স্থির তড়িৎ এবং চল তড়িৎ

বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার বিদ্যুৎ বা তড়িৎ । বর্তমান সভ্যজগতে বিদ্যুৎ ব্যতীত কোন কল্যাণকর কাজ আশা করা যায় না । বিদ্যুৎ শক্তি সমগ্র মানব সভ্যতার পরতে পরতে অনুপ্রবেশ করে সভ্যতার গাঁথুনিকে করেছে সুদৃঢ় ও মজবুত । বিদ্যুৎ এক কালের পৃথিবীকে করেছে আলোকিত , কল - কারখানা ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানে এনেছে গতি । এক কথায় বিদ্যুৎ ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে তা এখন কল্পনা করা ও সম্ভব নয় । আজকে আমরা আলোচনা করব স্থির তড়িৎ এবং চল চল তড়িৎ নিয়ে । যা আপনার জন্য অবশ্যই জানা উচিত ।

 স্থির তড়িৎ এবং  চল তড়িৎ

তড়িৎ বা বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎ: বিদ্যুৎ হচ্ছে এক প্রকার শক্তি। কোনো স্থির বা গতিশীল আধানের প্রকৃতি ও প্রভাব বা ক্রিয়াকে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ বলা হয়। তড়িৎ বা বিদ্যুৎ দুই প্রকার। যথাঃ ১. স্থির তড়িৎ, ২. চল তড়িৎ

স্থির তড়িৎ : খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে থেকেই গ্রীকদের জানা ছিল যে, অ্যাম্বারকে (Amber) রেশমী কাপড় দিয়ে ঘষলে অ্যাম্বার ছোট ছোট বস্তুকণা (যেমন, কাঠের গুঁড়া)কে আকর্ষণ করার গুণ অর্জন করে। একই ভাবে চিরুনী দিয়ে শুষ্ক চুল আঁচড়িয়ে ছোট ছোট কাগজের টুকরার কাছে নিলে টুকরাগুলো আকৃষ্ট হয়। এ গুণ শুধু অ্যাম্বার বা চিরুনীতে উৎপন্ন হয় তা নয়, অনেক বস্তুতেই হয়। ঘষার ফলে অ্যাম্বার বা চিরুনীতে এক ধরনের অদৃশ্য শক্তির সঞ্চার হয়। এ অদৃশ্য শক্তিকেই তড়িৎ বলে। আর এটাই স্থির তড়িৎ । স্থির তড়িৎ বস্তুতে আবদ্ধ থাকে । এর শক্তি থাকলে ও কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে না । অথবা আমাদের কোনো কাজে আসে না । পরিবাহী তার দিয়ে স্থির তড়িৎকে চলার সুযোগ করে দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ বা তড়িতের ব্যবহারে করে থাকি । এ কারণে আমরা যা ব্যবহার করি তা চল তড়িৎ এবং যে তড়িৎ ব্যবহার করতে পারি না সেটা স্থির তড়িৎ । গ্রীক ভাষায় অ্যাম্বারকে ইলেকট্রন (Electron) বলে। এই ইলেকট্রন থেকে ইলেকট্রিসিটি (Electricity) শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

চার্জ : যার স্থিতিতে কোন বস্তুতে স্থির তড়িৎ , বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র , স্থির তড়িৎ শক্তির সঞ্চার হয় ও বস্তু ছোট ছোট কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করবার সামর্থ্য রাখে এবং যার গতিতে তড়িৎপ্রবাহ, তড়িৎ ক্ষেত্র ও চৌম্বক ক্ষেত্রের উদ্ভব হয়, তাকে চার্জ বলে ।
চার্জের একক: কুলম্ব।

অ্যাম্বারকে রেশমী কাপড় দ্বারা ঘষলে, চার্জ (স্থির তড়িৎ) সঞ্চিত হয় বলে তা ছোট ছোট কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করে।
মেঘের অসংখ্য পানি ও বরফ কণার মধ্যে চার্জ সঞ্চিত হলে আকাশে বিজলী চমকায় ।
আর্দ্র বায়ু বা মেঘযুক্ত বায়ুর মধ্য দিয়ে বিমান চালনা করা ঝুঁকিপূর্ণ ।
পেট্রোলবাহী ট্রাকের নিচে মাটি স্পর্শ করে একটি ধাতব তার ঝুলিয়ে রাখা হয়: পেট্রোলবাহী ট্রাক চলার সময় পেট্রোল ও ট্যাংকের লোহার দেওয়ালের মধ্যে ঘর্ষণ হয়। এই ঘর্ষণের কারণে স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এভাবে উৎপন্ন স্থির তড়িৎ ক্রমশ জমা হতে হতে এক সময় তড়িৎ স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করলে পেট্রোল ও বায়ুর মিশ্রণে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ এবং আগুন ধরে যেতে পারে। উৎপন্ন চার্জ যেন জমা না হয়, সেজন্য পেট্রোলবাহী ট্রাকের নিচে মাটি স্পর্শ করে একটি ধাতব তার ঝুলিয়ে রাখা হয়।

স্বর্নপাত তড়িত্বীক্ষণ যন্ত্র - (Gold Leaf Electroscope) : বেনেট নামক একজন ধর্মযাজক এটি আবিষ্কার করেন । আধানের উপস্থিতি ও প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য তড়িৎবীক্ষন যন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

বজ্ৰপাত :
বজ্রপাতের সময় গুহার ভিতর বা মাটিতে শুয়ে থাকা উচিত।
বজ্রনিবারক: বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য গৃহ বা অট্টালিকায় যে তীক্ষ্ণ পরিবাহী দণ্ড ব্যবহৃত হয় তাই বজ্রনিবারক । বজ্র নিবারকের এক প্রান্তে একটি ধাতব পাত, মাঝে ধাতব দণ্ড এবং অগ্রভাগে সূচীমুখবিশিষ্ট পরিবাহী থাকে । সাধারণত বাড়ির ছাদে বা উচ্চতম স্থানে সূচীমুখটি রেখে ধাতব পাতটি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। বজ্রপাতের কারণে চার্জগ্রস্ত মেঘ সূচীমুখের সংস্পর্শে এসে দণ্ড বেয়ে মাটিতে চলে যায়। এতে ঘর-বাড়ি বা অট্টালিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

তড়িৎ পরিবাহীতা

তড়িৎ পরিবাহিতা তড়িৎ মাধ্যমের একটি ধর্ম যা এর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত করতে সহায়তা করে। তড়িৎ পরিবাহিতার একক সিমেন্স । তড়িৎ পরিবাহিতা ধর্মের উপর ভিত্তি করে পদার্থসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

ক) বিদ্যুৎ পরিবাহী : যেসব বস্তুর মধ্য দিয়ে সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে, তাদের বিদ্যুৎ পরিবাহী বলে । রূপার পরিবাহিতা সবচেয়ে বেশি ।

খ) অন্তরক: যেসব বস্তুর মধ্য দিয়ে সহজে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারেনা, তাদের অন্তরক বলে ।

গ) অর্ধপরিবাহী (semi-conductor): যে সকল পদার্থের তড়িৎ পরিবাহিতা পরিবাহী পদার্থের চেয়ে অনেক কম কিন্তু অন্তরকের চেয়ে অনেক বেশি, তাদের অর্ধপরিবাহী বলে ৷

পদার্থ উদাহরণ
বিদ্যুৎ পরিবাহী সোনা, রূপা, মারকারি, তামা, দস্তা, প্লাটিনাম, অ্যালুমিনিয়াম, এসিড, নিকেল, লোহা, ভেজা মাটি,পিতল,লবন ।
বিদ্যুৎ অর্ধপরিবাহী জার্মেনিয়াম, সিলিকন, ক্যাডমিয়াম, ইনডিয়াম, আর্সেনাইড, গ্যালিয়াম ।
বিদ্যুৎ অপরিবাহী কাঁচ, প্লাস্টিক, শুষ্ক বাতাস, চীনামাটি, কাগজ, রাবার, মোম, কাঠ

বিভব

বিভব হচ্ছে আহিত পরিবাহকের তড়িৎ অবস্থা যা নির্ধারণ করে ঐ পরিবাহকটিকে অন্য কোন পরিবাহকের সাথে পরিবাহক দ্বারা যুক্ত করলে তা আধান দেবে বা নিবে ।

পৃথিবী বা ভূমির বিভব: শূন্য ।
বিভব পার্থক্যের একক: ভোল্ট।
তড়িচ্চালক শক্তির একক: ভোল্ট ।
‘Voltage’: বৈদ্যুতিক (electric) চাপের পরিমাণ ।
তড়িৎ কারেন্ট: কোন তড়িৎ পরিবাহকের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনের প্রবাহ ।

তড়িৎ প্রবাহ: একক সময়ে পরিবাহীর কোন বিন্দু দিয়ে চার্জের প্রবাহকে তড়িৎ প্রবাহ বলে ।

প্রকারভেদঃ চল তড়িৎ দুই প্রকার। যথাঃ
১. সম বা একমুখী প্রবাহ (D.C) ২. পর্যাবৃত্ত বা পরিবর্তী প্রবাহ (A.C)
একক: অ্যাম্পিয়ার (A)।

১ অ্যাম্পিয়ার: পরিবাহীর কোন প্রস্থচ্ছেদ দিয়ে অভিলম্বভাবে ১ সেকেন্ডে ১ কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হলে যে প্রবাহমাত্রা পাওয়া যায় তাকে ১ অ্যাম্পিয়ার বলে । 1 অ্যাম্পিয়ার = 1 কুলম্ব 1 সেকেন্ড

মিলি অ্যাম্পিয়ার ও মাইক্রো অ্যাম্পিয়ার এর মধ্যে সম্পর্ক:
1 ই.এম.ইউ = 10 অ্যাম্পিয়ার
1 মিলি অ্যাম্পিয়ার = 10 -3 অ্যাম্পিয়ার
1 মাইক্রো অ্যাম্পিয়ার = 10 -6 অ্যাম্পিয়ার

সমপ্রবাহ (D.C): তড়িৎ প্রবাহ যদি সর্বদা একই দিকে প্রবাহিত হয় বা সময়ের সাথে তড়িৎ প্রবাহের দিকের কোন পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেই প্রবাহকে সম প্রবাহ বলে ।

পর্যাবৃত্ত প্রবাহ (A.C): যে তড়িৎ প্রবাহ নির্দিষ্ট সময় পর পর দিক পরিবর্তন করে অর্থাৎ যে তড়িৎ প্রবাহের দিক পর্যাবৃত্তভাবে পরিবর্তিত হয় তাকে পর্যাবৃত্ত প্রবাহ বলে ।

তড়িৎকোষ থেকে আমরা সমপ্রবাহ (D.C) পাই ।
আমাদের দেশে বাসায় পর্যাবৃত্ত প্রবাহ (A.C) পাই ।
বাংলাদেশের বাসা বাড়িতে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্জ।
বাংলাদেশের তড়িৎ-এর কম্পাংক প্রতি সেকেণ্ড ৫০ সাইকেল (৫০হার্জ) এর তাৎপর্য: প্রতি সেকেন্ডে বিদ্যুৎ প্রবাহ ৫০ বার দিক বদলায় ।
বাংলাদেশের বাসা-বাড়িতে বিদ্যুতের সাপ্লাই ভোল্টেজ: ২২০ ভোল্ট এ.সি
দূরের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে হলে হাইভোল্টেজ ব্যবহার করার কারণ: বিদ্যুৎ পরিবহনে যে তার ব্যবহৃত হয় তার রোধ আছে। রোধের কারণে তড়িৎ প্রবাহের সময় তড়িৎ শক্তি তাপ শক্তি হিসেবে অপচয় হয় । দূরত্ব যত বেশি হয়, অপচয়ও তত বেশি হয় । সেজন্য অধিক দূরত্বে তড়িৎ প্রেরণে তড়িৎ প্রবাহ কমিয়ে ভোল্টেজ বাড়ানো হয় যাতে অপচয় কম হয় ।

নবীনতর পূর্বতন