স্নেহ পদার্থ | Fat

স্নেহ বা চর্বিকে শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান বলা হয়। স্নেহ পদার্থে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। কার্বনের দহন ক্ষমতা বেশি থাকায় স্নেহ পদার্থের অণু থেকে বেশি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। স্নেহ পদার্থ ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারণের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগ। স্নেহ পদার্থ পরিপাক হয়ে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়। ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল ক্ষুদ্রান্ত্রের ভিলাইয়ের ভিতরে অবস্থিত লসিকা নালির মাধ্যমে শোষিত হয়। লিপিড বা স্নেহ পদার্থ পানিতে অদ্রবনীয় কিন্তু জৈব দ্রাবক যেমনঃ ইথার, ক্লোরোকরম, বেনজিন ইত্যাদিতে দ্রবনীয়।

 স্নেহ পদার্থ

চর্বি জাতীয় এসিড

দেহে যকৃতের মধ্যে চর্বি জাতীয় এসিড তৈরি হয়। তবে যকৃতের চর্বি জাতীয় এসিড তৈরির ক্ষমতা অত্যন্ত কম। অন্যদিকে কিছু কিছু চর্বি জাতীয় এসিড আছে যা দেহের জন্য অত্যাবশ্যক। এগুলো প্রধানত উদ্ভিজ্জ তেলে পাওয়া যায়। খাদ্যে স্নেহ পদার্থের পরিমাণ দ্বারা এর উপকারিতা যাচাই করা যায় না। যে স্নেহ জাতীয় খাদ্যে অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড বেশি থাকে তা বেশি উপকারী। যেমন- সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, তিলের তেল, ভুট্টার তেল ইত্যাদি। এসব তেল দিয়ে তৈরি খাবার উৎকৃষ্টতর স্নেহ জাতীয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- মেয়নিজ, সালাদ ড্রেসিং, কাসুন্দি, তেলের আচার ইত্যাদি উৎকৃষ্টতর স্নেহ জাতীয় খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। যেসব খাদ্যে সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড বেশি থাকে সে সকল খাদ্যগুলোকে স্নেহবহ্বল খাদ্য বলা হয়। যেমন- মাংস, মাখন, পনির, ডালডা , চকলেট, বাদাম ইত্যাদি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে দৈনিক মোট শক্তির ২০%-৩০% শক্তি স্নেহ থেকে পাওয়া যায়। দৈনিক আহার্যে এমন স্নেহযুক্ত খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা অত্যাবশ্যকীয় চর্বি জাতীয় এসিড যোগাতে পারে এবং ভিটামিন দ্রবণে সক্ষম হয়।

স্নেহ পদার্থে ২০ প্রকার চর্বি জাতীয় এসিড পাওয়া যায়। চর্বি জাতীয় এসিড দুই প্রকার। যথা- ১. অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড ও ২. সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড।

অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড: যে চর্বি জাতীয় এসিড বা ফ্যাটি এসিডে কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন থাকে তাকে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বা অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড বলে। যেমন: অলিক এসিড, লিনোলিক এসিড ইত্যাদি।

সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড : যে চর্বি জাতীয় এসিড বা ফ্যাটি এসিডে কার্বন-কার্বন একবন্ধন বিদ্যমান, তাকে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বা সম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় এসিড বলে। যেমনঃ পামিটিক এসিড, স্টিয়ারিক এসিড ইত্যাদি।

অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড

যেসব ফ্যাটি এসিড আমাদের দেহে তৈরি হতে পারে না, অথচ দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাদের অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড বলে। এসব ফ্যাটি এসিডকে খাদ্যের মাধ্যমে দেহে সরবরাহ করতে হয়। অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড ৩টি। যথা-

নাম উৎস
১. লিনোলিক এসিড ডিমের কুসুম, বাদাম, সয়াবিন তেল ইত্যাদি
২. লিনোলেনিক এসিড মাছের তেল, যকৃত ইত্যাদি
৩. অ্যারাকিডোনিক এসিড যকৃতের তেল

উৎস

উৎস অনুযায়ী স্নেহপদার্থ দুই ধরনের, উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ এবং প্রাণিজ স্নেহপদার্থ ।

উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ: সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী এবং ভুট্টার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল উৎকৃষ্টতম।

প্রাণিজ স্নেহপদার্থ: চর্বি, ঘি, ডালডা ইত্যাদি প্রাণিজ স্নেহপদার্থ। ডিমের কুসুমে স্নেহপদার্থ আছে, কিন্তু সাদা অংশে স্নেহপদার্থ থাকে না। স্নেহপদার্থ পানিতে অদ্রবণীয়। পানির চেয়ে হালকা বলে পানির উপর ভাসে। একজন সুস্থ সবল পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দিনে 50-60 গ্রাম চর্বির প্রয়োজন হয়।

স্নেহ পদার্থ এর কাজ

  • খাদ্যবস্তুর মধ্যে স্নেহ পদার্থ সবচেয়ে বেশি তাপ ও শক্তি উৎপন্ন করে।
  • দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য স্নেহ পদার্থ অতি আবশ্যক।
  • স্নেহপদার্থ দেহ থেকে তাপের অপচয় বন্ধ করে এবং ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য ভান্ডার হিসেবে কাজ করে।
  • ত্বকের মসৃণতা ও সজীবতা বজায় রাখে এবং চর্মরোগ প্রতিরোধ করে।
  • যেসব ভিটামিন (এ, ডি, ই এবং কে) স্নেহ জাতীয় পদার্থে দ্রবণীয়, সেগুলো শোষণে সাহায্য করে।

অভাবজনিত রোগ ও প্রতিকার

খাদ্যে স্নেহ পদার্থের অভাব ঘটলে দেহের চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের অভাব পরিলক্ষিত হয় ফলে ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ দেখা দেয়। যেমন-

  • স্নেহ পদার্থের অভাবে চর্মরোগ, একজিমা ইত্যাদি দেখা দেয়। ত্বক শুষ্ক এবং খসখসে হয়ে সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
  • দীর্ঘদিন স্নেহ পদার্থের অভাব হলে শরীরে সঞ্চিত প্রোটিন ক্ষয় হয় এবং দেহের ওজন কমে যায়।
  • শরীরের অতিরিক্ত স্নেহ পদার্থ জমা হলে দেহের রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে এবং এ কারণে মেদবহুল দেহে রোগ আক্রমণ করে।

কোলেস্টেরল

এক ধরনের স্নেহ জাতীয় পদার্থ। গরুর মাংস, খাসির মাংস, ডিমের কুসুম, কলিজা, মগজ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে। কোলেস্টেরল হলো এক ধরনের প্রাণিজ স্টেরল। স্টেরল হলো উদ্ভিজ্জ তেল ও প্রাণিজ চর্বি। এগুলো দানাদার যৌগ এবং কাঠামোতে একটি হাইড্রোক্সিল গ্রুপ আছে। স্টেরলগুলোকে কঠিন বা অসম্পৃক্ত অ্যালকোহল বলা হয়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে কোলেস্টেরল ধমনী গাত্রের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে একে Atherosclerosis বলে। এতে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট এটাক, হার্ট ফেইলর প্রভৃতি রোগের আংশকা বেড়ে যায়। রক্তকে পাতলা করে কোলেস্টেরল কমায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। মানবদেহে HDL ও LDL-এ দু'ধরনের কোলেস্টরল পাওয়া যায়। এদের মধ্যে HDL (High Density Lipid) মানব দেহের জন্য ভালো। অপরদিকে LDL (Law Density Lipid) উচ্চ বক্তচাপের জন্য দায়ী। ধমনি গাত্রে বা প্রাচীরে ফাটলের জন্যও এটি দায়ী। প্রাণিদেহের প্রধান অসম্পৃক্ত অ্যালকোহল (Steriod alcohol) হলো কোলেস্টেরল। দুই ধরনের প্রধান কোলেস্টরল হলো HDL ও LDL । VLDL-নামে অপর একটি কোলেস্টেরলে লিপিডের Density খুব কম (Very Low Density Lipid) ।

জাঙ্ক ফুড

জাঙ্ক ফুড হচ্ছে এমন এক ধরনের খাবার, যা এর স্বাস্থ্যগত মূল্যের চেয়ে বরং মুখরোচকতার জন্য উৎপাদন করা হয়। এটা খাওয়া খুব মজাদার এবং আবেদনময় কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এতে এমন অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা এ কে সুস্বাদু করে তোলে কিন্তু এগুলো অস্বাস্থ্যকর। এতে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে প্রাণিজ চর্বি ও চিনি থাকে। বার্গার, পিৎজা, ক্রিসপস (মচমচে ভাজা খাবার), পিঠা ও বিস্কুটে প্রাণিজ চর্বি উচ্চমাত্রায় থাকে। মিষ্টি, কোলা ও লেমনের এর মত গ্যাসীয় বুদবুদযুক্ত পানীয় চিনির দিক দিয়ে উচ্চমাত্রার। আমরা যখন অধিক পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাবার খাই, তখন আমাদের দেহ এগুলোকে রূপান্তরিত করে এবং অধিক পরিমাণ চিনি আমাদের দাঁত ও ত্বককে নষ্ট করে দিতে পারে।

তথ্য কণিকা

  • ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারিনের সমন্বয়ে স্নেহ পদার্থ গঠিত হয়।
  • আমাদের খাবারে প্রায় ২০ ধরণের ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়।
  • কঠিন স্নেহ পদার্থগুলোকে চর্বি বলে। চর্বি হল সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। যেমন: মাছ বা মাংসের চর্বি।
  • যেসব স্নেহ পদার্থ তরল, সেগুলোকে তেল বলে। তেল হল অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। সাধারণ তাপমাত্রায় এগুলো তরল থাকে। যেমন- সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি।
  • চর্বি জাতীয় খাদ্য পাকস্থলীতে অনেকক্ষণ থাকে, তাই তখন ক্ষুধা পায় না।
  • দেহের ত্বকের নিচে চর্বি জমা থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- যকৃৎ, মস্তিষ্ক, মাংসপেশিতে ও চর্বি জমা থাকে। দেহের এই সঞ্চিত চর্বি উপবাসের সময় কাজে লাগে।
  • শর্করা ও আমিষের তুলনায় চর্বিতে প্রায় দ্বিগুন পরিমান ক্যালরি থাকে। (ক্যালরি হল প্রাণীদেহে শক্তি মাপার একটি একক)
  • দেহাভ্যন্তরে ক্ষুদ্রান্তের যে খাদ্য বেশি শোষিত হয়------ স্নেহ জাতীয়।
নবীনতর পূর্বতন