পত্র লিখন || পত্র লেখার নিয়মাবলী

পত্র লিখন অধ্যায়টি আসলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার জন্য । অন্যান্য পরীক্ষায় ও এই অধ্যায় থেকে প্রশ্ন এসে থাকে তবে তা খুব কম। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পত্রলিখনের গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের কোন না কোন পত্র লিখতে হয়। তাই আজ আমরা পত্র লিখনের এ টু জেড জানার চেষ্টা করব।

পত্র বা চিঠি কাকে বলে ?

'পত্র' শব্দটির আভিধানিক বা ব্যবহারিক অর্থ স্মারক বা চিহ্ন । কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে মানবমনের কোনো ভাব, সংবাদ, তথ্য, আবেদন ইত্যাদি অপরের কাছে লিখিতভাবে জানানো হলে, তাকে সাধারণভাবে পত্র বা চিঠি বলে। সুন্দর, শুদ্ধ চিঠির মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে । সুলিখিত চিঠি অনেক সময় উন্নত সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছিন্নপত্র'।

পত্র/ চিঠি লিখার সাধারণ নিয়ম

ক. চিঠির প্রকাশভঙ্গি আকর্ষণীয় হতে হবে। এর জন্য সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় চিঠি লিখতে হবে।
খ. পত্রে কোনো কঠিন শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। ভাষাপ্রয়োগে শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে।
গ. হাতের লেখা যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে।
ঘ. চিঠির বক্তব্য হবে সুস্পষ্ট। পত্রে অনাবশ্যক কিংবা অতিরঞ্জিত কোনোকিছু না লেখাই ভালো।
ঙ. চিঠি লেখার পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। খামে নাম ঠিকানা স্পষ্টাক্ষরে লিখতে হবে।

পত্র বা চিঠির কয়টি অংশ ?

একটি চিঠি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। যথা: ১. শিরোনাম ২. পত্রগর্ভ।

১. শিরোনাম: এর প্রধান অংশ প্রাপকের ঠিকানা । এই অংশে চিঠির খামের ওপর বামদিকে প্রেরকের ঠিকানা ও ডান দিকে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে হয়। বর্তমানে সরকারি পোস্ট অফিসে প্রাপ্ত খামের সামনের অংশে প্রাপকের ঠিকানা লেখার নির্দিষ্ট ছক এবং পেছনের অংশে প্রেরকের ঠিকানা আলাদা ছাপানো ছক রয়েছে। ‘লেফাফা' শব্দের অর্থ- খাম বা চিঠিপত্রের উপরের আবরণবিশেষ; এতে ডাকটিকেট লাগানো হয়। পোস্টাল কোড পোস্ট অফিসের নাম নির্দেশ করে। প্রবাসী বন্ধুকে লেখা পত্রের ঠিকানা ইংরেজি ভাষায় লিখতে হবে। পূর্ণ ও স্পষ্ট ঠিকানার অভাবে চিঠিপত্র গুলোকে 'ডেড লেটার' বলা হয় ।

২. পত্রগর্ভ : এটি হচ্ছে চিঠির ভেতরের অংশ। পত্রের মূল বিষয়কে পত্রের গর্ভাংশ বলা হয়। বিষয়বস্তু, প্রসঙ্গ ও কাঠামো অনুসারে বিভিন্ন ধরনের পত্রকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা যায। যেমন-

১. ব্যক্তিগত চিঠি
২. আবেদনপত্র বা দরখাস্ত
৩. সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি
৪. মানপত্র ও স্মারকলিপি
৫. বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িকপত্র
৬. আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণপত্র

১. ব্যক্তিগত চিঠি

ব্যাক্তিগত চিঠির কাঠামো

ব্যক্তিগত চিঠির কাঠামোতে ছয়টি অংশ থাকে । যথা :

ক. মঙ্গলসূচক শব্দ

এককালে ব্যক্তিগত চিঠির প্রথমে কাগজের পৃষ্ঠার মাঝামাঝি জায়গায় পত্রলেখক মঙ্গলসূচক শব্দ লিখতেন। আজকাল ব্যক্তিগত চিঠিতে এগুলো আর লেখা হয় না।

খ. স্থান ও তারিখ

ব্যক্তিগত পত্রের ওপরের ডানদিকে তারিখ এবং যে স্থানে বসে পত্র লেখা হচ্ছে তার নাম লিখতে হয়।

গ. সম্বোধন

পত্র লেখার শুরুতে পত্রের বামদিকে প্রাপকের সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী সম্বোধন বা সম্ভাষণ লিখতে হয়। পত্রদাতার সঙ্গে প্রাপকের সম্পর্ক অনুসারে এবং পত্র-প্রাপকের মান, মর্যাদা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা অনুযায়ী সম্বোধনসূচক শব্দ নির্বাচন করতে হয়। যেমন-

ব্যক্তিগত পত্রের সম্ভাষণ রীতি

ব্যক্তিগত পত্রের সম্ভাষণ রীতি
মূল শব্দ সম্ভাষিত শব্দ
শ্রদ্ধাভাজন শ্রদ্ধাস্পদেষু, পরম শ্রদ্ধাভাজন, মাননীয়, মান্যবরেষু, মান্যবর, শ্রদ্ধাভাজনেষু ইত্যাদি।
শ্রদ্ধাভাজন (মহিলা) মাননীয়া, মাননীয়াসু, শ্রদ্ধেয়া, শ্রদ্ধাস্পদাসু ইত্যাদি।
সমবয়স্ক প্রিয়জন/বন্ধু (পুরুষ) বন্ধুবরেষু, অভিন্নহৃদয়েষু, প্রিয়বরেষু, প্রিয়, প্রিয়বর, বন্ধুবর, সুপ্রিয়, সুহৃদবরেষু, প্রীতিভাজনেষু ইত্যাদি।
সমবয়স্ক প্রিয়জন/বন্ধু (মহিলা) সুচরিতাসু, প্রীতিভাজনীয়াসু, প্রীতিলিয়াসু, সুহৃদয়াসু ইত্যাদি
বয়ঃকনিষ্ঠ (ছেলে) কল্যাণীয়, কল্যণীয়েষু, স্নেহাস্পদেষু, স্নেহভাজনেষু, স্নেহের, প্রীতিভাজনেষু, প্রীতিনিলয়েষু ইত্যাদি।
বয়ঃকনিষ্ঠ (মেয়ে) কল্যাণীয়া, কল্যাণীয়াসু, স্নেহের, স্নেহভাজনীয়া, স্নেহভাজনীয়াসু ইত্যাদি।

ঘ. মূল পত্রাংশ (মূল বক্তব্য)

পত্র লেখার সময় পত্রের বক্তব্য ও বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এই অংশে পত্রলেখকের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতি, ঔৎসুক্য ইত্যাদি লিখতে হয়। পত্র-সমাপ্তিসূচক অভিব্যক্তির পর বিদায় সম্ভাষণ হিসেবে পত্র-প্রাপকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। স্থান, কাল, পাত্রভেদে পত্র-প্রাপকের সঙ্গে সম্পর্ক অনুসারে বিশেষণ ব্যবহারে পার্থক্য দেখা যায়। বিদায় সম্ভাষণ সাধারণত পত্রের ডানদিকে লিখতে হয়। যেমন-

ব্যক্তিগত পত্রের বিদায় সম্ভাষণ

ব্যক্তিগত পত্রের বিদায় সম্ভাষণ
মূল শব্দ সম্ভাষিত শব্দ
প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন (পুরুষ) স্নেহভাজন, স্নেহধন্য, স্নেহাকাড়ী, প্রীত্যর্থী, গুণমুগ্ধ, প্রণত, প্রীতিধণ্য, প্রীতিস্নিগ্ধ ইত্যাদি।
প্রাপক শ্রদ্ধাভাজন (পত্রলেখক পুরুষ) স্নেহধন্যা, প্রণতা, বিনীতা, গুণমুগ্ধা প্রীতিধন্যা, প্রীতিস্নিগ্ধা ইত্যাদি ।
প্রাপক বয়সে ছোট হলে আশীর্বাদিক, আশীর্বাদিকা, শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ী ইত্যাদি।
প্রাপক অনাত্মীয় সম্মানীয় লোক (পত্রলেখক পুরুষ) নিবেদক, ভবদীয়, বিনীত, বিনয়াবনত ইত্যাদি।
(পত্রলেখক মহিলা) নিবেদিকা, বিনীতা, বিনয়াবনত ইত্যাদি ।
প্রাপক বন্ধুস্থানীয় বা প্রিয়ভাজন (পত্রলেখক পুরুষ) প্রীতিধন্য, প্রীতিমুগ্ধ, অভিন্নহৃদয়, আপনারই, তোমারই ইত্যাদি।
(পত্রলেখক মহিলা) প্রীতিধন্য, প্রীতিমুগ্ধ, অভিন্নহৃদয়া ইত্যাদি ।

ঙ. নাম-স্বাক্ষর (পত্রলেখকের স্বাক্ষর)

নাম-স্বাক্ষর চিঠির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই চিঠির শেষে অবশ্যই স্বাক্ষর করতে হয়।

চ. শিরোনাম

পত্র পাঠাবার খামের উপর লিখতে হয়। খামের উপর বাম দিকে পত্রলেখকের (প্রেরক) ঠিকানা এবং ডান দিকে পত্র প্রাপকের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা স্পষ্টভাবে লিখতে হয়। খামের উপরে ডান কোণে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মূল্যের ডাক টিকিট লাগাতে হয় । আজকাল বড় বড় পোস্ট অফিসে ডাক টিকিটের পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে খামের উপর ছাপ মারার ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

অন্যান্য পত্র / দরখাস্ত

২. আবেদনপত্র বা দরখাস্ত : যে পত্র চাকরির জন্য লিখতে হয় তার নামই আবেদনপত্র। অর্থাৎ সুযোগ-সুবিধা প্রার্থনা করে কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত পত্রের নাম আবেদনপত্র ।

৩. সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য চিঠি: সংবাদপত্র একটি আবেদন প্রকাশের জন্য সম্পাদকের বরাবর পাঠাতে হয়। বিজ্ঞপ্তি হলো- সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য নিখোঁজ সংবাদ ।

৪. মানপত্র ও স্মারকলিপি: অভিনন্দন বা সংবর্ধনা পত্রকে মানপত্র বা স্মারকলিপি বলা হয়।

৫. বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িকপত্র: বাণিজ্যিক পত্রে বিষয়ের স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।

৬. আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণপত্র: আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে যে দাওয়াত পত্র, তাকে নিমন্ত্রণপত্র বলে ।

৭. দলিল বা চুক্তিপত্র : বৈষয়িক ব্যাপারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আইনানুসারে লিখিত পত্রকে দলিলপত্র বা চুক্তিপত্র বলে ।

নবীনতর পূর্বতন