রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীবাদী লেখিকা ও মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি একাধারে একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন বাঙালি মুসলমান সমাজ, বিশেষত নারীসমাজ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা সব দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। তখন পর্দাপ্রথার কঠোর শাসনে নারীসমাজ ছিল অবরোধবাসিনী । রোকেয়া পিছিয়ে পড়া সমাজের এই বৃহত্তর অংশকে শিক্ষা ও কর্মের আলোয় আলোকিত করতে নিজের জীবনকে নিবেদন করেছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলে নারী আজ শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে, আদালতে সকল ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নারীদের কুসংস্কারমুক্ত ও শিক্ষিত করতে এবং সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলার 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উদ্‌যাপন করে এবং বিশিষ্ট নারীদের অনন্য অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রোকেয়ার পারিবারিক নাম রোকেয়া খাতুন। তাঁর পিতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী সাবের ছিলেন একজন জমিদার। তাঁর মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুন্নেসা ও হুমায়রা; আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তাঁর বড়ো দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের। পারিবারিক প্রথা অনুসারে পাঁচ বছর বয়স থেকে পর্দার কঠোরতার মধ্যে রোকেয়াকে শৈশবকাল অতিবাহিত করতে হয়।

শিক্ষাজীবন

শৈশবে আরবি-ফারসি-উর্দু শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও রোকেয়ার পিতা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। তাছাড়া তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ মেয়েদের ছিল না। কিন্তু মেধাবী রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকার সময়ে তিনি একজন ইংরেজ মেমের কাছে কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়। তবু রোকেয়া দমে যাননি। বোনের এই বিদ্যানুরাগ দেখে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষিত ভাই ইব্রাহিম সাবের ইংরেজি শেখান রোকেয়াকে। পিতার কঠোর নজর এড়িয়ে রোকেয়া বড়ো দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় বাংলা-ইংরেজি শিক্ষায় উৎসাহী ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বোন করিমুন্নেসার অনুপ্রেরণায় রোকেয়া বাংলা সাহিত্য রচনা ও চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি একইসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য আয়ত্ত করেন। ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিবাহ হয়। স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বা আর. এস. হোসেন নামে পরিচিত হন। স্বামীর ঐকান্তিক উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া পড়াশোনা ও সাহিত্যচর্চা অব্যহত রাখেন। ১৯০৯ সালে তাঁর স্বামীর জীবনাবসান ঘটে।

নারীশিক্ষা বিস্তার

বাংলার মুসলমান সমাজে রোকেয়া দুই ভাবে অবদান রাখেন। প্রথমত, শিক্ষাবিস্তারে এবং দ্বিতীয়ত, সাহিত্য সৃষ্টিতে। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে ভাগলপুরে রোকেয়া তাঁর স্বামীর স্মরণে মাত্র পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে তাঁর নারীশিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন । ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলটি’ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোকেয়া মুসলমান নারীদের সামনে আধুনিক শিক্ষার দরজা খুলে দেন। স্কুলটিতে ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশত পেরিয়ে যায় । ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ ইংরেজি স্কুলে পরিণত হয়। রোকেয়া বাঙালি মুসলমান মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য কেবল স্কুলই প্রতিষ্ঠা করেননি, ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের অনুরোধ করেছেন। মেয়েদের স্কুলে নেওয়ার জন্য পৃথক গাড়িরও ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯২৯ সালে কলকাতায় মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় । স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও তাদের উন্নয়নে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। রোকেয়া মনে করতেন, পড়তে লিখতে পারাই নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো নারীকে তার অধিকার লাভে সক্ষম করে তোলা। প্রকৃত শিক্ষা একজন নারীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। নারীরা যাতে অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন যাপনে বাধ্য না হয়, সে-বিষয়ে তিনি নারীদের সচেতন করতে সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যান। শিক্ষাগ্রহণে নারীর সচেনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ১৯১৬ সালে 'আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম' বা 'মুসলিম নারীদের সমিতি' গড়ে তোলেন। এর কার্যালয় ছিল কলকাতা এবং সদস্য সংখ্যা ১২। মুসলিম নারী সমাজকে সংগঠিত করতে 'নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা সমিতি', ‘বেগম উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্স', 'নারীতীর্থ সংস্থা' প্রভৃতি সংগঠনে যোগ দেন এবং নারীর উন্নয়নে দেশবাসীকে উৎসাহিত করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনী ধারণ করেন। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পুরুষের বহুবিবাহ, নারীদের বাল্যবিবাহ এবং পুরুষের একতরফা তালাক প্রথার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন। রোকেয়ার এই প্রচেষ্টার ফলে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন পাশ হয়।

সাহিত্যচর্চার সূচনা

বাংলা সাহিত্যে রোকেয়ার আনুষ্ঠানিক পদার্পণ ঘটে ১৯০২ সালে কলকাতার ‘নবপ্রভাত পত্রিকায় ‘পিপাসা' নামক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে। ' পিপাসা' তার প্রথম প্রকাশিত গল্প । এরপর ‘নবনূর', 'সওগাত', ‘মোহাম্মদী' প্রভৃতি সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। সবাই তার রচনা পছন্দ করে। তার ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তাঁর লেখনী তৎকালীন মুসলিম সমাজকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজ তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। রোকেয়া তাঁর লেখায় যেমন নারীমুক্তির কথা বলেছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ত্রুটিগুলোকে নির্দেশ করেছেন, একইভাবে নারীর মানসিক দাসত্বেরও সমালোচনা করেছেন। নারীর অলংকারকে রোকেয়া দাসত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। রোকেয়া তাঁর নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন 'মতিচূর' প্রথম খণ্ড (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯২২)। ‘সুলতানাজ ড্রিম' (১৯০৮) তাঁর একটি ইংরেজি রচনা যা পরবর্তী কালে 'সুলতানার স্বপ্ন' নামে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া ‘পদ্মরাগ' (১৯২৪) ও ‘অবরোধবাসিনী' (১৯৩১) তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি রচনা। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহয্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর সকল রচনাই নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত।

সাহিত্যকর্ম

উপন্যাস

বেগম রোকেয়ার উপন্যাস দুটি যথা: পদ্মরাগ (১৯২৪), Sultana's Dream : এটি ইংরেজিতে লেখা।

পদ্মরাগ : 'পদ্মরাগ' রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত উপন্যাস । আসলে একে উপন্যাস না বলে উপন্যাসোপম গদ্য- আখ্যায়িক৷ বলাই ভালো । কেননা উপন্যাসের গাঁথুনি এখানে নেই, শিল্প হিসেবেও অসফল । তবে 'পদ্মরাগে'র মূল্য অন্যত্র । প্রথমত কোনো মুসলিম নারীর রচনা; দ্বিতীয়ত মুসলিম সমাজের অন্তঃস্থিত ক্লেদকে এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যা কোনো হিন্দু লেখকের পক্ষে সম্ভব ছিল না; তৃতীয়ত অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে এ জন্যে । লতিফ ও সিদ্দিকার প্রেমচিত্র আছে এখানে । ঈশান কম্পাউন্ডারের ভাষায় এবং 'তারিণীভবন'কে কেন্দ্র করে 'পদ্মরাগে বলা হয়েছে যে, হিন্দু-মুসলিম-ব্রাহ্ম- খ্রিষ্টান একই মাতৃগর্ভজাত । একটি চমৎকার গল্প আছে এ গ্রন্থের অবতারণা অংশে । এক মুসলিম ধর্মপিপাসু দরবেশের কাছে এলো শিক্ষা নিতে । দরবেশ তাকে নিজের হিন্দু গুরুর কাছে নিয়ে গেলেন । সেই হিন্দুগুরু আবার তাদের নিয়ে গেলেন নিজের মুসলিম গুরুর কাছে। এভাবে বোঝানো হলো প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে সম্প্রদায়জ্ঞান থাকে না । জ্ঞানের আলোতে কূপমন্ডুকতা দূর করতে হয় । 'পদ্মরাগ' উৎসর্গ করা হয় রোকেয়ার জ্যেষ্ঠভ্রাতা আবুল আসাদ ইব্রাহিমকে ।

Sultana's Dream : বাংলা সাহিত্যে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত 'সুলতানার স্বপ্ন' গ্রন্থটি ইংরেজি 'Sultana's Dream' শিরোনামে রচিত। এখানে মূল চরিত্র Sultana একজন অবরুদ্ধা নারী। গৃহের চতুষ্কোণ হচ্ছে তার বিচরণ ও কর্মক্ষেত্র, বাইরের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার তার ছিল না। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তিনি তার বোন সারার মতো অপরিচিতা এক নারীর সাথে অন্তঃপুর ত্যাগ করে উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে ফুল-বাগান দেখতে বের হয়েছেন, যাকে স্বপ্নরাজ্য ‘Lady Land' বলা হয়েছে। এ গ্রন্থে রোকেয়া একটি নারীবাদী স্বপ্নরাজ্য বা ইউটোপিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। এ কল্পরাজ্যে সমাজের সকল কর্মকাণ্ডে নারীরা হবেন প্রধান চালিকাশক্তি আর পুরুষরা হবেন গৃহবন্দী। এখানে থাকবে না কোন অপরাধ, প্রচলিত থাকবে ‘ভালোবাসা ও সত্যের' ধর্ম।

গদ্যগ্রন্থ

বেগম রোকেয়ার গদ্যগ্রন্থসমূহ: মতিচূর (১ম খণ্ড - ১৯০৪, ২য় খণ্ড- ১৯২২), অবরোধবাসিনী (১৯৩১)।

মতিচূর : বেগম রোকেয়ার লেখা প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ মতিচূরের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯০৪ এবং ১৯২২ সালে। প্রথম খণ্ডে ৭টি এবং দ্বিতীয় খণ্ডে ১০টি মিলিয়ে দুটি খণ্ডে মোট ১৭টি প্রবন্ধ সংকলন করা হয়েছিল। এই গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটা প্রবন্ধ হলো অর্ধাঙ্গী, নিরীহ বাঙালি, গৃহ, সুগৃহিনী, পিপাসা, সৌরজগৎ, জ্ঞানফল, শিশু-পালন এবং মুক্তিফল। অর্ধাঙ্গী রচনায় তিনি নারীদেরকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আবার পিপাসা রচনায় তিনি কারবালার প্রান্তরে হোসেন (রা.)-এর মর্মান্তিক পরিণতির দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। মতিচূর-এ সংকলিত আরেকটি প্রবন্ধে তিনি নারীদের বর্তমান সামাজিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। ‘নার্স নেলী’ নামের একটি গল্পও সংযোজন করা হয়েছিল এই গ্রন্থে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা একজন বাঙালি নারীর ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্পটি সেই সময়ে অনেক সাড়া জাগিয়েছিল। মতিচূরের দ্বিতীয় খণ্ডে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত মেরী করেলির লেখা উপন্যাস ‘মার্ডার অফ ডেলিসিয়া’র কিছু অংশের অনুবাদ সংযোজন করা হয়েছিল। শিশু-পালন’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া গ্রামাঞ্চলের অনেক কুসংস্কারের কথা তুলে ধরেছেন। মতিচূর-এ সংকলিত ভিন্ন ধরনের একটি রচনা হলো ‘মুক্তিফল’ প্রবন্ধটি। এটি মূলত একটি রূপকথা, যেখানে কথা বলা পাখি এবং দৈত্য-দানবের গল্প উঠে এসেছে। প্রবন্ধটিতে গ্রামবাংলার প্রচলিত অনেক প্রবাদও সংযোজন করেছেন তিনি। গ্রন্থটির অন্যান্য প্রবন্ধে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের দুরাবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বেগম রোকেয়া।

অবরোধবাসিনী : মুসলিম নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত ‘অবরোধবাসিনী’ একটি উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ। । কতগুলি ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ সত্য ঘটনার হাসি- কান্না নিয়ে এই গ্রন্থের কাহিনি রচিত । নকশাধর্মী ছোট ছোট রচনাগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে অবরুদ্ধ নারীর মর্মান্তিক জীবনকথা । রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর এই গ্রন্থে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, লক্ষ্মৌ, লাহোর, পাঞ্জাব, দিল্লি ও আলিগড়ের সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবারে পর্দার নামে অবরোধের অমানবিক ঘটনার ৪৭টি চিত্র তুলে ধরেছেন। রোকেয়া নিজে এগুলোকে ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ সত্য ঘটনার হাসিকান্না' বলে অভিহিত করেছেন । এই লেখাগুলো কলকাতার মাসিক 'মোহাম্মদী'র মহিলা পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। ১৯৩১ সালে রোকেয়ার এই সৃষ্টিকর্ম 'অবরোধবাসিনী' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।

স্বীকৃতি

  • বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে 'নারী জাগরণের অগ্রদূত' হিসেবে তার নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন। উল্লেখ্য, নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি।
  • বেগম রোকেয়ার নামে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-এর দশকে ছাত্রীনিবাস 'রোকেয়া হল' খোলা হয় যার নাম আগে ছিলো 'উইমেন্স হল' তবে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৮ সালে 'চামেলি হাউজ' নামে প্রথমে হলটি চালু হয়েছিলো।
  • মহীয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল "রোকেয়া হল" নামকরণ করা হয়।
  • প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার জন্মদিনে বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয় এবং নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদেরকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
  • ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
  • তার ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তার জন্মদিন উদ্‌যাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় সাদা পোশাকে চশমা পরা বেগম রোকেয়া বই হাতে হেঁটে যাচ্ছেন।

স্মৃতি কেন্দ্র

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে স্মৃতিকেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলা একাডেমি।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

বেগম রোকেয়ার উপন্যাসিকা সুলতানার স্বপ্ন অবলম্বনে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা তৈরি করেছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। স্প্যানিশ ভাষায় চলচিত্রটির নাম রাখা হয়েছে 'এল সুয়েনো দে লা সুলতানা'—ইংরেজিতে 'সুলতানাস ড্রিম'।

মৃত্যু

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তার কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন ।

নবীনতর পূর্বতন