যকৃতের রোগ | liver disease

যকৃত আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। যকৃতের রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে সংক্রমণ, অ্যালকোহল পান, অটোইমিউন রোগ এবং ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

পিত্তথলির প্রদাহ হয় কেন

পিত্তরসের রাসায়নিক উপাদানসমূহের হেরফের ঘটলে এর ঘনত্ব বেশি হয়। পিত্তরসের প্রবাহে আংশিক বা পুরো বাধার ফলেও এ রকম হতে পারে। ফলে পিত্তথলিতে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন অনুজীবের সংক্রমণ ঘটে যা পিত্তনালী দিয়েও যকৃতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো পিত্তথলি ফুটো হয়ে যায় এবং পেরিটোনাইটিস হয়। অনেক ক্ষেত্রে অন্ত্রের সঙ্গে সংযোগনালী সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন কিংবা বার বার প্রদাহের ফলে ক্রণিক কোলেসিয়াইসিস বা দীর্ঘকালীন পিত্তথলির প্রদাহের সৃষ্টি হয় ফলে পিত্তথলির দেয়াল পুরু হয় ও কুঁচকে যায়। এতে পিত্তথলির স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যহত হয়।

হেপাটাইটিস

যকৃতের আরেক নাম হেপাটিকা। যকৃতের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলা হয়। ভাইরাসের আক্রমণে যকৃতের কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে হেপাটাইটিস বলে। হেপাটাইটিস-বি অত্যন্ত মারাত্মক। এ রোগে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

হেপাটাইটিসের কারণ:

ক) হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী জীবাণুঃ হেপাটাইটিস প্রধানত পাঁচ প্রকারের হেপাটাইটিস ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে। যথাঃ

  • হেপাটাইটিস-এ,
  • হেপাটাইটিস-বি,
  • হেপাটাইটিস-সি,
  • হেপাটাইটিস-ডি
  • হেপাটাইটিস-ই

এছাড়া সাইটোমেগালো ভাইরাস ও হার্পিস ভাইরাসের কারণেও হেপাটাইটিস হয়ে থাকে।

খ) অন্যান্য কারণ: অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক সেবন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ও ম্যালেরিয়া জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হলে যকৃতের কোষগুলোর অতিমাত্রায় ভাঙ্গনের ফলে হেপাটাইটিস সৃষ্ট হয়। এছাড়াও কোনো কারণে পিত্তনালী অবরুদ্ধ বা বন্ধ হয়ে গেলেও Obstructive হেপাটাইটিস দেখা দেয়।

  • রক্তের মাধ্যমে সংক্রমিত হেপাটাইটিস ভাইরাস : হেপাটাইটিস-বি ও হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস
  • খাদ্যের মাধ্যমে সংক্রমিত হেপাটাইটিস ভাইরাস : হেপাটাইটিস-এ ও হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস

মা এর রক্তে হেপাটাইটিস-বি (Hepatitis-B) ভাইরাস থাকলে নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কি হওয়া উচিত?

উত্তর: জন্মের ১২ ঘন্টার মধ্যে ভ্যাকসিন ও এইচ বি আই জি (HBIG) শট দিতে হবে।

ক্রনিক হেপাটাইটিস রোগের চিকিৎসায় কি ঔষধ ব্যবহৃত হয়: ইন্টারফেরন, ল্যামিভিউডিন।

জন্ডিস

রক্তের বিলিরুবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ হলো প্রতি মিলি রক্তে ০.২ মিগ্রা থেকে ০.৮ মিগ্রা। এ পরিমাণ যখন বেড়ে যায় তখন শরীর ও চোখ হলুদ বর্ণ ধারণ করে, যা জন্ডিস নামে পরিচিত।

লক্ষণ:

  1. শরীর ম্যাজম্যাজ করা
  2. মাথা ব্যথা করা এবং শীত ভাব অনুভব করা
  3. হঠাৎ করে বমি বমি ভাব অনুভব করা
  4. ক্ষুধামন্দা হওয়া এবং দূর্বলতা অনুভব করা
  5. বমি ও পাতলা পায়খানা হওয়া এবং পায়খানার রং সাদাটে হওয়া
  6. যথেষ্ট পানি পান করা সত্ত্বেও চোখ, ত্বক ও প্রস্রাব হলুদ বর্ণের হওয়া
  7. ডান দিকে পাঁজরের নিচে ব্যথা হওয়া
  8. লিভার বড় হয়ে যাওয়া

প্রতিকার: জন্ডিসের কোনো ঔষধ নেই। জন্ডিসের রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা যায়। সম্পূর্ণ বিশ্রাম জন্ডিস নিরাময়ের একমাত্র ব্যবস্থা।

লিভার সিরোসিস: এটি যকৃতের একটি রোগ, যা যকৃতের ভিজা ও নরম কোষে ক্ষত সৃষ্টির মাধ্যমে হয়। এ রোগের কারণে যকৃত অকেজো হয়ে যায়। অতিরিক্ত মদ্যপান, বিষাক্ত ধোঁয়া এ রোগের কারণ হতে পারে।

রক্তজনিত রোগ

রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া) হলো রক্তকণিকার স্বল্পতা বা রক্তের পরিমাণ বা অক্সিজেনবাহী রক্তরঞ্জক হিমোগ্লোবিনের অভাব। রক্তশূন্যতা অন্য রোগের সঙ্গে একটি উপসর্গ হতে পারে (যেমন ক্রনিক রেনাল ফেইলির অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বৃক্কীয় কার্যহীনতা)

হিমোফিলিয়া (HAEMOPHILIA): এটি এক প্রকার Sex linked রোগ। এই রোগের বাহক হচ্ছে মহিলারা কিন্তু এর ক্ষতির শিকার পুরুষরা। এক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধতে বিলম্বের কারণে ক্ষতস্থান হতে অতিরিক্ত রক্তকরণ হয়। এর প্রকারভেদ:

  1. হিমোফিলিয়া – A (85%)-Factor-VIII অনুপস্থিত থাকলে।
  2. হিমোফিলিয়া – B (15%) Factor IX অনুপস্থিত থাকলে।

Thrombocytopenia: শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে ৫০০০ এর নিচে হলে, তাকে Thrombocytopenia বলে।

গলগন্ড রোগ কেন হয়: আয়োডিনের অভাবজনিত একটি রোগ হলো গলগন্ড রোগ। গলার থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এ রোগের প্রধান লক্ষণ।

রিকেটস: এ রোগের ফলে হাড় বেঁকে যায় ও পেট ফুলে ওঠে। শিশুরা খুব দূর্বল হয়ে পড়ে ও আকারে ছোট হয়ে যায়। ভিটামিন A ও D এর অভাবে এ রোগ হয়।

হরমোনজনিত রোগ

Acromegaly: যখন কোনো পূর্ণ বয়স্ক মানুষের গ্রোথ হরমোন বেশি কাজ করে।
কারণ: পিটুইটারি গ্রন্থির Tumour
বৈশিষ্ট্য:

  1. নিচের চোয়াল লম্বা হয়
  2. হাত-পা অতিরিক্ত লম্বা হয়
  3. মাথা বড় হয়ে যায়।
  4. চামড়া মোটা হয়ে যায়।
  5. অতিরিক্ত ঘামানো।
  6. ঠোঁট মোটা হয়ে যায়।
  7. যকৃত, প্লীহা বড় হয়ে যায়।

Cretinism: থাইরয়েড হরমোনের কম কাজ করার জন্য শিশু-কিশোরদের যে রোগ হয় তাকে Critinsm বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য:

  1. লম্বা কম হয়।
  2. নির্বোধ।
  3. জিহ্বা বের হয়ে থাকা।
  4. ঠোঁট মোটা হয়ে যায়।
  5. মুখ দিয়ে লালা পড়া।
  6. মানসিক বৃদ্ধি হয় না।
  7. চামড়া খসখসে হয়ে যায়।

ইনসুলিন: ইনসুলিন হচ্ছে একটি পলিপেপটাইড। এর আণবিক ওজন প্রায় ৬০০০ গ্রাম। কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত ইনসুলিন সাধারণত গরুর অগ্ন্যাশয় থেকে প্রস্তুত করা হয়। এ গো-ইনসুলিনে কার্বনের ২৫৪টি, হাইড্রোজেনের ৩৭৭টি, নাইট্রোজেনের ৬৫টি, অক্সিজেনের ৭৫টি এবং সালফারের ৬টি পরমাণু থাকে। ইনসুলিন অণুতে ৪৮টি এমাইনো এসিড থাকে।

ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন, যা অগ্ন্যাশয় থেকে নির্গত হয় এবং চিনির বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ কর। স্বাভাবিক জীবদেহের রক্তে চিনির মাত্রা ধ্রুবক থাকে। রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়লে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন নির্গমন বৃদ্ধি করে দেয়। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস টিস্যু চিনির বিপাক করার মতো ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে। এভাবে জীবদেহ থেকে অব্যবহৃত চিনি বের হয়ে আসে। ফলে রক্তে চিনি বৃদ্ধি পায়। শরীরে ইনসুলিনের অভাবে ডায়াবেটিস মেলাইটিস বা বহুমূত্র রোগ হয়।

ইনসুলিনের কাজ :

  1. ইনসুলিন দেহের বিভিন্ন কোষে গুকোজের অনুপ্রবেশ ঘটায়
  2. গ্লুকোজের জারণ বৃদ্ধি করে
  3. গ্লাইকোজেনকে সংশ্লেষিত করে
  4. ইনসুলিন শ্বেতসার, আমিষ ও চর্বির বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে
  5. ইনসুলিনের প্রধান কাজ রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা

কি ত্রুটির জন্য বহুমূত্র রোগ হয়: অগ্ন্যাশয়ে আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন নামক হরমোন গ্লুকোজের পরিমাণ কাম্য মাত্রায় ধরে রাখে। কোনো কারণে এই অতীব প্রয়োজনীয় ইনসুলিন পরিমিত মাত্রায় নিঃসৃত না হলে বা একেবারেই নিঃসৃত না হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ক্রমাগত হারে বাড়তে থাকে। ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব, সীমাহীন দূর্বলতা, অধিক এবং ঘন ঘন খাবার ইচ্ছা নিয়ে যে রোগটির জন্ম হয় সেটিই বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস।

ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন-এর মধ্যে সম্পর্ক: অগ্ন্যাশয়ের অভ্যন্তরে আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স নামক এক প্রকার গ্রন্থি আছে যে গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন তৈরি হয়। এ হরমোন শরীরের শর্করা কার্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি না হয়, তখন রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত শর্করা বা গ্লুকোজ প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত হওয়ার দরুণ যে রোগ হয় তাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলে। ডায়াসিটিসের চিকিৎসায় ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়। খালি পেটে থাকা অবস্থায় একজন লোকের রক্তরসে যদি ৭.৮ মি. লি. মোলের বেশি গ্লুকোজ এবং খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে রক্তরসে যদি ১১.১ মি. লি. মোলের বেশি গ্লুকোজ থাকে, তবে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগ হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়। ডায়াবেটিস সাধারণত বংশগত এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়।

নবীনতর পূর্বতন