একটা দালান কোঠা তৈরি করতে যেমন একটা একটা করে ইটের গাথুঁনির প্রয়োজন হয় তেমনিভাবে ধ্বনি ও ভাষার প্রাণ। একাধিক ধ্বনি মিলিত হয়ে এক একটা শব্দ তৈরি হয়। সুতরাং ধ্বনি ছাড়া ভাষার কল্পনাই করা যায় না। ধ্বনির উৎপত্তি না হলে ভাষা কোনভাবেই সৃষ্টি হত না। মানুষ তার নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব এত সহজ ভাবে প্রকাশ করতে পারত না । কিন্তু ধ্বনি যেহেতু মানুষের উচ্চারণের বিষয় তাই ভাষার শব্দ বহুজনে ব্যবহৃত হতে হতে কখনো সেই শব্দের ধ্বনিসমূহের নির্দিষ্ট ক্রমরক্ষা হয় না অথবা এর কোনো কোনো ধ্বনি লোপ পায় বা এতে নতুন ধ্বনির আগমন ঘটে কিন্তু পরিবর্তিত ধ্বনিটি দ্বারা পূর্বের অর্থটিই বোঝায়। অর্থাৎ পূর্বের অর্থ প্রকাশ করার জন্য মানুষ নতুন উচ্চারণটিকেই একসময় গ্রহণ করে নেয়। এতে করে হারিয়ে যায় পূর্বের উচ্চারণরীতি। আর এভাবেই পরিবর্তিত হয় ভাষা। শব্দের ধ্বনিসমূহের এরুপ পরিবর্তনকেই বলা হয় ধ্বনি পরিবর্তন। যেমন “স্কুল ” এই শব্দটি দ্রুত উচ্চারণ করলে হয় ইস্কুল ।এখানে শব্দের শুরুতে একটি স্বরধ্বনি “ই” অবচেতন মনেই যুক্ত হয়ে গেল । সাধারণত আমরা তাই করে থাকি উচ্চারণের সময়। এই ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আসুন তা আমরা জানার চেষ্টা করি।
- ধ্বনি পরিবর্তনের কারণসমূহ
- ধ্বনি পরিবর্তনের প্রকারভেদ
- আদি স্বরাগম (Prothesis)
- মধ্য স্বরাগম, স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ (Anaptyxis)
- অন্ত স্বরাগম (Apotheosis)
- অপিনিহিতি (Apenthesis)
- অসমীকরণ (Dissimilation)
- স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony)
- ধ্বনিলোপ
- ধ্বনি বিপর্যয় (Metathesis)
- সমীভবন বা সমীকরণ (Assimilation)
- বিষমীভবন (Dissimilation)
- দ্বিত্বব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা (Long Consonant)
- ব্যঞ্জন বিকৃতি
- অন্তর্হতি
- অভিশ্রুতি
- ঘোষীভবন
- অঘোষীভবন
- অন্যান্য ধ্বনি পরিবর্তন
☞ ধ্বনি পরিবর্তনের কারণসমূহ
- ক. উচ্চারণের দ্রুততা: অনেক সময় আমরা একটু দীর্ঘ শব্দকে তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করার জন্য সংক্ষিপ্ত করে ফেলি।অর্থাৎ দ্রুতগতিতে উচ্চারণ করার বাসনায় আমরা অবচেতন মনেই ধ্বনির পরিবর্তন করে নেই। যা দ্বারা পূর্বের অর্থই প্রকাশ পায়।যেমন-বউদিদি> বউদি ইত্যাদি।
- খ. উচ্চারণের সহজতা: উচ্চারণকে সহজীকরণ করার জন্য আমরা উচ্চারণের সময় মূল শব্দের মহাপ্রাণ ধ্বনিকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি দিয়েই প্রকাশ করে নেই। এতে আমাদের উচ্চারণের শ্রম লাঘব হয় যার ফলস্বরুপ ধ্বনির পরিবর্তন।।যেমন-বাঘ>বাগ ।উচ্চারণের সময় “ঘ” এর পূর্ণ উচ্চারণ করি না যার ফলে এটা”গ” এর উচ্চারণই অবচেতন মনে হয়ে যায়।
- গ. উচ্চারণের সময় অসাবধানতা: উচ্চারণের সময় অসাবধানতার কারণে ও ধ্বনির পরিবর্তন হয়।এটা সাধারণত হয়ে থাকে আঞ্চলিক বা উপভাষার ভাষার প্রভাবে।একেকটি ধ্বনির উচ্চারণ একেক অঞ্চলে এক এক রকম হয়ে যায়।
- ঘ. মুখগহ্বরের প্রত্যঙ্গ-আড়ষ্টতা বা হীনতা: এটা সাধারণত মানুষের বাগযন্ত্রের ত্রুটিজনিত কারণে হয়ে থাকে।অনেক সংযুক্ত ধ্বনিই অনেকে সংযুক্তভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। এটা ও এক ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন।
☞ ধ্বনি পরিবর্তনের প্রকারভেদ
আসলে ধ্বনি পরিবর্তনের প্রকারভেদ নিয়ে স্পষ্টভাবে কোথাও উল্লেখ নেই।তবে ধ্বনি যেহেতু দুই প্রকার স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি। এইদিক থেকে বিবেচনা করলে ধ্বনির পরিবর্তন দুই প্রকার বলা যেতে পারে। কারণ ধ্বনির পরিবর্তনে হয় স্বরধ্বনির প্রয়োজন অথবা বিচ্যুতি ঘটবে নতুবা ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে এরুপ ঘটবে। ধ্বনির পরিবর্তন কত প্রকার? এই প্রশ্নটি ২০১৮ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ১ম ধাপের প্রশ্নপত্রে করা হয়েছিল। তাছাড়া আর কোথাও এই প্রশ্নটি এখনও পর্যন্ত করা হয় নি।কেউ কেউ আবার তিন প্রকার ও বলে থাকেন। তাদের যুক্তি স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির আগমন এবং বিচ্যুতি ছাড়া ও ধ্বনির পরিবর্তন হয়। তাদের ভাষ্য ধ্বনির স্থানান্তর ও ঘটে থাকে যেমন- রিকশা> রিশকা।তবে স্থানান্তরকে যদি প্রকারভেদে নেই তাহলে তো রুপান্তরকেও নিতে হবে । যেমন গল্প> গপ্প ।এখানে ল পরিবর্তিত হয়ে প তে রুপান্তরিত হয়েছে। যাই হোক এ বিষয়টির সুষ্পষ্ট প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই এই আর্টিকেলে উল্লেখ করব। ভাষার পরিবর্তন ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমেই ঘটে থাকে। ধ্বনির পরিবর্তন বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে।নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
☞ আদি স্বরাগম (Prothesis)
মূল শব্দের আদিতে বা শুরুতে সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে তা না ভেঙেই তার আগে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে আদি স্বরাগম বলে। যেমন:
- স্কুল > ইস্কুল
- স্পর্ধা > আস্পর্ধা
- স্তাবল > আস্তাবল
- স্টিমার > ইস্টিমার ইত্যাদি।
☞ মধ্য স্বরাগম, স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ (Anaptyxis)
সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিকে ভেঙে তার মধ্যে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে মধ্য স্বরাগম, স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বলে। যেমন:
- রত্ন > রতন (র্+অ+ত+ন)
- ধর্ম > ধরম
- স্বপ্ন > স্বপন
- ফিল্ম > ফিলিম
- মুক্ত > মুকুতা
- ভ্রু >ভুরু
- গ্রাম > গেরাম
- শ্লোক > শোলক
- মুরগ > মুরোগ
- ক্লি > কিলিপ ইত্যাদি।
☞ অন্ত স্বরাগম (Apotheosis)
মূল শব্দের শেষে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে অন্ত স্বরাগম বলে। যেমন:
- সত্য>সত্যি
- বেঞ্চ>বেঞ্চি
- পোখত্ > পোক্ত
- দিশ্> দিশা ইত্যাদি।
☞ অপিনিহিতি (Apenthesis)
শব্দের মধ্যে ‘ই’ বা ‘উ’ থাকলে সেই ‘ই’ বা ‘উ’ কে আগে থেকেই উচ্চারণের প্রবণতাকে অপিনিহিতি বলে। অর্থ্যাৎ শব্দে ই বা উ ধ্বনি থাকলে তাদের উচ্চারণ যথাস্থানের আগে করার প্রবণতাই অপিনিহিতি। যেমন:
- আজি > আইজ
- চারি > চাইর
- রাখিয়া > রাইখ্যা
- বাক্য > বাইক্য ইত্যাদি।
☞ অসমীকরণ (Dissimilation)
সমধ্বনি পাশাপাশি উচ্চারণের সময় অনেক ক্ষেত্রে মাঝখানে একটি স্বরধ্বনি যুক্ত হয় অথবা একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দুর করার জন্য মাঝখানে যখন স্বরধ্বনি যুক্ত হয় তখন তাকে অসমীকরণ বলে। একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি দুর করতে মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত হয়। যেমন:
- ফট+ফট = ফটাফট
- ধপ+ধপ = ধপাধপ
- টপ+টপ = টপাটপ ইত্যাদি।
☞ স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony)
পরপর দুটি স্বরধ্বনি থাকলে উচ্চারণের সময় একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে শব্দে অপর স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বা উচ্চতাসাম্য বলে। যেমন: কবুল>কোবুল; বিলাতি>বিলিতি; মুলা>মুলো; বিদ্যা>বিদ্যে; দেশি>দিশি; তুলা>তুলো; মোজা>মুজো; জুতা>জুতো; ফিতা>ফিতে; নৌকা>নৌকো; পূজা>পূজো; সুতা>সুতো; শিয়াল>শেয়াল; ধুলা>ধুলো ইত্যাদি। একে আবার ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
- প্রগত(Progressive): আদিস্বর অনুযায়ী অন্ত্যস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: মুলা>মুলো, তুলা>তুলো ইত্যাদি।
- পরাগত (Regressive): অন্ত্যস্বর অনুযায়ী আদিস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: দেশি>দিশি।
- মধ্যগত (Mutul): আদিস্বর ও অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে। যেমন: বিলাতি>বিলিতি
- অন্যোন্য (Reciprocal): আদিস্বর ও অন্ত্যস্বর দুটিই পরস্পর প্রভাবিত হলে। যেমন: মোজা>মুজো
- চলিত বাংলা স্বরসঙ্গতি: মিঠা > মিঠে, চুলা > চুলো, ইচ্ছা>ইচ্ছে ইত্যাদি।
- বিশেষ নিয়মে – এখনি > এখুনি।
☞ ধ্বনিলোপ
উচ্চারণের সময় শব্দস্থিত কিছু ধ্বনি উচ্চারিত হয়না। এই প্রক্রিয়াকে ধ্বনিলোপ বলে। স্বরধ্বনি লুপ্ত হলে বা উচ্চারিত না হলে স্বরধ্বনিলোপ বা সম্প্রকর্ষ, ব্যঞ্জনধ্বনি লুপ্ত হলে ব্যঞ্জনধ্বনিলোপ বা ব্যঞ্জনচ্যুতি বলে। স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে-
- আদিস্বর লোপ: শব্দের আদি বা প্রথমে স্বরধ্বনিলোপ পেলে। যেমন: অলাবু>লাবু>লাউ; উদ্ধার>উধার>ধার ইত্যাদি
- মধ্যস্বর লোপ: শব্দের মধ্যে স্বরধ্বনি লোপ পেলে। যেমন: বসতি>বস্ তি; গামোছা>গাম্ ছা ইত্যাদি।
- অন্ত্যস্বর লোপ: শব্দের অন্তে বা শেষে লোপ পেলে। যেমন: আজি (ই)>আজ; চারি (ই)>চার ইত্যাদি।
উল্লেখ্য স্বরাগম এবং স্বরালোপ সম্পর্কে পরস্পর বিপরীত। অনুরূপভাবে ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে-
- আদি ব্যঞ্জনলোপ: রংপুর>অংপুর; শ্রাবণ>শাবন
- মধ্যব্যঞ্জনলোপ: মজদুর>মজুর; দুগ্ধ> দুধ
- অন্তব্যঞ্জনলোপ: বৌদিদি>বৌদি; ছোটকাকা>ছোটকা; শিয়ালদহ>শিয়ালদ
☞ ধ্বনি বিপর্যয় (Metathesis)
উচ্চারণের সময় শব্দের দুটি ব্যঞ্জন পরস্পর স্থান পরিবর্তন করলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। যেমন:
- নকশা > নশকা
- কলমি > কমলি
- পিশাচ > পিচাশ
- রিক্সা > রিস্কা
- লোকসান > লোসকান ইত্যাদি।
☞ সমীভবন বা সমীকরণ (Assimilation)
উচ্চারণের সময় পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্প বিস্তর সমতা লাভ করলে তাকে বলা হয় সমীভবন। একে ব্যঞ্জনসঙ্গতিও বলা হয়। যেমন: দুর্গা>দুগ্গা; জন্ম>জম্ম ইত্যাদি।
- ক.প্রগত সমীভবন (Progressive): পূর্ববর্তী ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে।অর্থাৎ পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনির মতো হয়, একে বলে প্রগত সমীভবন। যেমন-চক্র>চক্ ক,পক্ ক> পদ্ম>পদ্দ,লগ্ন>লগ্ ন।
- খ.পরাগত সমীভবন (Regressive): পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়, একে বলে পরাগত সমীভবন। যেমন-তৎ+জন্য> তজ্জন্য, তৎ+হিত>তদ্ধিত,উৎ+মুখ>উন্মুখ> ইত্যাদি।
- গ.অন্যোন্য সমীভবন (Reciprocal): যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় তখন তাকে বলে অন্যোন্য সমীভবন। যেমন-সংস্কৃত সত্য>প্রাকৃত সচ্চ, সংস্কৃত বিদ্যা > প্রাকৃত বিজ্জা।
☞ বিষমীভবন (Dissimilation)
দুটো সমবর্ণের একটির পরিবর্তনকে বিষমীভবন বলে। যেমন:
- শরীর > শরীল
- লাল > নাল
- জরুরি > জরুলি
- লাঙ্গল > নাঙ্গল ইত্যাদি।
☞ দ্বিত্বব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জনদ্বিত্বতা (Long Consonant)
কখনো কখনো জোর দেয়ার জন্য শব্দের অন্তর্গত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়, তাকে দ্বিত্ব ব্যঞ্জন বা ব্যঞ্জন দ্বিত্বতা বলে। যেমন- পাকা>পাক্কা,সকাল>সক্কাল ইত্যাদি।
☞ ব্যঞ্জন বিকৃতি
শব্দের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যখন কোন নতুন ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয় তখন তাকে ব্যঞ্জন বিকৃতি বলে। যেমন:
- কবাট>কপাট
- ধোবা>ধোপা
- ধাইমা>দাইমা ইত্যাদি।
- শাক>শাগ
☞ অন্তর্হতি
পদের মধ্যে কোন ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে তাকে অন্তর্হতি বলে। যেমন: ফাল্গুন>ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি।
☞ অভিশ্রুতি
অপিনিহিতি ও পরে বিপর্যয়ের ফলে পরিবর্তিত ধ্বনিতে যদি অপিনিহিতির প্রভাবজনিত ই কিংবা উ ধ্বনি পূর্বধ্বনির সঙ্গে মিলে শব্দের পরিবর্তন ঘটায় তাকে অভিশ্রুতি বলে। যেমন: (করিয়া>করিইয়া>কইরা>করে) করিয়া থেকে অপিনিহিতির ফলে করিইয়া হয়, তা থাকে বিপর্যয়ের ফলে কইরা হয় এবং শেষে অভিশ্রুতির ফলে করে শব্দ গঠিত হয়। অনুরূপভাবে, মানিয়া > মাইন্যা > মেনে; আজি > আইজ > আজ ইত্যাদি।
☞ ঘোষীভবন
ঘোষীভবন (ঘোষ + ইভবন) হলো ধ্বনি পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যেখানে অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।
সহজভাবে বলতে গেলে, যখন কোনো শব্দে অঘোষ ধ্বনির (যেমন: ক, চ, ট, ত, প) পরে কোনো ঘোষ ধ্বনি (যেমন: গ, জ, ড, দ, ব, ম, ন, ল, র, হ, বা স্বরধ্বনি) আসে, তখন অঘোষ ধ্বনিটি তার কাছাকাছি ঘোষ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
উদাহরণ:
- কাক > কাগ: এখানে 'ক' (অঘোষ) 'গ' (ঘোষ)-এ পরিবর্তিত হয়েছে।
- শাক > শাগ: এখানে 'ক' (অঘোষ) 'গ' (ঘোষ)-এ পরিবর্তিত হয়েছে।
- ছোট > ছোড়: এখানে 'ট' (অঘোষ) 'ড়' (ঘোষ)-এ পরিবর্তিত হয়েছে।
☞ অঘোষীভবন
অঘোষীভবন (অঘোষ + ইভবন) হলো ধ্বনি পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যেখানে ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। এটি ঘোষীভবনের ঠিক বিপরীত।
অর্থাৎ, যখন কোনো শব্দে ঘোষ ধ্বনির (যেমন: গ, জ, ড, দ, ব) পরে কোনো অঘোষ ধ্বনি (যেমন: ক, চ, ট, ত, প) আসে, অথবা অন্য কোনো ধ্বনিগত কারণে ঘোষ ধ্বনিটি তার কাছাকাছি অঘোষ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
উদাহরণ:
বাংলায় অঘোষীভবনের উদাহরণ ঘোষীভবনের মতো ততটা প্রকট বা বহুল প্রচলিত নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে দ্রুত উচ্চারণের সময় বা যখন দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি পাশাপাশি আসে।
যেমন:
- ধোঁয়া > ধোঁকা (অপ্রচলিত বা উপভাষায়): এখানে 'ধ' (ঘোষ মহাপ্রাণ) 'ক' (অঘোষ অল্পপ্রাণ)-এর দিকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে, যদিও এটি সরাসরি আদর্শ উদাহরণ নয়।
- দুধ + ছানা > দুছানা (প্রচলিত নয়, তবে একটি ধারণা): এখানে 'ধ' (ঘোষ) 'ছ' (অঘোষ)-এর প্রভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
তবে, আধুনিক বাংলা ভাষায় ঘোষীভবন যেমন 'কাক > কাগ' এর মতো স্পষ্ট ও বহু ব্যবহৃত উদাহরণ অঘোষীভবনের ক্ষেত্রে প্রায় নেই বললেই চলে। এটি তুলনামূলকভাবে কম ঘটে।
☞ অন্যান্য ধ্বনি পরিবর্তন
- র-কার লোপ: আধুনিক চলিত বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে র-কার লোপ পায় এবং পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। যেমন: তর্ক>তক্ক, করতে, কত্তে।
- হ-কার লোপ: দুই স্বরের মাঝামাঝে হ-কারের লোপ হয়। যেমন: পুরোহিত>পুরুত, গাহিল>গাইল, শাহ্>শা ইত্যাদি।
- ক্ষীণায়নঃ শব্দ মধ্যস্তিত মহাপ্রাণ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত হলে তাকে ক্ষীণায়ন বলে। যেমন-পাঁঠা>পাঁটা,কাঠ>কাট ইত্যাদি ।
- পীনায়নঃ শব্দ মধ্যস্তিত অল্পপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণ পরীণত হলে তাকে পীনায়ন বলে । যেমন- কাঁটাল> কাঁঠাল, পুকুর>পুখুর ইত্যাদি ।