![]() |
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য |
আমাদের আজকের টপিক বাংলা ভাষার রীতি। আমার মনে হয় এই প্রসঙ্গটি নিয়ে প্রশ্ন করলেই সবাই এক বাক্যে বলে দিবে সাধু ও চলিত। অর্থাৎ খুব কমন টপিক, তাই না? কিন্তু আমি এমন ও দেখেছি বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অনেক পরীক্ষার্থীই এই টপিকে ও ভুল করে বসেন। আপনারা বলতে পারেন এটা হেয়ালী ভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু না এটা আসলে জানার অভাবের কারণেই হয়ে থাকে।আর তাই আজ আমরা সাধু ও চলিত কি এবং সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য এ টু জেড জানার চেষ্টা করব। সেই সাথে বাংলা ভাষা সম্পর্কে ও যৎসামান্য জানব । তা না হলে বিষয়টা পুরোপুরি অনুধাবন এবং হৃদয়ঙ্গম করতে পারব না।চলুন তাহলে শুরু করা যাক আমাদের আজকের বিষয়টির আদ্যোপান্ত।
পরিচ্ছেদসমূহ
বাংলা ভাষা
মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কত কিছুই না করে, তাই না? কখনো অঙ্গভঙ্গি, কখনো ইশারা, ইঙ্গিত আবার কখনো বা কন্ঠধ্বনির সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনির সমষ্টি। কন্ঠধ্বনি ছাড়া বাকি সবকিছু যেমন হাত,পা, মুখ এবং চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ ইঙ্গিত করে থাকে।কন্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ততটা পারে না।কন্ঠধ্বনি বলতে মুখগহ্বর,কন্ঠ,নাক,ঠোট ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টিকে বোঝায়।এই ধ্বনির সাহায্যে ভাষার সৃষ্টি হয়। বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে।আর তাই ভাষার সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি “মনের ভাব প্রকাশের জন্য, বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে। ভাষার মূল উপাদান ধ্বনি। তবে ভাষার মেীলিক উপাদান শব্দ। এখানে মনে রাখতে হবে মূল উপাদান এবং মৌলিক উপাদান । মেীলিক উপাদান শব্দ কারণ শব্দেই প্রথম অর্থের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়।ভাষার প্রধান উদ্দেশ্য যেহেতু অর্থবাচকতা প্রকাশ করা,সেহেতু শব্দ ভাষার মেীলিক উপাদান। প্রত্যেক ভাষারই ৪টি মেীলিক অংশ থাকে।যথা: ক.ধ্বনি খ.শব্দ গ.অর্থ ঘ.বাক্য। দেশ,কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে।ভাষা ও ব্যাকরণের মধ্যে ভাষা আগে সৃষ্টি হয়েছে।মূলত ভাষাকে শাসন করার জন্যই ব্যাকরণের সৃষ্টি। বাংলাদেশ ছাড়া ও পশ্চিমবঙ্গ,ত্রিপুরা,বিহার,উাড়ষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষাবাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ হল অর্থদ্যোতকতা,মানুষের কন্ঠনিঃসৃত ধ্বনি এবং জনসমাজে ব্যবহারের যোগ্যতা। বাক্য ভাষার মূল উপকরণ।কারণ একটি সম্পূর্ণ বাক্যই ভাষার প্রাণ।বাক্য ব্যতীত ভাষা প্রাণহীন।
বাংলা ভাষারীতি- সাধু ও চলিত ভাষা
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য জানার আগে আমরা সাধু ও চলিত ভাষা কী তা ভাল ভাবে জানব।আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলা ভাষার মৌলিক রূপ কয়টি? তখন কি উত্তর দিবেন? হয়ত বলবেন সাধু ও চলিত রীতি।কিন্তু না বাংলা ভাষার মৌলিক রূপ হচ্ছে দুইটি। যথা: ১. মৌখিক বা কথ্য (চলিত ও আঞ্চলিক বা উপভাষা) ও ২. লৈখিক বা লেখ্য (সাধু ও চলিত)। বাংলা ভাষার মেীখিক রুপ আবার দুই ধরনের যথা চলিত ভাষা ও আঞ্চলিক বা উপভাষা। লৈখিক রুপ ও আবার দুই ধরনের যথা সাধু ও চলিত। সাধু ও চলিত হচ্ছে বাংলা ভাষার রীতি। সাধু ভাষা প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের শুরু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সাধু ভাষা ছিল সাহিত্যিক ও কৃত্রিম ভাষা। সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন ভাষাকে সাধু ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে সাধু রীতির ব্যাপক প্রচলন ছিল। রাজা রামমোহন রায় প্রথম সাধু ভাষার প্রয়োগ করেন।সাধু ভাষার সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায় যে ভাষা রীতিতে ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের পূর্ণরুপ ব্যবহার করা হয় তাকে সাধু ভাষা বলে। সাধারণত সাধু ভাষায় ক্রিয়া ও সর্বনাম পদগুলো দীর্ঘতর হয়।সহজে আমরা এই জিনিসটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকি সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য।যা মোটে ও কাম্য নয়।প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শনে সাধুভাষার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বাংলা সাহিত্যে 'চলিত ভাষা'র প্রচলন শুরু হতে থাকে। তৎকালীন সময়ের কিছু গদ্যলেখক পণ্ডিতি সাহিত্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে আপামর জনসাধারণের ‘কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন এবং সফল হন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রমথ চৌধুরী। তিনিই প্রথম চলিত ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন এবং 'সবুজপত্র' (১৯১৪) সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে চলিত রীতিকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেন। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে চলিত ভাষা বলে। চলিত ভাষার আদর্শরূপ থেকে গৃহীত ভাষাকে বলা হয় প্রমিত ভাষা। চলিত ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রমিত উচ্চারণ।কলকাতা অঞ্চলের মেীখিক ভাষাকে ভিত্তি করে চলিত ভাষা গড়ে উঠেছে। চলিত ভাষারীতির প্রবর্তনে প্রমথ চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। আঞ্চলিক ভাষা কী? বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বলে। আঞ্চলিক ভাষার অপর নাম উপভাষা। আক্ষরিক অর্থে উপভাষা বলতে ‘ভাষা'র চেয়ে একটু নিম্ন বা কিছুটা কম মর্যাদাসম্পন্ন ভাষাকে বোঝায়। পৃথিবীর সব ভাষারই উপভাষা আছে। বাংলা ভাষার উপভাষা মোট ৫টি। যথা:
ক. রাঢ়ি (পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গ),
খ. ঝাড়খণ্ডি (দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গ, সিংভূম, মানভূম, পুরুলিয়া অঞ্চল)
গ. বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ),
ঘ. বঙ্গালি (পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ, বাংলাদেশ) ও
ঙ. কামরুপি ( উত্তর-পূর্ববঙ্গ,কোচবিহার,কাছাড়)
সাধু রীতি ও চলিত ভাষার পার্থক্য
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
---|---|
সাধু রীতি ব্যাকরণের নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে এবং এর পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত | চলিত রীতি পরিবর্তনশীল |
এ রীতি গুরুগম্ভীর ও তৎসম শব্দবহুল | এ রীতি তদ্ভব শব্দবহুল |
সাধু রীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতায় অনুপযোগী | এ রীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতায় উপযোগী |
এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক বিশেষ গঠন পদ্ধতি মেনে চলে | এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ পরিবর্তিত ও সহজতর রূপ লাভ করে |
সর্বনাম, ক্রিয়া ও অনুসর্গের পূর্ণরূপ ব্যবহার করা হয় | সর্বনাম, ক্রিয়া ও অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয় |
সাধু ভাষায় ধ্বন্যাত্নক শব্দের প্রাধান্য নেই | চলিত ভাষায় ধ্বন্যাত্নক শব্দের প্রাধান্য আছে।যেমন-হনহন,ঝনঝন,গনগনে ইত্যাদি। |
সাধু ও চলিত ভাষার বিভিন্ন পদের রূপভেদ
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
---|---|
বিশেষ্য পদ | |
জুতা | জুতো |
জোসনা/জ্যোৎস্না | জোছনা |
তুলা | তুলো |
পূজা | পূজো |
মস্তক | মাথা |
সুতা | সুতো |
সর্প | সাপ |
হস্ত | হাত |
বিশেষণ পদ | |
কিয়ৎক্ষণ | কিছুক্ষণ |
বন্য | বুনো |
রঙ্গিন | রঙিন |
সাতিশয় | অত্যন্ত |
শুষ্ক/শুকনা | শুকনো |
সর্বনাম পদ | |
উহা | ওটা |
তাহাকে | তাকে |
তাঁহার | তাঁর |
তাঁহারা | তাঁরা |
অব্যয় (অনুসর্গ) | |
অপেক্ষা | চেয়ে |
পূর্বেই | আগেই |
সহিত | সাথে |
হইতে | হতে |
দ্বারা | দিয়ে |
নিমিত্ত | জন্য/জন্যে |
ব্যতীত | ছাড়া |
ক্রিয়া পদ | |
আসিয়া | এসে |
করিল | করল |
করিয়া | করে |
খুলিয়া | খুলে |
দেন নাই | দেন নি |
হউক | হোক |
দেখিয়া | দেখে |
পড়িল | পড়ল |
পড়িয়াছেন | পড়েছেন |
ফুটিয়া | ফুটে |
রহিয়াছে | রয়েছে |
হইয়া | হয়ে |
লিখা | লেখা |
সাধু ও চলিত ভাষার বাক্যে প্রয়োগ
সাধু ভাষায় | চলিত ভাষায় |
---|---|
যে কথা একবার জমিয়ে বলা গিয়াছে, তাহার পর তা ফেনাইয়া ব্যাখ্যা করা চলে না’ । | যে কথা একবার জমে বলা গেছে, তার পর তা ফেনিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না । |
অতঃপর তাহারা চলিয়া গেল । | তারপর তারা চলে গেল । |
এইরূপ সাদৃশ্য অনেক চক্ষে পড়িবে। | এরকম সাদৃশ্য অনেক চোখে পড়বে। |
সে আসিবে বলিয়া ভরসাও করিতেছি না। | সে আসবে বলে ভরসাও করছি না। |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন