে।
  • ১৮০৯ সালে তিনি বাংলাতে সম্পূর্ণ বাইবেলের অনুবাদ এবং ছাপার কাজ সম্পন্ন করেন।
  • ১৮১২ সালে কেরির "ইতিহাস মালা" পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে প্রায় ১৫০টি শিরোনামের নানা স্থানের ১৪৮টি গল্প মুদ্রিত হয়।
  • ১৮১১ সালে মারাঠি ভাষায় করা তার অনুবাদ নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।
  • ১৮১৪ সালে ভারতবর্ষের জনসাধারণের জন্যে তিনি সরকারের কাছে বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব (Plan for instructing native inhabitants of India in European Sciences) পেশ করেন।
  • ১৮১৫ সালে পাঞ্জাবি ভাষায় করা তার অনুবাদ নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়।
  • ১৮১৭ সালে দেশীয় ছাত্রদের মাঝে পুস্তকের অভাব মেটানোর উদ্দেশ্যে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে ১৬ জন ইউরোপীয়, ৪ জন মৌলভী ও ৪ জন বাঙালী হিন্দু, নিয়ে এর পরিচালক সমিতি গঠন করা হয়।
  • ১৮১৮ সালে কেরির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • ১৮১৯ সালে বড়লাট পত্নী লেডি হেস্টিংসের উৎসাহে ড.উইলিয়াম কেরি একটি কৃষি সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতির কয়েকটি স্থানে আদর্শ কৃষি উদ্যান ছিল।
  • ১৮২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হর্টিকালচার ও এ্যাগ্রিকালচার সোসাইটি স্থাপন করেন।
  • ১৮২০ সালে তিনি মারাঠি ভাষায় পুরাতন নিয়ম প্রকাশ করেন ।
  • ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর স্কুলকে কলেজে উন্নীত করেন।
  • ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন।
  • ১৮২৯ সালে ৫ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক যে আইনটি জারি করেন তার বাংলা অনুবাদ করেন বৃদ্ধ কেরি যেটি নিজেই বেন্টিঙ্কের হাতে পৌঁছে দেন।

এক নজরে উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)

  • উইলিয়াম কেরি ১৭ আগস্ট, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের নর্দানটন শায়ার, টাউসেস্টারের পলার্সপিউরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।
  • তিনি ১৭৯৩ সালে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতে আসেন।
  • তিনি বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে ১৮০১ সালের মে মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন।
  • তিনি ১০ জানুয়ারি, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘শ্রীরামপুর মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন । ‘শ্রীরামপুর মিশন’ থেকে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ‘মথি রচিত মিশন সমাচার': এটি ১৮ মার্চ, ১৮০০ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • কেরি রচিত ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণের নাম ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ' (১৮০১)।
  • তিনি ‘রামায়ণ’ সম্পাদনা (১৮০৬-১৮১০) করেন ।
  • ১৮১০ সালে দরিদ্র খ্রিস্টান সন্তানদের জন্য উইলিয়াম কেরি কলকাতায় বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি ‘এগ্রি-হার্টিকালচারাল সোসাইটি' (১৮২৩) প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • বাইবেলের প্রথম বাংলা অনুবাদক উইলিয়াম কেরি । তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাইবেলের বাংলা অনুবাদ করেন।
  • ১৮৩৪ সালের ৯ জুন ৭৩ বছর বয়সে উইলিয়াম কেরি নামক এই ভদ্রলোকের মহান কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের সমাধি ক্ষেত্রে তাকে সমাহিত করা হয়।

শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থটির নাম কী ?

‘শ্রীরামপুর মিশন’ থেকে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ‘মথি রচিত মিশন সমাচার': এটি ১৮ মার্চ, ১৮০০ সালে প্রকাশিত হয় ।

উইলিয়াম কেরি রচিত গ্রন্থগুলো কী কী ?

উইলিয়াম কেরি রচিত গ্রন্থগুলো:

  • ‘কথোপকথন’ (১৮০১): এটি বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ এবং বাংলা ভাষার কথ্যরীতির প্রথম নিদর্শন। একাধিক মানুষের মুখের সাধারণ কথা বা কথোপকথন বা ডায়লগ এ গ্রন্থের উপজীব্য।
  • ‘ইতিহাসমালা’ (১৮১২): এটি বাংলা ভাষার প্রথম গল্পগ্রন্থ। বাংলার নানা অঞ্চলে প্রচলিত প্রায় ১৫০টি গল্পের সংকলন এ গ্রন্থটি।
নবীনতর পূর্বতন