বিহারীলাল চক্রবর্তী

আধুনিক গীতিকবিতার কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও গীতোচ্ছ্বাস বিশুদ্ধভাবে তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। সৌন্দর্যপিয়াসী প্রকৃতি প্রেমিক কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতায় সমাজ-সমকাল ও সমকালীন সমস্যাবলি প্রাধান্য পায়নি। মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির রস আস্বাদন করেছেন যেভাবে, সেই মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতার চরণে চরণে ঢেউ তুলেছে নূপুর-নিক্বণ। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

জন্ম ও পরিচয়

বিহারীলাল চক্রবর্তী ২৫ মে, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলের নিমতলায় জন্মগ্রহণ করেন । গীতিকবিতার জনক বিহারীলাল চক্রবর্তীর পিতার নাম ছিল দীননাথ চক্রবর্তী। মাতা মারা যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল মাত্র চার বছর । তাঁর পূর্বপুরুষেদের আদি নিবাস ছিল ফরাসডাঙ্গায়। তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল ‘চট্টোপাধ্যায়’। গীতিকবিতার ক্ষেত্রে বিহারীলাল চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের গুরু হিসেবে খ্যাত । তিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক গীতিকবিতার স্রষ্টা। এ জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ‘ভোরের পাখি' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

শিক্ষাজীবন

বিহারীলাল চক্রবর্তী শৈশবে নিজ গৃহে সংস্কৃত , ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন।

বিবাহ

বিহারীলাল চক্রবর্তী উনিশ বছর বয়সে মাত্র দশ বছর বয়সী অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য , অভয়া শক্তি বা মহাদেবী হিন্দুধর্মের শাক্ত সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী।

সাহিত্যকর্ম

বিহারীলাল চক্রবর্তী রচিত কাব্যগ্রন্থসমূহ :

  • স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮) : এটি তাঁর প্রথম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নকালে কবি এই গ্রন্থ রচনা করেন "পূর্ণিমা" পত্রিকায়। "সংবাদ প্রভাকর " পত্রিকা(১৮৫৮,৩রা আগস্ট) এই গ্রন্থের প্রশংসা করে। গ্রন্থটির বিষয় ছিল দেশ ও দেশমাতৃকার দুর্ভাগ্যের জন্য গভীর আক্ষেপ।
  • সঙ্গীতশতক (১৮৬২) : এটি তাঁর রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটি একশত(১০০) বাংলা গানের সমষ্টি। কবি এই গ্রন্থ সম্পর্কে অনাথবন্ধু রায়কে লিখেছিলেন, "১৫ হইতে ২৫ বৎসর পর্যন্ত আমার মনে যে যে ভাবোদগম হইয়াছিল,তাহার অধিকাংশ "সঙ্গীতশতক" এ বর্ণিত আছে। এই "সঙ্গীতশতক" গ্রন্থটি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
  • বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) : বিহারীলালের প্রথম সার্থক গীতিকবিতার গ্রন্থ বঙ্গসুন্দরী । এ কাব্যে কবি বলেছেন : 'সর্বদাই হুহু করে মন / বিশ্ব যেন মরুর মতন / চারিদিকে ঝালাপালা / উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা / অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।' রবীন্দ্রনাথ এ-প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে এই প্রথম বোধ হয় কবির নিজের কথা প্রকাশ পাইয়াছে।' কবি এই কাব্যে বঙ্গ নারীর বন্দনা করেছেন। কাব্যের দশটি সর্গ হল "উপহার", "নারী বন্দনা", "সুরবালা", "চিরপরাধিনী" "করুনাসুন্দরী", "বিষাদিনী", "প্রিয়সখী", "বিরহিনী", "প্রিয়়়তমা" ও " অভাগিনী"। এই গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের ছিল নয়টি সর্গ, দ্বিতীয় সংস্করণে আর একটি সর্গ "সুরবালা" সংযোজিত হয়।
  • নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০) : এটি ধারাবাহিক ভাবে "অবোধবন্ধু" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই কাব্য সাতটি সর্গে রচিত। সাতটি সর্গ যথাক্রমে- চিন্তা , সমুদ্রদর্শন , বীরাঙ্গনা , নভোমণ্ডল , ঝটিকা রজনী , ঝটিকা সম্ভোগ এবং প্রভাত ।
  • বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০) : এটি প্রথমে 'পূর্ণিমা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চারটি সর্গে কবি তাঁর চারজন বন্ধু (পূর্ণচন্দ্র,কৈলাস, বিজয় ও রামচন্দ্র) এবং প্রথমা স্ত্রী অভয়ার বিয়োগব্যাথা ব্যক্ত করেছেন।
  • প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০) : কাব্যটি ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে । এটি পাঁচ সর্গে রচিত যথাঃ পতন , বিরাগ, বিষাদ , অন্বেষণ , নির্বাণ ।
  • সারদামঙ্গল (১৮৭৯) : বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ 'সারদামঙ্গল' ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত । এটি পাঁচ সর্গে ত্রিপদী দীর্ঘ স্তবকময় লালিত্যপূর্ণ ভাষায় রচিত । কাব্যের প্রথম সর্গে কবির মনোজগতে এক কাব্যলক্ষ্মীর আবির্ভাব, দ্বিতীয় সর্গে হারানো আনন্দ লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে কবির মানসভ্রমণ, তৃতীয় সর্গে কবিচিত্তের দ্বন্দ্ব, চতুর্থ সর্গে হিমালয়ের উদার প্রশান্তির মধ্যে কবিচিত্তের আশ্বাস লাভ, পঞ্চম সর্গে হিমালয়ের পুণ্যভূমিতে কবির আনন্দ উপলব্ধির চিত্র পাওয়া যায় । ‘সারদামঙ্গল' কাব্য সম্পূর্ণরূপে জীবনরহিত, বিশেষ সৌন্দর্যধ্যান । শেলির মতো বিহারীলাল তাঁর প্রিয়তমার মধ্যে সারদাকে অন্বেষণ করেছেন এবং দীর্ঘ বিরহের পর হিমাদ্রিশিখরে ভাব- সম্মিলনের চিত্র অংকন করে কবি কাব্যের পরিসমাপ্তি টেনেছেন ।
  • সাধের আসন (১৮৮৯) : বিহারীলালের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘সাধের আসন'কে (১৮৮৯) 'সারদামঙ্গল' কাব্যের পরিশিষ্ট বলা যায় । কোন এক সম্ভ্রান্ত বিবাহিত নারী কবির 'সারদামঙ্গল' কাব্য পাঠ করে নিজ হাতে একটি আসন বুনে কবিকে উপহার দিয়েছেন । সেখানে ওই নারী কবিকে প্রশ্ন করেছেন, তুমি কাকে ধ্যান কর? এর উত্তর স্বরূপ বিহারীলাল ‘সাধের আসন’ লিখেছেন। শুরুই করেছেন এভাবে : 'ধেয়াই কাহারে দেবী নিজে আমি জানি নে / কবিগুরু বাল্মীকির ধ্যান-ধনে চিনিনে।' এ কাব্যের সূচনাতে কবির রোম্যান্টিক মনোবৃত্তি প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু কাব্যের শেষে তা মিস্টিসিজমে রূপান্তরিত । উপসংহার ছাড়া ‘সাধের আসন' কাব্য দশ সর্গ বিশিষ্ট । এর প্রথম সর্গ মাধুরী, দ্বিতীয় সর্গ গোধূলি ও নিশীথে, তৃতীয় সর্গ প্রভাত যোগেন্দ্রবালা, চতুর্থ সর্গ নন্দনকানন, পঞ্চম সর্গ অমরাবতীর প্রবেশ পথ, ষষ্ঠ সর্গ তুমি, সপ্তম সর্গ মায়া, অষ্টম সর্গ শশিকলা, নবম সর্গ আসনদাত্রী, দশম সর্গ পতিব্রতা নামকরণ করা হয়েছে । অনেকের মতে, এই কাব্যে কবি তাঁর মানসলক্ষ্মীর সন্ধান পেয়েছেন এবং এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য ।
  • মায়াদেবী (১৮৮২) : বিহারীলালের জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • ধূমকেতু (১৮৮২) : এটি ও কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • দেবরাণী (১৮৮২) : এটি ও কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • নিসর্গসঙ্গীত (১৮৮২) : এটি ও কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • বাউল বিংশতি (১৮৮৭) : এটি ও কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ।
  • গোধূলি (১৮৯৯) : কবির মৃত্যুর পর এটি ও কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয় ।

সম্পাদনা

তিনি পূর্ণিমা (১৮৫৯), সাহিত্য সংক্রান্তি (১৮৬৩), অবোধ বন্ধু (১৮৬৮) পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

উপাধি

যে কবিতায় কবির একান্ত ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা ও আনন্দবেদনা প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে আবেগকম্পিত সুরে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে তাকে ‘গীতিকবিতা’ বলে। আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার সূত্রপাত টপ্পাগান থেকে। বিহারীলালই প্রথম বাংলায় ব্যক্তির আত্মলীনতা, ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও গীতোচ্ছ্বাস সহযোগে কবিতা রচনা করে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেন বলেই তাকে ‘ভোরের পাখি' বলা হয় ।

রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

সৌন্দর্যপিয়াসী প্রকৃতি প্রেমিক কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতায় সমাজ সমকাল ও সমকালীন সমস্যাবলি ততোটা প্রাধান্য পায় নি । কিন্তু কবিতার চরণে ছন্দে ঢেউ তুলেছে নূপুর-নিক্কণ । মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির রস পান করেছেন যেভাবে, সেই-মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায় । নগরবাসের অভিজ্ঞতা কঠিন আবরণে আচ্ছন্ন করতে পারে নি তাঁর সলজ্জ সরস মানসভূমিকে ।

মৃত্যু

তিনি ২৪ মে, ১৮৯৪ সালে কলকাতায় মারা যান।

নবীনতর পূর্বতন