বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বাঙালি নবজাগরণের অগ্রদূত, বাংলা সাহিত্যের সার্থক ঔপন্যাসিক, বাংলা সাহিত্যধারার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অগ্রজ । তিনি ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা, সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালি জাতিকে চিন্তা-চেতনায় ও মননশীলতায় দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার তুলনামূলক সমালোচনা ধারার পথ প্রদর্শক এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের সমন্বয় সাধনকারী হিসেবে খ্যাত। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট ( ১৮৫৮ ) । কর্মজীবনে তিনি সরকারি আমলা ছিলেন । ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বা সাময়িকপত্র বঙ্গদর্শন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । ছদ্মনাম হিসেবে তিনি কমলাকান্ত নামটি ব্যবহার করেছিলেন। তাকে বাংলা উপন‍্যাসের জনক বলা হয়। এছাড়াও সাহিত্যের রসবোদ্ধাদের কাছ থেকে তিনি সাহিত্যসম্রাট আখ্যা লাভ করেন । বঙ্কিম রচিত আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাসের কবিতা বন্দে মাতরম কে ১৯৩৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তার রচনা 'বঙ্কিমী শৈলী' বা 'বঙ্কিমী রীতি' নামে পরিচিত।

জন্ম ও বংশপরিচয়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৬ জুন, ১৮৩৮ সালে (বাংলা- ১৩ আষাঢ়, ১২৪৫)। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী । তাদের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়ার রঘুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিবাহ করেন ৷ রামজীবনের পুত্র তথা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ অর্থাৎ পিতামহের পিতা ( দাদার পিতা ) রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের ( দাদী ) সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র বা নাতি যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র,মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী,বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে ও তাদের আরো দুই পুত্র সন্তান ছিল - শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাদের ছোট । দুর্গাসুন্দরী দেবী বঙ্কিমের জন্মদানকালে যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

শিক্ষাজীবন

অধিকাংশের মতো , প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি তার জন্মস্থানেই হয় । কারণ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়াতেই জীবন অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সেই তার প্রথম শিক্ষার হাতেখড়ি হয় বংশীয় পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে । তবে তিনি কখনোই গ্রাম পাঠশালায় যান নি । শিশু বয়সেই তিনি অসামান্য মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। বঙ্কিমের কনিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিল ” । বংশীয় পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের পর গ্রাম্য পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তার গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে কোনরুপ আনন্দ পান নি বা উপকৃত হতে পারেন নি । কারণ তিনি তার রচনার কোন এক জায়গায় লিখেছিলেন “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” এই মুক্তিলাভ লাভ করার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে । এমন ও হতে পারে ছেলে বয়সের কারণে তিনি রামপ্রাণকে বুঝে উঠতে পারেন নি অথবা বঙ্কিমকে ও রামপ্রাণ বুঝে উঠতে পারেন নি যে তিনি কিভাবে শিক্ষাকে আনন্দের সহিত নিতে পারবেন । আবার এমন ও হতে পারে এই গৃহশিক্ষকের অবহেলা ছিল । বঙ্কিমচন্দ্রের পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুর । সেই সূত্রে মেদিনীপুর ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে ১৮৪৪ সালে পিতা যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। এখানেও বঙ্কিম স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই নিজ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে সক্ষম হন। মেদিনীপুর ইংরেজি স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় বঙ্কিম ভাল ফলাফল করলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপ্রণোদিত হয়ে এফ টিড সাহেব তাকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হন । কিন্তু পিতা যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় মেদিনীপুর থেকে কাঁঠালপাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং একই বছর তার মাত্র এগার বছর বয়সে পাঁচবছর বয়সী মোহিনীদেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এ সময় তিনি কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এ সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তি ও করতে পারতেন । সংবাদ প্রভাকর সংবাদ সাধুরঞ্জন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করতেন এবং আবৃত্তি করতেন । ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব রচিত ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন।

অত:পর ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ( বর্তমানে হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। সেখানেই তিনি একটানা সাত বছর পড়াশোনা চালিয়ে যান । হুগলি কলেজ পড়াকালীন সময়ে ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছরে ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর সাহিত্য পত্রিকায় কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। এ সময় থেকেই তিনি কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকায় গদ্য এবং পদ্য দিয়ে রচনা শুরু করেন । পরবর্তীতে তার বহু লেখা এই দুই সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ থেকে ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই ১৮৫৬ সালেই কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথমবারের মত আইন বিভাগ চালু হয় । তাই তিনি তার অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়কে নিয়ে হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। উল্লেখ্য বঙ্কিম এখানে কৃতকার্য হলে ও সঞ্জীবচন্দ্র অকৃতকার্যই রয়ে গেলেন । ১৮৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় । বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করলে তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন । পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। এজন্যই তাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট বলা হয় ।

বিবাহ

১৮৪৯ সালে যখন বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ে হয় তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১১ বছর। নারায়নপুর গ্রামের পাঁচ বছর বয়সী মোহিনীদেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । কিন্তু চাকুরি জীবনের শুরুতে যশোর অবস্থান কালে ১৮৫৯ সালে এ পত্নীর মৃত্যু হয়। অতঃপর ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

কর্মজীবন

তার পিতার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে ১৮৫৮ সালে যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগদান করেন । তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদ ছাড়া ও কালেক্টর পদে মুর্শিদাবাদ ( তখন তার পদোন্নতি হয়েছিল ) এবং বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারি পদে কলিকাতাতে চাকরি করেছেন । চাকরিসূত্রে খুলনায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর থাকাকালীন নীলকরদের অত্যাচার দমন করেছিলেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর সরকারি চাকরি করে তিনি অবসর গ্রহণ করেন ১৮৯১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন । কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখনী দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন । পরিচিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হিসেবে ।

সাহিত্যকর্ম

তিনি ১৮৫২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কবিতা লিখে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪টি। তাঁর সাহিত্যিক জীবন মাত্র ২২ বছর। তিনি নেপালের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেন । তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ললিতা তথা মানস (পুরাকালিক গল্প) – (১৮৫৬) ।

উপন্যাস

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস মোট ১৫টি। এর মধ্যে বাংলা উপন্যাস ১৪টি। তাঁর প্রথম উপন্যাস Rajmohon's Wife (১৮৬৪) যা ইংরেজিতে রচিত। এটি প্রথম Indian Field পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । তাঁর রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাসের নাম দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) । বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী উপন্যাসগুলো হলো : আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭)। ইন্দিরা , যুগলাঙ্গুরীয় রাধারানী তাঁর ত্রয়ী সংগ্রহ ।

  • দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫): এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। দুর্গেশনন্দিনী এর অর্থ দুর্গ প্রধানের কন্যা । ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্রের চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের রচনা। এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় এক নতুন যুগ প্রবর্তিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক উপন্যাস মনে করা হয় না। কোনো কোনো সমালোচক এই উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো উপন্যাসের ছায়া লক্ষ্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই উপন্যাসের তেরোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ইংরেজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও এটি অনূদিত হয়।
  • কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬): বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্সধর্মী উপন্যাস। ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ' এ উপন্যাসের বিখ্যাত সংলাপ। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক সংলাপ। এই উপন্যাসের আর একটি উল্লেখযোগ্য বাক্য - “ তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?” কপালকুণ্ডলা বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস । এতে নিগূঢ় ভাবসঙ্গতির জন্য "রোমান্স বলা যায়। অরণ্যে এক কাপালিক-পালিতা নারী কপালকুণ্ডলাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে অপরিচিতা এই নারীর নবকুমারের সঙ্গে বিয়ে এবং কপালকুণ্ডলার সমাজবন্ধনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এই কাহিনির মূল ঘটনা। কুপালকুণ্ডলার মধ্যে যে রহস্য সেই রহস্য উদঘাটনই উপন্যাসের প্রধান বিষয়। কাহিনিতে একদিকে আছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়কার আগ্রার নগর ও স্থাপত্য এবং অন্যদিকে অরণ্য ও সমুদ্র । প্রকৃতির সৌন্দর্য রহস্যময়তা, কপালকুণ্ডলার চরিত্র, কাহিনির ট্র্যাজিক পরিণতি এই তিনটি কারণে উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম স্মরণীয় রচনা। বঙ্কিমের জীবৎকালেই এই উপন্যাসের আটটি সংস্করণ হয় । অনেকের মতে এটি বঙ্কিমের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র: কুপালকুণ্ডলা, নবকুমার, কাপালিক ইত্যাদি । গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই উপন্যাসের একটি নাট্যরূপ দেন (১৮৭৩) এবং দামোদর মুখোপাধ্যায় এই উপন্যাসের একটি উপসংহার উপন্যাস রচনা করেন এবং নামকরণ করেন মৃন্ময়ী (১৮৭৪) ।
  • মৃণালিনী (১৮৬৯) : মৃণালিনী ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলাদেশ ও তুর্কি আক্রমণ এর ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত । মগধের রাজপুত্র হেমচন্দ্রের সঙ্গে মৃণালিনীর প্রণয় এবং দেশরক্ষার জন্য হেমচন্দ্রের সংকল্প ও ব্যর্থতার সঙ্গে এক রহস্যময়ী নারী মনোরমার কাহিনি এ উপন্যাসের মূল কথাবস্তু। বঙ্কিমের দেশাত্মবোধ এবং ইতিহাস জিজ্ঞাসার প্রথম প্রকাশ এই উপন্যাসে। ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তরালে হেমচন্দ্ৰ-মৃণালিনী এবং পশুপতি মনোরমার প্রেমকাহিনি এই উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে । ইতিহাসের উপাদান নিয়ে এখানে জীবনকে মুখ্য করা হয়েছে । এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ।
  • বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) : বিষবৃক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় সমস্যার সঙ্গে বিধবা বিবাহ, পুরুষের একাধিক বিবাহ তার রূপতৃষ্ণা ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, নারীর আত্মসম্মান ও অধিকারবোধ প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত । বাংল৷ উপন্যাসে বিষবৃক্ষের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। চরিত্রায়নে ঘটনা সংস্থানে এবং জীবনের কঠিন সমস্যার রূপায়ণে 'বিষবৃক্ষ' বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস । কারণ বঙ্কিমচন্দ্রের আগে আর কোন লেখক এ জাতীয় বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনার চেষ্টা পর্যন্ত করেন নি । বাল্যবিধবা কুন্দনন্দিনীর প্রেম ও কামনার বিকাশকে তৎকালীন সমাজ যে প্রশ্রয় দেয় নি, এ উপন্যাস তার প্রমাণ । লেখকও মনে করেছেন, কুন্দর কাহিনি পাঠ করার ফলে ঘরে ঘরে অমৃত ফলবে অর্থাৎ এ ধরনের প্রণয়াকাঙ্ক্ষা রহিত হবে। বঙ্কিমচন্দ্র কী চেয়েছেন সেটি মুখ্য নয় । 'বিষবৃক্ষে' তিনি সমস্যার যে যথার্থ রূপায়ণ করতে পেরেছেন এটাই আসল । 'বিষবৃক্ষ' আজও বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি।
  • ইন্দিরা (১৮৭৩) : ইন্দিরা' গল্প না উপন্যাস এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে । ইন্দিরা' আকারে ছোট উপন্যাস ( নভেলা ) , অনেকে বলেন বড়ো গল্প । ১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শনে' প্রথম প্রকাশিত এবং ‘উপকথা' (১৮৭৭) গ্রন্থে সংকলিত । ১৮৯৩ সালে পুনর্লিখিত এবং পরিবর্ধিত হয় । এই কাহিনিটি উত্তমপুরুষের বয়ানে রচিত। কৌতুক-পরিহাসপূর্ণ উপভোগ্য কাহিনি 'ইন্দিরা'। অনেকের মতে, বঙ্কিমচন্দ্রের কালে শিল্পমাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পের অস্তিত্ব ছিলো না বলে তিনি একটি গল্পের বিষয়কে উপন্যাসে রূপ দিতে গিয়েছেন । তাঁদের মতে, 'ইন্দিরা' বাংলা ছোটগল্পের ইঙ্গিত, সূচনার বার্তাবহ ।
  • যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪) : যুগলাঙ্গুরীয় ছোট আখ্যান । কেউ বলে থাকেন নভেলা বা ছোট উপন্যাস, কেউ বলেন বড় গল্প । বঙ্কিম একে বলেছেন উপকথা । প্রাচীন পটভূমিকায় একটি প্রেম কাহিনি । ছোটগল্প শিল্পমাধ্যমটি ওইকালে থাকলে ‘যুগলাঙ্গুরীয়' একটি গল্প হতে পারত । 'ইন্দিরা'র পর এই আখ্যানে বঙ্কিমচন্দ্র আবার একই ফর্মচর্চা করেন ।
  • চন্দ্রশেখর (১৮৭৫) : এটি প্রথমে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় । প্রতাপ ও শৈবলিনীর বাল্যপ্রণয় এবং সেই প্রেমের করুণ পরিণতি এই উপন্যাসের প্রধান কাহিনি । প্রেম, দাম্পত্য আদর্শ, সমাজের শাসন, সতীত্ব ইত্যাদি এই কাহিনিতে বিশেষভাবে সমস্যায়িত হয়েছে । এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্ৰধান অভিযোগ বঙ্কিমের নীতি ও প্রথানুগত্য । কেননা, লেখক এখানে 'তবে যাও প্রতাপ, স্বর্গধামে' বলে নায়ককে পরলোকের পথ দেখিয়েছেন । উপন্যাসটির পটভূমি ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং মীর কাসিমের সঙ্গে ইংরেজদের সংগ্রাম । ইতিহাসাশ্রয়ী ঘটনার সঙ্গে গার্হস্থ্য জীবনের কাহিনির রূপায়ণ ঘটেছে বলে মীর কাসিম-দলনি বেগমের সঙ্গে চন্দ্রশেখর-প্রতাপ-শৈবলিনীর আখ্যান রচিত হয়েছে এই উপন্যাসে ।
  • রজনী (১৮৭৭): এটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণমূলক সামাজিক উপন্যাস। এটি ইংরেজ ঔপন্যাসিক লর্ড লিটন রচিত The Last Days of Pompeii অবলম্বনে রচিত। উপন্যাসের নায়িকা রজনীর সঙ্গে লর্ড লিটন প্রণীত 'The Last Days of Pompeii' নামক উপন্যাসের নিডিয়া চরিত্রের কিছুটা ঐক্য আছে । বিভিন্ন পাত্র-পাত্রীর জবানবন্দিতে এই উপন্যাস রচিত । এই রীতিটিও যে বঙ্কিম ইংরেজ ঔপন্যাসিক কার্লিনস অনুসরণে করেছেন তা তিনি ভূমিকায় জানিয়েছেন । বাংলা উপন্যাস গড়ে তুলবার জন্য এভাবেই পাশ্চাত্যের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র । বঙ্কিমের অধিকাংশ উপন্যাসের মতোই এখানেও প্রেম ও আদর্শের সংঘাতই কাহিনির মূল উপজীব্য ‘রজনী’কে প্রকৃত উপন্যাস না বলে রোমান্স বলা হয়ে থাকে । কারণ এখানে বেশ কল্পদৃশ্যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ।
  • কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮) : এটি বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সমকালে বিতর্কিত উপন্যাস । এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিধবা নারী রোহিনীকে অবলম্বন করে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই শিল্পবোধ ও নৈতিক আদর্শের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন । ঔপন্যাসিকের জীবদ্দশায় এই গ্রন্থের চারটি সংস্করণ হয় । এটি সামাজিক উপন্যাস। প্রধান চরিত্র : রোহিনী , গোবিন্দলাল, ভ্রমর ।
  • আনন্দমঠ (১৮৮২): ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ছায়া অবলম্বনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৮২ সালে। উপন্যাসটিতে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে স্বদেশভক্তি, স্বজাতি ও স্বধর্মপ্রীতি । এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশ বলতে বঙ্গভূমিকে, আর ধর্ম বলতে হিন্দু ধর্মকে বুঝিয়েছেন । বন্দে মাতরম গান দ্বারা বুঝিয়েছেন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের দীক্ষা। উল্লেখ্য যে এটি কোন ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। এর ঘটনা কল্পিত কিন্তু অবিশ্বাস্য নয় । চরিত্রগুলি আদর্শায়িত । মন্বন্তরের বর্ণনা নিখুঁত, সাধারণ গ্রামীণ জীবনের আখ্যান বাস্তব । সর্বোপরি প্রেম এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের কাহিনিকে নিবিড়তা দিয়েছে । কিন্তু এই উপমহাদেশের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এ উপন্যাসের মূল্য অসামান্য । বঙ্কিমচন্দ্র রচিত এই গ্রন্থের 'বন্দে মাতরম' গানটির ভূমিকা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি ঐতিহাসিক এই উপন্যাসের প্রভাব । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত The Abbey of Bliss (1907) এবং শ্রী অরবিন্দ Ananda Math (1910) নামে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এটি মূলত বাস্তবানুগ রোমান্সধর্মী উপন্যাস । এই গ্রন্থে রচিত গানের 'বন্দে মাতরম' ধ্বনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীদের অত্যন্ত প্রিয় ও উদ্দীপক স্লোগান হিসেবে গৃহীত হয় । এই গ্রন্থ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় স্বসম্প্রদায়প্রীতি লক্ষ করা যায় । এ উপন্যাসে মুসলমান সম্পর্কে বক্রোক্তির জবাবে শেখ মুহম্মদ ইদ্রিস আলী ‘বঙ্কিম দুহিতা' উপন্যাস রচনা করেন।
  • রাজসিংহ (১৮৮২) : এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের মূল বিষয় হিন্দুর বাহুবল ও বীরত্ব রূপায়িত করা । রাজস্থানের চঞ্চল কুমারীকে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিবাহ ইচ্ছার ফলে রাজা রাজসিংহের সাথে বিরোধ বাঁধে এবং রাজসিংহের জয় হয়। ফলশ্রুতিতে রাজসিংহ চঞ্চল কুমারীকে লাভ করেন । এটিই এ উপন্যাসের উপজীব্য।
  • দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪): রংপুর অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ, ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলনের নেত্রী দেবী চৌধুরাণী ছিলেন। রংপুরের পীরগাছার জমিদার। ইংরেজ বিরোধী অনেকগুলো সফল অভিযানের পর ১৭৮৩ সালে স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি নিহত হন। পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রংপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে এ ঘটনা জানতে পারেন এবং রচনা করেন ‘দেবী চৌধুরাণী’।
  • রাধারাণী (১৮৮৬) : অনু-উপন্যাস। প্রথম প্রকাশ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১২৮২)। ১৮৭৭ ও ১৮৮১ সালে উপন্যাস – অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপন্যাস সংগ্রহ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ১৮৮৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশের সময় পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৮। ১৮৯৩ সংস্করণে পৃষ্ঠাসংখ্যা বেড়ে হয় ৬৫।
  • সীতারাম (১৮৮৭) : বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশেষ উপন্যাস। সীতারাম একটি ঐতিহাসিক চরিত্র । উপন্যাসে ঐতিহাসিক কিছু ঘটনাও আছে । মূলত এটি এক ব্যক্তির পারিবারিক জীবনের এবং আদর্শের ট্র্যাজেডি । বঙ্কিমের ধর্মচিন্তা এই উপন্যাসের গঠনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। তবে চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য এবং কাহিনির বর্ণনা কুশলতায় বঙ্কিমের প্রতিভার ছাপ স্পষ্ট । তাঁর ‘আনন্দমঠ', 'দেবী চৌধুরাণী' ও ‘সীতারাম’কে ‘ত্রয়ী' উপন্যাস বলা হয় ।

প্রবন্ধ গ্রন্থ

বঙ্কিমচন্দ্র জ্ঞান, বিজ্ঞান ও বিবিধ বিষয়ে করতে প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালি জাতিকে চিত্তা ও মননশীলতায় দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ রচনার মূলে উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও স্বদেশিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু ও সচেতন করা । বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হল :

  • কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫) : এটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিভিন্ন মেজাজের লঘু ঢঙে লেখা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ । কমলাকান্ত নামক এক চরিত্রের জবানিতে প্রবন্ধগুলি লিখিত। ফলে এদের মধ্যে একটি ক্ষীণ আখ্যানগত এবং চরিত্রগত ঐক্য আছে । কমলাকান্ত নামক আফিমখোর, খ্যাপাটে কিন্তু চিন্তাশীল ও কবিপ্রতিভাসম্পন্ন চরিত্রটি বঙ্কিমের অনন্য সৃষ্টি। মনে করা হয়, কমলাকান্ত বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই । কমলাকান্ত আফিম খেলেই দিব্যদৃষ্টি ফিরে পায় । তার কবিত্ব, দেশপ্রেম, দার্শনিকতা, ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপশক্তি সমস্তই একাধারে এই গ্রন্থে ঘনীভূত । প্রসন্ন গোয়ালিনী কমলাকান্তের অনুষঙ্গী চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র যে কত মহৎ গদ্যশিল্পী এ গ্রন্থে তা বোঝা যায়। তৎসম শব্দের স্থাপত্যধর্মী স্বভাব পরিত্যাগ করে এ গ্রন্থে তিনি পেলব গদ্যশৈলী নির্মাণ করেছেন। অনেকের মতে, কমলাকান্তের দপ্তর বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ।
  • সাম্য (১৮৭৯) : এটি গদ্যগ্রন্থ। 'বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত ‘সাম্য’ বিষয়ক তিনটি এবং ‘বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধের কিছু অংশ নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় । ইউরোপীয় সাম্যচিন্তার ধারার ইতিহাস এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে । এই গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ ও অর্থনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তা প্রকাশিত । তবে পরবর্তী জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ‘সাম্য' গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করেন নি। এটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করা নেন । বঙ্কিমচন্দ্রের আগে বাংলা ভাষায় সাম্যবাদী চিন্তার এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ হতে দেখা যায় না। এই ঐতিহাসিক কারণেও 'সাম্য' গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ । এই গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোতে সমাজে সাম্যপ্রতিষ্ঠা কামনা এবং কৃষকদের দুঃখের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক শোষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
  • বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খণ্ড ১৮৮৭, ২য় খণ্ড ১৮৯২) : এটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রবন্ধাবলি । প্রথম খণ্ডের বিষয়বস্তু মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাসে এই প্রবন্ধগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ধর্ম, সমাজ, ইতিহাস বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ আছে। এই প্রবন্ধগুলোতেও বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনার নির্দিষ্ট পথে বাংলা প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ পথ সূচনা করলেন । উল্লেখ্য , 'বিবিধ প্রবন্ধ' (১৮৯৫) নামে ভূদেব মুখোপাধ্যায়েরও একটি প্রবন্ধ সংকলন আছে।
  • গদ্যপদ্য বা কবিতাপুস্তক (১৮৯১) : ১৮৭৮-এ প্রকাশিত ‘কবিতাপুস্তক' নামক পদ্যসংগ্রহের সঙ্গে কয়েকটি গদ্যরচনা যুক্ত করে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় । অনেকের মতে এই গ্রন্থের কোনো কোনো গদ্যরচনায় গদ্য কবিতার পূর্বাভাস লক্ষ করা যায় । সে বিবেচনায় এই গ্রন্থটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।
  • লোকরহস্য (১৮৭৪)
  • বিজ্ঞানরহস্য (১৮৭৫)
  • বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬)
  • কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬)
  • ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮)
  • শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৯০২)
  • মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত (ব্যঙ্গ)
  • প্রবন্ধ-পুস্তক

সম্পাদিত গ্রন্থাবলী

  • দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী
  • বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান
  • সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

বাংলা উপন্যাসের জনক

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা উপন্যাসকে জনক বলার কারণ হলো, বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম পাশ্চাত্যরীতি অবলম্বন কারে একটি পরিপূর্ণ আখ্যান রচনা করেন। উপন্যাস একটি পাশ্চাত্য শিল্প- ধারণা । এখানে একটি ক. প্লট থাকবে; খ. আখ্যানবস্তুর দেশকালগত অবস্থান ও পরিবর্তন দেখা যাবে ; গ. চরিত্রের গঠন ও বিবর্তন, পারিণতি ও পরিব্যাপ্তি থাকবে ; ঘ. সামায় ও ফ্যানের ঐক্য থাকবে । এই বিচারে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের আগে কেউ সর্বাঙ্গ সার্থক উপন্যাস লিখতে পারেন নি । ফুলমণি ও করুণার বিবরণ" ও "আলালের ঘরের দুলাল" উপন্যাস- যাচাইয়ের মাপকাঠিতে সর্বাঙ্গ সার্থক 'দুর্গেশনন্দিনী' (১৮৬৫) রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর তিনি মোট ১৪টি সার্থক উপন্যাস রচনা করে সে ধারাকে বেগবান করেন এবং একের পর এক সার্থক উপন্যাস রচনা করে চলেন বলে বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয় ।

সম্পাদনা

তিনি ‘বঙ্গদর্শন' (১৮৭২) পত্রিকা সম্পাদনা (১৮৭২- ১৮৭৬) করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর এটি সম্পাদনা করেন তাঁর অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ আরো অনেকে । ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকার অন্যতম লেখক ছিলেন- রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ।

উপাধি

তিনি সাহিত্য রসবোদ্ধাদের কাছ থেকে সাহিত্যসম্রাট, হিন্দু ধর্মানুরাগীদের কাছ থেকে ঋষি আখ্যা লাভ করেন। তিনি বাংলার স্কট এবং বাংলা উপন্যাসের জনক। ছদ্মনাম- কমলাকান্ত। নিষ্ঠার সাথে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ‘রায়বাহাদুর' (১৮৯১) এবং ১৮৯৪ সালে সি.আই.ই উপাধি প্রদান করে ।

মৃত্যু

তিনি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮ এপ্রিল, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা- ২৬ চৈত্র, ১৩০০) কলকাতায় মারা যান।

নবীনতর পূর্বতন