শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। তাঁর উপন্যাসে মানুষের অন্তরে তার ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস-সংস্কারের সাথে প্রণয়াকাঙ্ক্ষার যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব-সংঘাত, গার্হস্থ্য ও সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি অসাধারণভাবে শিল্প কুশলতার সাথে অঙ্কিত হয়েছে। বাঙালি সমাজে নারীর বঞ্চনা, নারীর দুঃখ তাঁর উপন্যাসের অন্যতম দিক। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার জন্য তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী নামে খ্যাত।

জন্ম ও পরিবার

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ৩১ ভাদ্র, ১২৮৩ ) হুগলীর দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । [ সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান ] তাদের পিতৃপুরুষের আদিনিবাস ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকট মামুদপুরে । দেবানন্দপুর গ্রাম ছিল প্রকৃতপক্ষে তার পিতার মাতুলালয় । তার পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। তার মাতা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহরের রামধন গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা । গঙ্গোপাধ্যায়রা কালক্রমে বিহার রাজ্যের ভাগলপুরে বসবাস শুরু করেন ৷ পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তার দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তার দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তার এক বোন ছিল। শরৎ চন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বিহার রাজ্যের ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎ চন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল।

শিক্ষাজীবন

পাঁচ বছর বয়সে শরৎচন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবানন্দপুর গ্রামের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তির মাধ্যমে । যেখানে তিনি মাত্র দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুরে দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে তার মামার সহায়তায় ভর্তি হন । ১৮৮৭ সালে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন।কিন্তু সেখানে ও বেশিদিন পড়াশোনা করতে পারেন নি । কারণ তার বাবা মতিলালের চাকরি চলে যায় ১৮৮৯ সালে । যার ফলস্বরুপ জেলা স্কুল ত্যাগ করে তারা দেবানন্দপুর গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হন । অত:পর দেবানন্দপুর গ্রামে থেকে তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন । কিন্তু বিধিবাম এখানেও বেশিদিন টেকে নি ; ১৮৯২ সালে , চরম দারিদ্র্যের জন্য স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি দুটি গল্প লেখেন -'কাশীনাথ' ও 'ব্রহ্মদৈত্য' নামে । ১৮৯৩ সালে মতিলাল সপরিবারে পুনরায় ভাগলপুর ফিরে আসেন । এরপর প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় তাকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন । ১৮৯৪ সালে তিনি এখান থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন এবং তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তার মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়ানোর বিনিময়ে অঘোরনাথ তার কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতেন । এতৎসত্ত্বেও এফ.এ. পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না-পারার জন্য তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এরপর দারিদ্র্যের জন্য আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয় নি ।

কর্মজীবন

শরৎচন্দ্রের কর্মজীবন ছিল খুবই বন্ধুর এবং কন্টকাকীর্ণ । চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি । কলেজ ছাড়ার পর শরৎচন্দ্র কিছুকাল ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটান । একই সময়ে ভাগলপুর শহরের খঞ্জরপুর পল্লীতে তাদের প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে একটি সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন , এ সময় তিনি বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস রচনা করেন যেমন-বড়দিদি, 'দেবদাস', চন্দ্রনাথ, শুভদা ইত্যাদি উপন্যাস এবং 'অনুপমার প্রেম', আলো ও ছায়া, 'বোঝা', হরিচরণ' ইত্যাদি গল্প । যেগুলো বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে থাকত। এই সময় শরৎচন্দ্র বনেলী রাজ-এস্টেটে চাকরি শুরু করেন । কিন্তু কিছুদিন পর পিতার সাথে অভিমান করে তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। পিতার মৃত্যু হলে তিনি ভাগলপুর ফিরে এসে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন শেষে কলকাতা পাড়ি জমান । তাঁর মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় সেখানে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য মাসে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি পান। এ সময়, তিনি 'মন্দির' নামে একটি গল্প লিখেন এবং তা 'কুন্তলীন' প্রতিযোগিতায় পাঠালে তা বিজয়ী ঘোষিত হয়। লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে তিনি ছয়মাস চাকরি করেছিলেন । অত:পর লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে রেঙ্গুনে অবস্থিত তারই ভগ্নিপতি উকিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন । অঘোরনাথ তাকে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন বার্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে । ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বার্মায়ই জীবন অতিবাহিত করেন । দুই বছর পর তার রেলওয়ের চাকরিটি চলে যায় । আবার পড়েন বিপাকে । অত:পর তার বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগু চলে যান ও সেখানে অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসবাস করেন। মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সহায়তায় ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে বার্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসে একটি চাকরি পান । মণীন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন বার্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি এক্সামিনার । এই চাকরিটি তিনি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দশ বছর করেছিলেন । চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে দেশে আসতেন । ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসলে 'যমুনা' পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পাল তাকে পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। কথা অনুযায়ী , তিনি রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে রামের সুমতি গল্পটি ফনীন্দ্রনাথ পালের কাছে পাঠান , যা যমুনা পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন ‘ভারতী’ পত্রিকার দায়িত্বপালনকালে তিনি ভারতী পত্রিকায় ও লেখা শুরু করেন । সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে তার বড় দিদি উপন্যাসটি বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যায় তিন ভাগে প্রকাশিত হয় হয় । প্রথম দুই সংখ্যায় লেখকের নাম ঊহ্য রাখার কারণে এই লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কি না তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী হয়। তাই আষাঢ় সংখ্যায় বড়দিদির লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের নাম প্রকাশ করা হয়। ১৯১৩ সালে যমুনা পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল শরৎচন্দ্রের নিষেধ সত্ত্বেও এই উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ১৯১৬ সালে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্যের কারণে শরৎচন্দ্র চাকরি ছেড়ে দিয়ে রেঙ্গুন থেকে বাংলায় ফিরে আসেন। তারপর তিনি সাহিত্য সাধনা করেই বাকি জীবন কাটান।

বৈবাহিক জীবন

শরৎচন্দ্র দুটি বিয়ে করেছিলেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯০৫ সালে । তিনি যখন বার্মা রেলওয়ে অফিসে চাকরি করতেন তখন তিনি রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বসবাস করতেন। সেখানেই তার বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। শান্তি দেবীর পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ে ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন। ফলে শরৎচন্দ্র বিপাকে পড়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। এভাবেই ১৯০৫ সালে তার প্রথম বিয়ে হয় । তাদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। এর অনেকদিন পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন 'হিরন্ময়ী দেবী'। তাদের ঘরে কোন সন্তান জন্ম নেয়নি।

শেষ জীবন

শেষ জীবনে চূড়ান্ত অপমান ও ব্যক্তি-আক্রমণ সহ্য করেছিলেন শরৎচন্দ্র । তিনি যেমনভাবে পাঠক সমাজে অধিক আদরণীয় হয়েছিলেন তেমনিভাবে অপর এক শ্রেণির লোকের কাছ থেকে পেয়েছেন তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণ। তাঁর সমসাময়িক সময়ে এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অন্য আর কোনও সাহিত্যিকের ভাগ্যে জোটেনি। তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে লোকেরা সামান্য খুঁত পেলেই তাঁকে নিয়ে বানিয়ে মিথ্যে গল্প প্রচার করতে সচেষ্ট হতেন। শুধু তাই নয় সেইসব মিথ্যা , বানোয়াট তথ্যগুলো পত্রিকায় ছাপা হত । তাঁর বিরুদ্ধে যায় এমনসব আজগুবি তথ্য দিয়ে সেই সময়কার অনেক পত্রিকাই তাদের পেট চালাত । বর্তমান সময়ে আমরা যেটাকে ভাইরাল বলে আখ্যায়িত করি শরৎচন্দ্র ঠিক সেরকমটাই ছিলেন সে সময় । তাঁর নামে যা কিছুই লেখা হোক না কেন সে সময় সবার কাছে সেটা ছিল হটকেক । উদাহরণস্বরুপ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি - একবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ শরৎচন্দ্রকে একটি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি উপহার দিলেন। মূর্তিটা শরৎচন্দ্র বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু এত বড় মূর্তি তিনি তো ট্যাক্সি থেকে একা নামাতে পারেন না । তাই বাড়ির কাছে এসে প্রতিবেশী অমরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ডেকে নিয়ে মূর্তিটি ট্যাক্সি থেকে দুজনে মিলে নামালেন। পরের দিন সংবাদ হল - 'শরৎচন্দ্র গতকাল রাতে এতটাই মদ পান করে বাড়ি ফিরেছিলেন যে তাঁকে ধরে ট্যাক্সি থেকে নামাতে হয়েছে।' এভাবেই তাঁকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হত । তাঁর লেখা নিয়ে ও তখনকার সময়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে তাঁর নামে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করা হতো । তবে তিনি তাঁর মতোই কাজ করে গেছেন । দমে যান নি কখনো । যাই হোক মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়া জেলার পানিত্রাস (সামতাবেড়) গ্রামের মাটির বাড়িতে বাস করতেন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দেউলটি স্টেশন থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটারের পথ সামতাবেড়ের বাড়িটা রূপনারায়ণ নদের তীরে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। পাশাপাশি দুটো পুকুরে সানের ঘাট, বাগান, ডালিম, পেয়ারা গাছে ঘেরা। ১৯৭৮ সালের ঘরভাঙানি বন্যায় পাশাপাশি সব গাঁয়ের মাটির বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটা রূপনারায়ণের কূলে থেকেও আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পেয়ে যায়। জানালা পর্যন্ত ভিতটি ইঁট-সিমেন্টে গাঁথা ছিল বলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পড়ে যায়নি। পরে সরকারি উদ্যোগে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র শিবপুরেও থাকতেন। শিবপুর ব্যাতাইতলা বাজার থেকে চ্যাটার্জিহাট পর্যন্ত রাস্তা শরৎচন্দ্রের নামেই চালু আছে। ১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্র প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেওঘরে তিন চার মাস কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়, কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসক তার অস্ত্রোপচারের পক্ষে মত দেন। চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ও পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার দেহে অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চার দিন পর ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় শরৎচন্দ্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

সাহিত্যকর্ম

বার্মা জীবনের পরবর্তী সময়ে তিনি সাহিত্যকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন । তিনি আমাদের বহু গল্প , উপন্যাস , প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন । তিনি ছিলেন মূলত কথা সাহিত্যিক । নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হল :

উপন্যাস

  • বড়দিদি (১৯১৩): বড়দিদি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস । এই উপন্যাসটি ১৯০৭ সালে সরলা দেবী সম্পাদিত 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশকালে বাংলা সাহিত্যে আলোড়নের সৃষ্টি করে । এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে । প্রথমে এর নাম ছিল 'শিশু'। শরৎ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ, নারীচরিত্রের সংযম ও মাধুর্য, শাস্ত্রশাসিত জীবন ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে টানাপোড়েন এবং সহজ সাবলীল ভাষা-সবই এখানে পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত । উল্লেখযোগ্য চরিত্র : সুরেন্দ্রনাথ, ব্রজরাজ, মাধবী, প্রমীলা । বড়দিদি 'মাধবী'র নাম ।
  • বিরাজ বৌ (১৯১৪) : বিরাজ বৌ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত জনপ্রিয় এবং পুস্তক আকারে দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। ‘ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে । বাঙালি গৃহস্থ জীবনের বাস্তব ছবি এবং বাঙালি নারীর মমত্ব ও কারুণ্যের রূপায়ণের জন্য এই উপন্যাস ভাবাকুলতা সত্ত্বেও অভিনন্দিত হয়। সুন্দরী বিরাজ বৌয়ের নানা সমস্যা এ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু ।
  • পরিণীতা (১৯১৪) : এই উপন্যাসটি শরৎচন্দ্রের একটি রোমান্টিক উপন্যাস । এখানে তিনি গুরুচরণকে দিয়ে সমাজের কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের চিত্র অত্যন্ত নিপুণ ভাবে তুলে ধরে ধরেছেন । গুরুচরণ মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন । পরিণীতা উপন্যাসে খুব ছোট একটি দৃশ্যপটে মানবমনের ইন্দ্রিয়বৃত্তির দ্বন্দ্বের বৃহৎ যে রূপ শরৎচন্দ্র এখানে দেখিয়েছেন তা সত্যই অতুলনীয়। স্বার্থ কিংবা লজ্জা অথবা ভয় এর কবলে পতিত হয়ে উত্তাল ইন্দ্রিয় সাগরে মনের নৌকায় দিশেহারা হয়ে চরিত্রগুলোর মানবিক যে স্খলন ঘটে তা এই উপন্যাসের উপজীব্য ।
  • পণ্ডিত মশাই (১৯১৪) : পন্ডিতমশাই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হল বৃন্দাবন। গ্রামের মানুষ বৃন্দাবনকে পন্ডিতমশাই নামে ডাকে। এ উপন্যাসের আকর্ষণীয় ও কেন্দ্রিয় চরিত্র কুসুম চরিত্রের বিকাশে ও প্রকাশে বৃন্দাবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৃন্দাবন অত্যন্ত সৎ চরিত্র , স্বল্পবাক এবং স্বভাবধর্মে বিনয়ী ও সংযত মানুষ। এ উপন্যাসে সততা , ন্যায় , মানবিকতার বিকাশ ঘটানো হয়েছে বৃন্দাবন চরিত্রটির মাধ্যমে ।
  • পল্লীসমাজ (১৯১৬): উপন্যাসটি ১৯১৫ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলার পল্লীজীবনের নীচতা ও ক্ষুদ্র রাজনীতির পটভূমিকায় এক আদর্শবাদী যুবক- যুবতীর সম্পর্ক ও বিশেষ করে তাদের অভিশপ্ত প্রেমকাহিনি এই উপন্যাসের মূল বিষয়। এ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘রমা’ (১৯২৮)। চরিত্র: রমা, রমেশ, বেণী, বলরাম।
  • বৈকুণ্ঠের উইল (১৯১৬) : একজন ব্যবসায়ী লোক বৈকুণ্ঠ মজুমদার। ব্যবসার প্রতি তাঁর যেমন আদর্শ, তেমনিই ভালোবাসা। খুব সৎভাবে পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁর ধ্বংসপ্রায় মুদির দোকানকে বড় আড়তে পরিণত করেন তিনি। বৈকুণ্ঠের দুই ছেলে-বড় ছেলে গোকুল এবং ছোট ছেলে বিনোদ। গোকুল হচ্ছে তাঁর প্রথম স্ত্রীর সন্তান, যখন তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যান তখন ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেন এবং সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান হচ্ছে বিনোদ। গোকুল অনেকটা বোকা ধরনের কিন্তু বাবা, মা এবং ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা অনেক গভীর। পড়ালেখাতে ভালো ছিল না বিধায় সে ছোটবেলা থেকেই বাবার আড়তের কাজে লেগে যায়। অন্যদিকে বিনোদ পড়ালেখায় খুবই ভালো তাই সবার আস্থা ও আশা বেশি তাকে নিয়ে । কিন্তু বিনোদের স্বভাব-চরিত্র, চালচলনে মোটেও সন্তুষ্ট নন বাবা বৈকুণ্ঠ । বৈকুণ্ঠের কেন যেন মনে হয় এত কষ্ট করে গড়ে তোলা তাঁর সহায়-সম্পদ বিনোদ আরাম-আয়েস করেই ধ্বংস করে দেবে আর এই ভাবনা থেকেই মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর স্ত্রী ভবানীর সম্মতি নিয়ে সমস্ত সম্পত্তি গোকুলের নামে উইল করে যান। গোকুল বোকাসোকা হলেও সে যথেষ্ট আদর্শবান । এই বিষয়-আশয়ের উইল নিয়ে দুই ভাইয়ের মনোভাবের কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ ।
  • অরক্ষণীয়া (১৯১৬) : অরক্ষনীয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে যাকে বিবাহ না দিয়ে ঘরে রাখা যায় না। এটি একটি চিরায়ত সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গিনি। গিনির বয়স অল্প। গিনিকে ঘিরেই পুরো উপন্যাস। মা দুর্গা মনিকে নিয়ে তার জীবনে দুঃখের শেষ নেই। গিনির রুপ নেই । রূপ না থাকা এক গরীব দুঃখী মেয়ের এ সমাজে বিয়ে দেয়া যে কতটা কঠিন এই সামাজিক সমস্যাটি অত্যন্ত নিপুণভাবে লেখক তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে ।
  • শ্রীকান্ত : ‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের আত্মজৈবনিক উপন্যাস । এর চারটি খণ্ড। ১ম খণ্ড ১৯১৭, ২য় খণ্ড ১৯১৮, ৩য় খণ্ড ১৯২৭, ৪র্থ খণ্ড ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । ১ম খণ্ড মাসিক ‘ভারতবর্ষে' (১৯১৬-'১৭) ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী' নামে প্রকাশ পায় । লেখকের নাম মুদ্রিত হয় শ্রীশ্রীকান্ত শর্মা'। ২য় ও ৩য় খণ্ড ও ‘ভারতবর্ষে প্রকাশ পায় । তবে ৪র্থ খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয় 'বিচিত্রা' পত্রিকায় । ১ম খণ্ডে বালক শ্রীকান্তের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন । খণ্ডটি যখন শেষ হয় তখন শ্রীকান্তের মনে হলো : 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।' এই খণ্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, ইন্দ্ৰনাথ, অন্নদাদিদি, রাজলক্ষ্মী (পিয়ারী)। ২য় খণ্ডে যুবক শ্রীকান্তের রেঙ্গুন যাত্রার জীবন্ত উপস্থাপনা আছে । এই অংশে শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর আন্তরিকতা অন্যদের সম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে । এই খণ্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, অভয়া, রোহিণী, গুরুদেব, রাজলক্ষ্মী । ৩য় খণ্ডে অসুস্থ শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীর শুশ্রূষায় সুস্থ হলেও তাদের মধ্যে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয় । শ্রীকান্ত তাই রেঙ্গুনে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগে রাজলক্ষ্মীর কাছে বিদায় নিতে এসে দেখে রাজলক্ষ্মীর সন্ন্যাসিনীর বেশ। এ খণ্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত, যদুনাথ, সুনন্দা, কুশারী, রাজলক্ষ্মী । ৪র্থ খণ্ডে শ্রীকান্তের সঙ্গে পুঁটুর বিয়ের দিন ধার্য, রাজলক্ষ্মীর সন্ন্যাসিনীর বেশ ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক গ্ৰহণ, কমললতা কর্তৃক শ্রীকান্তকে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত ও মৃত্যুপথযাত্রী গহরকে সেবা করার কাহিনি আছে । উপন্যাসটি শেষ হয় কমললতার নিরুদ্দেশ যাত্রার মধ্য দিয়ে । এ খণ্ডের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : শ্রীকান্ত,ঠাকুর্দা, পুঁটু, গহর, কমললতা, রাজলক্ষ্মী ।
  • নিষ্কৃতি (১৯১৭) : নিষ্কৃতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ক্ষুদ্র উপন্যাস। এর প্রথমাংশ ‘ঘরভাঙা' নামে ‘যমুনা' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে বিরোধ ও শেষ পর্যন্ত সম্প্রীতি এই কাহিনির উপজীব্য । উল্লেখযোগ্য চরিত্র : গিরিশ, রমেশ, সিদ্ধেশ্বরী, শৈলজা প্রমুখ । ১৯৪৪ সালে Deliverance নামে দিলীপকুমার রায়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ।
  • দেবদাস (১৯১৭): উপন্যাসটি 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । সামাজিক প্রতিবন্ধকতায় দেবদাস তার বাল্যপ্রণয়ী পার্বতীকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয় । সেই ব্যর্থতায় নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করার বেদনাময় কাহিনি । এই উপন্যাস সমস্ত ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হয়। দেবদাস ও পার্বতী আধুনিক ভারতীয় জীবনে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকার রূপকে পরিণত করেছে । বাংলায় বহুবার এর চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। ২০০৪ সালে হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত হয়ে বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগায়। এর পরিচালক ছিলেন সঞ্জয় লীলা বংশালী। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র : দেবদাস, পার্বতী (পারু), চন্দ্রমুখী, চুনিলাল, ধর্মদাস ।
  • চরিত্রহীন (১৯১৭) : উপন্যাসটি প্রথমে 'যমুনা' পত্রিকায় কিছুটা প্রকাশিত হয়। প্রথা বহির্ভূত প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক সময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । সতীশ ও সাবিত্রী, দিবাকর ও কিরণময়ীর তৎকালীন এবং বর্তমান সমাজ অননুমোদিত সম্পর্ক কাহিনির মুখ্য আকর্ষণ। উপন্যাসের নামকরণ তাই ‘চরিত্রহীন' ।
  • দত্তা (১৯১৮) : 'দত্তা' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত সুখপাঠ্য প্রেমের উপন্যাস । ১৩২৪- '২৫ বঙ্গাব্দে 'ভারতবর্ষে' প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসটি 'বিজয়া' (১৯৪৩) নামে নাট্যায়িত হয়। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : বিজয়া, নরেন, রাসবিহারী, বনমালী ।
  • গৃহদাহ (১৯২০) : ' গৃহদাহ' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক রচিত একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস । মাসিক 'ভারতবর্ষে' প্রকাশিত হয় । মহিম ও সুরেশ দুই পুরুষের প্রতি অচলার আকর্ষণ-বিকর্ষণ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় উপকরণ । বিবাহ-বহির্ভূত কথিত অসামাজিক প্রেমের কাহিনিটি নিপুণ ঘটনা সংস্থানে ও বর্ণনার মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার দ্বারা সমস্যায়িত হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র হিন্দু বিধবা মৃণালকে আদর্শ হিসেবে রূপায়িত করেছেন । চরিত্র: সুরেশ, অচলা, মহিম।
  • বামুনের মেয়ে (১৯২০) : সন্ধ্যা একজন উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণের মেয়ে এবং এজন্য সে গর্বিত। এই কারণেই তিনি অরুণকে ঘৃণা করেন, যিনি শিক্ষিত এবং সদাচারী, কিন্তু একজন নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টে যায় তখনই যখন সন্ধ্যার বিয়ে হতে চলেছে গোলক চ্যাটার্জি , একজন সহকর্মী ব্রাহ্মণের সাথে । এমন সময় জানা যায়, সন্ধ্যা আসলে একজন শূদ্র নাপিত কন্যা। সন্ধ্যা কি করবে? তার প্রকৃত পিতামাতার প্রকাশের সাথে সাথে, তার বিবাহ কি বাতিল হয়ে যাবে? শরৎচন্দ্র এই জাত প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত করে যেমন করে রবী ঠাকুর "গোরা" উপন্যাসে করেছিলেন। বামুনের মেয়ে আর গোরা একে অপরের পরিপুরক ।
  • দেনাপাওনা (১৯২৩): এ উপন্যাসের বিখ্যাত চরিত্র- জীবানন্দ, ষোড়শী। 'দেনাপাওনা' শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই নারীপুরুষের সম্পর্ক, নারীত্ব ও সতীত্বের ধারণার বিচার এই আখ্যানের মূলসূত্র । কাহিনির নায়ক জীবনানন্দ শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্যতম । এই উপন্যাস ‘ষোড়শী’ (১৩২৭) নামে নাট্যায়িত হয় এবং মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয় ।
  • নববিধান (১৯২৪) : 'নববিধান' উপন্যাসের বিষয়ও দাম্পত্য প্রেম, তবে তা ব্যক্তিগত অভিরুচির সঙ্গে এক নব বিধানের সঞ্চার করেছে এই উপন্যাস ।
  • পথের দাবী (১৯২৬): ‘পথের দাবী' একটি রাজনৈতিক উপন্যাস । স্বদেশী বিপ্লবীদের হাতে হাতে থাকত কাহিনির পটভূমিকা ব্রহ্মদেশ । এক গুপ্ত বিপ্লবী দলের নায়ক সব্যসাচী এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। কারো কারো মতে সব্যসাচী চরিত্রে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ছায়াপাত ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এই কাহিনিতে ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা এবং সশস্ত্র বিপ্লবকে আন্তরিক সমর্থন আছে । গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় । নান্দনিক মানদণ্ডে ‘পথের দাবী' উৎকৃষ্ট সাহিত্য কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে । কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এ উপন্যাস উদ্দীপকের ভূমিকা রাখে । ‘আমি বিপ্লবী, ভারতের স্বাধীনতাই আমার একমাত্র কাম্য, আমার একটিমাত্র সাধনা।' এই বক্তব্য ছিল উপন্যাসের শেষে । ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই গ্রন্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় ১৩২৯-এর ফাল্গুন সংখ্যা থেকে 'পথের ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয় ।
  • শেষপ্রশ্ন (১৯৩১) : শেষপ্রশ্ন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিতর্কপ্রধান ও সমস্যামূলক উপন্যাস । শরৎচন্দ্রের মূল উপন্যাস ধারা থেকে এটি কিছুটা পৃথক । উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র কমল । বাস্তব অপেক্ষা আদর্শের দ্বারা এই চরিত্র রূপায়িত হয়েছে। কমল কোনো সংস্কার ও ঐতিহ্যকে স্বীকার করে না, জীবনে কোনো কিছুকেই তর্কাতীত ও শাশ্বত বলে মানে না। সম্পূর্ণ নূতন ধরনের নারীচরিত্র রচনার জন্য এই উপন্যাস স্মরণীয় । শিবনাথ-মনোরমা, অজিত-কমল, নীলিমা -আশুবাবুর প্রণয়ের নানা-মাত্রা এখানে প্রকাশিত ।
  • বিপ্রদাস (১৯৩৫): বিপ্রদাস' জনপ্রিয় এবং সুখপাঠ্য উপন্যাস । বিপ্রদাস, দ্বিজদাস, বন্দনা প্রভৃতি চরিত্র এবং তাদের মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এবং মাধুর্য, কাহিনীর টানাপোড়েন এবং পরিণাম-রমণীয়তা এই উপন্যাসটিকে বিশেষ জনপ্রিয় করেছিল সমগ্র ‘বিপ্রদাস' ‘বিচিত্রা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । এটি শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ উপন্যাসগ্রন্থ ।
  • শেষের পরিচয় (১৯৩৯): ‘শেষের পরিচয়' শরৎচন্দ্র মৃত্যুর পূর্বে শেষ করতে পারেন নি । পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের ‘রাখাল এ প্রশ্নে নীরবে বাহির হইয়া গেল' পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের রচনা । বাকি অংশ রাধারানী দেবী কর্তৃক রচিত । উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ‘ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল ।

প্রবন্ধ

তিনি খুব বেশি প্রবন্ধ রচনা করেন নি । কিন্তু যে কয়টি প্রবন্ধই তিনি লিখেছিলেন তাতেই তিনি অকপটভাবে, সহজ সরল ভাষাতেই নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরতে পেরেছেন । নিচে সেগুলো দেওয়া হল :

  • নারীর মূল্য (১৯২৩): ‘নারীর মূল্য' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত নারীর সামাজিক অধিকার ও সমাজে নারীর স্থান সম্পর্কিত মূল্যবান নিবন্ধ গ্রন্থ। 'অনিলা দেবী' ছদ্মনামে 'যমুনা' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । অনিলা দেবী শরৎচন্দ্রের বড়দিদির নাম ।
  • তরুণের বিদ্রোহ (১৯২৯): এ প্রবন্ধটি ১৯২৯ সালের ৩০ মার্চ রংপুর বঙ্গীয় যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ। এ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘সত্য ও মিথ্যা' নামে আরো একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • স্বদেশ ও সাহিত্য (১৯৩২) : এ প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ স্থান পায় যেমন- স্বরাজ সাধনায় নারী, শিক্ষার বিরোধ , স্মৃতিকথা , অভিনন্দন , ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য , গুরু-শিষ্য সংবাদ , সাহিত্য ও নীতি , সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি ইত্যাদি । উল্লেখ্য স্বর্গীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কারামুক্তির পর মির্জাপুর পার্কে (বর্তমান শ্ৰদ্ধানন্দ পার্ক) দেশবাসীর পক্ষ হইতে তাহাকে যে অভিনন্দন পত্র দেওয়া হয়, তাহা শরৎচন্দ্রের রচনা। আর এটাই অভিনন্দন নামে স্বদেশ ও সাহিত্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয় ।

ছোটগল্প

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সহজ সরল ও সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় পরম যত্নে তুলে ধরেছেন । তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম ‘মন্দির’। এটি কুন্তলীন পুরস্কার পায় ১৯০৩ সালে।

  • কাশীনাথ (১৯১৭): সতের বছর বয়সে তিনি সর্বপ্রথম পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নামে গল্পটি লিখেন। এই গল্পগ্রন্থে সাতটি গল্প রয়েছে যথা: কাশীনাথ, আলো ও ছায়া , মন্দির , বোঝা , অনুপমার প্রেম , বাল্যস্মৃতি , হরিচরণ । প্রথম গল্প কাশীনাথ এবং শেষ গল্প হরিচরণ ।
  • মন্দির ( ১৯০৩ ) : এটি কুন্তলীন পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকের প্রথম প্রকাশিত গল্প । "বসুমতী" পত্রিকার সম্পাদক দেড়শ'টি গল্পের মধ্যে "মন্দির" গল্পটিকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেন। অমরনাথ অপর্ণাকে বিবাহ করেও দাম্পত্য জীবনে শান্তিলাভ করতে পারেনি। অপর্ণা পিতৃগৃহে স্থাপিত রাধাকৃষ্ণের চরণে নিজেকে উৎসর্গীকৃত করেছেন অনেক আগে। উল্লেখযোগ্য চরিত্র : 'অমরনাথ', 'অপর্ণা' প্রমুখ।
  • মহেশ (১৯২২): শরৎচন্দ্র রচিত সবচেয়ে সার্থক ছোটগল্প হলো 'মহেশ'। এ গল্পটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ‘মহেশ’ একটি বলদের নাম। মহেশের প্রতি দরিদ্র কৃষক গফুরের অকৃত্রিম ভালোবাসা; মহেশকে খেতে দিতে না পারার বেদনা, কসাইয়ের কাছে মহেশকে বিক্রি এবং পরে অস্বীকার, গফুর কর্তৃক মহেশের মাথায় আঘাত এবং মহেশের মৃত্যু; শেষান্তে রাতের আঁধারে গফুরের গ্রাম ত্যাগ — এ কাহিনিই ‘মহেশ' গল্পে বর্ণিত হয়েছে।
  • অভাগীর স্বর্গ (১৯২৩): এই গল্পটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ( ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ ) মাঘ সংখ্যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ।
  • বিলাসী (১৯১৮): এই গল্পটি ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ( ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ ) বৈশাখ সংখ্যায় ভারতী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ।

বড় গল্প

  • বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য গল্প (১৯১৪) : 'বিন্দুর ছেলে', 'রামের সুমতি' ও 'পথনির্দেশ' এই তিনটি গল্পের সংকলন 'বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৪)। এই গল্পগুলি 'যমুনা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । প্রত্যেকটি গল্পে শরৎচন্দ্রের আখ্যান রচনার স্বাভাবিক নৈপুণ্য আছে গল্পগুলি শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় রচনার অন্যতম ।
  • ছবি (১৯২০): ‘ ছবি' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত গল্পগ্রন্থ । ছবি, বিলাসী ও মামলার ফল এই তিনটি গল্পের সংকলন। 'ছবি' গল্পের ঘটনাস্থল ব্রহ্মদেশ। চিত্রকর বা- থিন এবং ধনীকন্যা মাশায়ের গভীর প্রেম এই গল্পের বিষয়বস্তু। 'বিলাসী' গল্পে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়-বিলাসীর বিয়ে সংঘটনের মাধ্যমে। গল্পের ন্যাড়া চরিত্র আসলে লেখক নিজেই । ‘মামলার ফল' গল্পে দুই ভাইয়ের (শিবু ও শম্ভু) মামলায় নিঃসন্তান সঙ্গামণির অপত্য শিশু গয়ারামকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে ।
  • অনুরাধা সতী ও পরেশ (১৯৩৪) : অনুরাধা সতী ও পরেশ” (১৯৩৪) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত তিনটি গল্পের সংগ্রহ। ‘অনুরাধা’ ভারতবর্ষে, 'সতী' বঙ্গবাণীতে এবং ‘পরেশ’ ‘শরতের ফুল’ নামক সাময়িকীর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় । তিনটি রচনারই বিষয় প্রেম এবং পারিবারিক দ্বন্দ্ব । ‘সতী' গল্পটি শরৎ রচনার ব্যতিক্রম । এক সতীসাধ্বী কিন্তু সন্দেহপরায়ণা স্ত্রী এই কাহিনির নায়িকা অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ গল্প হিসেবে শরৎ- সাহিত্যে ‘অনুরাধা’ সর্বশেষ গল্প । ‘পরেশ’ গল্পের প্রধান চরিত্র গুরুচরণের নামে এর নামকরণ হতে পারত ।
  • মেজদিদি ও অন্যান্য গল্প (১৯১৫): এটি শরৎচন্দ্র প্রকাশিত দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ । এটি মেজদিদি, দর্পচূর্ণ ও আঁধারে আলো গল্পের সংকলন। মেজদিদি গল্পটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের ( ১৯১-১৫ খ্রিস্টাব্দ ) ভাদ্র সংখ্যায় , দর্পচূর্ণ কার্তিক সংখ্যায় , আঁধারে আলো মাঘ সংখ্যায় ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । ‘মেজদিদি' শরৎচন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় রচনা। তিনটি রচনাই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে । এই গ্রন্থে নারীর মহত্ত্বের পাশাপাশি ‘স্বামীর কাছে স্ত্রীর অহংকার সাজে না' এই বক্তব্যও প্রকাশিত । ‘মেজদিদি'র চরিত্র: হেমাঙ্গিনী, কেষ্ট, কাদম্বিনী।
  • স্বামী (১৯১৮ ): এ গল্পগ্রন্থে দুটি গল্প রয়েছে যথা স্বামী ও একাদশ বৈরাগী । স্বামী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ( ১৯১৭ ) শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় নারায়ণ পত্রিকায় । আর একাদশ বৈরাগী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ( ১৯১৭ ) কার্তিক সংখ্যায় ভারতবর্ষ পত্রিকায় ।

নাটক

শরৎচন্দ্রের নাটকগুলো: ষোড়শী (১৯২৮), রমা (১৯২৮), বিজয়া (১৯৩৫)।

চলচ্চিত্রায়ণ

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য-কর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে । এর মধ্যে তার 'দেবদাস' উপন্যাসটি নিয়েই বাংলা, হিন্দি এবং তেলুগু ভাষায় আটবার চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এছাড়া মেজদিদি, দর্পচূর্ণ ও আঁধারে আলো গল্পগুলো নিয়ে ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে । তার 'বড়দিদি', উপন্যাসটি নিয়ে ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। 'পরিণীতা' উপন্যাস দু-বার চলচ্চিত্রায়িত হয় । তাছাড়া তার 'স্বামী' (১৯৭৭) গল্পটি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা লেখকের পুরস্কার পান। 'বিন্দুর ছেলে' গল্প অবলম্বনে ও 'ছোটি বহু' (১৯৭১) নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ১৯৭৬ সালে তার 'দত্তা' উপন্যাসটির গল্প অবলম্বনে 'দত্তা' চলচ্চিত্র তৈরি হয় । এছাড়া তার 'নববিধান' উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ২০১৩ সালে 'তুমহারি পাখি' নামে একটি ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয় ।

ছদ্মনাম

শরৎচন্দ্র সাতটি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন যথা: অনিলা দেবী; অপরাজিতা দেবী; শ্রী চট্টোপাধ্যায়; অনুরূপা দেবী; পরশুরাম (পরশুরাম রাজশেখর বসুরও ছদ্মনাম । সাহিত্যসমাজে রাজশেখর বসুই এ নামে অধিক পরিচিত।); শ্রীকান্ত শর্মা; সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ।

পদক প্রাপ্তি

শরৎচন্দ্র ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রী লাভ করেন । উল্লেখ্য, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর মাতার নামে জগত্তারিণী পদক প্রবর্তন করেন ।

নবীনতর পূর্বতন