বাংলাদেশের বনজ সম্পদ

বনজ সম্পদ যে কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনভূমির প্রয়োজন মোট ভূমির ২৫ শতাংশ। কিন্তু সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের বনজ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণের জন্য অবশ্যই আমাদেরকে সামাজিক বনায়নে গুরুত্ব দিতে হবে । বর্তমানে দেশে মোট বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২.৩২ মিলিয়ন হেক্টর । ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বনভূমি মোট ভূমির ২০% এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে । অঞ্চল হিসাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম বনভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনভূমি। সুন্দরবন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বনভূমি। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবন বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘন অভয়ারণ্য ও জীববৈচিত্রে ভরপুর। তাই সুন্দরবনকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয়। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার বা ২৪০০ বর্গমাইল যা মোট বনভূমির ৬২ শতাংশ , অবশিষ্ট অংশ ভারতে রয়েছে । খুলনা , সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন।

বনভূমির প্রকারভেদ

বন বা অরণ্য থেকে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় যে সম্পদ পাওয়া যায়, যা মূলত মানুষের দৈনন্দির ব্যবহারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলিকে বনজ সম্পদ বলে। যেমন- কাঠ, ভেষজ ওষুধ, মশলা, পাতা, আঠা ,মধু, মোম , গাছের তেল, জ্বালানি ও আসবাবপত্র, যানবাহন তৈরির মূল্যবান কাঠ , প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি । বাস্তুসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বনভূমি নিম্নোক্ত শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা-

  1. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি বা পাহাড়ি বন
  2. ক্রান্তীয় পতনশীল বৃক্ষের বনভূমি বা শালবন
  3. প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন বা স্রোতজ বন
  4. সৃজিত উপকূলীয় বন
  5. জলাভূমির বন

১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি বা পাহাড়ি বন

এ বন মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেট- মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। অতিবৃষ্টির জন্য এ বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এ বনভূমির পরিমাণ ১৩,৭৭,০০০ হেক্টর যা দেশের আয়তনের ৯.৩৩%। গর্জন, ময়না, তেলসুর, চাপালিশ, গামার, জারুল, কড়ই, সেগুন, চম্পা প্রভৃতি বৃক্ষ এ বনে পাওয়া যায়। এ বনাঞ্চলে প্রচুর বাঁশ ও বেত জন্মে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য অঞ্চলে বিরল প্রজাতির বৈলাম বৃক্ষ দেখা যায়। বৈলাম বৃক্ষের উচ্চতা ১০০ মিটার যা বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু বৃক্ষ নামে পরিচিত। গর্জন ও জারুল গাছ রেলের স্লিপার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গামার ও চাপালিশ গাছ সাম্পান ও নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চন্দ্রঘোনা কাগজকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঁশ ব্যবহৃত হয়। এ বনের উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী হচ্ছে হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ (সাম্বার হরিণ ও মায়া হরিণ), বন্য শুকর, হনুমান, বানর, উল্লুক, সজারু, বনরুই, ধনেশ, মথুরা, শকুন, অজগর, টিয়া, ময়না প্রভৃতি।

২. ক্রান্তীয় পতনশীল বৃক্ষের বনভূমি বা শালবন

এ বন মূলত ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চলের মধুপুর গড়, গাজীপুর জেলার ভাওয়ালের গড়, কুমিল্লার লালমাই এবং রংপুর-দিনাজপুরের বরেন্দ্রভূমি (আয়তন ৪৫০ বর্গমাইল) এলাকায় অবস্থিত। এ বনের মূল প্রজাতি শাল যা অনেকে গজারি নামে চেনে। শুষ্ক মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) শাল গাছের পাতা ঝরে যায় বলে একে পত্রঝরা বনও বলে। যে সকল গাছের পাতা বছরে একবার সম্পূর্ণ ঝরে যায়, তাদের পাতাঝরা উদ্ভিদ বলে। এছাড়া হরিতকি, ছাতিম, কুর্চি, কড়ই, বহেরা, কাঁঠাল, কুস্তি, হিজল, শিমুল, অর্জুন প্রভৃতি প্রজাতির বৃক্ষও এ বনে পাওয়া যায়। শাল বৃক্ষ বৈদ্যুতিক তারের খুঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ছাতিম টেক্সটাইল মিলে, কুর্চি ছাতার বাট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মেছোবাঘ, বনরুই (এক ধরনের পিপীলিকাভুক চতুষ্পদ প্রাণি), বানর, শিয়াল ইত্যাদি এ বনের উল্লেখযোগ্য প্রাণী।

৩. প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন বা স্রোতজ বন

যে বন জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় আবার ভাটার সময় শুকিয়ে যায়, তাকে জোয়ার-ভাটার বন (Tidal Forest) বা ম্যানগ্রোভ বন (Mangrove Forest) বলে। বেশির ভাগই সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। মাত্র ৯৫ বর্গকিলোমিটার পটুয়াখালী ও বরগুনায় অবস্থিত। ম্যানগ্রোভ বন জোয়ার-ভাটায় বিধৌত লবণাক্ত সমতলভূমি। পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত বনভূমি সুন্দরবন। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পশুর, ধুন্দল, কেওড়া, বায়েন বৃক্ষ প্রচুর জন্মে। এ সকল উদ্ভিদের শ্বাসমূল থাকে। এছাড়া ছন ও গোলপাতা সুন্দরবন হতে সংগ্রহ করা হয়। সুন্দরী বড় বড় খুঁটি তৈরিতে, গেওয়া নিউজপ্রিন্ট ও দিয়াশলাই কারখানায়, ধুন্দল পেনসিল তৈরিতে, গরান বৃক্ষের বাকল চামড়া পাকা করার কাজে, গোলপাতা ঘরের ছাউনিতে ব্যবহৃত হয়। এ বন থেকে প্রচুর মধু ও মোম আহরণ করা হয়। চকোরিয়া সুন্দরবন কক্সবাজার জেলার মাতামুহুরী নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি ব-দ্বীপীয় ম্যানগ্রোভ বন।

৪. সৃজিত উপকূলীয় বন

উপকূলীয় জেলাগুলোতে বনায়নের মাধ্যমে সৃজিত উপকূলীয় বন গড়ে তোলা হয়েছে। উপকূল বরাবর বনায়ন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে উপকূবর্তী এলাকায় জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করার লক্ষ্যে গৃহীত একটি কার্যকর ব্যবস্থা হল উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী বা সৃজিত উপকূলীয় বন । উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী রয়েছে ১০টি জেলায় । সবুজবেষ্টনী রচনার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো: (১) ভেড়িবাঁধের সম্মুখ ঢালকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করা, এবং (২) উপকূলীয় এলাকায় জান-মাল ও কৃষিজমিকে রক্ষা করা। এ ছাড়াও বনায়নের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ।

৫. জলাভূমির বন

সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার হাওড় ও বিল জুড়ে এ বন বিস্তৃত। বানর, মেছোবাঘ, ভোদর, কাঠবিড়ালী প্রভৃতি প্রাণী এ বনে দেখা যায়। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত 'রাতারগুল' দেশের একটি দৃষ্টিনন্দন জলাভূমির বন। এ বনে বিরল প্রজাতির বন্য গোলাপ দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল

নিচে বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলের পরিচয় তুলে ধরা হল :

সুন্দরবন

বাংলাদেশ এবং ভারতে বিস্তৃত সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০০০০ বর্গ কিমি.। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬২% বাংলাদেশে অবস্থিত। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা অবস্থিত। মাত্র ৯৫ বর্গকিলোমিটার পটুয়াখালী ও বরগুনায় অবস্থিত। সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো পশুর, শিবসা, রায়মঙ্গল, বলেশ্বর প্রভৃতি। সুন্দরবনের পূর্বে বলেশ্বর এবং পশ্চিমে রায়মঙ্গল। সুন্দরবন অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদী হাড়িয়াভাঙ্গা। সুন্দরবনের অন্য নাম বাদাবন।

কাটকা, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, টাইগার পয়েন্ট (কচিখালী) এ প্রতিবছর পর্যটকদের প্রচুর সমাগম ঘটে। হিরণ পয়েন্ট, কটকা প্রভৃতি সুন্দরবনের অভয়ারণ্য। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হিরণ পয়েন্ট সাধারণভাবে নীল কমল নামে পরিচিত। দুবলার চর একটি ছোট দ্বীপ, এর সমুদ্র সৈকত অতি মনোরম। মৎস্য আহরণ, শুটকি উৎপাদন এবং উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর জন্য এটি বিখ্যাত। দুবলার চর থেকে ১০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত একটি দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে 'বঙ্গবন্ধু দ্বীপ'। সুন্দরবনকে 'বাংলাদেশের ফুসফুস' বলা হয়। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পশুর, ধুন্দুল, কেওড়া, বাইন, ওড়া, হেন্দাল, কাকড়া প্রভৃতি এ এলাকার প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি। সুন্দরী বৃক্ষ 'লুকিং গ্লাস ট্রি' নামেও পরিচিত। 'সুন্দরী' বৃক্ষের প্রাচুর্যের জন্য এই বনের নামকরণ করা হয়েছে 'সুন্দরবন'। সুন্দরবনে প্রায় সব খালের পাড়েই ঘনভাবে জন্মে নিপা পাম বা গোলপাতা। স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'বাউয়াল'দের পেশা গোলপাতা সংগ্রহ করা। সুন্দরী বড় বড় খুঁটি তৈরিতে, গেওয়া নিউজপ্রিন্ট ও দিয়াশলাই কারখানায়, ধুন্দুল পেন্সিল তৈরিতে, গরান বৃক্ষের ছালের কষ রং তৈরি, জাল রং করা ও চামড়া পাকা করার কাজে, গোলপাতা ঘরের ছাউনিতে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল এবং হার্ডবোর্ড মিলস। প্রথমটির কাঁচামাল গেওয়া এবং দ্বিতীয়টির সুন্দরী বৃক্ষ।

সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণিবৈচিত্র্য বিদ্যমান। সুন্দরবন সুদর্শন 'রয়েল বেঙ্গল টাইগার' এর আবাসস্থল। সুন্দরবনে দুই ধরনের হরিণ পাওয়া যায়। যথা- মায়া হরিণ (Barking Deer) এবং চিত্রা হরিণ (Spotted Deer) । এ বনে তিন প্রজাতির কচ্ছপ (কেটো কাছিম, সুন্দি কাছিম, ধুম তরুণাস্থি কাছিম) দেখা যায়। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে গিরগিটি, রেসাস বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ, বন্য শুকর, মোহনা কুমির, গুই সাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাস, গাঙচিল, ডলফিন, ঈগল, চিল, মাছরাঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন কেন্দ্র খুলনার করমজলে (সুন্দরবনে) অবস্থিত। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'মৌয়াল'দের পেশা মধু সংগ্রহ করা। সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ (পাগমার্ক) গণনা করে বাঘশুমারি করা হতো। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো 'ক্যামেরা ট্র্যাপ' (ক্যামেরা ফাঁদ) পদ্ধতিতে বাঘ গণণা করে বন অধিদপ্তর। সুন্দরবন অঞ্চলের কিংবদন্তী শিকারি পচাব্দী গাজী। তিনি ৫৭টি বাঘ শিকার করেন।

 বাঘ
বাঘ

রেমা-কালেঙ্গার

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা (আয়তন প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর)। সুন্দরবনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক এ বন ঢাকা থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা। পাহাড়গুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৭ মিটার। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে তিনটি ট্রেইল বা পথ, যেখানে দাঁড়িয়ে বনের ভিতরের দূর-দূরান্তের দৃশ্যাবলি দেখা যায়। এ বনের ভিতরেই আছে চারটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস- ত্রিপুরা, সাঁওতাল, তেলেগু ও উড়ং ।

লাউয়াছড়া

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাঝখানে অবস্থিত লাউয়াছড়া। এটি মিশ্র চিরহরিৎ বন। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বনে রয়েছে বিশ্বের মাত্র ৪টি দেশে দেখতে পাওয়া বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক। লাউয়াছড়া উদ্যানের ভিতর খাসিয়া নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দুটি গ্রাম রয়েছে লাউয়াছড়াপুঞ্জ ও মাগুরাছড়াপুঞ্জ। আর বনের দুপাশে রয়েছে ত্রিপুরা ও মণিপুরী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আরো দুটি আদিবাসী পল্লী। এ বনে আরো রয়েছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে বিখ্যাত Around the World চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের কিছু অংশ এখানে হয়েছিল।

বাংলার আমাজন রাতারগুল

বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন (Swamp Forest) রাতারগুল। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এ জলাবন বছরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি সময় কোমর পানিতে ডুবে থাকে । সিলেট শহর থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটার দূরে পানিতে অর্ধেক পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ বনের গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। সিলেটের শীতল পাটি তৈরির মূল উপাদান মুর্তার বড় একটা অংশ এ বন থেকেই আসে।

মধুপুরের শালবন

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার এবং টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে মধুপুর উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন মধুপুরের শালবন। এ বনের প্রধান বৃক্ষ শালগাছের মোলা বা শিকড় থেকে গজানো চারায় গাছ হয় বলে স্থানীয়রা একে 'গজারি বন' বলে থাকে।

সামাজিক বনায়ন

বনবিভাগ ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচি বনাঞ্চলের বাহিরে জনগণের কাছে নিয়ে যায়। বৃক্ষরোপণ উৎসাহিত করার জন্য ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক 'বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার' প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৪ সালে বৃক্ষমেলা চালু হয়।

সংরক্ষিত এলাকা

জাতীয় উদ্যান: উল্লেখযোগ্য জাতীয় উদ্যানগুলো নিম্নরূপ-

  • ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, গাজীপুর: ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • রামসাগর জাতীয় উদ্যান, দিনাজপুর: উদ্যানটির প্রধান আকর্ষণ হলো রামসাগর দিঘি। রামসাগরকে দেশের বৃহত্তম মানবসৃষ্ট দিঘি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে (১৭৫০ - ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) রাজা রামনাথ দিঘিটি খনন করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে দিঘিটির নামকরণ করা হয়েছে।
  • লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মৌলভীবাজার: এটি ক্রান্তীয় চিরহরিৎ ও ক্রান্তীয় আধা চিরহরিৎ বনভূমির অন্তর্গত। উদ্যানটি বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত।
  • সাতছরি জাতীয় উদ্যান, হবিগঞ্জ

উদ্ভিদ উদ্যান :

  • জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (National Botanic Garden), মিরপুর, ঢাকা।
  • বলধা গার্ডেন ঢাকার ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত। ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বলধা গার্ডেনের সূচনা করেন।

বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য (Wildlife Sanctuary) :

  • চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, চট্টগ্রাম
  • চর কুকরি-মুকরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ভোলা

সামুদ্রিক রক্ষিত এলাকা

  • সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেক্টটেড এরিয়া
  • নিঝুমদ্বীপ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা

ইকোপার্ক: Ecopark (Ecological Park) প্রাকৃতিক পরিবেশে সৃষ্ট বিনোদন উদ্যান যা জীববৈচিত্র্যের উপর কোনোরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে না। বনাঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে ইকোপার্ক হিসেবে চিহ্নিত করে একটি নিবিড় ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়। উল্লেখযোগ্য ইকোপার্কগুলো হলো-

  • সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং ইকো পার্ক, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের প্রথম ইকোপার্ক।
  • টিলাগড় ইকোপার্ক, সিলেট
  • মুরাইছড়া ইকোপার্ক, বড়লেখা, মৌলভীবাজার

সাফারি পার্ক: পার্ক তৈরি হবে বন্যপ্রাণীদের প্রকৃত বাসস্থানের আদলে তাদের মনে হবে যেন তারা জঙ্গলেই আছে। নিজেদের অভয়ারণ্যেই আছে। মানুষ থাকবে সুরক্ষিত খাঁচা বা যানবাহনের মধ্যে- চিড়িয়াখানার বিপরীত অবস্থা।

  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক: কক্সবাজার জেলার ডুলাহাজরায় অবস্থিত। পূর্বনাম ছিল 'ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক'। 'ডুলাহাজরা' শব্দের অর্থ 'হাজার পালকি'।
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, শ্রীপুর, গাজীপুর

অ্যাভিয়ারি পার্ক : শেখ রাসেল এভিয়ারী এন্ড ইকোপার্ক-এর বন্যপ্রাণী ও গাছ-গাছড়া, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম

বনজ সম্পদ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • বাংলাদেশের বিভাগ অনুযায়ী বনভূমির বিন্যাস: ঢাকা ৭% , চট্টগ্রাম ৪৩% , রাজশাহী ২% , খুলনা ৩৯% , বরিশাল ৩% , সিলেট ৬% , ময়মনসিংহ ৩%
  • বৃক্ষরোপনে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার চালু হয় : ১৯৯৬ সালে
  • বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় বননীতি গৃহীত হয় : ১৯৭২ সালে
  • বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের কাজ শুরু হয় : ১৯৮১ সালে (চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়
  • জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু হয় : ১৯৭২ সালে
  • জাতীয় বৃক্ষমেলা প্রবর্তন করা হয় : ১৯৯৪ সালে
  • বাংলাদেশে পরিবেশ নীতি ঘোষণা করা হয় : ১৯৯২ সালে
  • সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয় : ১৯৯২ সালে
  • বৃক্ষরোপণে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের নাম : প্রধানমন্ত্রির পুরস্কার (১৯৯৩)
  • সুন্দরবন দিবস পালিত হয় : ১৪ ফেব্রুয়ারি
  • সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তিনটি অভয়ারণ্য হল : কটকা, দক্ষিণ নীলকমল, পশ্চিম মাদারবাড়ি
  • বিভাগ অনুসারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বনভূমি : চট্টগ্রাম বিভাগে (৪৩%)
  • বিভাগ অনুসারে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বনভূমি : রাজশাহী বিভাগে (২%)
  • হিমালয়ের চূড়ায় বৈঠক করে : নেপাল
  • জেলা অনুসারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বনভূমি আছে : বাগেরহাট জেলায়
  • বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বনভূমি নেই : ২৮ টি জেলায়
  • উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে : ১০টি জেলায়
  • বাংলাদেশের উচ্চতম বৃক্ষ : বৈলাম (বান্দরবানে পাওয়া যায়)
  • বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ : আম
  • 'লুকিং গ্লাস ট্রি' নামে পরিচিত : সুন্দরী বৃক্ষ
  • সূর্যকন্যা বলা হয় : তুলা গাছকে
  • পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছ : ইউক্লিপটাস
  • পঁচাব্দী গাজী বিখ্যাত : বাঘ শিকারের জন্য
  • বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট অবস্থিত অবস্থিত : চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায়
  • জাতিসংঘের ২০১৫ অধিবেশনে পরিবেশ বিষয়ক চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কার লাভ করেন : শেখ হাসিনা
  • পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বনভূমি আছে : ৭ টি জেলায়। যথা- বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার।
  • বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত কাঠ ও লাকড়ি : দেশের মোট জ্বালানির ৬০% পূরণ করে
নবীনতর পূর্বতন