বাক্য প্রকরণ || বাংলা ব্যাকরণ

বাক্যের মেীলিক উপাদান শব্দ হলে ও ভাষার মূল উপকরণ বাক্য। এই বাক্য সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে বাক্য তার ভাষাগত যোগ্যতা হারায়। যার ফলস্বরুপ মনের ভাব সুস্পষ্টরুপে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না বা আমরা যথাযথভাবে বুঝতে পারি না।ত্রুটিমুক্ত বাক্যই পারে সঠিকভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে। ভাষাগত যোগ্যতার বিচারে সঠিক বাক্য বলা বা প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই আজ আমরা ত্রুটিমুক্ত বাক্য গঠনের জন্য বাক্য প্রকরণ অধ্যায়টি এ টু জেড জানার চেষ্টার করব। চলুন তাহলে শুরু করি।

সার্থক বাক্য

যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টির দ্বারা বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় তাই বাক্য। অর্থবোধক কিছু শব্দ বা পদ মিলে একটিবাক্য তৈরি হয়। অবশ্য তার মাঝে অর্থ প্রকাশের গুণ থাকতে হয়। এজন্য প্রয়োজন বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা। যদি বাক্যের পদগুলো | মিলে একটি অখন্ড ভাব প্রকাশ করে তবেই তা সার্থক বাক্য হতে পারে।

ভাষার বিচারে সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ থাকতে হয়-

১. আকাঙ্ক্ষা : একপদের পর অন্যপদ শোনার যে ইচ্ছা।
২. আসত্তি : বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার সুশৃঙ্খল পদ বিন্যাস।
৩. যোগ্যতা : অর্থগত ও ভাবগত সমন্বয় বুঝানো।

১. আকাঙ্ক্ষা (Expectancy)

বাক্যের অর্থ সুস্পষ্টরুপে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে আগ্রহ জাগে তা-ই আকাঙ্ক্ষা। বাক্য গঠনে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হবে তার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি ঘটতে হবে। তাহলেই তা বাক্য হয়ে উঠবে। যেমন: কামরান প্রতিদিন এখানে….। এটুকু বললে বাক্যের অর্থের পরিসমাপ্তি ঘটে না বরং আরো কিছু শোনার আগ্রহ থাকে। ’কামরান প্রতিদিন এখানে আসে’ বললে বাক্যের অর্থের পরিসমাপ্তি ঘটে।তখনই কেবল এটি সার্থক বাক্য হয়ে উঠে।

২. ক্রম বা আসত্তি (Proximity)

বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর মাঝে অর্থের সঙ্গতি বা মিল রাখার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে পদবিন্যাসকেই বলা হয় ক্রম বা আসত্তি। বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদ বিন্যাসই আসত্তি।অর্থাৎ বাক্যের পদগুলোকে যথাস্থানে বসানোর নামই হল ক্রম বা আসত্তি। যেমন-

রহিম মাছ থেকে বাজার কিনে…

উপরের বাক্যে পদ সন্নিবেশ ঠিকভাবে না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি একটি বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে ।

রহিম বাজার থেকে মাছ কিনে। —বাক্যটি আসত্তি গুণসম্পন্ন।

৩. যোগ্যতা (Propriety)

বাক্যস্থিত পদসমূহের অর্থগত এবং ভাবগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলো অর্থগত ও ভাবগত দিক থেকে মিলে গেলে তাকে যোগ্যতা বলে। আরো সহজভাবে বললে বাক্যে এমন পদসমুহের প্রয়োগ করতে হবে যা বাস্তবে ঘটে বা যেমন :

করিম তার জমিতে হালচাষ করে। পাখিরা আকাশে উড়ে। কিন্তু যদি বলা হয় - করিম তার সাগরে হালচাষ করে। মাছেরা আকাশে উড়ে। তাহলে বাক্য দুটি ভাব প্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ, সাগরে কখনো হালচাষ করা যায় না, আর মাছেরা কখনো আকাশে উড়ে না।

শব্দের যোগ্যতার সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত থাকে

(ক) রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা :

প্রকৃতি ও প্রত্যয়লাভ অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার দিক থেকে রীতিসিদ্ধ অর্থের দিকে লক্ষ রেখে কতকগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হবে। যেমন:

শব্দ রীতিসিদ্ধ প্রকৃতি+প্রত্যয় প্রকৃতি+প্রত্যয়জাত অর্থ
বাধিত অনুগৃহীত বা কৃতজ্ঞ বাধ+ইত বাধাপ্রাপ্ত
তৈল তিল জাতীয় তিল+ ষ্ঞ তিলজাত স্নেহ পদার্থ ,যে কোন শস্যের রস ।

(খ) দুর্বোধ্যতা :

অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্য যোগ্যতা হরায়।যেমন: তুমি আমার সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছ। (চাতুরি বা মায়া অর্থে) । যদি বলা হত তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ।তাহলে দুর্বোধ্যতার কারণে বাক্যটি তার যোগ্যতা হারাত না। কারণ প্রপঞ্চ শব্দটি প্রচলিত নয়।

(গ) উপমার ভুল প্রয়োগ :

ঠিকভাবে উপমা অলঙ্কার ব্যবহার না করলে বাক্যের যোগ্যতার হানি ঘটে। যেমন: আমার হৃদয় মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হল। বীজ ক্ষেতে বপন করা হয়, মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হবে : আমার হৃদয় ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হল।

(ঘ) বাহুল্য দোষ :

প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারে বাক্যে বাহুল্য দোষ ঘটে এবং এর ফলে শব্দ তার যোগ্যতা গুণ হারিয়ে থাকে। যেমন :স্কুলের সকল ছাত্ররা আজ খেলায় অংশগ্রহণ করেছে। এখানে 'ছাত্ররা' বহুবচনবাচক শব্দ । এর সঙ্গে 'সকল' শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার বাহুল্য দোষ সৃষ্টি করেছে। বাংলায় দুইবার বহুবচন চিহ্ন ব্যবহৃত হয় না, কীন্তু ইংরেজিতে হয়। যেমন Five boys, কিন্তু বাংলায় 'পাঁচজন বালকেরা' লিখলে ভুল হবে। লিখতে হবে : পাঁচজন বালক।

(ঙ) বাগধারার শব্দ পরিবর্তন :

বাগধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছ পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। যেমন: 'অরণ্যে রোদন' (অর্থ : নিষ্ফল আবেদন)-এর পরিবর্তে যদি বলা হয়, 'বনে রোদন ‘ তবে বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।

(চ) গুরুচণ্ডালী দোষ :

তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে দুষ্ট শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। যেমন : “গরুর গাড়ি' "শবদাহ' 'মড়াপোড়া' প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে 'গরুর । শকট' 'শবপোড়া', 'মড়াদাহ' প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে।

বাক্যের প্রকারভেদ

বাক্যকে প্রধানত দুটি দৃষ্টিকোণ হতে ভাগ করা হয়—
(ক) অর্থানুযায়ী
(খ) গঠন অনুযায়ী
অর্থানুসারে বাক্যকে প্রধানত সাত ভাগে ভাগ করা যায় এবং গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার ।

অর্থানুসারে বাক্যের প্রকারভেদ

১. বর্ণনাত্মক বা নির্দেশাত্মক বাক্য :

যে বাক্যে কোনো ঘটনার ভাব বা তথ্য থাকে এবং সে বক্তব্যকে সাধারণভাবে বিবৃত বা নির্দেশ করা হয়, তাকে বর্ণনাত্মক বা নির্দেশাত্মক বাক্য বলে। যেমন : সূর্য পশ্চিমে অস্ত যায়। কামরান রোজ এখানে আসে । সে এখন আর কবিতা লিখে না। আজ রোদ উঠবে না। নির্দেশাত্মক বাক্য দুই ভাগে বিভক্ত (ক) অস্তিবাচক ও (খ) নেতিবাচক

(ক) অস্তিবাচক বাক্য :

কোন শস্যের রস।। যে বাক্যে কোন ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব বা হ্যাঁ-সূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে অস্তিবাচক বাক্য বলে। যেমন : রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’। ১১ সেপ্টেম্বর পেন্টাগনে সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়।

(খ) নেতিবাচক বাক্য :

যে বাক্যে কোন ঘটনায় কাজে বা ভাবে অস্বীকৃতি, অনস্তিত্ব, নিষেধ বা না-সূচক অর্থ বোঝায়, তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে। যেমন : রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি ছাড়া অন্যটি নয়। বাবা আজ বাড়ি নেই।

২. প্রশ্নবোধক বাক্য :

যে ধরনের বাক্যে কোন কিছু জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে। যেমন : আপনি কোথা থেকে এসেছেন? রহিম তুমি কী কাল ঢাকা যাবে? সে কী আমাদের এখানে আসবে না? প্রশ্নবোধক বাক্য দু ধরনের হতে পারে। যথা: (ক) হ্যাঁ-না বাচক ও (খ) বস্তুগত প্রশ্ন।

(ক) হ্যাঁ-না বাচক :

যে ধরনের প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়েই শেষ করা যায়, তাকে হ্যাঁ-না বাচক প্রশ্নবাচক বাক্য বলে। যেমন : আপনি কী কখনো জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন? তুমি কী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়?

(খ) বস্তুগত প্রশ্নবোধক বাক্য :

যে ধরনের প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তরে হ্যাঁ-না দিয়েই শেষ হয় না। বিষয় বা বস্তুগত উত্তর করতে হয়, তাকে বস্তুগত প্রশ্নবোধক বাক্য বলে। যেমন : জাতীয় স্মৃতিসৌধটি কোথায়? তুমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়?

৩. অনুজ্ঞাবাচক বাক্য :

যে বাক্যে আদেশ, অনুরোধ, উপদেশ, নিষেধ,প্রস্তাব ইত্যাদি বোঝায়, তাকে অনুজ্ঞাবাচক বাক্য বলে। যেমন :
আদেশ—ঘর থেকে বের হয়ে যাও।
অনুরোধ—আমাকে ৫০টি টাকা ধার দাও।
উপদেশ—অযথা ঋণ করিও না।
নিষেধ—অনুমতি ছাড়া কখনো প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করবে না।
প্রস্তাব—চল, মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক দেখে আসি।

৪.ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য :

যে বাক্যে ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য বলে।যেমন-

ইচ্ছা— আমার যেতে ইচ্ছে করে গ্রামের বাড়িতে।
প্রার্থনা— খোদা তোমার মঙ্গল করুক।
উচ্ছ্বাস – ওহ, আমরা খেলায় জিতেছি।

৫. কার্যকারণাত্মক বাক্য :

যদ্যপি, যদি প্রভৃতি অব্যয়যোগে যে বাক্য গঠিত হয় এবং যাতে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রকাশ পায়, তাকে কার্যকারণাত্মক বাক্য বলে।
যেমন : দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কী মহীতে। (শর্ত)
মন দিয়ে লেখাপড়া না করলে পাস করা যায় না। (নিয়ম)
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। (স্বীকৃতি)

৬. সংশয়সূচক বা সন্দেহদ্যোতক বাক্য :

যে ধরনের নির্দেশক বাক্যে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে প্রকাশের জন্য সন্দেহ, সংশয়, সম্ভাবনা, অনুমান, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ভাব প্রকাশিত হয়, তাকে সংশয়সূচক বা সন্দেহদ্যোতক বাক্য বলে। এ ধরনের বাক্যে হয়ত, বুঝি, বুঝিবা, সম্ভবত, বোধ হয়, নাকী, নিশ্চয় প্রভৃতি সন্দেহসূচক ক্রিয়া বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। যেমন : লোকটাকে খারাপ বোধ হয়। হয়ত আসতে পারি, নয়তো নয়, তোমাকে চূড়ান্ত কথা দিচ্ছিনে। সম্ভবত আমিই একমাত্র ভালোবাসাহীন হতভাগ্য ব্যক্তি। মনে হয়, সুমন পাস করবে।

৭. আবেগসূচক বাক্য :

যে বাক্যে বিস্ময়, হর্ষ, ঘৃণা, শোক, ক্রোধ, ভয়, শোক ইত্যাদি প্রকাশ পায়, তাকে আবেগসূচক বাক্য বলে। যেমন :

বিস্ময়— কী ভয়ঙ্কর চেহারা।
হর্ষ– ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো।
ঘৃণা—ধিক তারে শত ধিক, নির্লজ্জ যেজন।
শোক–শোক সাগরে ভাসিয়ে বাবা ধরাধাম ত্যাগ করলেন।
ক্রোধ—এত বড় স্পর্ধা, তুমি আমার মুখের উপর কথা বল।
ভয়— ওরে বাপরে, আমি অন্ধকারে একেলা থাকতে পারব না।
আবেগ— বাহ, সুন্দর গান গাইলে তুমি!

গঠন অনুসারে বাক্যের প্রকারভেদ

১. সরল বাক্য :

যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা এবং একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন—গরু ঘাস খায়। বাক্যে যদি একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়াও থাকে এবং তা যদি একাধিক বাক্যকে যুক্তও করে আর যদি সমাপিকা ক্রিয়া একটি হয়, তাহলে বাক্যটি সরল বাক্য হবে। যেমন: রহিম খেতে খেতে গলায় বাধিয়ে পানি পান করলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সরল বাক্যে ক্রিয়াপদ উহ্য থাকতে পারে। যেমন : রহিম আমার ভাই।

২. জটিল বা মিশ্র বাক্য :

যে বাক্যে একটি প্রধান বাক্যাংশ এবং এক বা একাধিক অপ্রধান বাক্যাংশ থাকে, তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। প্রধান বাক্যাংশ অর্থ প্রকাশে স্বাধীন, কিন্তু অপ্রধান বাক্যাংশ অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বাক্যাংশের উপর নির্ভরশীল। জটিল বাক্যে দুটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে। যথা :

আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্য
যে পড়াশোনা করে, সে-ই ভাল ফলাফল করে।
সে যে পরীক্ষায় ফেল করেছে, তার মুখ দেখেই বুঝেছি।

খণ্ডবাক্য : একাধিক বাক্য নিয়ে জটিল বা যৌগিক বাক্য তৈরি হলে জটিল বা যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত প্রতিটি বাক্যকে খণ্ডবাক্য বলে। নিম্নে খণ্ডবাক্য দেখানো হল :
আমি জানি যে সে বাড়ি গেছে। এখানে ‘আমি জানি' ও ‘সে বাড়ি গেছে' দুটি খণ্ডবাক্য।
খণ্ডবাক্য দু প্রকার। ১. প্রধান খণ্ডবাক্য, ২. আশ্রিত খণ্ডবাক্য।

প্রধান খণ্ডবাক্য : বাক্যস্থিত যে খণ্ডবাক্য তার নিজের অর্থ প্রকাশে অন্য কোনো খণ্ডবাক্যের উপর গঠনগত দিক থেকে নির্ভর করে না, তাকে প্রধান খণ্ডবাক্য বলে। যেমন—আমরা যদি বলি : আমি অবাক হলাম তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে।

আশ্রিত খণ্ডবাক্য : বাক্যস্থিত যে খণ্ডবাক্য তার অর্থ সম্পূর্ণরূপে আর একটি প্রধান খণ্ডবাক্যের উপর নির্ভর করে, তাকে আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে। যেমন : আমি অবাক হলাম তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে।

৩. যৌগিক বাক্য :

দুই বা ততোধিক সরল বা জটিল বাক্য মিলিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত স্বাধীন বাক্যগুলো ও, এবং, কিন্তু, অথবা, নতুবা, অথচ, কিংবা, বরং প্রভৃতি অব্যয় দ্বারা যুক্ত থাকে। যেমন—চুপ করে শোন নতুবা চলে যাও। আমি মরব তবুও ভিক্ষা করব না। যৌগিক বাক্যের গঠন প্রকৃতি :
(ক) সরল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + সরল বাক্য
কায়সার হামিদ ভাল ফুটবলার আর তাঁর মা বিখ্যাত দাবারু।
খ) জটিল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + জটিল বাক্য
যখন তোমাকে ডেকেছি তখন আসনি কিন্তু যখন এলে তখন সব শেষ।
(গ) সরল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + জটিল বাক্য
তুমি বুদ্ধিমান কিন্তু তোমার সাথে যে এসেছিল সে বোকা।
(ঘ) জটিল বাক্য + সংযোজক অব্যয় + সরল বাক্য
যে অন্যায় করেছে সে মুক্ত হল কিন্তু শাস্তি পেল নির্দোষী ব্যক্তি।

বাক্য রূপান্তর

অর্থের কোন রূপ পরিবর্তন না করে এক প্রকারের বাক্যকে অন্য প্রকার বাক্যে রূপান্তর করার নামই বাক্য পরিবর্তন বা বাক্য রূপান্তর ।

(ক) সরল বাক্যকে জটিল বাক্যে রূপান্তর

সরল বাক্যকে মিশ্র বা জটিল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে নিম্নলিখিত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে :
১. অর্থের পরিবর্তন করা যাবে না।
২. সরল বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়া ও কর্তাকে পরিবর্তন করা যাবে না। তবে একে জটিল বাক্যের প্রধান উপবাক্য হিসেবে প্রকাশ করতে হবে।
৩. প্রধান উপবাক্যকে সাপেক্ষবাচক সর্বনাম দিয়ে সংযুক্ত করতে হবে।
৪. অপ্রধান উপবাক্যকে নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় দিয়ে সংযুক্ত করতে হবে।

নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় : বটে-কিন্তু, যেই-সেই, বরঞ্চ-তথাপি, হয়-নয়, এত- যে, যেমন-তেমন, একে-তায়, যদি-তবু, ও-ও, এরূপ-যে, যত-তত, যাই-তাই ইত্যাদি।
সাপেক্ষবাচক সর্বনাম : পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এক প্রকার সংযোগবাচক সর্বনামই হলো সাপেক্ষবাচক সর্বনাম। উদাহরণ : যে-সে, যিনি-তিনি, যাহা-তাহা, যাহার-তাহার, যতক্ষণ-ততক্ষণ ইত্যাদি। একটি অংশকে প্রধান বাক্য হিসেবে রেখে অপর অংশকে অপ্রধান বাক্যে পরিণত করতে হবে। এরপর নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয় বা সাপেক্ষবাচক সর্বনাম দ্বারা উভয় বাক্যকে যুক্ত করতে হবে।যেমন-
সরল : ঘাটে পৌঁছানোমাত্র স্টিমারটি ছেড়ে দিল।
জটিল : যেই ঘাটে পৌঁছলাম, অমনি স্টিমারটি ছেড়ে দিল।
সরল : অপরাধী বলে শাস্তি তুমি পাবেই।
জটিল : অপরাধ যখন করেছ, তখন শাস্তি তুমি পাবেই।
সরল : গিরিশিখর হইতে নির্ঝরিণী নামিলে, কে তাহার গতিরোধ করে?
জটিল : যখন গিরিশিখর হইতে নির্ঝরিণী নামে তখন কে তাহার গতিরোধ করে?

(খ) সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর

সরল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর করতে হলে নিম্নলিখিত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে :
১. সরল বাক্যের কর্তা ও সমাপিকা ক্রিয়া অপরিবর্তিত থাকবে।
২. সরল বাক্যের অসমাপিকা ক্রিয়া সম্প্রসারিত হয়ে নিরপেক্ষ উপবাক্যে পরিণত হবে।
৩. প্রধান উপবাক্যগুলোকে সংযোজক অব্যয় 'ও', 'আর', 'এবং' ইত্যাদি; বিয়োজক অব্যয় ‘বা', 'কিংবা' ‘অথবা' নচেৎ' এবং সংকোচক অব্যয় ‘কিন্তু, 'তবে', 'তথাপি'- ইত্যাদি সহযোগে পরস্পরকে সম্পৃক্ত করে নিতে হবে।
সুতরাং, সরল বাক্যকে জটিল বাক্যে রূপান্তরে সরল বাক্যের অন্তর্ভুক্ত কোনও একটি পদ বা পদ-সমষ্টিকে সম্প্রসারিত করে নিরপেক্ষ অপ্রধান বাক্যে বা খন্ডবাক্যে পরিণত করতে হবে। মূল বাক্যের সাথে প্রয়োজন মত সংযোজক-বিয়োজক অব্যয় ব্যবহার করতে হবে।যেমন-
সরল : তিনি ভরসা দিলেও আমার সাহস হল না ।
যৌগিক : তিনি ভরসা দিলেন, কিন্তু আমার সাহস হল না ।
সরল : ছাত্রদের সঙ্গত আপত্তি প্রধান শিক্ষককে মানতে হয়েছিল।
যৌগিক : ছাত্রদের আপত্তি ছিল সঙ্গত এবং তা প্রধান শিক্ষককে মানতে হয়েছিল।
সরল : দেশের অধিকাংশ লোকই লিখিত ভাষা বুঝিতে পারে না।
যৌগিক : দেশের অধিকাংশ লোকই বুঝিতে পারে না, এবং তাহা হইল লিখিত ভাষা ।

(গ) যৌগিক বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর

১. বাক্যসমূহের একটি সমাপিকা ক্রিয়াকে অপরিবর্তিত রাখতে হয়।
২. অন্যান্য সমাপিকা ক্রিয়াকে অসমাপিকা ক্রিয়ায় পরিণত করতে হয়।
৩. অব্যয় পদ থাকলে তা বর্জন করতে হয়।
৪. প্রধান খণ্ডবাক্যকে রেখে অন্য খণ্ডবাক্যকে সংকুচিত করতে হবে।
সুতরাং, যৌগিক বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে যৌগিক বাক্যের অন্তর্ভুক্ত প্রধান খণ্ডবাক্যটিকে ভিত্তি করে অন্য নিরপেক্ষ খণ্ডবাক্যকে সংকুচিত করে পদ বা পদসমষ্টিতে পরিণত করতে হবে এবং সংযোজক অব্যয়গুলো বর্জন করতে হবে। এ বাক্যে কেবল একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে। যেমন-

যৌগিক : আমরা বস্তিবাসী, কিন্তু লৌকিক ব্যাপারে আমরা অজ্ঞ নই।
সরল : বস্তিসী হলেও লৌকিক ব্যাপারে আমরা অজ্ঞ নই।
যৌগিক : সুনাম পেতে চাও, নামের প্রতি লোভ ছাড়।
সরল : সুনাম পেতে চাইলে নামের প্রতি লোভ ছাড় ।
যৌগিক : আমি অত্যন্ত দুর্বল, তাই কোন কাজ করতে পারছি না।
সরল : অত্যন্ত দুর্বলতাহেতু আমি কোন কাজ করতে পারছি না।

(ঘ) যৌগিক বাক্যকে জটিল বাক্যে রূপান্তর

যৌগিক বাক্যকে মিশ্র বা জটিল বাক্যে রূপান্তরিত করতে হলে কতগুলো নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।

১. বাক্যের অর্থ অপরিবর্তিত থাকবে।
২. প্রধান খণ্ড বাক্যগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া অন্যগুলোকে অপ্রধান খণ্ডবাক্যে পরিণত করতে হবে।
৩. নিরপেক্ষ বাক্য দুটির প্রথমটির আগে যদি/যদিও এবং দ্বিতীয়টির আগে তাহলে/তথাপিও বা তবুও ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
৪. নিরপেক্ষসূচক অব্যয়ের পরিবর্তে প্রয়োজনে সাপেক্ষসূচক অব্যয় ব্যবহার করা যাবে।

সুতরাং, যৌগিক বাক্যকে জটিল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যের মধ্যে একটি ছাড়া অপর বাক্য বা বাক্যগুলোকে অপ্রধান বাক্যে পরিণত করতে হবে এবং এগুলোকে নিরপেক্ষ না রাখার জন্য ‘যখন-তখন’, 'যদিও-তথাপি', 'যদি-তাহলে' ইত্যাদি সাপেক্ষসূচক অব্যয় ব্যবহার করতে হবে।যেমন-

যৌগিক : আমায় রক্ত দিন, আমি আপনাদের স্বাধীনতা এনে দেব।
জটিল : যদি আমাকে রক্ত দেন তবে আমি আপনাদের স্বাধীনতা এনে দেব।
যৌগিক : ক্ষান্ত হউন, নাহলে এই বর্শায় বিদ্ধ করিব।
জটিল : যদি ক্ষান্ত না হন তবে এই বর্শায় বিদ্ধ করিব।
যৌগিক : স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন জ্ঞানযোগী ও কর্মযোগী।
জটিল : স্বামী বিবেকানন্দ যিনি ছিলেন জ্ঞানযোগী, তিনিই ছিলেন কর্মযোগী।

(ঙ) জটিল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর

জটিল বাক্যকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর করতে হলে নিম্নলিখিত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে:

১. প্রধান স্বনির্ভর উপবাক্যটি যেন পরিবর্তিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
২. এক্ষেত্রে অপ্রধান উপবাক্যকে প্রধান স্বনির্ভর উপবাক্যে পরিণত করে। নিতে হবে।
৩. সংযোজক অব্যয় 'ও', 'আর' ইত্যাদি; বিয়োজক অব্যয় 'বা', 'কিংবা', ‘অথবা', 'নচেৎ' এবং সিদ্ধান্তমূলক অব্যয় 'সুতরাং', 'অতএব' ইত্যাদি যোগে স্বনির্ভর বাক্যগুলোকে সংযুক্ত করে নিতে হবে।

সুতরাং, জটিল বাক্য থেকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তর করতে হলে বাক্যের অন্তর্গত অপ্রধান খণ্ডবাক্যকে নিরপেক্ষ অপ্রধান খণ্ডবাক্যে রূপান্তরিত করে অব্যয়ের দ্বারা বাক্য দুটিকে যুক্ত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয় বা কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।যেমন-

জটিল : যেহেতু কোথাও পথ পেলাম না সেহেতু আপনার কাছে এসেছি।
যৌগিক : কোথাও পথ পেলাম না, তাই আপনার কাছে এসেছি।
জটিল : যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
যৌগিক : তোর ডাক শুনে কেউ না আসতে পারে, একলা চলতে হবে।
জটিল : যখন বড় ডাক্তার এসেছেন, তখন আর রোগীর জীবনশঙ্কা নেই।
যৌগিক : বড় ডাক্তার এসেছেন, এখন আর রোগীর জীবনশঙ্কা নেই ।

(চ) জটিল বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তর

মিশ্র বা জটিল বাক্যকে সরল বাক্যে রূপান্তরিত করতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় ।

১. বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত থাকবে।
২. মিশ্র বাক্যের অপ্রধান খণ্ডবাক্যটিকে সংকুচিত করে একটি পদ বা বাক্যাংশে রূপান্তরিত করতে হবে।
৩. প্রধান খণ্ডবাক্যটির কর্তা ও সমাপিকা ক্রিয়া অপরিবর্তিত থাকবে।
৪. মিশ্র বাক্যে যে সম্বন্ধসূচক অব্যয় অথবা সম্মানবাচক সর্বনাম পদ রয়েছে তাকে বিলুপ্ত করতে হবে।
৫. বাক্য সংকোচনের ক্ষেত্রে সমাস, প্রত্যয় অথবা ভিন্ন শব্দের সাহায্য গ্রহণ করা যাবে। প্রয়োজন হলে ন্যায়, মত, সদৃশ ইত্যাদি তুলনাবাচক শব্দ ব্যবহার করা যাবে।

সুতরাং, জটিল বা মিশ্র বাক্য থেকে সরল বাক্যে রূপান্তর করতে হলে জটিল বাক্যের অন্তর্গত অপ্রধান খণ্ডবাক্যকে সংকুচিত করে সমাসবদ্ধ পদ বা পদসমূহে পরিণত করতে হবে, সেই সঙ্গে বাক্যটিতে একটি কর্তা ও একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া রাখতে হবে। যেমন-

জটিল : যদিও এত টাকা পেলাম, তবুও অভাব মিটল না।
সরল : এত টাকা পাওয়া সত্ত্বেও আমার অভাব মিটল না ।
জটিল : যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা।
সরল : আর কেউ তোমায় ছাড়লেও আমি তোমায় ছাড়বো না মা ।
জটিল : যিনি পরের উপকার করেন, তাঁকে সকলেই শ্রদ্ধা করে।
সরল : পরের উপকারকারীকে সকলেই শ্রদ্ধা করে।

আরো পড়ুনঃ শব্দ প্রকরণ দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে ? দ্বিরুক্ত শব্দ কত প্রকার ও কি কি? পদ কাকে বলে? বাংলা পদের শ্রেণীবিভাগ এ টু জেড উপসর্গ মনে রাখার সহজ কৌশল

নবীনতর পূর্বতন