বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান ও ভবন

বাংলাদেশ তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। ঐতিহাসিক স্থাপত্য থেকে শুরু করে মনোরম পাহাড়ি অঞ্চল, বাংলাদেশে পর্যটকদের জন্য সবকিছুই আছে। দর্শনীয় স্থান ও ভবনের রয়েছে ঢাকার লালবাগ কেল্লা, বড় কাটরা , ছোট কাটরা , হোসনি দালান , উত্তরা গণভবন , নর্থ ব্রুক হল , কার্জন হল , আহসান মঞ্জিল , বঙ্গভবন , নাটোরের রাজবাড়ী ,তাজহাট রাজবাড়ী , ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার , তিন নেতার মাজার , বায়েজিদ বোস্তামির মাজার , রোজ গার্ডেন , আসাদ গেট , ইত্যাদি ।

লালবাগের কেল্লা

লালবাগের কেল্লা মুঘল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি পুরোনো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত একটি দূর্গ। এই কেল্লার পূর্ব নাম আওরঙ্গবাদ দূর্গ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মোহম্মদ আযম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে এর নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে। তবে তার কন্যা পরিবিবি (প্রকৃত নাম ইরান দুখত) এর মৃত্যুর পর ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। কেল্লা এলাকাতে পরিবিবির সমাধি অবস্থিত। কেল্লার উত্তর-পশ্চিমাংশে বিখ্যাত শাহী মসজিদ অবস্থিত।

  • লালবাগের কেল্লা: ঢাকার লালবাগে
  • লালকেল্লা : ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত

বড় কাটরা

বড় কাটরা ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত মুঘল আমলের নিদর্শন। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহসুজার নির্দেশে আবুল কাসেম ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। এতে প্রথমে শাহসুজা বসবাসের কথা থাকলেও পরবর্তীতে এটি মুসাফির খানা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

ছোট কাটরা

ছোট কাটরা ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত শায়েস্তা খাঁর আমলে তৈরি একটি ইমারত। তিনি এটি সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মাণ করেন। ১৬৬৩ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৬৭১ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

হোসনি দালান

হোসেনি দালান বা ইমাম বাড়া ঢাকা শহরের বকশিবাজার এলাকার একটি শিয়া উপাসনালয়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। হিজরী ১০৫২ সনে সৈয়দ মীর মুরাদ এটি নির্মাণ করেন।

উত্তরা গণভবন

দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ী বা উত্তরা গণভবন নাটোর জেলায় অবস্থিত। এককালে দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের উত্তরাঞ্চলীয় সচিবালয়। ১৭৪৩ সালে রাজা দয়ারাম রায় এটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদা নাথ রায় এটি পুনঃ নির্মাণ করেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান একে গভর্নরের বাসভবন হিসাবে উদ্বোধন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই রাজবাড়ীর নামকরণ করেন 'উত্তরা গণভবন'।

নর্থব্রুক হল

নর্থ ব্রুক হল পুরনো ঢাকায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত ভবন। এটি লালকুঠি নামেও পরিচিত। ১৮৭৪ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড নর্থব্রুকের সম্মানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এটি তৈরি করেন।

কার্জন হল

কার্জন হল ঢাকার একটি ঐতিহাসিক ভবন। ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও বড়লাট লর্ড কার্জন এর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। এটি নির্মিত হয় ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসাবে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কার্জন হল অন্তর্ভূক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের জন্য যা আজও ব্যবহৃত হয়।

আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিল পুরানো ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ। এর প্রতিষ্ঠাতা নবাব আব্দুল গণি। তিনি তাঁর পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৮৫৯-১৮৭২ সাল। ১৮৯৭ সালে ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তীকালে নবাব আহসানউল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। ১৯০৬ সালে এখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে আহসান মঞ্জিলকে 'আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে' রূপান্তর করা হয়।

বঙ্গভবন

বঙ্গভবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসভবন। এটি ঢাকার দিলকুশা এলাকায় অবস্থিত। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামের সরকার এ স্থানটি কিনে নেয় এবং প্রসাদোপম বাড়ি তৈরি করে। এটি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে 'গভর্নর হাউস' নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি গভর্নর হাউজের নাম পরিবর্তন করে 'বঙ্গভবন' করা হয়। ঐ দিনই আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি হন এবং এ স্থানটিকে রাষ্ট্রপতির ভবন হিসেবে ব্যবহার করেন।

নাটোরের রাজবাড়ী

নাটরের রাজবাড়ী বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। রাজশাহী জমিদার রানী ভবানী অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন।

তাজহাট রাজবাড়ী

তাজহাট রাজবাড়ী বা তাজহাট জমিদারবাড়ী রংপুর জেলার তাজহাটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। প্রসাদটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় এটি নির্মাণ করেন। এটি বর্তমানে জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঢাকা শহরের প্রধান কারাগার। এটি ঢাকার চানখারপুল এলাকায় অবস্থিত। মুঘল আমলে এখানে একটি দুর্গ ছিল। বিটিশ শাসনামলে তা কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে ৩ নভেম্বর এই কারাগারে আটক চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। এজন্য ৩ নভেম্বর 'জেলহত্যা দিবস' হিসেবে পালিত হয়। জেলখানায় যে চার নেতাকে হত্যা করা হয় তাঁরা হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী।

তিন নেতার মাজার

তিন নেতার মাজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত স্বাধীনতা পূর্ব বাংলার তিন বিখ্যাত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কবরের উপর নির্মিত ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন।

বায়োজিদ বোস্তামির মাজার

বায়োজিদ বোস্তামির মাজার চট্টগ্রামে নাসিরাবাদে একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। ইরানের বিখ্যাত সুফী বায়োজিদ বোস্তামির নামে গড়ে উঠা এই মাজার পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যদিও বায়োজিদ বোস্তামির নামে এই মাজার ইরানের বিখ্যাত সুফী বায়োজিদ বোস্তামীর এই অঞ্চলে আগমনের ঐতিহাসিক ভিত্তি খুজে পাওয়া যায় না। মাজারটি উনাকে উৎসর্গ করে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিরূপমাত্র।

রোজ গার্ডেন

রোজ গার্ডেন পুরান ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সূচনা ঘটে।

আসাদ গেট

২০ জানুয়ারি ১৯৬৯-এ মিছিলে নেতৃত্বদানকালে পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু হয় আর তার মৃত্যুতে উনসত্তরের গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অনেক জায়গায় জনতা আইয়ুবের নামফলক নামিয়ে আসাদের নাম উৎকীর্ণ করে। এভাবে 'আইয়ুব গেট' হয়ে যায় 'আসাদ গেট'।

ওয়াচ টাওয়ার

২৪ জানুয়ারি ২০১৮ ভোলার চরফ্যাশনে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক ও সুউচ্চ দৃষ্টিনন্দন ওয়াচ টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে চরফ্যাশন পৌরসভা টাওয়ারটি নির্মাণ করেছে। পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী এক স্থানীয় এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়েছে। তাই তার নামেই টাওয়ারটির নামকরণ করা হয় 'জ্যাকব টাওয়ার'। চরফ্যাশন পৌরসভার প্রায় এক একর জমির ওপর ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২৫ ফুট উচ্চতার এ টাওয়ারটি নির্মিত হয়। ১৯ তলাবিশিষ্ট এ টাওয়ারের পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামিমুজ্জামান বসু। এর ডিজাইন করেন স্থপতি কামরুজ্জামান লিটন। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। টাওয়ারে সর্বমোট ৫০০ জন দর্শক উঠতে পারবেন। টাওয়ারের চারদিকে অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ৫ মিলিমিটার ব্যাসের স্বচ্ছ গ্লাস রয়েছে। ১,০০০ বর্গফুট আয়তনের ১৭তম তলায় রয়েছে বিনোদনের নানা ব্যবস্থা। এছাড়াও রয়েছে বিশ্রাম, প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবারের সুব্যবস্থা। ওয়াচ টাওয়ারটিতে রয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার। এর সাহায্যে পর্যটকরা চর কুকরিমুকরি, তারুয়া সৈকত এবং বঙ্গোপসাগরের একটি অংশসহ চারপাশের ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পর্যবেক্ষণ ও উপভাগে করতে পারবেন। টাওয়ারে উঠতে জনপ্রতি প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয় ১০০ টাকা।

আলুটিলা প্রাকৃতিক গুহা

বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় মূল শহর হতে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল হতে ৩০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আলুটিলা বা আরবারী পাহাড়ে আলুটিলা গুহা অবস্থিত। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার কথা। এটি খাগড়াছড়ির একটি নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। কোন প্রকার সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বলে টর্চের আলো বা মশাল নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। সুড়ঙ্গের তলদেশ পিচ্ছিল এবং পাথুরে ও এর তলদেশে একটি ঝর্ণা প্রবহমান। গুহাটি দেখতে অনেকটা ভূ-গর্ভস্থ টানেলের মত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট। গুহাটির এপাশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বের হতে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মাঝে খুব কম হওয়ায় নতজানু হয়ে হেটে যেতে হয়।

হাওরের বিশ্ময় 'আভুরা' সড়ক

'বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও'-কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের সেই সব কষ্টের দিন এখন বদলে গেছে। ইটনা- মিঠামইন-অষ্টগ্রাম আভুরা সড়ক' বা অলওয়েদার রোড তাদের জন্য নিয়ে এসেছে নতুন দিনের বার্তা। হাওরের অথৈ জলরাশি ভেদ করে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া সড়কটি দেখলে মনে হতে পারে সমুদ্রের বুকে ভাসমান এক পথ।

বর্ষায় হাওরের যে সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়, আর শুষ্ক মৌসুমে চলাচল উপযোগী থাকে, তাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ভুরা সড়ক। আর বর্ষায় যে সড়ক ডুবে যায় না, তাকে বলে আভুরা সড়ক।
  • রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আগ্রহে আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সারা বছর চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক।
  • রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২১ এপ্রিল ২০১৬ হাওরের মাঝে এ অলওয়েদার সড়কের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
  • ৮ অক্টোবর ২০২০ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সড়কটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
  • এ সড়কের মাধ্যমে স্থলপথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওর বেষ্টিত তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম।
  • ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ অলওয়েদার সড়কটি নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলীর হাওরে দৃষ্টিনন্দন এ সড়কটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন পর্যটকরা আসছেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাওরের মাঝে বিস্ময় জাগানো এ সড়কটি দেখতে।
নবীনতর পূর্বতন