হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ, দার্শনিক, পণ্ডিত, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সংস্কৃত বিশারদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা। মহামহোপাধ্যায় হল ইংরেজ আমলে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে সরকার প্রদত্ত উপাধিবিশেষ। ভারততত্ত্ব নিয়ে শাস্ত্রীকে আগ্রহী করেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের (১৯২১) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ‘এশিয়াটিক সোসাইটি'র সভাপতি ছিলেন (১৯১৯-১৯২১)। তার প্রকৃত নাম ছিল শরৎনাথ ভট্টাচার্য । তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কর্তা। তিনি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিতম্ বা রামচরিতমানস পুঁথির সংগ্রাহক।

জন্ম ও পরিচয়

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ৬ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাদের আদি নিবাস ছিল খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে । তাদের পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য। তাঁর পিতার নাম ছিল রামকমল ন্যায়রত্ন।

শিক্ষাজীবন

অধিকাংশের মতোই , হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের স্কুলে । প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি তাঁর অগ্রজ নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু তথা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আশ্রয়ে থেকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৭১ সালে হরপ্রসাদ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৩ সালে ১৯ তম স্থান অধিকার করেন ফার্স্ট আর্টস (এফএ) পরীক্ষায়। ১৮৭৬ সালে ৮ম স্থান অধিকার করে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন । এই বি.এ. পরীক্ষায় তিনি সংস্কৃতে প্রথম স্থান অধিকার করেন । যার ফলে প্রতি মাসে ৫০ টাকা 'সংস্কৃত কলেজ স্নাতক বৃত্তি', ৫ টাকা 'লাহা বৃত্তি', এবং 'রাধাকান্ত দেব মেডেল' লাভ করেন। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃতে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে এম.এ. পরীক্ষায় পাস করেন ও 'শাস্ত্রী' উপাধি অর্জন করেন। উক্ত পরীক্ষায় হরপ্রসাদই ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র। টোল পাঠশালার পরিবর্তে হরপ্রসাদ আধুনিক স্কুল-কলেজে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন । শুধু তাই নয় সংস্কৃত কলেজে তাকে সংস্কৃতসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসারে তাঁকে বিস্তৃতভাবে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি , বীজগণিত , ত্রিকোনমিতি পড়ানো হয়েছিল। ফলে সংস্কৃতের পাশাপাশি তিনি আধুনিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন ।

কর্মজীবন

কর্মজীবনের শুরুতেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী হেয়ার স্কুলে অনুবাদ শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। একই বছরেই তিনি লখনৌ ক্যানিং কলেজে ও কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন । অত:পর ১৮৮৩ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং একই সাথে বঙ্গীয় সরকারের সহকারী অনুবাদক হিসেবে ও কাজ করার সুযোগ পান । সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা এবং বঙ্গীয় সরকারের সহকারী অনুবাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পদোন্নতির মাধ্যমে ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান এবং ১৯০০ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন । তিনি ১৯০৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন । অত:পর অবসর জীবনে সরকারের তথ্যকেন্দ্রে কিছুদিন কাজ করেছিলেন । ১৯২১ সালের ১৮ জুন তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং এখান থেকে অবসর গ্রহণ কনে ১৯২৪ সালের ৩০ জুন। অধ্যাপনা ও সরকারি কাজের পাশাপাশি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে দুই বছর হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির পদ এবং পরে আজীবন সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন , বারো বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কম্পানিয়ন অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার (সি.আই.ই.) উপাধি প্রদান করে।

গবেষণাকর্ম

ছাত্র বয়সে তাঁর বন্ধু, গুরু ও দেবতাতুল্য হয়ে ওঠেন অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় । রাজকৃষ্ণই হরপ্রসাদকে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন । তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশ হত । হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ছাত্র বয়সের প্রথম গবেষণাপত্রটি ভারত মহিলা নামে ১২৮২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন পত্রিকার মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে হরপ্রসাদ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে উঠেন এবং নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করেন। এ সময় তাঁর প্রায় ৩০টি রচনা বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশ হয় এবং বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পায়। প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রতিভা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহায়তায় ১৮৮৫ সালে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন এবং রাজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল গ্রন্থের বৌদ্ধ পুরাণগুলির অনুবাদ শুরু করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে হরপ্রসাদ রাজেন্দ্রলালের সহকারী ছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে রাজেন্দ্রলাল বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ের পুঁথি সংগ্রহ ও পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি (Descriptive Catalogue) প্রকাশের প্রকল্প তত্ত্বাবধান করতেন । তাঁর মৃত্যুতে ১৮৯১ সালের জুলাই থেকে হরপ্রসাদ সেই শূন্য পদে অর্থাৎ সোসাইটিতে সংস্কৃত পুঁথি অন্বেষণ বিভাগের পরিচালক হন। অল্প কয়েকজন সহকারী নিয়ে হরপ্রসাদ প্রায় দশ হাজার পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি বা ক্যাটালগ প্রণয়ন করেন, যা এগারো খন্ডে প্রকাশিত হয়। এই ক্যাটালগের যে দীর্ঘ মুখবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন, তা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি মূল্যবান ইতিহাস। সংস্কৃত পুঁথি সন্ধানের সূত্রেই হরপ্রসাদ বাংলা পুঁথির বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের কাজে তাঁকে সাহায্য করেন দীনেশচন্দ্র সেন এবং মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পুঁথির সন্ধানে তিনি অনেকবার নেপাল গিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি দুর্গম পথ অতিক্রম করে তৃতীয় বারের মত নেপাল যান এবং নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ 'চর্য্য বিনিশ্চয়', চর্যাগীতি বা চর্যাপদের পুঁথি। শাস্ত্রী মহাশয় একই সঙ্গে নিয়ে আসেন আরো তিনটি পুঁথি : সরহপাদ ও কৃষ্ণপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব। চারটি পুঁথি একত্রিত অবস্থায় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে ‘হাজার বছরের পুরানো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা' নামে । প্রকাশক বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। চারটি পুঁথির মধ্যে কেবল চর্যাপদের পুঁথিটিরই ভাষা বাংলা । অন্য তিনটি অর্বাচীন অপভ্রংশে রচিত। পুঁথিতে চর্যাপদের নাম ছিল চর্যাচর্যবিনিশ্চয় । কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৮৯৬-তে 'মহামহোপাধ্যায়'এবং ১৯১১-তে সি,আই,ই উপাধি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত হন ১৯২৭ সালে।

পুরস্কার

তিনি বিএ ক্লাসে অধ্যয়নকালেই ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘ভারত মহিলা' প্রবন্ধটি রচনা করে ‘হোলকার পুরস্কার' লাভ করেন।

উপাধি

তাঁর উপাধি- মহামহোপাধ্যায় (১৮৯৮), সি.আ.ই (১৯১১)। মহামহোপাধ্যায় হল ইংরেজ আমলে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতকে সরকার প্রদত্ত উপাধি বিশেষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি.লিট (১৯২৭) উপাধিতে ভূষিত হন । সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনিই একমাত্র প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ (১৮৭৭) হওয়ায় তাকে ‘শাস্ত্রী’ উপাধি দেওয়া হয়।

পুঁথি আবিষ্কার

বাংলার প্রাচীন পুঁথির খোঁজে তিনি চারবার (১৮৯৭, ১৮৯৮, ১৯০৭, ১৯২২) নেপাল ভ্রমণ করেন এবং ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার করেন ।

চর্যাপদ প্রকাশনা

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’ ‘ডাকার্ণব’, ‘সরহপাদের দোহা' ও ‘কাহ্নপাদের দোহা' গ্রন্থের সম্মিলন ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে প্রকাশিত হয়

গ্রন্থসমূহ

  • উপন্যাস : কাঞ্চনমালা (১৯১৬), বেণের মেয়ে (১৯২০)।
  • তৈল : এটি প্রথম 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
  • বাল্মীকির জয় (১৮৮১)
  • বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৮৮২)
  • মেঘদুত (১৯০২)
  • হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা (১৯১৬)
  • প্রাচীন বাংলার গৌরব (১৯৪৬)
  • বৌদ্ধধর্ম (১৯৪৮)
  • সচিত্র রামায়ণ

‘বেণের মেয়ে' উপন্যাসের পরিচয়

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিখ্যাত উপন্যাস 'বেণের মেয়ে' (১৯২০)। এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হলেও এর চরিত্রগুলো কাল্পনিক। দশম-একাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের অবসান, হিন্দু ধর্মের নবরূপে আবির্ভাবকালে সপ্তগ্রামের এক বৌদ্ধ পরিবারকে নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনির গতিপথ প্রসারিত হয়েছে। এ উপন্যাসের মাধ্যমে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অতীতকে নতুনরূপে উপস্থাপন করেছেন।

মৃত্যু

১৯৩১ সালের ১৭ নভেম্বর এই গুণী মৃত্যুবরণ করেন ।

নবীনতর পূর্বতন