বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ || কিভাবে সৃষ্টি হল বাংলা ভাষা

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। তাছাড়া পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই এখন বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন।সারা পৃথিবীতে ৩০ কোটির ও অধিক মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন এতগুলো মানুষের মুখের ভাষা কিভাবে এল বা কোথা থেকে এল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে অনেক পিছনে ফিরে যেতে হবে। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ও অধিক পিছনে। গেীরবময় এই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ জানতে হলে প্রথমেই আপনাকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ও জেনে নিতে হবে। চলুন তাহলে বাঙালি জাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি ডেমো জেনে আসি।

বাঙালি জাতির উৎপত্তি

আমরা সবাই জানি বাঙালি সংকর জাতি। সহজ ভাষায় সংকর মানে মিশ্রণ। সংক্ষেপে বললে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বহিরাগত জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে আজকের বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক. প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী খ. আর্য নরগোষ্ঠী।এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই আর্য ও অনার্য আবারা কারা? আর্য ছিলো ইন্দো ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠী।এদের অবস্থান ছিলো মধ্য ইউরোপে,অন্য মতে দক্ষিন রাশিয়ার ইউরাল পর্বতের পাদদেশে।খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে এরা ভারতবর্ষে আসে। আর্যরা ছিলো উন্নত জাতি গোষ্ঠী।তাদের ছিল নিজস্ব ভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতি । আরিয়াভারত বা প্রাচীন ভারতবর্ষের অধিবাসীদের অনার্য বলা হত। ভারতবর্ষকেই একসময় আরিয়াভারত বলা হত।আরিয়াভারতে আর্যদের আগমনের পূর্বে যে সব আদিম অধিবাসী বসবাস করত তারা হল অনার্য।

আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী আবার চার ভাগে বিভক্ত। যথা:
ক. নেগ্রিটো খ. অস্ট্রিক গ. দ্রাবিড় ঘ. ভোটচীনীয়

প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে অস্ট্রিক জাতি বাংলায় প্রবেশ করে নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। সমসাময়িককালে অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠে আর্যপূর্ব বাঙালি জাতি। খাইবার গিরিপথ দিয়ে বাংলায় আসে দ্রাবিড় জাতি।দ্রাবিড়রা সভ্যতায় উন্নততর বলে তারা অস্ট্রিক জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে ককেশীয় অঞ্চলের শ্বেতকায় আর্যগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে আর্যরা বাংলায় প্রবেশ করে। সে সময়ে বাংলায় বসবাস করতো অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের লোক, যারা সভ্যতায় ছিল অনেক পিছিয়ে এবং এরা অস্ট্রিক নামে পরিচিত। আর্যগণ অস্ট্রিক বা অনার্যদের তুলনায় সভ্যতায় অনেক উন্নততর ছিল বলে তারা অস্ট্রিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং বাংলা দখল করে নেয়। এভাবে আর্য ও অনার্য আদিম অধিবাসীদের সংমিশ্রণে এক নতুন মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়, যারা পরবর্তীতে ‘বাঙালি' নামে পরিচিত হয়।.‘ঋকবেদ’, ‘মহাভারত', ও 'মৎস্যপুরাণ' গ্রন্থে ‘বঙ্গ' কথাটির উল্লেখ আছে । খ্রিস্টের জন্মের পর থেকে সাত'শ বছর পর্যন্ত বাংলা বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল। প্রথমে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং পরবর্তীতে পাল আমলের রাজারা সকল জনপদকে একীভূত করেন। সম্রাট আকবর এ অখণ্ডসত্তার নাম দেন 'সুবা-বাঙলা'। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে এই পর্যায়ে আমরা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী সম্পর্কে জানব।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা

ইন্দো বলতে ভারতীয় উপমহাদেশ, এবং ইউরোপীয় বলতে ইউরোপ মহাদেশকে বোঝায়।ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে জানা যায়, আফ্রিকার মানুষেরাই সর্বপ্রথম ভাষার ব্যবহার করে। যাই হোক পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে কয়েকটি ভাষাবৃক্ষে বিভক্ত করা হয়। এই ভাষা বৃক্ষগুলোর মূলভাষার একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।নামটি যদি ও কাল্পনিক। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সব ভাষাকেই এই মূলভাষা বা ভাষাবাংশের অন্তভুক্ত মনে করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার উদ্ভব বলে ধারণা করা হয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।যথা: কেন্তুম ও শতম। কেন্তুম শাখা বিস্তার লাভ করে ইউরোপে আর শতম শাখা বিস্তার লাভ করে ভারত উপমহাদেশ সহ ইরানীয় দেশগুলোতে। এ দুটি শাখার উপশাখা রয়েছে ৮টি। যথা: গ্রিক, ইতালিক, কেলটিক, জার্মানিক, আর্য (ইন্দো-ইরানীয়., বাল্টো-স্লাভিক, আর্মেনীয় ও আলবেনীয়। এর প্রথম চারটি কেন্দ্রম শাখার, শেষের চারটি শতম শাখার অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে কেন্দ্রম ও আর্য (ইন্দো-ইরানীয়. ভাষাগুলোকে শতম শাখা ধরা হয়। বাংলা ভাষার উদ্ভব ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার শতম শাখা থেকে। আর আমাদের বাংলা ভাষা নিশ্চয়ই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের শতম শাখার একটি ভাষা। কেননা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলটি তো ভারতীয় উপমহাদেশেরই একটি। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা ভারতীয় আর্যভাষা সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা একটি আনুমানিক ভাষার নাম।এর কয়েকটি স্তর লক্ষ করা যায়। প্রথম স্তরটিই হল বৈদিক ভাষা। হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ 'বেদ' এর ভাষা হল বৈদিক ভাষা। দেবদেবীর পূজা এবং বৈদিক যজ্ঞকার্যে ব্যবহার করা এ ভাষা কালক্রমে উচ্চারণের অপপ্রয়োগ, বিকৃতি এবং স্থানীয় শব্দাবলির সংযোজনের কারণে কৌলিন্য হারিয়ে ক্রমেই অপ্রচলিত হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনি বৈদিক ভাষার সংস্কার সাধন করেন এবং নির্দিষ্ট সূত্র প্রদান করেন। সংস্কারকৃত এ নির্দিষ্ট ভাষাই সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল না, এ ভাষা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ব্যবহার করতেন।তার মানে আর্যভাষার দ্বিতীয় সংস্করণ হল সংস্কৃত ভাষা। যার সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত।তবে সংস্কৃত ভাষা এখন ও ভারত বর্ষে ব্যাপকভাবে পঠিত এবং পবিত্র ভাষা হিসেবে সংরক্ষিত।এর পরবর্তী স্তর প্রাকৃত ভাষা । কারণ সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল ‘প্রাকৃত ভাষা'। 'প্রাকৃত' শব্দের অর্থ ‘স্বাভাবিক'। পরবর্তীতে প্রাকৃত ভাষা থেকে ‘পালি' ও ‘অপভ্রংশ' নামক দুটি ভাষার উদ্ভব ঘটে। সাধুভাষা থেকে ভ্রষ্ট কিংবা বিকৃতভাবে উচ্চারিত শব্দই অপভ্রংশ। বৈয়াকরণ পতঞ্জলির মতে, 'বিশেষ ভাষার বিচ্যুত বা বিকৃত ভাবই অপভ্রংশ'। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অপভ্রংশের বিস্তারকাল ধরা হয়। সাধুভাষা থেকে ভ্রষ্ট কিংবা বিকৃতভাবে উচ্চারিত শব্দই অপভ্রংশ। বৈয়াকরণ পতঞ্জলির মতে, ‘বিশেষ ভাষার বিচ্যুত বা বিকৃত ভাবই অপভ্রংশ'। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অপভ্রংশের বিস্তারকাল ধরা হয়। বাংলা ভাষা অপভ্রংশের নিকট ঋণী। ‘প্রাকৃত' ভাষার প্রকারভেদ ঘটলেও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা প্রাকৃতই থেকে গেল। পরবর্তীতে ‘প্রাকৃত' ভাষাই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে, কথ্য ভাষার উচ্চারণের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। কালক্রমে ‘প্রাকৃত' থেকে উৎপত্তি লাভ করে ‘বাংলা ভাষা'। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত আজকের সর্বশেষ আমরা বাংলা ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে জানব।

বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তন

বাংলার আদিম অধিবাসীগণ প্রথম থেকেই বাংলায় কথা বলেনি। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা হিসেবে বাঙলা বিবর্তিত হয়েছে বলে প্রাক-আর্য যুগের অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার সাথে বাংলার সংশ্লিষ্টতা নেই। বাংলার আদিম অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক। অনার্যদের তাড়িয়ে আর্যরা এদেশে বসবাস শুরু করলে তাদেরই আর্য ভাষা হতে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। অতএব বলা যায় যে, বাঙালি জাতি যেমন সংকর জাতি তেমনি বাংলা ভাষাও সংকরায়ণের মাধ্যমে সৃষ্টি।যাইহোক বাংলা ভাষার ক্রম বিবর্তনকে তিনটি ধাপে ভাগ করা যায়।যথা: (ক) প্রাচীন যুগ (খ) মধ্যযুগ (গ) আধুনিক যুগ।

প্রাচীন যুগের একমাত্র লিখিত নির্দশন চর্যাপদ । এর অন্যান্য নাম গুলো হলো হলো চর্যাগীতিকোষ, দোহাকোষ, চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, এবং চর্যাগীতিকা। ধারণা করা হয়, এটি ৬৫০ খ্রি. থেকে ১২০০ খ্রি. পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে রচিত এবং পাল শাসন আমলে রচিত। চর্যাপদের ভাষা ছিল সান্ধ্যভাষা বা আলো আধারি ভাষা। খানিকটা বুঝ যায় আবার খানিকটা বুঝা যায় না।বর্তমান বাংলা ভাষার যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। বাংলা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে- সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী । ড. সুনীতিকুমারের মতে- দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী তার পরের স্তর মধ্যযুগ যা ১২০০ খ্রি. থেকে ১৮০০ খ্রি. পর্যন্ত এর মধ্যবর্তী সময়। এই সময়ে বাংলা সবচেয়ে বেশি সুগঠিত হয়। মধ্যযুগের সাহিত্য ও ছিল সম্পুর্ণ ধর্ম নির্ভর। এভাবেই ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে আজকের বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।

ব্রজবুলি কী?

ব্রজবুলি হলো বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি এক প্রকার কৃত্রিম কবিভাষা। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি এ ভাষার স্রষ্টা। এ ভাষা কখনো মানুষের মুখের ভাষা ছিল না; সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহার নেই। এতে কিছু হিন্দি শব্দ আছে। এ ভাষায় চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস বিভিন্ন বৈষ্ণব পদ রচনা করেন।

‘ঋগ্বেদ' কী ?

‘ঋগ্বেদ’ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় রচিত প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এটি প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত স্তোত্র সংকলন। এর রচয়িতা হিসেবে ৩৭৮ জনের নাম পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৩৫০ জন ঋষি এবং ২৮ জন ঋষিকা। এটি ৭টি মৌলিক ছন্দ এবং প্রায় ৪০ টি মিশ্র ছন্দে রচিত। এর সংকলক পরাশপুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।

أحدث أقدم