পৌষ্টিকতন্ত্রের রোগ

পৌষ্টিকতন্ত্র হলো আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গব্যবস্থা যা খাদ্যকে হজম করে পুষ্টি শোষণ করে এবং বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। পৌষ্টিকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা ব্যাহত হলে পৌষ্টিকতন্ত্রের রোগ দেখা দেয়।

পৌষ্টিকতন্ত্রের রোগ

  • অম্ল বা অ্যাসিডিটি (Acidity) : অম্ল বা অ্যাসিডিটি এক প্রকার অজীর্ণ রোগ। পাকস্থলি থেকে অধিকমাত্রায় পাকরস বের হওয়ার ফলে এই রোগ হয়। এই রোগের লক্ষণ হল বুক জ্বালা, মাথা ধরা, পিপাসা, পেটফুলে উঠা, মুখ দিয়ে অম্ল ঢেঁকুর, খাবারের আগে বা পরে গলা জ্বালা প্রভৃতি এই রোগের লক্ষণ। দীর্ঘদিন যাবৎ এই রোগে ভুগলে আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • আলসার কেন হয় : আলসার এক ধরনের ঘা। পাকস্থলীর অভ্যন্তরস্থ ঝিল্লিতে এ ধরনের ঘা হলে তাকে গ্যাসট্রিক আলসার এবং ক্ষুদ্রান্তের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিতে এ ধরনের ঘা হলে তাকে ডিউডেনাল আলসার বলে। এ দুই ধরনের আলসারকে একত্রে পেপটিক আলসার বলে। অতিরিক্ত এসিড ক্ষরণ এবং মানসিক আবেগের জন্য এটা হতে পারে।
  • রক্তবমি (Haematemesis): কালাজ্বর, পাকস্থলির শিরা ছিড়ে যাওয়া, পাকস্থলিতে ক্যান্সার, যকৃতে রক্তাধিক্যের জন্য রক্ত বমি হয়। তাছাড়া উপরোক্ত কারণে অনেক সময় নাক, চোখ, কান, যোনি এবং গুহ্যদ্বার দিয়েও কখনও কখনও রক্ত বের হতে থাকে। রক্তবমির পূর্ব লক্ষণ হল পেটব্যাথা, ভারবোধ, বদহজম, অবসাদ, মুখে নোনতা ভাব, মাথা ঝিমঝিম, দূর্বল নাড়ী, দীর্ঘশ্বাস প্রভৃতি। বমিসহ রক্তস্রাব হলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী হিমাঙ্গ হয়ে মারা যায়।
  • সরলান্ত্র নির্গমণ বা হারিস নির্গমণ কি : মলত্যাগের সময় কোঁথানি, অর্শ, উদরাময়, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতির কারণে সরলান্ত্রের কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। মলত্যাগের সময় সরল যন্ত্রটা বাইরে বেরিয়ে আসলেও পুনরায় ভিতরে প্রবেশ করে। কোন ঘা, ব্যাথা প্রভৃতি না থাকলে ভয়ের কিছু থাকে না তবে অনেক সময় রক্তস্রাব, ব্যাথা, জ্বালা প্রভৃতি হতে দেখা যায়। অন্ত্র বের হয়ে থাকলে Ice bag -এর সাহায্যে ধীরে ধীরে অন্ত্রকে যথাস্থানে ঢুকিয়ে তুলো গোল করে পাকিয়ে মলদ্বারে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে জিয়লমাছের ঝোল, পুরোনো চালের ভাত, কলায়ের ডাল, মানকচু প্রভৃতি খাদ্য উপকার দেয়।
  • অ্যাপেন্ডিসাইটিস : মানুষের পরিপাকতন্ত্রে অবস্থিত বৃহদান্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মাঝে অ্যাপেন্ডিক্স নামে একটি সরু নালী রয়েছে। কোনো কারণে এটি ক্ষতিগ্রস্ত অথবা পঁচে দৈহিক বৈকল্য দেখা দিলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ বলে।
  • এপেন্ডিক্স এবং এপেন্ডিসাইটিস : এপেন্ডিসাইটিস ভার্মিফর্ম এর প্রদাহ। সাধারণত ভাইরাল কিংবা আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে প্রদাহ হয়। পরিপাকতন্ত্রের বৃহদান্ত্রের শুরুতে সিকামের সাথে এপেন্ডিক্স থাকে। কোনো কারণে এটি পঁচে গেলে তীব্র ব্যাথাসহ দৈহিক বৈকল্য দেখা দেয়। এপেন্ডিসাইটিস হল রোগ বিশেষ। এপেন্ডিক্সের তীব্র ব্যাথাসম্বলিত রোগই এপেন্ডিসাইটিস। মল, কৃমি প্রভৃতি দ্বারা এপেন্ডিক্সের নালী বন্ধ হলে এতে পচন ধরে তীব্র ব্যাথা হয়। আবার ভাইরাস বা আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট প্রদাহের কারণে এপেন্ডিক্স গাত্র ফুলে ওঠে এবং রক্ত প্রবাহের বাধা সৃষ্টি করে। ফলে এপেন্ডিক্সে পচন ধরে তীব্র ব্যাথা হয়। প্রদাহজনিত এ ব্যাথা প্রথম নাভির গোড়ায় অনুভূত হয় এবং পরে তলপেটের ডানদিকে সরে যায়। এপেন্ডিসাইটিস হলে জরুরি শল্য চিকিৎসা করাই সর্বোত্তম।
  • অন্ত্রবৃদ্ধি (Hernia) : অধিক পরিশ্রম, মলমূত্র ত্যাগে জোরে কোঁথ দেওয়া, আঘাত লাগা, কোষ্ঠকাঠিন্য, জোরে চিৎকার করা, পেটে চাপ পড়া ইত্যাদি কারণে অন্ত্রবৃদ্ধি হতে পারে। এই রোগে পেটের ভিতরের নাড়ীর অংশ বিশেষ অম্লাবরণসহ কুচকির রন্ধ্র পথে নাড়ী অন্ডকোষে চলে যায়। এই অন্ত্রকে উপযুক্ত স্থানে সরিয়ে না আনলে বমি, জ্বর, পেট ফোলা, হেঁচকী, পেটে তীব্র ব্যাথা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়। এই রোগে অপারেশন ছাড়া সহজে সারে না। অনেক সময় রোগীকে চিৎকরে শুইয়ে পা দুটিকে উঁচু করে রাখলে অস্ত্র কখনও কখনও যথাস্থানে ফিরে আসে। ব্যাথার Ice bag অথবা হার্ণিয়ার ট্রাস ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়।
  • কোষ্ঠ-বদ্ধতা (Constipation): মলত্যাগের নিয়মিত অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটলে অথবা দীর্ঘ বিরতির পর মল ত্যাগ করলে তা কোষ্ঠকাঠিন্য নামে চিহ্নিত করা হয়। দুশ্চিন্তা, শোক, দুঃখ, ভয়, স্নায়ুবিক দূর্বলতা, চা, কফি, মাদক দ্রব্য পান, ঠান্ডা লাগা, অধিক শ্রম, হস্তমৈথুন, লিভার রোগ, আন্ত্রিক রোগ, আঘাত লাগা, চর্ম রোগ প্রভৃতি হতে এই রোগ দেখা দেয়। এই রোগের প্রধান প্রধান লক্ষণ হল মাথা ধরা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা লোপ, অস্বাচ্ছন্দ বোধ, মলের রং কাদা মাটি বা ছাইয়ের মতো হওয়া। তাছাড়া অনেক সময় জন্ডিসের লক্ষণও প্রকাশ পায়।
  • অর্শ (Piles) : মলদ্বারের বাইরে অথবা ভিতরে বা কখনও কখনও উভয় স্থানেই শিরা ফুলে উঠে মটর দানার মতো বলি উৎপন্ন করে তাকে অর্শ বলে। কখনও একটি বা কখনও একাধিক বলি আঙ্গুরের থলির আকারে দেখা যায়। বাহিরের বলিকে বলা হয় বহিঃবলি এবং ভিতরের বলিকে বলা হয় অন্তর্বলি। কোষ্ঠকাঠিন্য, পাথরী, গর্ভকালীন, পায়ুতে চাপ বেড়ে, প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি হয়ে অথবা লিভারের পুরাতন রোগ থেকে অর্শ হতে পারে। নালী ঘা, চুলকানী, ব্যাথা, জ্বালা, কুটকুট করে কামড়ানী প্রভৃতি এই রোগের লক্ষণ। দীর্ঘ রোগ ভোগে ভগন্দর, স্ফোটক, রক্ত শূন্যতা, হৃদপিন্ডের দূর্বলতা প্রভৃতি দেখা যায়।
নবীনতর পূর্বতন