মধ্যযুগের সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম

যদিও ইতঃপূর্বে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সম্পর্কে এ টু জেড আলোচনা করা হয়েছে।তারপর ও কিছু খামতি থেকেই যায়। আর তা হচ্ছে মধ্যযুগের শুধু কবি সাহিত্যিকদের একটা সাহিত্যিক বিবরণী। এটা এক নজরে দেখে নিলে হয়তো মধ্যযুগ সম্পর্কে আর কোন খামতি থাকবে না। সেইজন্যই মূলত শুধু কবি সাহিত্যিকদের একটা হ্যান্ডনোট তুলে ধরা হল। এতে করে মধ্যযুগের সাহিত্য আরো সাবলীলভাবে আত্নস্থ করা যাবে। নিচে মধ্যযুগের সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তারিত স্টেপ বাই স্টেপ তুলে ধরা হল।

বড়ু চণ্ডীদাস (১৩৭০-১৪৩৩)

মধ্যযুগের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের ১০০/১২৫ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন । তিনি বাসলী দেবীর আরাধনা করেই কবি প্রতিভা অর্জন করেছিলেন। দেবী বরে তিনি কবিত্বশক্তি লাভ করেন, এটি তাঁর সহজাত প্রতিভা নয়।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু বড় চণ্ডীদাস জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১৩০৯ সালে (বসন্তরঞ্জন রায়ের মতে) এবং ড. শহীদুল্লাহর মতে, ১৩৭০ সালে ছাতনার বাঁকুড়ায়; মতান্তরে বীরভূমের নানুর গ্রামে । বসন্তরঞ্জন রায়ের মতে, তিনি মারা যান আনুমানিক ১৩৯৯ সালে এবং ড. শহীদুল্লাহর মতে, ১৪৩৩ সালে ।
প্রকৃত নাম তাঁর প্রকৃত নাম অনন্ত। তাঁর কৌলিন্য উপাধি বড়ু। গুরু প্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস ।
অন্য নাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে বড়ু চণ্ডীদাসের তিনটি নাম পাওয়া যায় যথা: অনন্ত চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বড়ু চণ্ডীদাস।
বিশেষত্ব তিনি মধ্যযুগের আদি কবি। বৈষ্ঞব পদাবলীর আদি রচয়িতা।
কাব্যগ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ -বাংলা সাহিত্যের প্রথম একক রচনা বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য অপর নাম: ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের অপর নাম শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামটি রাখেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ।
খন্ড সংখ্যা: ১৩টি খণ্ড।
চরিত্র: রাধা (জীবাত্মা বা প্রাণিকূল), কৃষ্ণ (পরমাত্মা বা ঈশ্বর), বড়ায়ি ( রাধাকৃষ্ণের প্রেমের দূতি) ।
প্রকাশকাল: বসন্তরঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য ১৯১৬ সালে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
আবিষ্কার: ১৯০৯ সালে (১৩১৬ ব.) পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা (কালিয়া) গ্রামের শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণের বাড়ির গোয়ালঘরের মাচার ওপর থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পুঁথিশালার অধ্যক্ষ বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ এটি উদ্ধার করেন। বসন্তরঞ্জন রায়ের উপাধি- ‘বিদ্বদ্বল্লভ'

চণ্ডীদাস

পূর্ব বাংলার বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস ছিলেন জাতিতে ব্রাহ্মণ। তাঁর আরাধ্য দেবতার নাম বাশুলী বা বিশালাক্ষী । তিনি চৈতন্যপূর্ব যুগের কি অর্থাৎ চৌদ্দ শতকের শেষার্ধ থেকে পনের শতকের প্রথমার্ধ সময়ের কবি ছিলেন। তিনি বড়ু চণ্ডীদাস থেকে পৃথক কবি ছিলেন এ কথা নিশ্চিত।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “চণ্ডীদাস সহজ ভাষায় সহজ ভাবের কবি- এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি।' এছাড়াও তিনি চণ্ডীদাসকে ‘দুঃখবাদী কবি' বলেছেন ।
কবিত্ব / পাণ্ডিত্য চণ্ডীদাস ছিলেন বৈষ্ণব কবি , সহজিয়াপন্থী ও বাশুলি দেবী ভক্ত। তিনি বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলির আদি কবি। শিক্ষিত বাঙালি বৈষ্ণব সাহিত্যের রস ও আনন্দের সংবাদ পেয়েছে চণ্ডীদাসের পদাবলি থেকে। চৈতন্যদেব তাঁ পদাবলি শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন। তিনি পূর্বরাগ পর্যায়ে পদ রচনায় পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন।
শ্রীকৃষ্ঞের স্বরুপ চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকে সম্পূর্ণ পৌরাণিক ভূমিকায় স্থাপন করেছেন। তিনি রাধার চরিত্রে মিলনের আনন্দের চেয়ে বিচ্ছেদের বেদনাকে তীব্রতর করে রূপায়িত করেছেন।
মানবতাবাদী কবি তিনি ‘শুনহ মানুষ ভাই / সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।' বলে জাত-পাতযুক্ত সমাজে প্রথম মানবতার বাণী কাব্যে ধারণ করেছেন। তাছাড়া ব্যক্তিজীবনেও তিনি জাত-সংস্কারের ঊর্ধ্বে ছিলেন। এজন্য তাকে বাংলা ভাষার প্রথম মানবতাবাদী বলা হয়।
বিখ্যাত উক্তি ১. ‘সই কেমনে ধরিব হিয়া / আমার বঁধূয়া আন বাড়ী যায় আমার আঙিনা দিয়া।'
২. ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম ।’
৩. “শুনহ মানুষ ভাই / সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর না ”। এটি বাংলা ভাষার প্রথম মানবতা বাণী।

বিদ্যাপতি (১৩৮০-১৪৬০)

মিথিলার রাজসভার কবি, বৈষ্ণব কবি ও পদসঙ্গীত ধারার রূপকার বিদ্যাপতি। তিনি বাঙালি না হয়েও বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছেন। বিদ্যাপতির রচিত পদ চৈতন্যদেব বিশেষভাবে শ্রবণ করতেন। তাঁর কৌলিক উপাধি ঠক্কর বা ঠাকুর।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু বিদ্যাপতি আনুমানিক ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে মিথিলার দ্বারভাঙা জেলার সীতাময়ী মহকুমার বিসফী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।তিনি আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান ।
কবিত্ব তিনি পদাবলির প্রথম কবি । তিনি মিথিলার রাজা কীর্তি সিংহ কর্তৃক সভাপণ্ডিত নিযুক্ত হন এবং রাজা দেব সিংহ ও শিব সিংহের রাজসভার কবি ছিলেন।
উপাধি বিদ্যাপতির উপাধি 'কবিকণ্ঠহার' (রাজা শিবসিংহ কর্তৃক), ‘মৈথিল কোকিল’, ‘অভিনব জয়দেব’।তাঁর রচিত কাব্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাজকন্ঠের মণিমালা' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শ্রেষ্ঠ কীর্তি তিনি মৈথিলি, অবহটঠ ও সংস্কৃত ভাষায় পদ রচনা করেন । তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ব্রজবুলিতে রচিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা। বৈষ্ণব পদাবলির অধিকাংশ পদ ব্রজবুলি ভাষায় রচিত ।
ব্রজবুলি ব্রজবুলি হলো বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি এক প্রকার কৃত্রিম কবিভাষা। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি এ ভাষার স্রষ্টা। এ ভাষা কখনো মানুষের মুখের ভাষা ছিল না; সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহার নেই। এতে কিছু হিন্দি শব্দ আছে। এ ভাষায় চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস বিভিন্ন বৈষ্ণব পদ রচনা করেন ।
‘মৈথিল কোকিল' মিথিলার কবি বিদ্যাপতিকে ‘মৈথিল কোকিল' বলা হয়। তিনি পদাবলির আদি বৈষ্ণব কবি এবং পদসঙ্গীত ধারার রূপকার। তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি পঙ্ক্তি না লিখেও বাংলায় স্মরণীয় কবি। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেন ।
সাহিত্যকর্মসমূহ ‘কীর্তিলতা’, ‘কীর্তিপতাকা', ‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘শৈবসর্বস্বসার’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’,‘লিখনাবলী’, ‘ভাগবত', ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’, ‘বিভাগসার’ ।
বিদ্যাপতির উক্তি ‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর ।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।'

কৃত্তিবাস ওঝা (১৩৮১-১৪৬১)

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পনের শতকের প্রধান কবি ও বাংলা রামায়ণের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তিনি বাল্মীকির রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক । মৈথিলি ব্রাহ্মণদের অসমিয়া ভাষায় ওঝা বলা হয়। ওঝা শব্দটি এসেছে ‘উপাধ্যায়’ থেকে।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু কৃত্তিবাস ওঝা আনুমানিক ১৩৮১ সালে রাজশাহী জেলার প্রেমতলীতে | পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপের অন্তর্গত ফুলিয়া গ্রামের মুখুটি বংশে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি আনুমানিক ১৪৬১ সালে মারা যান ।
পদবী কৃত্তিবাসের পদবী মুখোপাধ্যায় । পিতামহ প্রদত্ত নাম কৃত্তিবাস ।
মধুসূদন দত্তের মন্তব্য কৃত্তিবাস সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, “কৃত্তিবাস ‘কীর্তিবাস কবি’, এ বঙ্গের অলঙ্কার।”
কৃত্তিবাসের রামায়ণের পরিচয় গৌড়েশ্বরের আদেশে কৃত্তিবাস ওঝা প্রথম ‘রামায়ণ সহজবোধ্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক।এটি পয়ার ছন্দে রচিত। তাঁর রচিত রামায়ণের অন্য নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী । এটি ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ' নামেও পরিচিত। এর মাধ্যমে অনুবাদ সাহিত্যের সূচনা হয়। ১৮০২ সালে উইলিয়াম কেরির সহায়তায় শ্রীরামপুর মিশনের প্রেস থেকে এটি পাঁচখণ্ডে মুদ্রিত হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।

শাহ মুহম্মদ সগীর

শাহ মুহম্মদ সগীর মধ্যযুগের প্রথম মুসলমান কবি। তাছাড়া মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বলে তাঁকে প্রাচীন কবিও বলা হয়। তিনি মূলত প্রাকৃত ভাবাপন্ন কবি। তাঁর কবিতায় আরবি ও ফারসি ভাষার ব্যবহারও লক্ষণীয়।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম শাহ মুহম্মদ সগীর আনুমানিক ১৪ শতকের শেষ থেকে ১৫ শতকের শুরুতে জন্মগ্রহণ করেন।
বিশেষত্ব তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি । তিনি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি ।
কাব্যগ্রন্থ ‘ইউসুফ জোলেখা’। গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে সগীর এটি রচনা করেন।
‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য শাহ মুহম্মদ সগীর গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) পারসি কবি আবদুর রহমান জামী রচিত ‘ইউসুফ ওয়া জুলায়খা' থেকে বাংলায় ‘ইউসুফ জোলেখা' নামে অনুবাদ করেন। কোরআন ও বাইবেলের নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে ‘ইউসুফ জোলেখা’র কাহিনি বর্ণিত আছে। তৈমুস বাদশার কন্যা জোলেখার আজিজের সাথে বিবাহ হলেও ক্রীতদাস ইউসুফের (নবী) প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ইউসুফ (আঃ) তা এড়িয়ে যান। বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় ইউসুফ মিশরের অধিপতি হন এবং জোলেখার প্রতি তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। শেষে ধর্মান্তরের মাধ্যমে ইউসুফ-জোলেখার মিলন ঘটে। সুফিবাদীরা ইউসুফকে পরমাত্মা এবং জোলেখাকে জীবাত্মা হিসেবে উপস্থাপন করেন ।

চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০)

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান বাঙালি ও প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। ষোড়শ শতাব্দীর সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর রচিত রামায়ণে লৌকিক, মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে ।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু চন্দ্রাবতী ১৫৫০ সালে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের পাতোয়ারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস ।তিনি আনুমানিক ১৬০০ সালে কিশোরগঞ্জে মারা যান।
মহিলা কবি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ৩ জন মহিলা কবির নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন: চন্দ্রাবতী, চৈতন্যদেবের সময়ের মাধবী এবং চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গীনী রামী বা রজকিনী । ড. আহমদ শরীফের মতে, চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের ২য় মহিলা কবি । প্রথম মহিলা কবি চৈতন্যদেবের সময়ের মাধবী।
উপাধি চন্দ্রাবতীকে মহিলা রামায়ণকার বলা হয়। তিনি রামায়ণের প্রথম মহিলা অনুবাদক।
কাব্যসমূহ ‘রামায়ণ’ (অনূদিত), ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা'। তার রচনাসমূহ ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

গোবিন্দদাস (১৫৩৪-১৬১৩)

কবি বিদ্যাপতির ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ চৈতন্যোত্তরকালে খ্যাতি অর্জনকারী কবিদের একজন গোবিন্দদাস। গোবিন্দদাসের কবিত্বগুণের সাথে বিদ্যাপতির ভাবের বিশেষ মিলের কারণে কবি বল্লভদাস তাকে ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য' অভিধা প্রদান করেন। তাঁর পদাবলিতে রাধা চরিত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ও পরিণতি লক্ষ করা যায়। প্রথম জীবনে তিনি শাক্ত ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। ৪০ বছর বয়সে বৈষ্ণবগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের কাছ থেকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু গোবিন্দদাস মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলার নিকটবর্তী তেলিয়াবুধুরি গ্রামে আনুমানিক ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আনুমানিক ১৬১৩ সালে মারা যান ।
ভাবাদর্শ গোবিন্দদাস বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়োছিলেন বিদ্যাপতির ভাবাদর্শে।এজন্য তাঁকে ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য' বলা হয়।
পদবি গোবিন্দদাসের আসল পদবি ‘সেন’
উপাধি তাঁর পদাবলিতে মুগ্ধ হয়ে জীব গোস্বামী তাকে ‘কবিন্দ্ৰ’ উপাধি প্রদান করেন ।
পদাবলি ‘গীতগোবিন্দ' তার বিখ্যাত পদাবলি । তার নামে প্রায় সাড়ে চারশত বৈষ্ণবপদ পাওয়া যায়।
সংস্কৃত নাটক গোবিন্দদাস রচিত সংস্কৃত নাটকের নাম ‘সংগীতমাধব’ । তিনি এটি রচনা করেন রাজা সন্তোষদত্তের অনুরোধে । এ গ্রন্থে তার পারিবারিক পরিচিতি পাওয়া যায় ।
বিখ্যাত পক্তি ‘যাঁহা যাঁহা নিবসয়ে তনু তনু জ্যোতি,
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।’
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি
অবনী বহিয়া যায়।
ঈষত হাসির তরঙ্গ-হিল্লোলে
মদন মুরুছা পায় ।

জ্ঞানদাস

চৈতন্যোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি জ্ঞানদাস। তিনি চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য ছিলেন। চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। জ্ঞানদাস ছিলেন শিল্পী এবং চণ্ডীদাস ছিলেন সাধক । তিনি বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রায় দুইশ পদ রচনা করেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে কবি জ্ঞানদাসের জন্ম ।
অন্য নাম তিনি শ্রীমঙ্গল, মঙ্গল ঠাকুর বা মদনমঙ্গলা নামেও পরিচিত ছিলেন।
বৈষ্ঞব গীতিকাব্য জ্ঞানদাস রচিত দুটি বৈষ্ণব গীতিকাব্য যথা: ‘মাথুর’ ও মুরলীশিক্ষা'
কবিতার বিষয় তিনি শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, নৌকাবিলাস ও দানখণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে কবিতা লিখতেন। পদ রচনার সময় তিনি রাধা- কৃষ্ণের কিশোর-কিশোরী বয়সকে প্রাধান্য দিতেন ।
বিখ্যাত পক্তি ১. ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।’
প্রতি অঙ্গলাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর
২. ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।'

দৌলত উজির বাহরাম খান

ষোল শতকের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার মুসলিম কবি দৌলত উজির বাহরাম খান। তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা এবং ইসলামী ধর্মশাস্ত্রের মতো হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ‘লায়লী-মজনু' কাব্যের মতো বিশ্বখ্যাত বিরহকথা নিয়ে মানবিক প্রেমবোধকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম কাব্য তিনি রচনা করেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম দৌলত উজির বাহরাম খান চট্টগ্রামের ফতেহবাদ / জাফরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চট্টলাধিপতির উজির মোবারক খান ।
প্রকৃত নাম তাঁর প্রকৃত নাম আসাউদ্দীন / বাহরাম খান।
উপাধি তার উপাধি দৌলত উজির
কাব্যসমূহ ১. ‘জঙ্গনামা’ বা ‘মক্তুল হোসেন’: এটি তার রচিত প্রথম কাব্য । কারবালার বিষাদময় কাহিনি অবলম্বনে এটি রচনা করেন।
২. ‘লায়লী-মজনু' (১৫৪৩-৫৩)।
৩. ‘ইমাম-বিজয়’
‘লায়লী-মজনু' কাব্য বাংলা ভাষায় প্রথম লায়লী মজনু কাব্য রচনা করেন দৌলত উজির বাহরাম খান। তিনি পারসিয়ান কবি নিজামির ‘লায়লা ওয়া মজনুন' থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। এর উৎস আরবি লোকগাঁথা ।

আরো জানতে পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ || ( ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রি. )

শেখ ফয়জুল্লাহ

১৬ শতকের মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শেখ ফয়জুল্লাহ । তিনি মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি এবং নাথ সাহিত্যের প্রধান কবি।মুসলমান হয়েও তিনি নাথ সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর নাথ ধর্মবিষয়ের আখ্যানকাব্যের নাম ‘গোরক্ষ বিজয়’। এ কাব্যটি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আবিষ্কার করেন ।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম শেখ ফয়জুল্লাহ পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত / দক্ষিণ রাঢ় / কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন ।
নাথ সাহিত্য ‘গোরক্ষ বিজয়’।
প্রথম মর্সিয়া তাঁর রচিত প্রথম মর্সিয়া কাব্য ‘জয়নাবের চৌতিশা’ (১৫৭০)। এটি কারবালার কাহিনির একটি ছোট অংশ অবলম্বনে রচিত। এ কাব্যের মূল বিষয় ইমাম হোসেনের পত্নী জয়নাবের বিলাপ ।
অন্যান্য রচনাবলি ‘গাজী বিজয়’: রংপুরের খোঁট দুয়ারের পীর ইসমাইল গাজীর বিজয় এ কাব্যের মূল বিষয়।
‘সত্যপীর’ (১৫৭৫), ‘সুলতান জমজমা’ (নীতিকথা বিষয়ক), ‘রাগনামা’ (সঙ্গীত সম্পর্কিত), ‘পদাবলী’
ফয়জুল্লাহ বিভ্রান্তি উনিশ শতকে ফয়জুল্লাহ নামে একজন দোভাষী শায়ের ছিলেন । তিনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার পাঁচনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার কাব্যের নাম ‘সত্যপীর’

সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮)

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কবি, বাংলা সুফী সাহিত্য ধারায় উল্লেখযোগ্য কবি, শাস্ত্রবিদ ও পীর সৈয়দ সুলতান। তিনি কাহিনিকাব্য ও শাস্ত্রকাব্য রচয়িতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু সৈয়দ মিনা ওরফে সৈয়দ সুলতান ১৫৫০ সালে হবিগঞ্জ জেলার লস্করপুর (প্রাচীন তরফ রাজ্যের রাজধানী) গ্রামে/ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চক্রশালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি আনুমানিক ১৬৪৮ সালে মারা যান ।
‘সুলতানশী হাবেলী’ তিনি লস্করপুর গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ‘সুলতানশী হাবেলী’ নামে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এবং এ বাড়িতে বসেই সাহিত্যচর্চা করেন । সৈয়দ সুলতানের রচনাবলি সম্পাদনা করেন ড. আহমদ শরীফ
রচিত গ্রন্থসমূহ ‘নবীবংশ’ (১৫৮৪): এটি ফারসি ‘কাসাসুল আম্বিয়া' কাব্যের অনুসরণে রচিত। এটি দুটি খণ্ডে হযরত মুহম্মদ (স.) এর জীবনীকাব্য। এ কাব্যে হিন্দু দেবদেবীর (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, হরি, শিব, মহেশ্বর, বামন, রাম, কৃষ্ণ) উল্লেখ থাকলেও ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনাই কবির উদ্দেশ্য ছিল। এ কাব্যের ২য় খণ্ডের নাম ‘রসুল চরিত’। মধ্যযুগে রচিত হযরত মুহম্মদ (স.) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী হিসেবে ‘রসুল চরিত’ই শ্রেষ্ঠ কাব্য। এ কাব্যের শেষাংশে উল্লেখ আছে শবে মিরাজের ইতিহাস ।
‘শব-ই-মিরাজ’, ‘রসুল বিজয়', “জ্ঞানপ্রদীপ”, ‘জ্ঞানচৌতিশা’, ‘জয়কুম রাজার লড়াই', ‘ইবলিশনামা’, ‘মারফতী গান’, ‘পদাবলি’, ‘ওফাৎ-ই-রসুল'।

দৌলত কাজী (১৬০০-১৬৩৮)

সপ্তদশ শতকের আরাকান রাজসভার প্রথম বাঙালি কবি এবং লৌকিক কাহিনির আদি রচয়িতা দৌলত কাজী। তিনি বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি ও ব্রজবুলি ভাষায় বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি তাঁর রচনায় রামায়ণ, মহাভারত ও বৈষ্ণব পদাবলি থেকে অনুষঙ্গ ব্যবহারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিন ক্ল্যাসিক ও রোমান্টিক রীতির সংমিশ্রণের মাধ্যমে রূপকথাকে রোমান্টিক কাহিনিতে পরিণত করেছিলেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু দৌলত কাজী আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের কাজী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৬৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে আরাকানের আকিয়াবে সমাহিত করা হয়।
বিশেষত্ব আরাকান রাজসভার প্রথম বাঙালি কবি এবং লৌকিক কাহিনির আদি রচয়িতা। তিনি বাংলা কাব্যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রণয়কাহিনির পথিকৃৎ।
কাব্য ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’
‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী” তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যের নাম ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী'। এটি হিন্দি কবি সাধনের ‘মৈনাসত' কাব্য অবলম্বনে তিন খণ্ডে রচিত। আরাকানের রাজা সুধর্মের সমর সচিব আশরাফ খানের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এটি রচনা করেন। এ কাব্যের ৩য় খণ্ড রচনাকালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে প্রায় ২০ বছর পর ১৬৫৯ সালে মহাকবি আলাওল এটির রচনা সমাপ্ত করেন।

কোরেশী মাগন ঠাকুর (১৬০০-১৬৬০)

রোসাঙ্গ রাজসভার বাঙালি কবি ও সিদ্দিক বংশজাত কোরেশী মাগন ঠাকুর মধ্যযুগের অন্যতম কবি। তিনি রোসাঙ্গরাজ সাদ উমাদার ও তাঁর পুত্র চন্দ্র সুধর্মার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু কোরেশী মাগন ঠাকুর আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চক্রশালা (মতান্তরে আরাকান) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৬৬০ সালে মারা যান।
পিতা তাঁর পিতা বড়াই ঠাকুর আরাকান রাজসভার মন্ত্রী ছিলেন
ডাকনাম ও উপাধি ডাকনাম: মাগন। উপাধি: ঠাকুর (আরাকানি রাজাদের সম্মানিত উপাধি) ।
কাব্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রাবতী’ : এটি লোককাহিনি আশ্রিত কোরেশী মাগন ঠাকুর রচিত রোমান্টিক প্রণয়কাব্য।
পৃষ্ঠপোষকতা মহাকবি আলাওল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘পদ্মাবতী” ও ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল' কাব্য রচনা করেন।

আলাওল (১৬০৭-১৬৮০)

মহাকবি আলাওল ছিলেন বাঙালি পণ্ডিত কবি। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের ধর্মীয় বিষয়বস্তুর গতানুগতিক পরিসীমায় রোমান্টিক প্রণয়কাব্যধারা প্রবর্তনকারী হিসেবে মুসলমান কবিদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনি রাজসভার কবি হিসেবে আবির্ভূত হলেও মধ্যযুগের সকল বাঙালি কবির মধ্যে ‘শিরোমণি আলাওল' রূপে আরবি, ফারসি ও হিন্দি সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও ভাববৈচিত্র্য অবলম্বনে কাব্য রচনায় এক নতুন যুগের সূচনা করেন ।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু আলাওল ১৬০৭ সালের দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম / ফরিদপুরের ফতেয়াবাদ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
পিতা আলাওলের পিতা ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিস কুতুবের অমাত্য ছিলেন। জলপথে ফতেয়াবাদ থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে আলাওল ও তাঁর পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং ঘটনাস্থলে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে আরাকান রাজ্যে উপস্থিত হন ।
পৃষ্ঠপোষকতা আলাওল আরাকানে প্রথমে রাজদেহরক্ষী অশ্বারোহী পরে সেনাবাহিনীর চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।আরাকানের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুর আলাওলকে কাব্য রচনায় উৎসাহিত করেন।তিনি দৌলত কাজী রচিত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী' (১৬৫৯) কাব্যের ৩য় খণ্ড রচনা করেন।
“পদ্মাবতী” ‘পদ্মাবতী' (১৬৪৮) মহাকবি আলাওলের প্রথম রচনা, যা ইতিহাস আশ্রিত রোমান্টিক প্রেমকাব্য। মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি ভাষায় রচিত ‘পদুমাবৎ’ অবলম্বনে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম কবি আলাওল মাগন ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় ‘পদ্মাবতী' কাব্য রচনা করেন। পদ্মাবতী কাব্য দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব হচ্ছে সিংহলের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য চিতোররাজ রত্নসেনের সফল অভিযান এবং দ্বিতীয় পর্বে আছে রানি পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর ব্যর্থ সামরিক অভিযানের বিবরণ। এ কাব্যে হিরামন নামে একটি শুকপাখির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ কাব্যে কবির নাগরিক শিক্ষা, রুচির বৈদগ্ধ্য রূপ, ভাবের গভীরতা, ভাষা ও অলংকার প্রয়োগে বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় পাওয়া যায় বলে ‘পদ্মাবতী’কে আলাওলের শ্রেষ্ঠ রচনা বলা হয়। এ কাব্যের বিখ্যাত পঙ্ক্তি- “তাম্বুল রাতুল হৈল অধর পরশে।'
মহাকবি আলাওলের অসাধারণ প্রতিভা এবং বিভিন্ন ভাষার যথোপযুক্ত প্রয়োগ দক্ষতার জন্য তাকে মহাকবি বলা হলে ও আসলে তিনি মহাকবি ছিলেন না।কারণ মহাকবি তারাই যারা জাত / মেীলিক মহাকাব্য রচনা করেন।কিন্তু আলাওল এরকম কোন মহাকাব্য রচনা করেন নি।তাই প্রচলিত মতে আলাওলকে মহাকবি বলা হলে ও তিনি তেমনটি নন।

আলাওলের কাব্যসমূহ

গ্রন্থ ও প্রকাশকাল উৎস পৃষ্ঠপোষক
পদ্মাবতী (১৬৪৮ ) : প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্য। পদুমাবৎ (মালিকমুহম্মদজায়সী) কোরেশী মাগন ঠাকুর
রত্তনকলিকা আনন্দবর্মা ( ১৬৫৯ ) মৌলিক (সতীময়না ও লোরচন্দ্রানীর উত্তরাংশ) শ্রীমন্ত সোলেমান
তোহফা (নীতিকাব্য)-(১৬৬৪) তুহফ-ই নসাঈহ (ইউসুফ গদা) শ্রীমন্ত সোলেমান
হপ্তপয়কর ( ১৬৬৫ ) হফত্ পয়কর (নিজামী) সৈয়দ মুহম্মদ খান
সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল (১৬৬৯) সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল (গাওয়াসী) মাগন ঠাকুর
সিকান্দরনামা (১৬৭৩) সিকান্দরনামা (নিজামী) নবরাজ মজলিস
রাগতালনামা মৌলিক -
পদাবলী মৌলিক -
শিরী খসরু মৌলিক -

আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০)

সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবি আবদুল হাকিম। মধ্যযুগে মুসলমানগণ বাংলাকে নিজেদের ভাষা মনে না করে ফারসি-আরবি-উর্দুকে আপন ভাষা মনে করতো। এই পরভাষা প্রীতিকে আঘাত করার জন্য তিনি বিভিন্ন শ্লেষমূলক কবিতা রচনা করেন। তিনি সমাজের সার্বিক কল্যাণে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সে লক্ষ্যে বিভিন্ন গ্রন্থে আদর্শ জীবন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু আবদুল হাকিম ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপের সুধারাম/ নোয়াখালি জেলার বাবুপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
বিখ্যাত কবিতা তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বঙ্গবাণী' ।
কাব্যগ্রন্থ তাঁর ৮টিকাব্য পাওয়া গেছে যথা: ‘ইউসুফ জোলেখা’, ‘নূরনামা’, ‘দোররে মজলিশ’, ‘লালমতী সয়ফুলমূলক’, ‘হানিফার লড়াই’, ‘শিহাবুদ্দীন নামা’, ‘নসীহত্নামা’, ‘কারবালা ও শহরনামা'
‘নূরনামা’ ‘নূরনামা’ ফারসি নীতিকাব্য ‘নূরনামাহ’ অবলম্বনে রচিত। “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” পঙ্ক্তিটি এ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। বাংলা ভাষার প্রতি এরূপ শ্রদ্ধাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য কবির ‘নূরনামা’ কাব্যটি বিশেষ প্রশংসিত ।
বিখ্যাত পক্তি ১. ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।'
২. ‘তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রমে তোষি আমি সর্বজন।'
৩. ‘দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়,
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’

শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ (১৬৭০-১৭৭০)

অষ্টাদশ শতাব্দীর পুঁথি সাহিত্যের প্রাচীনতম লেখক ফকির গরীবুল্লাহ (শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ)। তিনি দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের আদি, শ্রেষ্ঠ ও সার্থক কবি। [উল্লেখ্য, পুঁথি সাহিত্যের আদি কবি ফকির গরীবুল্লাহ না থাকলে উত্তর হবে সৈয়দ হামজা]

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু ফকির গরীবুল্লাহ আনুমানিক ১৬৭০ সালে হুগলীর বালিয়া পরগনার হাফিজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি আনুমানিক ১৭৭০ সালে মারা যান ।
প্রকৃত নাম ফকির গরীবুল্লাহর প্রকৃত নাম শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ।
বিশেষত্ব পুঁথি সাহিত্যের আদি কবি এবং মর্সিয়া সাহিত্য ধারার প্রধান কবি।
সাহিত্যকর্মসমূহ ‘জঙ্গনামা’, ‘সোনাভান’, ‘সত্যপীরের পুঁথি’, ‘ইউসুফ জোলেখা’, ‘আমীর হামজা' (তিনি এ কাব্যটি জীবদ্দশায় শেষ করে যেতে পারেন নি । এটি শেষ করেন সৈয়দ হামজা)।

ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০)

অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্তা ভাষার সংমিশ্রণে আশ্চর্য নতুন এক বাভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে বাংলা কবিতায় নিপুণ ছন্দপ্রয়োগ ছিল তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য।

সাহিত্যিক উপাদান সাহিত্যিক তথ্য
জন্ম ও মৃত্যু ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার ভুরশুট পরগণার পেঁড়ো (পাওয়া) গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে।
উপাধি তিনি নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। তাঁর কবিত্ব শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে ‘রায়গুণাকর' উপাধি দেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি এবং মঙ্গলযুগের শেষ কবি হিসেবে পরিচিত। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে মধ্যযুগের ‘শেষ বড় কবি' বলা হয়।
বিশেষত্ব তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী' (১৭২৭) রচনা করেন। তিনি অন্নদামঙ্গল ধারার প্রধান কবি।
সাহিত্যকর্মসমূহ ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য' (১৭৫২-৫৩): এটি তিনি নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে রচনা করেন। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। অন্নদামঙ্গল কাব্য ৩টি খণ্ডে বিভক্ত । এতে দেবী অন্নদার বন্দনা আছে । এ কাব্যের দ্বিতীয় অংশ ‘বিদ্যাসুন্দর’।
‘সত্য পীরের পাঁচালী' (১৭৩৭-৩৮): এটি তাঁর রচিত অন্যতম গ্রন্থ ।
‘রসমঞ্জরী’, ‘নাগাষ্টক’, ‘গঙ্গাষ্টক’, ‘চণ্ডীনাটক’ (নাটক)।
বিখ্যাত উক্তি ১. ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।'
২. ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায় ?”
৩. ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।'
৪. “হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়।’
৫. ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ! ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেকে চাঁদ।
৬. ‘না রবে প্রাসাদগুণ না হবে রসাল অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল ।’

আরো জানতে পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ || ( ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রি. )

নবীনতর পূর্বতন