কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে আমৃত্যু সকল অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। এ জন্য তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ‘বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। আবার একই সাথে কোমল দরদি মন নিয়ে ব্যথিত ও বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন তিনি। এক হাতে বাঁশি আরেক হাতে রণতূর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আর এসেই প্রচলিত শিল্পধারাসমূহকে পাল্টে দিয়ে নতুন বিষয় ও নতুন শব্দে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে করেছেন সমৃদ্ধতর । কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক । বাংলা ভাষায় তিনি প্রথম ইসলামি গান ও গজল রচনা করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম কাজী নজরুল ইসলাম ২৪ মে, ১৮৯৯ সালে (বাংলা- ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।
পিতা-মাতা তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন । (কাজী ফকির আহমেদ এর ২য় স্ত্রী জাহেদা খাতুন)। জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হয় বলে তার নাম রাখা হয়- দুখু মিয়া। বাল্যকালে তাঁকে ‘ত্যারা ক্ষ্যাপা' ও ‘নজর আলী' নামেও ডাকা হতো। সাহিত্যে তিনি ‘নুরু’ নামও ব্যবহার করেছেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু (১৯০৭) হলে তিনি চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হন ।
রাজনীতি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর মাধ্যমে কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগদান করেন। কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন ‘মজুর স্বরাজ পার্টি'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে ফরিদপুর থেকে বঙ্গীয় বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তমিজুদ্দীন খানের নিকট পরাজিত হন ।
জাতীয় সংবর্ধনা ১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এ অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে ‘প্রতিভাবান বাঙালি কবি' বলে আখ্যায়িত করেন।
অসুস্থতা ১০ অক্টোবর, ১৯৪২ সালে মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দূরারোগ্য (পিক্স ডিজিজ) ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় এই ঋদ্ধ ও সম্ভাবনাময় জীবন আমৃত্যু নির্বাক হয়ে যায় ।
বাংলা একাডেমির প্রকাশনা কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র রচনাবলি বাংলা একাডেমি থেকে ‘নজরুল রচনাবলি' (২০০৫) নামে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত ।
প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নজরুল ১৯০৯ সালে গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
লেটো গানের দলে তিনি ১৯০৯-১৯১০ সালে লেটো গানের দলে ছিলেন। নজরুলের চাচা কাজী বজলে করিম লেটো গানের দলের ওস্তাদ ছিলেন। এ গানের দলে তিনি পালা গান রচনা করতেন। নজরুলের লেটোগানে পারদর্শিতা দেখে সে সময়কার লেটোদলের বিখ্যাত কবিয়াল শেখ চাকার তাঁকে ‘ব্যাঙাচি’ বলে ডাকতেন। (পরবর্তীতে ১০ সালের শেষে রুটির দোকানে কাজ নেন)।
লেটো কী বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল।
৭ম শ্রেণিতে ভর্তি ১৯১৪ সালে আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করার সময় তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে আসানসোল থানার দারোগা কাজী রফিজউদ্দিন ময়মনসিংহের ত্রিশাল বাজারের নিকটবর্তী কাজী সিমলা গ্রামের দরিরামপুর স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি করান।
সেনাবাহিনিতে যোগদান ১৯১৭ সালে শিয়ারশোল স্কুলে ১০ম শ্রেণির প্রি-টেস্ট দিয়ে সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান এবং ১৯২০ এর শুরুতে বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হলে তিনি করাচি ত্যাগ করে কলকাতায় এসে ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটের ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
দাম্পত্য জীবন ১৮ জুন, ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলা আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সাথে কবির বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্তে আলী আকবর খান নজরুলকে ঘরজামাই থাকার শর্ত জুড়ে দেন যা তিনি কোনোভাবেই মানতে না পেরে বাসর রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ১৯৩৭ সালে তিনি নার্গিসকে একটি চিঠি লেখেন ।

নজরুল কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে গিয়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে থাকতেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী, গিরিবালা দেবীর (বিরজাসুন্দরীর জা) কন্যা আশালতার সাথে নজরুলের প্রণয় জন্মে। ২৪ এপ্রিল, ১৯২৪ সালে [সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান] নজরুল আশালতা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করেন। আশালতার ডাক নাম ছিল দুলি, তাই তারে আদর করে দোলন বা দুলু নামে ডাকা হতো। বিয়ের পর নজরুল নাম রাখেন প্রমীলা ।

কাজী নজরুল ইসলামের পুত্র কৃষ্ণ মোহম্মদ ও অরিন্দম খালেদ বুলবুলের অকাল প্রয়াণের পর কাজী সব্যসাচী (১৯২৯-১৯৭৯) ও কাজী অনিরুদ্ধ (১৯৩১-১৯৭৪) বেঁচে ছিলেন। কাজী সব্যসাচী ছিলেন আবৃত্তিকার এবং তাঁর কন্যার নাম খিলখিল কাজী। কাজী অনিরুদ্ধ ছিলেন সুরকার এবং তাঁর কন্যার নাম অনিন্দিতা কাজী ।
সম্পাদনা নজরুল ‘দৈনিক নবযুগ” (১২ জুলাই, ১৯২০) পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। এ পত্রিকার সাথে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ও শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক যুক্ত ছিলেন। এটি ছিল সান্ধ্য পত্রিকা। ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে ‘দৈনিক নবযুগ' পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি এর সম্পাদক নিযুক্ত হন । তাছাড়া তিনি ‘ধূমকেতু’- ১৯২২ (অর্ধ-সাপ্তাহিক) এবং লাঙ্গল (১৯২৫) পত্রিকার সম্পাদনা করতেন।

‘ধূমকেতু' পত্রিকায় দেশের মুক্তির দিশারি হিসেবে ‘অনুশীলন' ও 'যুগান্তর' দলের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকে উৎসাহ প্রদান ও ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে তৎকর্তৃক বহু অগ্নিঝরা সম্পাদকীয়, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার এ পত্রিকা নিষিদ্ধ করেন।

‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু....’ এই বাণী ছাপা হয়।
নজরুলের প্রথম প্রকাশিত রচনাবলির নাম
প্রথম প্রকাশিত রচনা/গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্নকাহিনি' (১৯১৯)। এটি ‘সওগাত' পত্রিকার মে-জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ।
প্রথম প্রকাশিত কবিতা মুক্তি ’ (১৯১৯)। এটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র জুলাই-আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা' (সেপ্টেম্বর, ১৯২২)। কবি এ কাব্যটি বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন। এ কাব্যে মোট ১২টি কবিতা আছে। এর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’, এটি ‘সাপ্তাহিক বিজলী’ পত্রিকার ২২ ডিসেম্বর (১৯২১)-জানুয়ারি (১৯২২) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় । ‘বিদ্রোহী' কবিতাটি অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) প্রেক্ষাপটে লেখা। ‘ অগ্নিবীণা ' কাব্যের প্রথম কবিতা ‘ প্রলয়োল্লাস'।
প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘তুর্কিমহিলার ঘোমটা খোলা' (১৯১৯)। এটি ‘ সওগাত ’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (অক্টোবর-নভেম্বর) প্রকাশিত হয় ।
প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী ’ (অক্টোবর, ১৯২২)
প্রথম প্রকাশিত নাটক ঝিলিমিলি' (১৯৩০)
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ/ গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান' (১৯২২)
প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস বাঁধনহারা ' (১৯২৭)
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম
নিষিদ্ধ গ্রন্থ সাহিত্য সমালোচক শিশির কর ‘নিষিদ্ধ নজরুল' নামক গ্রন্থে ৫টি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:

যুগবাণী ' (নিষিদ্ধ- ২৩ নভেম্বর, ১৯২২। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: ১৯৪৭),
বিষের বাঁশি' (নিষিদ্ধ- ২২ অক্টোবর, ১৯২৪। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার- ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৫),
‘ভাঙার গান' (নিষিদ্ধ- ১১ নভেম্বর, ১৯২৪),
‘প্রলয়শিখা’ (নিষিদ্ধ- ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩০),
চন্দ্ৰবিন্দু' (নিষিদ্ধ- ১৪ অক্টোবর, ১৯৩১)।

গ্রন্থ হিসেবে ‘অগ্নিবীণা' কাব্যটি কখনো নিষিদ্ধ হয়নি। এ কাব্যের ‘রক্তাম্বরধারিণী মা' কবিতাটি নিষিদ্ধ হয়। ‘ধূমকেতুর’ পূজা (২২ সেপ্টেম্বর) সংখ্যায় রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশিত হলে পত্রিকার এ সংখ্যা নিষিদ্ধ হয় এবং নজরুল ইসলাম গ্রেফতার হন। এ কবিতা রচনার জন্য কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (ব্রিটিশ সরকার) রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন (৮ জানুয়ারি, ১৯২৩)।
কাব্যগ্রন্থ কাজী নজরুল ইসলামের মোট কাব্য সংখ্যা ২২টি।

দোলনচাঁপা’ (অক্টোবর, ১৯২৩): কাজী নজরুল ইসলাম রাজবন্দি থাকা অবস্থায় কাব্যটি প্রকাশিত হয়। এটি প্রেমের কাব্য। তাঁর স্ত্রী দুলির নামানুসারে এ কাব্যের নামকরণ করেন। এ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'। বেলাশেষে, পূবের হাওয়া, চোখের চাতক, অবেলার ডাক, পূজারিণী ইত্যাদি এ কাব্যের অন্যতম কবিতা ।

‘বিষের বাঁশি’ (আগস্ট, ১৯২৪): ২২ অক্টোবর, ১৯২৪ সালে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে। এটি তিনি উৎসর্গ করেন এদেশের নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রনায়িকা মিসেস এম. রহমানকে (মোসাম্মদ মাসুদা খাতুন)।

‘ভাঙার গান' (আগস্ট, ১৯২৪): এটি মেদিনীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।

‘ছায়ানট' (১৯২৪): এটি উৎসর্গ করেন মুজাফ্ফর আহমদ ও কুতুবউদ্দীন আহমদকে ।

‘চিত্তনামা’ (১৯২৫): দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দার্জিলিঙে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকার্ত কবি অর্ঘ্য, অকাল- সন্ধ্যা, সান্ত্বনা, রাজভিখারি নামে কয়েকটি কবিতা লেখেন। ‘ইন্দ্ৰপতন' কবিতায় কবি মহানবীর সাথে চিত্তরঞ্জনকে তুলনা করে কবিতা লেখেন ।

‘জন্মিলে তুমি মোহাম্মদের আগে হে পুরুষবর
কোরানে ঘোষিত তোমার মহিমা হতে পয়গাম্বর।'
এ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে মুসলিমরা কবির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে এটির সংশোধিত রূপ প্রকাশ পায়। কাব্যটি উৎসর্গ করেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। বাসন্তী দেবীকে তিনি মা বলে ডাকতেন ।

‘ঝিঙেফুল' (১৯২৬): শিশুতোষ কাব্য। এটি উৎসর্গ করেন বীর বাদলকে ।

‘সাতভাই চম্পা' (১৯২৬): শিশুতোষ কাব্য । ‘সর্বহারা' (১৯২৬): এ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার'। এটি উৎসর্গ করেন বিরজাসুন্দরী দেবীকে।

‘সিন্ধু হিন্দোল' (১৯২৭): এ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘দারিদ্র্য’। এটি উৎসর্গ করেন হাবীবুল্লাহ বাহার শামসুন্নাহার মাহমুদকে ।

‘সঞ্চিতা' (১৯২৮): বিভিন্ন কাব্যের বাছাইকৃত কবিতা সংকলন। এতে মোট ৭৮টি কবিতা ও গান সংকলিত হয়েছে। তিনি এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গপত্রে লিখেন : “ বিশ্বকবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু' ।

চক্রবাক’ (১৯২৯): চট্টগ্রামে অবস্থানকালে লেখা অধিকাংশ কবিতা এতে স্থান পায়। তিনি এটি উৎসর্গ করেন তৎকালিন ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজের (বর্তমান- ঢাকা কলেজ) অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রকে।

সন্ধ্যা' (১৯২৯): এ কাব্যের অন্যতম কবিতা ‘চল্‌ চল্‌ চল্‌’ । ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য নজরুল ঢাকায় আসেন। তখন তিনি সৈয়দ আবুল হেসেনের সরকারি বাসা বর্ধমান হাউসে (বর্তমান- বাংলা একাডেমি) অবস্থানকালে এ গানটি রচনা করেন। এটি প্রথম ‘নতুনের গান' শিরোনামে ‘শিখা’ পত্রিকায় ১৯২৮ (বাংলা- ১৩৩৫) সালে প্রকাশিত হয়। এটি উৎসর্গ করেন মাদারীপুরের শান্তিসেনাদেরকে। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ কবিতার / গানের ২১ চরণ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় ।

প্রলয়শিখা' (১৯৩০): এ কাব্যের জন্য কবি ৬ মাস কারাভোগ করেন।

মরুভাস্কর' (১৯৫০): এটি হযরত মুহাম্মাদ (স) এর জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ। এটি ৪টি সর্গে ১৮টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে রচিত।

‘শেষ সওগাত' (১৯৫৮): এ কাব্যের ভূমিকা লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ।

‘সাম্যবাদী' (ডিসেম্বর, ১৯২৫),
‘ফণি-মনসা' (১৯২৭),
জিঞ্জির' '(১৯২৮),
‘পূবের হাওয়া' (১৯২৫),
নির্ঝর’ (১৯৩৯),
‘নতুন চাঁদ' (১৯৩৯)।
উপন্যাস নজরুলের উপন্যাস ৩টি ‘বাঁধনহারা' (১৯২৭): এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস। ১৯২১ সাল থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে ‘মোসলেম ভারত' পত্রিকায় ছাপা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত এ উপন্যাসের কিছু অংশ ১৯২৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় বাদ পড়ে যায়। পরবর্তীতে তা খুঁজে পাওয়া গেলে ১৯ মে, ২০০৬ সালে দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের পত্র সংখ্যা ১৮টি। নুরুর সাথে মাহবুবার প্রণয় এবং বিয়ের উদ্যোগ অনেক এগিয়ে গেলে হঠাৎ নুরু পালিয়ে গিয়ে সৈনিক জীবন গ্রহণ করে। যদিও এর পেছনে দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালীন কোনো তাগিদ ছিলনা। অনেকের মতে, এ উপন্যাসের নুরুই নজরুল। চরিত্র: নুরুল হুদা, মাহবুবা, সাহসিকা, রাবেয়া।

‘মৃত্যুক্ষুধা' (১৯৩০) : ত্রিশাল গ্রাম ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এটি রচিত। এটি ১৯২৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘সওগাত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে। (সুত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান।

কুহেলিকা' (১৯৩১): ১৯২৭ সাল থেকে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। এটি রাজনৈতিক উপন্যাস। কারণ, নায়ক জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনকে সশস্ত্র বিপ্লবকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি- ‘নারী কুহেলিকা, ইহারা মায়াবিনীর জাত। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা গহন-পথের কন্টক, রাজপথের দস্যু।'
গল্পগ্রন্থ নজরুলের গল্পগ্রন্থগুলো:

‘ব্যথার দান’ (ফেব্রুয়ারি, ১৯২২): এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। এতে মোট ৬টি গল্প আছে- ব্যথার দান, হেনা, অতৃপ্ত কামনা, বাদল-বরিষণে, ঘুমের ঘোরে, রাজবন্দীর চিঠি।

‘রিক্তের বেদন' (১৯২৫): প্রতিটি গল্পই সমকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের গল্পসমূহ হলো: রিক্তের বেদন , বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী, মেহের-নেগার, সাঁঝের তারা, রাক্ষুসী, সালেক, স্বামীহারা, দুরন্ত পথিক। গল্পগুলোর প্রধান বিষয় প্রেম।

‘শিউলিমালা” (১৯৩১): এ গ্রন্থের গল্পগুলো হলো: পদ্ম- গোখরা, জিনের বাদশা, অগ্নি-গিরি, শিউলিমালা।
নাট্যগ্রন্থ নজরুলের নাট্যগ্রন্থগুলো:

ঝিলিমিলি' (১৯৩০): এটি ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ ও শিল্পী নামের ৩টি নাটকের সংকলন এবং প্রথম নাট্যগ্রন্থ।
আলেয়া' (১৯৩১),
মধুমালা' (১৯৫৯),
`পুতুলের বিয়ে'
প্রবন্ধগ্রন্থ নজরুল রচিত প্রবন্ধগ্রন্থগুলো:

‘রাজবন্দীর জবানবন্দী' (০৭/০১/১৯২৩): এটি তিনি জেলে বসে লেখেন। ‘ধূমকেতু' পত্রিকায় 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা প্রকাশিত হলে তা নিষিদ্ধ হয় এবং নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। হুগলী জেলে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে নজরুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশন শুরু করেন। এ অবস্থায় নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠান- 'Give up hunger strike, our literature claims you. কিন্তু ঠিকানা না থাকায় জেল কর্তৃপক্ষ সে চিঠি রবীন্দ্রনাথের নিকট ফেরত পাঠায়। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত' নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে তিনি ৩৯ দিন পর অনশন ভঙ্গ করেন। জেলে থাকা অবস্থায় কর্তৃপক্ষ তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি তা মাত্র ৪ পৃষ্ঠায় লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন, এটাকেই বলা হয় ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী'। এ প্রবন্ধে তিনি নিজেকে ‘বিদ্রোহী কবি' হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি লিখেছেন- “শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট।” পরবর্তীতে তিনি জেল থেকে ১৫ অক্টোবর, ১৯২৩ সালে মুক্তি পান ।

‘যৌবনের গান’ : ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজ কাজী নজরুল ইসলামকে অভিনন্দন জানাতে গেলে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তারই পরিমার্জিত ও লিখিত রূপ ‘যৌবনের গান' ।

‘যুগবাণী' (১৯২২),

‘রুদ্রমঙ্গল' (১৯২৩),

‘দুর্দিনের যাত্রী' (১৯২৬)।
সংগীতগ্রন্থ নজরুলের সংগীতগ্রন্থসমূহ:

বুলবুল ' (১ম খণ্ড-১৯২৮, ২য় খণ্ড-১৯৫২),
চোখের চাতক ’ (১৯২৯),
নজরুল গীতিকা ' (১৯৩০),
নজরুল স্বরলিপি' (১৯৩১),
চন্দ্ৰবিন্দু’ (১৯৩১),
সুরসাকী’ (১৯৩১),
জুলফিকার' (১৯৩২),
বনগীতি' (১৯৩২),
গুলবাগিচা’ (১৯৩৩),
গানের মালা' (১৯৩৪),
গীতি শতদল' (১৯৩৪),
সুরলিপি' (১৯৩৪),
সুর-মুকুর' (১৯৩৪),
রাঙা জবা’।
অনুবাদ গ্রন্থ নজরুলের অনুবাদ গ্রন্থের নাম :

‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম' : ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের কবিতা অনুবাদ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী এর ভূমিকা লেখেন।

‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ' (১৯৩০) ।
চলচ্চিত্র নজরুল পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ ধূপছায়া’ (১৯৩১)। নজরুল অভিনীত চলচ্চিত্র- ধ্রুব। কানাডায় নজরুলকে নিয়ে ফিলিপ স্পারেল ' নজরুল ' নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
রণসংগীত বাংলাদেশের রণসংগীতের রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম।তার রচিত "চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি' ঘোষণা করা হয় এবং মৃত্যুর ছয়মাস পূর্বে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ সালে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
পদক ও সম্মাননা নজরুল যেসব পদক পান:

‘জগত্তারিনী স্বর্ণপদক'- ১৯৪৫ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়),
‘পদ্মভূষণ’- ১৯৬০ (ভারত সরকার),
‘ডি.লিট’- ১৯৬৯ (রবীন্দ্রভারতী),
‘ডি.লিট’- ১৯৭৪ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়),
‘একুশে পদক’- ১৯৭৬ (বাংলাদেশ সরকার)।
বিখ্যাত পঙক্তি ১.কোন কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী। (নারী)

২. তবুও থামে না যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে। (জীবন-বন্দনা)

৩.রমযানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ । (নজরুলগীতি)

৪.মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য । (বিদ্রোহী)

৫. আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!(বিদ্রোহী)

৬. আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর ।
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর। (বিদ্রোহী)

৭. আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ । (বিদ্রোহী)

৮. সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই । (নারী)

৯. গাহি সাম্যের গান, ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান। (জীবন বন্দনা)

১০. গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। (মানুষ)

১১. দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার। (কাণ্ডারী হুশিয়ার)

১২. কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাঁড়ী মুখে সারিগান- লা শরীক আল্লাহ । (খেয়াপারের তরণী)

১৩. দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে । (আমার কৈফিয়ৎ)

১৪. ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান । (কাণ্ডারী হুশিয়ার)

১৫. হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ, খ্রীস্টের সম্মান কণ্টক-মুকুট শোভা। (দারিদ্র্য)

১৬. বউ কথা কও, বউ কথা কও, কও কথা অভিমানিনী,
সেধে সেধে কেঁদে কেঁদে যাবে কত যামিনী । (নজরুলগীতি)

১৭. নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ! মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!

১৮. নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে, ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে। (খেয়াপারের তরণী)

১৯. বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। (নারী)

২০. দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে । (কুলি-মজুর)

২১. কাঁটা-কুঞ্জে বসি তুই গাঁথিবি মালিকা, দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টীকা। (দারিদ্র্য)

২২. চাষী ওরা, নয়কো চাষা, নয়কো ছোট লোক ।

২৩. সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে। (সাহেব ও মোসাহেব)
মৃত্যু তিনি ২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ সালে (বাংলা- ১২ই ভাদ্র, ১৩৮৩) সকাল ১০টা ১০মিনিটে মাত্র ৭৭ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ইহলোক ত্যাগ করেন । তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে বিকেল ৫.৩০ ঘটিকায় সমাধিস্থ করা হয়।

‘অগ্নিবীণা' কাব্যগ্রন্থের পরিচয়

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা' (সেপ্টেম্বর, ১৯২২)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে মানবতার অবক্ষয় এবং ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি 'অগ্নিবীণা' কাব্য রচনা করেন। কাব্যটিতে ভারতীয় পুরাণ এবং পশ্চিম এশীয় ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সাথে। এ কাব্যের অন্যতম কবিতা 'বিদ্রোহী'। এ কবিতার জন্যই তাকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। 'প্রলয়োল্লাস' এ কাব্যের প্রথম কবিতা এবং শেষ কবিতা 'মোহররম'। 'বিদ্রোহী', ‘রক্তাম্বরধারিণী মা', ‘আগমনী', 'ধূমকেতু', ‘কামালপাশা', ‘আনোয়ার’, ‘রণভেরী', 'সাত-ইল-আরব', ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম'- এ ১২টি কবিতার সমন্বয়ে ‘অগ্নিবীণা' কাব্যটি কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়। কাব্যটির প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি এটি বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন।

‘সাম্যবাদী' কাব্যগ্রন্থের পরিচয়

কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ ও মানবতাবাদী কাব্যগ্রন্থ 'সাম্যবাদী' ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী', ‘ঈশ্বর', 'মানুষ', 'বারাঙ্গনা', 'কুলি-মজুর', 'নারী' ইত্যাদি কবিতার সমন্বয়ে রচিত এ কাব্য। কাব্যটিতে সমাজের অসাম্য, গরিবদের প্রতি নির্যাতন ও অবহেলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিপ্লবাত্মক বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এ কাব্যের বিখ্যাত উক্তি-

মানুষেরে ঘৃণা করি,
ও কারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি,
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোড় করে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল- মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো ।

‘মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসের পরিচয়

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, চল্লিশের দশকের ভঙ্গুর ও বিপর্যস্ত সময়কে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা' (১৯৩০)। কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কের দরিদ্র হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য ও দুঃখে ভরা জীবন নিয়ে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র গজালের মা চাঁদসড়কের বস্তিতে বাস করে। তার তিন ছেলে যৌবন বয়সে মারা যায়। মৃত ছেলেদের বিধবা স্ত্রী আর তাদের প্রায় এক ডজন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ছোট ছেলে প্যাকালে রাজমিস্ত্রির কাজ করে সবার ভরণ-পোষণের চেষ্টা করে। উপন্যাসের প্রথম অংশে দেখা যায়, এসব অভাব- অনটনের মধ্যে খ্রিস্টান কুর্শি ও প্যাঁকালে একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে এবং ভালোবাসার জন্য প্যাকালে ধর্মান্তরিত হয়। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখতে পাই, আনসার ও রুবির প্রসঙ্গ। সমগ্র উপন্যাসের যোগসূত্র মেজে বউ । শেষে দেখা যায়, অভাবের তাড়নায় মেজো বউ খ্রিস্টান হয় এবং বরিশালে নিজের জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সন্তানদের টানে তাকে বস্তিতে ফিরে আসতে হয়। অন্যদিকে প্যাঁকালেকে খাঁন বাহাদুর সাহেব কুড়ি টাকা বেতনের চাকরি দিলে সে কুর্শিকে নিয়ে মুসলমান হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় । এখানেই উপন্যাসের কাহিনির পরিসমাপ্তি।

কাজী নজরুলের বিদ্রোহের নানা দিক

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ঘটে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে। যেখানে প্রতিটি স্তরে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস দেশের বাতাসকে বিষাক্ত করেছে; জাতীয় জীবনে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজিত। তিনি লেখনি ধারণ করলেন, যাতে প্রবল প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়। ‘অগ্নিবীণা', ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘ফণীমনসা' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে নজরুলের স্বাদেশিকতা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তিনি বিধাতার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন। এজন্য তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।

‘নজরুলের ঢাকায় আগমন

কাজী নজরুল ইসলাম অবিভক্ত বাংলার স্বদেশি নেতা হেমন্তকুমার সরকারের সাথে ১৯২৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে প্রথম ঢাকায় আসেন। তিনি প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের চতুর্থ বৈঠকে অংশগ্রহণ করার জন্য।

১৯৪০ সালের ১২ ডিসেম্বর কাজী নজরুল ইসলাম সর্বশেষ সুস্থ থাকা অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ঢাকায় নজরুলের প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিযান’, যা ‘সিন্ধু- হিন্দোল' কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি মোট ঢাকা আসেন ১৩ বার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন মোট ৫ বার ।

নবীনতর পূর্বতন