প্রাচীন বাংলার ইতিহাস | বিসিএস প্রস্তুতি

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস বলতে শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসকে বোঝায় এমনটি নয় বরং বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বিগত চার সহস্রাব্দের ইতিহাসকে বোঝায়। প্রাচীন বাংলা কখনো একক রাষ্ট্র ছিল না অথবা একই শাসকের অধীনে সমগ্র বাংলা কখনোই শাসিত হয় নি । কারণ প্রাচীন বাংলা তখন কতগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিল । ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসক বাংলাকে শাসন করেছে । কাজেই জাতি হিসেবে আমরা এক হলে ও বরাবরই আমাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের পরিচয় দিতে হয়েছে যেমন- বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ । প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে বাঙালী জাতির উৎপত্তি থেকে শুরু করে বাংলায় মৌর্য যুগ , গুপ্ত যুগ , গুপ্ত পরবর্তী বাংলা , পাল বংশ , সেন বংশ , উপমহাদেশের মুসলিম শাসন , স্বাধীন সুলতানী শাসন , বারভূঁইয়াদের ইতিহাস , বাংলায় মুঘল শাসন , সুবেদারী শাসন , নবাবী শাসন , ব্রিটিশ শাসন ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে জানতে হবে । ফিরে যেতে হবে চার হাজারের ও অধিক সময় আগে । তাছাড়া বাংলার সকল অঞ্চলের ভূমি একইরূপ পুরানো নয়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার মাটি অপেক্ষাকৃত নতুন। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, বাংলায়ও মানব সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছে। এখানেও মানুষ পুরাতন পাথরের যুগ, নতুন পাথরের যুগ এবং তামার যুগ পার হয়ে এসেছে। পঁচিশ হাজার বছর থেকে দশ হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত সময়কে বলা হয় পুরাতন পাথরের যুগ। তারপর যথাক্রমে আসে নতুন পাথরের যুগ ও তামার যুগ। লোহার আবিষ্কার হয় আরও পরে। সাধারণত ধারণা করা হয় যে, খ্রিষ্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগে মানুষ লোহা ব্যবহার করতে শিখে। পাথরের যুগের হাতিয়ারের নিদর্শন পাওয়া গেছে কুমিল্লার লালমাই, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে। সুতরাং এ থেকে অনুমান করা যায় যে, দক্ষিণ- পূর্ব বাংলা বাদে বাংলার বাকি অঞ্চলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বাস করে আসছে।

বাঙালী জাতির উৎপত্তি

বাঙালি জাতির মূল কাঠামো সৃষ্টির কাল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুসলমান অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী এবং আর্য নরগোষ্ঠী। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত চার শাখায় বিভক্ত যথাঃ নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় বা মঙ্গোলীয় । অস্ট্রো এশিয়াটিক বা অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়। এদের 'নিষাদ জাতি' নামেও অভিহিত করা হয়।

প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। অস্ট্রিক জাতির সমকালে বা কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি খাইবার গিরিপথ দিয়ে আসে এবং সভ্যতায় উন্নততর বলে তারা অস্ট্রিক জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। অস্ট্রিক দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালি জাতি । অর্থাৎ বাংলার প্রাচীন জাতি অস্ট্রিক দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা । নৃতাত্ত্বিকভাবে এরা আদি অস্ট্রোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে মঙ্গোলীয়দের আগমন ঘটে। বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতীয়দের বড় অংশ মঙ্গোলয়েড

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে ককেশীয় অঞ্চলের (ইউরাল পর্বতের দক্ষিণের তৃণভূমি অঞ্চল-বর্তমান মধ্যএশিয়া, ইরান) শ্বেতকায় আর্যগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। উপমহাদেশে আগমনের অন্তত চৌদ্দশত বছর পরে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে বঙ্গ ভূখণ্ডে আর্যদের আগমন ঘটে ।

স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আর্যগণ সাফল্য লাভ করে এবং বঙ্গ ভূখণ্ড দখল করে নেয় পরবর্তীতে এরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়। এভাবে আর্য ও অনার্য আদিম অধিবাসীদের সংমিশ্রণে এক নতুন মিশ্র জাতির উদ্ভব ঘটে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে সেমীয় গোত্রের আরবীয়গণ ধর্মপ্রচার ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বঙালি জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়।

বাঙালী জাতির উৎপত্তি
  • নিগ্রোদের মত দেহযুক্ত এক আদিম জাতি এদেশে বসবাস করত। এরাই ভীল, সাওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতির পূর্বপুরুষ হিসাবে চিহ্নিত। বাঙালির রক্তে এদের প্রভাব আছে।
  • অস্ট্রিক জাতি থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ তাদের 'নিষাদ জাতি' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
  • অস্ট্রিক জাতির সমকালে বা কিছু পরে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে এবং সভ্যতায় উন্নততর বলে তাঁরা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে।
  • অস্ট্রিক দ্রাবিড় জাতির সাথে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতীর সংমিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশে আর্যকরণের পরেই এদের আগমন ঘটে বলে বাঙালির রক্তে এদের মিশ্রণ উল্লেখযোগ্য নয়। গারো, কোচ, ত্রিপুরা, চাকমা ইত্যাদি এই গোষ্ঠীভূক্ত।
  • আর্যরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ। তাদের ভাষা বৈদিক।
  • খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে সেমীয় গোত্রের আরবীয়রা ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। তাদের অনুকরণে নেগ্রিটো রক্তবাহী হাবশিরাও এদেশে আসে। এমনিভাবে অন্তত দেড় হাজার বছরের অনুশীলন, গ্রহণ, বর্জন এবং রূপান্তরকরণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি গড়ে উঠে।
  • নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত আদি-অস্ট্রেলীয় (Proto-Australian) নরগোষ্ঠীভূক্ত।
  • আর্য যুগকে বলা হয় বৈদিক যুগ।
  • আর্য সংস্কৃতি সমাধিক বিকাশ লাভ করে পাল শাসনামলে।
  • আর্য জাতি ভারতে প্রবেশের পর প্রথমে বসতি স্থাপন করে সিন্ধুবিধৌত অঞ্চলে।
  • বর্তমান বাঙালি জাতি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলীয়, সেমীয়, নিগ্রো ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির রক্তধারায় এক বিচিত্র জনগোষ্ঠীর রূপে গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এর সাথে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীও যায়। তাই বাঙালীকে সংকর জাতি বলা হয়।

আর্যপূর্ব ও আর্য যুগে বাংলা

আর্য জাতি : যারা আর্য ভাষা অর্থাৎ ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ফরাসি ভাষায় কথা বলত তারা আর্য জাতি। এদের বসবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণের তৃণভূমি অঞ্চলে । এদের প্রাচীন সাহিত্যিক ধর্মীয় গ্রন্থ হলো 'ঋগবেদ’ । খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে আর্যগণ ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে প্রবেশের চৌদ্দশত বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দে আর্যগণ বাংলায় প্রবেশ করে। এ সময় বঙ্গদেশ অস্ট্রিক জাতির প্রভাবাধীন ছিল। ধারণা করা হয় যে, মৌর্যযুগ হতে গুপ্ত বংশের শাসনামল পর্যান্ত প্রায় আটশত বছর বঙ্গদেশে আর্যীকরণ ঘটেছিল। আর্যপূর্ব বঙ্গ জনগোষ্ঠী ছিল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির মিশ্রণ। আর্যদের আগমনের পরে বঙ্গদেশে আসে ভোটচীনীয় জাতি। এরা হলো গারো, কোচ, চাকমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি।

আর্যপূর্ব যুগে বাংলা : বঙ্গদেশে জনবসতির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রত্ন-প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ এবং তাম্র যুগের কিছু অস্ত্রশস্ত্র এখানে পাওয়া গিয়েছে । পন্ডিতেরা অনুমান করেন যে, গ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এখানে এক সুসভ্য জাতির বাস ছিল। এরা ধান চাষ করত, সম্বর ও নীলগাই শিকার করত এবং শূকর পালন করত। এরা পাথর ও তামা ব্যবহার করত এবং ইট-পাথরের ভিটির উপর প্রশস্ত ঘর তৈরি করত। প্রাচীন পুন্ড্র ও বঙ্গ জাতি আর্যপূর্ব যুগের মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হয় । আর্য-পূর্ব যুগে বাংলার অধিবাসীরা সভ্যতায় যথেষ্ট উন্নত ছিল। বাংলায় কৃষিকাজ, নৌকা নির্মাণ, বয়নশিল্প, ধাতুশিল্প প্রভৃতি আর্যপূর্ব যুগের লোকেরাই প্রচলন করে। কুমার, কামার, সুত্রধর, তাম্রকার, স্বর্ণকার, মণিকার, কাঁসারী, শাঁখারী ইত্যাদি পেশাদারদের কারিগরী কাজে এরা সুদক্ষ ছিল।

আর্য যুগে বাংলা : খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচার উপলক্ষে আর্যরা ক্রমশ অধিক সংখ্যায় এদেশে এসে বসবাস আরম্ভ করে। আর্যরা এদেশে আসার ফলে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর আর্যদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও সভ্যতার অন্যান্য ক্ষেত্রে দারুণ প্রভাব পড়তে থাকে। ক্রমে বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারিত হয় এবং বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা অনুসারে সমাজ গঠিত হয়। আর্য ভাষার প্রভাবে বাংলায় আদি ভাষাগুলো লুপ্ত হয় এবং কালক্রমে বহুযুগ পরে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে। তা সত্ত্বেও বাংলার আদি ভাষা, ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি, বরং সংমিশ্রিত আকারে বিকাশ লাভ করেছে।

বাংলার প্রাচীন জনপদ

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় , বাংলা অখণ্ড কোন রাজ্য ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন নামে খণ্ডে খণ্ডে বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল সমগ্র বাংলা। প্রাচীন জনপদগুলোর সীমা ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। বিভিন্ন সময়ে ও রাজন্যবর্গের শাসনামলে এর সীমা ও পরিধির পরিবর্তন ঘটেছে। তাই প্রাচীন বাংলার কোন সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। তবে গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ড্র, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র এরকম প্রায় ১৬টি জনপদের কথা জানা যায়। জনপদগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম হল পুণ্ড্র। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল। যা পুণ্ড্রবর্ধন নামেও পরিচিত ছিল। প্রাচীরবেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বাংলার আদি জনপদ গুলোর ভাষা ছিলো অস্ট্রিক।

প্রাচীন জনপদের সীমারেখা
প্রাচীন জনপদ বর্তমান অবস্থান
পুন্ড্র (Pundra) বৃহত্তর বগুড়া (মহাস্থানগড়), রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল
বরেন্দ্র (Barendra) রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাংশ (রাজশাহী জেলার উত্তরাংশ, বগুড়ার পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ)
বঙ্গ (Banga) বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া, যশোর, নদীয়া, শান্তিপুর ও পটুয়াখালি অঞ্চল
সমতট (Samatata) বৃহত্তর কুমিল্লা (বড় কামতা) ও নোয়াখালী অঞ্চল।
গৌড় (Gaur) মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ।
রাঢ় উত্তর রাঢ় : মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা।
দক্ষিণ রাঢ়: বর্ধমানের দক্ষিনাংশ, হুগলির বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা ।
হরিকেল (Harikela) সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চল
তাম্রলিপি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা
চন্দ্রদ্বীপ বরিশাল
বিক্রমপুর মুন্সীগঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল
আরাকান কক্সবাজার, বার্মার কিয়দংশ, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণাঞ্চল
কামরূপ রংপুর, জলপাইগুড়ি, আসামের কামরূপ জেলা
সপ্তগাঁও খুলনা এবং সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল
বাংলা বা বাঙলা খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী

গৌড় : বাংলার উত্তরাংশ এবং উত্তরবঙ্গে ছিল গৌড় রাজ্য। সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত গৌড় রাজ্যের সীমা বর্ধিত করেন। প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোকে শশাংক গৌড় নামে একত্রিত করেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ (বর্তমান রাঙামাটি অঞ্চল) ছিল শশাঙ্কের সময়ে গৌড় রাজ্যের রাজধানী। আমাদের বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সন্নিকটের এলাকা গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুলতানী সময় বাংলার উত্তর পশ্চিমাংশ, বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলের রাজধানীও ছিল গৌড় নগরী।

বঙ্গ : ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি এবং পশ্চিমের উচ্চভূমি যশোর, কুষ্টিয়া, নদীয়া, শান্তিপুর ও ঢাকার বিক্রমপুর সংলগ্ন অঞ্চল ছিল বঙ্গ জনপদের অন্তর্গত । সুতরাং বৃহত্তর ঢাকা প্রাচীনকালে বঙ্গ জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুরানো শিলালিপিতে 'বিক্রমপুর' ও 'নাব্য' নামে দুটি অংশের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন বঙ্গ ছিল একটি শক্তিশালী রাজ্য। ঋগ্বেদের (প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য। 'ঐতরেয় আরণ্যক'-এ সর্বপ্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর পূর্বে । মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তাঁর 'আইন-ই-আকবরি' গ্রন্থে দেশবাচক বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন। এছাড়া রামায়ণ ও মহাভারতে এবং কালিদাসের 'রঘুবংশ'-এ 'বঙ্গ' নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমগ্র বাংলা বঙ্গ নামে ঐক্যবদ্ধ হয় পাঠান আমলে। রাজা শশাঙ্কের শাসনামলের পর বঙ্গদেশ তিনটি জনপদে বিভক্ত ছিল: [ক] পুণ্ড্র [খ] গৌড় [গ] বঙ্গ । প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম ' কলহনের লেখা রাজতরঙ্গিনী' । মৌর্য আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী অনেক ঘটনা বিশেষ করে কাশ্মীরের রাজাদের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা লেখক উক্ত গ্রন্থে দিয়েছেন।

সমতট : হিউয়েন সাং এর বিবরণ অনুযায়ী সমতট ছিল বঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ- পূর্বাংশের একটি নতুন রাজ্য। মেঘনা নদীর মোহনাসহ বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল সমতটের অন্তর্ভুক্ত। কুমিল্লা জেলার বড় কামতা এ রাজ্যের রাজধানী ছিল বলে জানা যায় ।

রাঢ় : রাঢ় বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীর হতে গঙ্গা নদীর দক্ষিণাঞ্চল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। অজয় নদী রাঢ় অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। রাঢ়ের দক্ষিণে মেদেনীপুর জেলায় 'তাম্রলিপি' ও 'দণ্ডভুক্তি' নামে দুটি ছোট বিভাগ ছিল। তৎকালে তাম্রলিপি ছিল একটি বিখ্যাত নৌবন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র । রাঢ় জনপদের অপর নাম ছিলো সূস্ম । রাঢ়দের রাজধানী কোটিবর্ষ।

পুণ্ড্র : বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অবস্থানভূমিকে কেন্দ্র করে পুণ্ড্র জনপদ গড়ে ওঠে। এটি বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন জনপদ। পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর ছিল প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী। এর অবস্থান বর্তমান বগুড়ার মহাস্থানগড়। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রাচীন পুণ্ড্র রাজ্যের স্বাধীন সত্ত্বা বিলুপ্ত হয়। পৌন্দ্রিক' শব্দের অর্থ আখ বা চিনি। এ শব্দ থেকে 'পুণ্ড্রবর্ধন' নামের উৎপত্তি। পুণ্ড্রবর্ধনের বর্তমান মহাস্থানগড় । পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী ছিল- পুণ্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর (মহাস্থান গড়)। বেহুলা-লখিন্দারের বাসর ঘর মহাস্থানগড়ে অবস্থিত । বিখ্যাত সাধক সুলতান বলখীর মাজার মহাস্থানগড়ে। পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ পাওয়া যায় মনসা-মঙ্গল কাব্যে ।

বরেন্দ্র : পাল রাজারা উত্তরবঙ্গকে তাদের পিতৃভূমি মনে করত। সে কারণে এর নামকরণ করেছিল বারিন্দ্রী। এ বারিন্দ্রী থেকে বরেন্দ্র শব্দের উৎপত্তি। রাজশাহী বিভাগের উত্তর-পশ্চিমাংশ তথা রংপুরের সামান্য এলাকা ব্যতীত উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে বরেন্দ্রভূমি গড়ে উঠে। বর্তমান করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরের লালমাটি সমৃদ্ধ অঞ্চলই বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত। রামায়ণে গঙ্গা ও করতোয়া নদীর পশ্চিমাংশের মধ্যবর্তী অংশকে বরেন্দ্রীমণ্ডল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হরিকেল : হরিকেল হলো ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তের অঞ্চল। ত্রিপুরার শৈলশ্রেণীর সমান্তরাল অঞ্চল সিলেট হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হরিকেল বিস্তৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত দুইটি শিলালিপিতে হরিকেল সিলেটের সঙ্গে সমার্থক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রাচীন বাংলার সীমা

নীহার রঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বঙ্গদেশের সীমানা নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, বঙ্গদেশের সীমা ছিল উত্তরে হিমালয় পর্বত, নেপাল, ভূটান ও সিকিম রাজ্য; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে জৈন্তা পাহাড়, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম শৈলশ্রেনী পশ্চিমে সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর, কেওঞ্জর ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যভূমি; উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকা এবং উত্তর-পশ্চিমে বিহারের দ্বারভাঙ্গা পর্যন্ত ভাগীরথী নদীর উত্তরে সমান্তরাল এলাকা।

বাংলার উৎপত্তি

  • চীনা শব্দ 'অং' ( যার অর্থ জলাভূমি ) পরিবর্তিত হয়ে 'বং' শব্দে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে, বং → বংগ ; বংগ + আল (আইল ) → বংগাল ।
  • ড. মুহম্মদ হান্নান তাঁর 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত নূহ (আঃ) এর সময়ের মহাপ্লাবনের পর বেঁচে যাওয়া চল্লিশ জোড়া নর-নারীকে বংশবিস্তার ও বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়েছিল। নূহ (আ) এর পৌত্র 'হিন্দ' এর নাম অনুসারে 'হিন্দুস্তান' এবং প্রপৌত্র 'বঙ্গ' এর নামানুসারে 'বঙ্গদেশ' নামকরণ করা হয়েছিল। বঙ্গ এর বংশধরগণই 'বাঙাল' বা বাঙালি নামে পরিচিত।
  • ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম তার ‘রিয়াজুস সালাতীন' গ্রন্থে বলেছেন, বংগ (জনৈক ব্যক্তি ) + আহাল (সন্তান) → বংগাহাল → বংগাল ।
  • শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার নামকরণ করেন মূলক-ই-বাংগালাহ ।
  • বাংলার ইতিহাসের প্রথম প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় রাজা শশাঙ্কের আমল হতে। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক গৌড়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে । তিনি বাংলার জনপদগুলোকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। তিনি সমগ্র বাংলা ভূখন্ডকে দুটি প্রশাসনিক এককে আনার চেষ্টা করেন। তাকে বাংলার প্রথম স্বাধীন নরপতি বলা হয়।

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ

গ্রীস অঞ্চলের ম্যাসিডনের রাজা মহাবীর আলেকজান্ডার জাতিতে ছিলেন আর্য গ্রিক । তিনি ছিলেন ম্যাডিসনের রাজা ফিলিপসের পুত্র। তার প্রাচ্যদেশীয় নাম সিকান্দার শাহ বা বাদশা সিকান্দার। বাল্যকালে তিনি প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের নিকট গৃহশিক্ষা লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে পিতা ফিলিপসের মৃত্যুর পর তিনি ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরোহন করেন। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। দিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে তিনি পূর্বদিকে রাজ্য জয় এবং ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। ৩২৭ অব্দে সিন্ধু নদের পশ্চিমাঞ্চল জয়লাভের পর তার সেনাবাহিনী পূর্বদিকে আর অগ্রসর হয়নি। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার সেনাপতি সেলুকাসের হস্তে ন্যস্ত করে তিনি ম্যাসিডনে ফিরে যাবার পথে ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবিলনের নিকটে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ বছর। আলেকজান্ডারের শাসনামল থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায় । আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উপমহাদেশে গ্রিক অধিকৃত অঞ্চলসমূহ জয় করেন।

গঙ্গারিডই : আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে বাংলায় গঙ্গারিডই নামে এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল। পন্ডিতদের ধারণা, গঙ্গা নদীর যে দুইটি ধারা এখন ভাগীরথী ও পদ্মা নামে পরিচিত , এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গঙ্গারিডই জাতির লোক বাস করত। এদের রাজা খুব পরাক্রমশালী ছিল । এ রাজ্যের রাজধানী ছিল 'বঙ্গ' নামে একটি বন্দর নগর। এখান থেকে সুক্ষ্ন সুতী কাপড় সুদূর পশ্চিমা দেশে রফতানি হতো। গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস গঙ্গারিডই রাজ্যকে দক্ষিণ এশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সমৃদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, গঙ্গারিডই রাজ্যটি আসলে বঙ্গ রাজ্যই ছিল, গঙ্গারিডই ছিল শুধু এর নামান্তর।

বাংলায় মৌর্য সাম্রাজ্য

প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের একটি বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে মৌর্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই সাম্রাজ্য ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। এটি ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

হিমালয়ের পাদদেশে 'মৌর্য ' নামক ক্ষত্রিয় বংশে চন্দ্রগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পিতৃহীন চন্দ্রগুপ্তের মাতা তাকে নিয়ে তক্ষশীলায় বসবাস করতেন। এ সময় তক্ষশীলার বিখ্যাত পন্ডিত চাণক্যের আনুকূল্যে চন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেন। গ্রীক মহাবীর আলেকজান্ডার ৩২৭ অব্দে পাঞ্জাব জয় করলে চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শিবিরে থেকে রণকৌশল শিক্ষা লাভ করেন । চন্দ্রগুপ্তের নির্ভীক আচরণে সম্রাট আলেকজান্ডার রুষ্ট হয়ে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলে দ্রুত পালিয়ে চন্দ্রগুপ্ত আত্মরক্ষা করেন। এ দিকে কুটনীতিবিশারদ চাণক্য মগধরাজ ধননন্দ কর্তৃক অপমানিত হয়ে প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক শিবির হতে পলায়নের পর চাণক্যের সহায়তায় সমরশক্তি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে মগধরাজ ধননন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বাংলার উত্তরাংশ, বিহার ও উড়িষ্যার অংশবিশেষ নিয়ে ছিল মগধ। আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ ত্যাগের পর গ্রিক সেনাপতি সেলিউকাসকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র। তিনি ভারতের প্রথম সম্রাট। চাণক্য ছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী। চাণক্যের বিখ্যাত ছদ্মনাম কৌটিল্য বা বিষ্ণু গুপ্ত , যা তিনি তাঁর বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্র' এ গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি চানক্য নামে অধিক পরিচিত। গ্রিক সেনাপতি সেলিউকাস খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে মেগাস্থিনিস নামে একজন গ্রিক দূতকে চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি কয়েকবছর এদেশে অবস্থান করে ভারতের শাসনপ্রকৃতি, ভৌগোলিক বিবরণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'ইন্ডিকা 'তে লিপিবদ্ধ করেন। এই 'ইন্ডিকা' গ্রন্থ বর্তমানে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে পরিগণিত।

বিন্দুসার (২৯৮-২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্বেচ্ছা অবসরের পর তার পুত্র বিন্দুসার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। বিন্দুসার মৌর্য সাম্রাজ্যকে তিনি দক্ষিণ দিকে আরো প্রসারিত করেন এবং কলিঙ্গ, চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজ্য ব্যতিরেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ছাড়াও উত্তর ভারতের সমগ্র অংশ তার করায়ত্ত হয়। তার রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করেন কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি। ২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসার মৃত্যুবরণ করেন ।

সম্রাট অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ এবং মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন অশোক। প্রাচীন পুণ্ড্রনগর ছিল এ প্রদেশের রাজধানী। মহাস্থানগড়ে সম্রাট অশোকের একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। কথিত আছে যে, মৌর্য বংশের এই সম্রাট তাঁর নিরানব্বই জন ভ্রাতাদের মধ্যে অধিকাংশকে পরাজিত করে এবং কোন কোন ভ্রাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। এজন্য তাকে 'চণ্ডাশোক' বলা হয়। তাঁর শাসনামলে প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের স্বাধীন সত্ত্বা বিলোপ হয়। মৌর্য সাম্রাজ্য বাংলায় উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। সম্রাট অশোক সিংহাসনে আরোহণের অষ্টম বছরে কলিঙ্গ যুদ্ধে জয়ী হন । ' কলিঙ্গের যুদ্ধ ' সম্রাট অশোকের জীবনে ছিল এক মাইলস্টোন। এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ লোক নিহত হয়। যুদ্ধের বিভীষিকা ও রক্তপাত দেখে তিনি অহিংস বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে বৌদ্ধধর্ম রাজধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এজন্য তাঁকে ' বৌদ্ধধর্মের কনস্ট্যানটাইন ' বলা হয়। তিনি ব্রাহ্মীলিপির পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং এ লিপিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। আমাদের বাংলা লিপির উৎপত্তি এ ব্রাহ্মীলিপি থেকে। মৌর্যযুগ প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগ হিসেব পরিচিত।

পতন

অশোকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর পর্যন্ত , মৌর্য সাম্রাজ্য ছয়জন সম্রাটের রাজত্বকালে দুর্বল হতে শুরু করে: দশরথ, পরে শালিসুক, দেববর্মণ, সতধনবন এবং বৃহদ্রথ। শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ তার সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হওয়ার পর মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়।

বাংলায় গুপ্ত সাম্রাজ্য

গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল । গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পের খুবই উন্নতি হয়। গুপ্ত যুগের আমলে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা -এর অবির্ভাব হয়েছিলো। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ সম্রাট।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩২০-৩৪০ সাল)

গুপ্তবংশের প্রথম রাজা ছিলেন শ্রীগুপ্ত। শ্রীকৃঞ্চের পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুণ্ড ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩২০ সালে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র । তিনি মগধ হতে এলাহাবাদ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন।

সমুদ্রগুপ্ত (৩৪০-৩৮০ সাল)

চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর সমুদ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের (পাটনা) সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ ও কুশলী যোদ্ধা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শক্তিমান মাত্রই যুদ্ধ করবে এবং শত্রু নিপাত করবে, অন্যথায় সে একদিন বিপন্ন হবে। সমগ্র পাক-ভারতকে একরাষ্ট্রে পরিণত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং এ লক্ষ্যে রাজ্যজয়ের কারণে তাকে 'প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ান' আখ্যা দেয়া হয় । তিনি মগধ রাজ্যকে উত্তরে হিমালয় , দক্ষিণে নর্মদা নদী এবং পশ্চিমে চম্বল নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তাঁর আমলে সমতট ছাড়া বাংলার অন্যান্য জনপদ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। গুপ্ত অধিকৃত বাংলার রাজধানীও ছিল পুণ্ড্রনগর।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৫ সাল)

সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। তিনি মালবের উজ্জয়িনীতে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি ' বিক্রমাদিত্য ' উপাধি গ্রহণ করেন এবং ' বিক্রমাব্দ ' নামক সাল গণনা প্রবর্তন করেন। তিনি মালব, গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র জয় করেন। তাঁর সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য উন্নতির শিখরে পৌঁছে। তাঁর সামরিক শক্তির সাফল্য তাঁকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত উপমহাদেশ থেকে শক শাসন বিলোপ করেন। মহাকবি কালিদাস ছিলেন তাঁর সভাকবি । অনেক প্রতিভাবান ও গুণী ব্যক্তি তাঁর দরবারে সমবেত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রধান নয়জনকে 'নবরত্ন' বলা হয়। তাঁর সভায় কালিদাস, বিশাখ দত্ত, নাগার্জুন, আর্যদেব, সিদ্ধসেন, দিবাকর প্রমুখ কবি সাহিত্যিকের সমাবেশ ঘটে। আর্যভট্ট এবং বরাহমিহির ছিলেন ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আর্যভট্ট অন্য সবার আগে পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি নির্ণয় করেন। আর্যভট্টের গ্রন্থের নাম ' আর্য সিদ্ধান্ত '। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের ফা-হিয়েন নামক একজন চীনা পর্যটক ভারতে আসেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 'ফো- কুয়ো-কিং'।

পতন

৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে বিশাল গুপ্ত সম্রাজ্যের পতন ঘটে। গুপ্তবংশের শেষ শাসক বুধগুপ্তের সময়ে মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতি হুনদের আক্রমণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গুপ্ত সম্রাজ্য।

গুপ্ত পরবর্তী বাংলা

প্রাচীনকালে এদেশকে বঙ্গ নামে অভিহিত করা হতো। গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের পর বঙ্গদেশ দুটি স্বাধীন অংশে বিভক্ত হয়- প্রাচীন বঙ্গ রাজা ও গৌড়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চল ছিল বঙ্গ রাজা এবং বাংলার পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল জুড়ে ছিল গৌড়। সপ্তম শতকে গৌড় বলতে বাংলাকে বুঝাতো ।

স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য

প্রাচীনকালে রাজারা তামার পাতে খোদাই করে বিভিন্ন ঘোষণা বা নির্দেশ দিতেন। এগুলোকে তাম্রশাসন বলা হত। স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য আমলের এ রকম ৭টি তাম্র লিপি পাওয়া গেছে।

রাজা শশাঙ্ক

গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোন অঞ্চলের শাসনকর্তাকে বলা হত 'মহাসামন্ত'। শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত রাজা মহাসেন গুপ্তের একজন মহাসামন্ত। শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা হয়েছিলেন ৬০৬ সালের কিছু আগে। তিনি প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। শশাঙ্কের উপাধি ছিল রাজাধিরাজ। গৌড় রাজ্যের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হলেন শশাঙ্ক । শশাঙ্ক প্রথম বাঙালি রাজা । তিনি হলেন প্রাচীন বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা শশাঙ্ক গৌড় রাজ্য শাসন করেন। তিনি ছিলেন গৌড়ের স্বাধীন সুলতান। তার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী ‘কর্ণসুবর্ণ'। এটি বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি অঞ্চল। তার রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে পুণ্ড্রবর্ধন, দক্ষিণে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলা, পশ্চিমে বারানসী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ শশাঙ্কের রাজ্য ছিল না। রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে তিনি পূর্ব ভারতের সম্রাট হন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন। ৬৩৭ সালে রাজা শশাঙ্ক মারা যান। কথিত, গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করায় শশাঙ্কের গায়ে ক্ষতরোগ হলে তিনি মারা যান। কূটনীতি ও সামরিক দক্ষতার মাধ্যমে শশাঙ্ক গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরী রাজবংশের উচ্ছেদ সাধন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট হর্ষবর্ধনের মোকাবেলায়ও নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন। তিনি বাংলার প্রথম রাজা যিনি বাংলার বাইরে উত্তর ভারতে বাংলার আধিপত্য ও গৌরব বিস্তারে সমর্থ হন । তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তবে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং হিন্দু ধর্মের অনুসারী রাজা শশাঙ্ককে বৌদ্ধ ধর্মের নিগ্রহকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ।

হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭)

৬০৬ সালে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে নিহত হলে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ করেন। হর্ষবর্ধন পুষ্যভূতি বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সিংহাসন আরোহণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি 'হর্ষাব্দ' নামক সাল গণনার প্রচলন করেন । সিংহাসন আরোহণ করেই তিনি ভগ্নি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারে ব্রতী হন এবং মিত্র কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের বাহিনীসহ গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন। তীব্র আক্রমণের আশংকায় শশাঙ্ক সম্মুখযুদ্ধে এড়াতে বন্দী রাজ্যশ্রীকে মুক্তি দিয়ে পূর্বদিকে সরে যান। ভগ্নি উদ্ধার করে হর্ষবর্ধন থানেশ্বরে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন গৌড় রাজ্য দখল করেন। প্রথম জীবনে হর্ষবর্ধন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও পরবর্তীতে 'মহাযানী বৌদ্ধ’ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে এক বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের আয়োজন করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর রাজত্বকালে ৬৩০-৬৪৪ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ সফর করেন এবং তাঁর শাসনের বিভিন্ন দিক লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন বানভট্ট । বানভট্টের বিখ্যাত গ্রন্থ 'হর্ষচরিত'।

পাল বংশ ( ৭৫৬-১১৬১)

মাৎস্যন্যায় : শশাঙ্কের পর দীর্ঘদিন বাংলায় কোন যোগ্য শাসক ছিলনা। ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় শাসন শক্তভাবে ধরার মত কেউ ছিলনা। সামন্ত রাজারা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে থাকেন। এ অরাজকতাপূর্ণ সময় (৭ম-৮ম শতক) কে পাল তাম্র শাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'মাৎস্যন্যায়' বলে। পুকুরে বড় মাছগুলো শক্তির দাপটে ছোট মাছ ধরে ধরে খেয়ে ফেলার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে 'মাৎস্যন্যায়'।

অতীশ দীপঙ্কর : অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক। দশম শতাব্দীর এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য তিব্বতে গমন করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বিক্রমপুর। এটি বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলা।

গোপাল (৭৫৬-৭৮১)

৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে। গোপাল ছিলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম রাজা । তিনি ছিলেন উত্তরবঙ্গের একজন শক্তিশালী সামন্ত নেতা। রাজ্যের কলহ ও অরাজকতা দূর করার জন্য অমাত্যগণ ও সামন্তশ্রেণী গোপালকে রাজা নির্বাচন করেন। তিনি বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাসন শুরু করেন। তিনি বিহারের উদন্তপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণকারী গোপাল প্রায় সমগ্র বাংলায় প্রভুত্ব স্থাপন করেন। বাংলার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ হল পাল বংশ। এ বংশের রাজাগণ প্রায় চার শত বছর রাজত্ব করেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ সাল)

পাল রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল। তার যুগে তিনটি রাজবংশ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে। একটি বাংলার পাল বংশ, অন্যটির রাজপুতানার গুর্জর প্রতীহার বংশ এবং তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকুট বংশ। ইতিহাসে এ যুদ্ধ পরিচিত হয়েছে 'ত্রিশক্তির সংঘর্ষ' (Tripartite War) নামে। পাহাড়পুরের বিখ্যাত বৌদ্ধবিহার সোমপুর বিহার এবং মগধের (বর্তমান 'ভাগলপুর') বিখ্যাত বিক্রমশীলা বিহার ধর্মপালের অমর কীর্তি।

প্রথম মহীপাল (৯৯৫-১০৪৩খ্রি.)

মহীপাল বেনারস ও নালন্দার ধর্মমন্দির, দিনাজপুরের মহীপাল দিঘি, ফেনীর মহীপাল দিঘি খনন করেন। ফেনীতে এখনও মহীপাল স্টেশন নামে বাস স্টেশন আছে। বাংলার প্রাচীনতম চিত্রকলার নিদর্শন পাল-আমলে রাজা মহীপাল দেব এর সময়ে তালপাতার অঙ্কিত নালন্দা মহাবিহারের ' বৌদ্ধ-অনুচিত '।

দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০খ্রি.)

বরেন্দ্র বিদ্রোহ পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে সংঘঠিত হয়। এ বিদ্রোহের ফলে দ্বিতীয় মহীপালের মৃত্যু ঘটে এবং কৈবর্ত প্রধান দিব্যের হাতে বরেন্দ্র (উত্তর বাংলা) চলে আসে। ফলে এই বিদ্রোহ কৈবর্ত বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। আর কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দিব্য।

রামপাল (১০৮২-১১২৪ সাল)

পাল বংশের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন রামপাল। তাঁর মন্ত্রী ও সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিত' গ্রন্থ থেকে রামপালের রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। বরেন্দ্র এলাকায় পানিকষ্ট দূর করার জন্য তিনি অনেক দীঘি খনন করেন। দিনাজপুর শহরের নিকট যে 'রামসাগর' রয়েছে তা রামপালের কীর্তি।

পতন

রামপাল ছিলেন পাল রাজবংশের সর্বশেষ শক্তিশালী শাসক। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র কুমারপাল বৈদ্যদেবের মাধ্যমে কামরূপ রাজ্যের বিদ্রোহ দমন করেন । কিন্তু কুমারপালের মৃত্যুর পর বৈদ্যদেব নিজেই একটি পৃথক রাজ্য স্থাপন করেন। অত:পর সর্বশেষ রাজা মদনপালের শাসনকালে পূর্ব বাংলার বর্মণরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পূর্ব গঙ্গা রাজবংশ-এর সঙ্গে সংঘাত পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে । মদনপাল সেই সংকট কাটাতে পেরেছিলেন কিন্তু বিজয় সেন তাকে পরাজিত করে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন । পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর সেন রাজবংশ বাংলা শাসন করতে শুরু করে।

  • পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা: গোপাল
  • পাল বংশের শেষ রাজা: মদন পাল
  • পাল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা: ধর্মপাল

সেন রাজাদের ইতিহাস

সেন রাজাদের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক অঞ্চলের অধিবাসী। সামন্তসেন কর্ণাটক দেশে অনেক যুদ্ধে খ্যাতিমান হয়ে বৃদ্ধ বয়সে রাঢ় অঞ্চলে এসে বসতি প্রতিষ্ঠা করেন। সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র বিজয় সেন রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। বিজয় সেন বাংলাকে সর্বপ্রথম একক শাসনাধীনে আনায়ন করেন। তিনি ত্রিবেণীর নিকট স্বীয় নামানুসারে 'বিজয়পুর' নামে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপাল স্থানে)।

সেন রাজাদের ইতিহাস
হেমন্ত সেন
বিজয়সেন (১০৯৮-১১৬০)
বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮)
লক্ষ্মণ সেন (১১৭৮-১২০৬)
বিশ্বরুপ সেন ও কেশব সেন (১২০৫-১২৩০)

হেমন্ত সেন

বাংলার ব্যাপক অংশ জুড়ে একাদশ শতাব্দীর মাঝপর্বে প্রতিষ্ঠিত হয় শক্তিশালী সেন বংশের শাসন। বাংলায় সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামন্ত সেন। তিনি কর্ণাট থেকে বৃদ্ধ বয়সে বাংলায় আসেন। তিনি প্রথমে বসতি স্থাপন করেন রাঢ় অঞ্চলে গঙ্গা নদীর তীরে। তিনি রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করায় সেন বংশের প্রথম রাজার মর্যাদা দেওয়া হয় সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেনকে।

বিজয়সেন (১০৯৮-১১৬০)

হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন ক্ষুদ্র সেন রাজ্যকে একটি বিরাট সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ‘বারাকপুর তাম্রপট্ট’ ও ‘দেওপাড়া লেখ’ থেকে বিজয় সেন সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গের এক শূরবংশীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করে বর্ধমান অঞ্চলে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি উড়িষ্যার রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং সমগ্র রাঢ়ে নিজের একাধিপত্য স্থাপন করেন। বিজয় সেন মিথিলার নান্যদেব, গৌড়রাজ মদন পাল ও কোশাম্বীর সামন্তরাজা দ্বোরপবর্ধনকেও পরাজিত করেছিলেন। ভোজবর্মণকে পরাজিত করে বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ জয় করেন। এছাড়া কলিঙ্গ ও মগধের কিয়দংশও তিনি জয় করেছিলেন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বিজয় সেনের রাজত্বকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই ছিলেন সেন রাজবংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক। তিনি সমগ্র রাঢ়, গৌড়, মিথিলা ও পূর্ববঙ্গ জয় করেছিলেন। পাল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার রাষ্ট্রীয় ঐক্য ভেঙে গিয়েছিল। বিজয় সেন পুনরায় বাংলাকে রাষ্ট্রগতভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮)

তিনি বিজয় সেনের পুত্র। অনেকের মতে বল্লাল সেন বাংলায় কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই তথ্য অস্বীকার করেছেন। সেজন্যই তিনি সামাজিক সংস্কার বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তনকারী হিসাবে পরিচিত। বল্লাল সেন পাল রাজাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন। তার রাজত্বকালে বাগড়ি অঞ্চল (পাঞ্জাব,হিমাচল,রাজস্থান,হরিয়ানা) সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। বল্লাল সেন চালুক্য রাজকন্যা রমাদেবীকে বিয়ে করেছিলেন। বল্লাল সেন ধর্ম ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বেদ, স্মৃতি ও পুরাণে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি তান্ত্রিক হিন্দুধর্মেরও অনুরাগী ছিলেন। শেষ জীবনে পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে শাসনভার তুলে দিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরে শাস্ত্রচর্চায় শেষ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি 'দানসাগর' নামে স্মৃতিকথা এবং 'অদ্ভূত সাগর' নামে জ্যোতিষ গ্রন্থ রচনা করেন।

লক্ষণ সেন (১১৭৮-১২০৬)

১২০৪ সালে তুর্কি মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী বাংলা আক্রমণ করেন। এর কিছুদিন আগে লক্ষণ সেন নদিয়ায় অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। নদিয়া তুর্কিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বৃদ্ধ লক্ষণ সেন বাধা না দিয়ে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গের রাজধানী বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর আশ্রয় নেন। নদিয়া তুর্কি শাসনে চলে যায় তবে লক্ষণ সেন পূর্ববঙ্গ থেকে আরো ২/৩ বছর শাসন কাজ চালিয়ে যান।। লক্ষণ সেনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেন শাসনের পতন শুরু হয়। বল্লাল সেনের মতো লক্ষ্মণ সেনও বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ‘গীতগোবিন্দম্’ রচয়িতা জয়দেব, ‘পবনদূত’ রচয়িতা ধোয়ী, ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’ রচয়িতা হলায়ূধ তার সভাসদ ছিলেন। লক্ষ্মণ সেন নিজেও অনেক শ্লোক রচনা করেছিলেন পূর্বপুরুষদের ন্যায় তিনিও রাজর্ষি ছিলেন,মিনহাজ তাঁকে "হিন্দুদের খলিফা" বলে লিপিবদ্ধ করেন।। তিনি ‘পরম বৈষ্ণব’ উপাধি ধারণ করেন।তিনি দানশীল রাজা ছিলেন বলে জানা যায়। ১২০৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিশ্বরুপ সেন ও কেশব সেন (১২০৫-১২৩০)

লক্ষণ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন কিছুকাল পূর্ববাংলা শাসন করেন (১২০৫-১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ)। লক্ষণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলায় সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে সেন রাজ্যের পতন ঘটে। সেন বংশের রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেনযুগের অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলায় হিন্দু রাজাদের শাসনের অবসান ঘটে।

উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের রাজত্বকালে ইরাক ও পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। হাজ্জাজের ভ্রাতৃষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রিস্টান্দ মাত্র সতের বছর বয়সে সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধুর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করেন। একই বছরের মধ্যে তিনি মুলতানসহ পাঞ্জাবের দক্ষিণাংশ মুসলিম শাসনাধীনে আনয়ন করেন। এসময় নিম্নবর্ণের হিন্দুগণ মুহম্মদ বিন কাসিমকে ব্যাপক সাহায্য করে। ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফার পরিবর্তন ঘটলে নতুন খলিফা মুহম্মদ বিন কাসিমকে ডেকে পাঠান এবং অভিযোগ এনে বন্দী করেন। পরবর্তীতে বন্দী অবস্থায় মুহম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু হয়। মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসারের সূচনা ঘটে, আরব ও ভারতীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং মুসলমানগণ ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে আসে। কিন্তু মুহম্মদ বিন কাসিমের অকালমৃত্যুর কারণে ইসলাম উপমহাদেশে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান (১০০০-১০২৭ সাল)

মুহম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের প্রায় ৩০০ বছর পর গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে কতিপয় অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন গজনীর অধিপতি সবুক্তগীনের পুত্র। ভারতীয় উপমহাদেশের ধনরত্ন লাভের আকাঙ্ক্ষায় তিনি মোট ১৭ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। রাজ্য-জয় বা ইসলাম প্রচার তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। এসব আক্রমণকালে তিনি ভিরা, নগরকোট, থানেশ্বর, কনৌজ প্রভৃতি অধিকার করেন। তিনি পাঞ্জাব রাজ্য নিজ শাসনাধীনে রাখেন। পরবর্তীতে এসব অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল। ১০২৬ সালে সুলতান মাহমুদ গুজরাটের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। বহু রাজপুত মন্দিরটি রক্ষা করতে এগিয়ে আসলেও সুলতান মাহমুদ মন্দিরটি ধ্বংস করেন। কথিত যে, এ মন্দির হতে লুণ্ঠনকৃত সোনার মূল্য ছিল তৎকালে প্রায় ২ কোটি টাকা। তাঁর সভাকবি ছিলেন পারস্যের কবি ফেরদৌসী। বিখ্যাত দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ আল বিরুনী তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করেন।

ভারতে মুসলমান শাসন

ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন মুহম্মদ ঘুরী। ময়েজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ইতিহাসে মুহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত। কোন কোন ঐতিহাসিক ঘুরীদের পারসিক জাতি বলে অভিহিত করলেও ঐতিহাসিক লেনপুল তাদের আফগান জাতির বংশধর বলে অভিহিত করেছেন। সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর দেড়শত বছর পর মুহম্মদ ঘুরী ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন । মুহম্মদ ঘুরী ছিলেন গজনীর সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘুরীর ভ্রাতা। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র পাঞ্জাব দখল করেন। এরপর ভারতবর্ষের হিন্দু রাজ্যগুলো জয়ের মানসে আজমীর ও দিল্লীর চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজের সাথে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে লিপ্ত হন ১১৯১ সালে। এ যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরী শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও আহত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অধিক শক্তি সঞ্চয় করে মুহম্মদ ঘুরী ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজের মুখোমুখি হন। পৃথ্বিরাজ দেশীয় শতাধিক রাজার সহযোগিতা নিয়েও মুহম্মদ ঘুরীর নিকট পরাজিত হলে আজমীর ও দিল্লী মুসলমানদের দখলে আসে। তিনি মিরাট, আগ্রা পভৃতি জয় করে শাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন । অতঃপর মুহম্মদ ঘুরী উত্তর ভারতের শাসনভার তার সুযোগ্য সেনাপতি কুতুবুদ্দিনের উপর ন্যস্ত করে গজনী প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর কুতুবুদ্দীন আইবেক বারানসী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, বুন্দেলখণ্ড প্রভৃতি জয় করে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন । কুতুবউদ্দিন উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তার করে দিল্লীতে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন।

বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস

বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয় ত্রয়োদশ শতকে । মুহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেকের অনুমতিক্রমে তুর্কী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ১২০৪ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষণসেনকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন। বখতিয়ার খলজীর বাংলা অধিকারের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। তিনি দিনাজপুরের দেবকোটে বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। প্রথম বাংলা জয় করেন/ বাংলায় প্রথম মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের সূচনা করেন/ বাংলার প্রথম মুসলিম বিজেতা/ বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন/ বাংলার ১ম মুসলমান সুলতান / বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক ছিলেন - ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ।

বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায় ছিল ১২০৪ সাল থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত। এ যুগের শাসনকর্তারা সকলেই দিল্লীর সুলতানের অধীনে বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। অনেক শাসনকর্তাই দিল্লীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন। তবে এদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। দিল্লীর আক্রমণের মুখে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ঘন ঘন বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার জন্য বাংলাকে বলা হত 'বুলগাকপুর' বা বিদ্রোহের নগরী । দিল্লীর ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারাণী এ নাম দিয়েছিলেন।

  • ১২০৪: বখতিয়ার খলজী অশ্ব বিক্রেতার বেশে ১৭ জন অশ্বারোহীসহ লক্ষণ সেনের রাজধানীতে প্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ করেন (ত্রয়োদশ শতকে ) । লক্ষ্মণ সেন পূর্বদিকে পলায়ন করলে বখতিয়ার খলজী বিনা বাধায় নদীয়া দখল করেন এবং গৌড়ের নাম পরিবর্তন করে 'লক্ষণাবতী' রাখেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের বিরাট অংশ পদানত করেন। বর্তমান দিনাজপুর শহরের ১০ মাইল দক্ষিণ- পশ্চিমে অবস্থিত দেবকোট ছিল তাঁর রাজধানী। ১২০৬ সালে তিনি তিব্বত অভিযান পরিচালনা করেন এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলে অমাত্য আলী মর্দান খলজীর হস্তে নিহত হন ।
  • ১২০৬: আলী মর্দান খলজী বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করেন। বখতিয়ার খলজীর অনুচর মালিক শিরান খলজী কর্তৃক আলী মর্দান খলজী বিতাড়িত হলে শিরান খলজী বাংলার শাসনকর্তা হন। দিল্লার সম্রাট কুতুবুদ্দীন আইবেকের সহায়তায় আলী মর্দান খলজী পুনরায় বাংলার শাসনভার দখল করেন
  • ১২১২: বখতিয়ার খলজীর অনুচর গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজী বাংলা দখল করেন এবং স্বাধীন সুলতানরূপে বাংলা শাসন করেন। তিনি পুনরায় দেবকোট হতে রাজধানী গৌড়ে স্থানান্তর করেন। মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন এবং পূর্ববঙ্গে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন । তিনি জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাগদাদের খলিফার অধীনস্ত সুলতানরূপে মুদ্রা জারি করেন। গবেষকদের ধারণা, তিনি বাগদাদের খলিফার নিকট হতে সুলতানরূপে 'খিলাত' বা অনুমোদন লাভ করেন। তাঁর নামে জারি করা মুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ার পর গবেষকগণ নিশ্চিত হন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান।
  • ১২২৭ : দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বাংলা দখল করেন এবং বাংলা পুনরায় দিল্লীর শাসনে আসে। ১২৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলা দিল্লীর অধীনে ছিল। এ সময় সুলতান মুর্গীস উদ্দিন তুঘরীল (১২৭২-৮১) দিল্লীর প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিল্লীর সুলতান বলবন তার বিরুদ্ধে দুইবার সৈন্য প্রেরণ করলেও তুঘরীলকে পরাস্ত করতে পারেননি। পরে বৃদ্ধ বয়সে বলবন তিন লক্ষ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে তুঘরীলকে পরাজিত করেন। এত বড় বাহিনী নিয়ে দিল্লীর কোন নরপতি এর আগে বা পরে কোন যুদ্ধে যোগ দেয়নি। বলবন তুঘরীলকে পরাজিত করে নিজ পুত্র বুগরা খানকে ১২৮১ সালে দিল্লীর প্রতিনিধিরূপে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন।
  • ১২৮৭: মৃত্যুর পূর্বে বলবন বুগরা খানকে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণের আহবান জানান এবং তাঁকে দিল্লীতে ডেকে নেন। বুগরা খান বাংলার প্রতি এত আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে তিনি দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণে রাজি হননি এবং দুই মাস পর পলায়ন করে বাংলায় চলে আসেন ও বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে রাজধানী নিয়ে যান লক্ষ্মণাবতী ।
  • ১৩২৬: দিল্লির সম্রাট মুহম্মদ বিন তুঘলক বাংলা দখল করেন এবং বাংলা পুনরায় দিল্লীর অধীনে আসে।।
  • ১৩৩৮: ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার সময়ে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলা সফর করেন।

হযরত শাহজালালের বাংলায় আগমন

হযরত শাহজালাল ছিলেন প্রখ্যাত দরবেশ ও ইসলাম প্রচারক। তিনি ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামেনে (মতান্তরে তুরস্কে) জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত সুফী শাহপরান ছিলেন তাঁর ভাগ্নে এবং শিষ্য। সুলতান শামসুদ্দিন ফীরূজের শাসনামলে তিনি ৩৬০ জন শিষ্যসহ বাংলাদেশে আসেন। তাঁর এ সময় সিলেটের রাজা ছিলেন গৌরগোবিন্দ। সুলতান শামসুদ্দিন ফীরূজের সৈন্যদল দু'বার সিলেট জয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হযরত শাহজালাল শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সৈন্যদের সঙ্গে গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করেন। গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে সিলেট ত্যাগ করে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ঐ অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। শাহজালাল মৃত্যু অবধি সিলেটে অবস্থান করেন এবং তিনিই ঐ অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারের অগ্রনায়ক। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত শাহজালাল এবং হযরত শাহপরানের মাযার সিলেটে অবস্থিত। তার তরবারী বাংলাদেশে সংরক্ষণ করা হয়েছে ।

বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা

দিল্লীর সুলতানগণ ১৩৩৮-১৫৩৮ এ দুইশত বছর বাংলাকে তাদের অধিকারে রাখতে পারেনি। এ সময় বাংলার সুলতানরা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেন। বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ । ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের পূর্বনাম ফকরা। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান।

ফখরউদ্দিন মুবারক শাহী শাসন (১৩৩৮-১৩৪৯)

বাংলা ছিল দিল্লীর তুঘলক সুলতান শাসিত অঞ্চল। এটি ছিল তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত সোনারগাঁও (শাসক বাহরাম খান), সাতগাঁও (শাসক ইয়াজউদ্দিন ইয়াহিয়া) ও লখনৌতি (শাসক কদর খান)। ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর প্রধান সিলাহদার (বর্মরক্ষক) ফখরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ নাম নিয়ে সোনারগাঁয়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এসময় লখনৌতিতে কদর খানকে হত্যা করে সেনাপতি আলী মুবারক, সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ নামধারণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর রাজধানী লখনৌতি থেকে ফিরুজাবাদে (পান্ডুয়া) স্থানান্তরিত করেন। ফখরউদ্দিনের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের সূচনা হয়। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ দিল্লীর হস্তক্ষেপের বাইরে স্বাধীনভাবে বাংলার একাংশ শাসন করেন। তিনি ১৩৪৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর ১১ বছরের শাসনামলের উল্লেখযোগ্য দিক হল চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম শাসন বিস্তার।

ইবনে বতুতার বর্ণনা: মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ সালে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তিনি ১৩৪৫-৪৬ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সময়ে হযরত শাহজালালের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে সিলেট আগমন করেন। সিলেট থেকে নৌপথে তিনি রাজধানী সোনারগাঁও আসেন। বাংলার তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করেন। ইবনে বতুতা প্রথম বিদেশী পর্যটক হিসাবে " বাঙ্গালা " শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি সোনারগাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী রূপে বর্ণনা করেন এবং চীন ইন্দোনেশিয়া ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সাথে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। বাংলায় খাদ্যসামগ্রীর প্রাচুর্য এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য বাংলাকে তিনি 'ধনসম্পদপূর্ণ নরক' বা 'দোযখপুর্ণ নিয়ামত' বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর 'কিতাবুল রেহেলা' গ্রন্থে তৎকালীন বাংলার বর্ণনা রয়েছে।

সুলতানী আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের রাজধানী ছিল সোনারগাঁও এবং ইলিয়াস শাহের রাজধানী ছিল গৌড়। ফখরউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা হন। ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করলে গাজী শাহের শাসনের অবসান ঘটে।

ইলিয়াস শাহী শাসন (১৩৪২-১৪১২ সাল)

পূর্বে উল্লেখিত বাংলার তিনটি অঞ্চলের একটি সোনারগাঁও এর শাসনকর্তা ছিলেন ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ । অপরদিকে বাংলা আরেকটি অঞ্চল লখনৌতির শাসনকর্তা ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ যিনি কদর খানকে হত্যা করে সেনাপতি আলী মুবারক থেকে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ নাম ধারণ করেছিলেন । সেই সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে হাজী ইলিয়াস ১৩৪২ সালে হত্যা করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নাম ধারণ করে লখনৌতির সিংহাসন আরোহন করেন। অতঃপর বাংলার আরেকটি অঞ্চল সাতগাঁও ১৩৪৫ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ দখল করেন । আবার ১৩৫২ সালে সোনারগাঁও দখল করে ইলিয়াশ শাহ পুরো বাংলার কর্তৃত্ব নিয়ে নেন ।

সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭)

হাজী ইলিয়াস ১৩৪২ সালে লখনৌতির শাসনকর্তা আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নাম ধারণ করে লখনৌতির সিংহাসন আরোহন করেন। তিনি ১৩৪৫ সালে সাতগাঁও দখল করেন। এরপর তিনি ত্রিপুরা, নেপাল, উড়িষ্যা, বারানসী জয় করেন। ১৩৫২ সালে ফখরউদ্দিনের পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁও দখল করে সমগ্র বাংলার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ ভূখণ্ডের নামকরণ করেন 'মূলক-ই-বাঙ্গালাহ' এবং নিজেকে 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি প্রথম স্বাধীন নরপতি যিনি বাঙালি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। তার সময়ে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল পরিচিত হয়ে ওঠে বাঙ্গালাহ নামে। বাঙ্গালাহ শব্দটির প্রচলন করেন ইলিয়াস শাহ। তিনি রাজধানী গৌড় হতে পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত করেন।। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতা সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। কারণ তিনি পুরো বাংলা অধিকার করতে পেরেছিলেন । তাঁর রাজত্বকালে বিখ্যাত সুফী সাধক শেখ সিরাজ উদ্দিন ও শেখ বিয়াবানী বাংলায় এসেছিলেন।

দিল্লীর সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলক ১৩৫৩ সালে বাংলা আক্রমণ করলে ইলিয়াস শাহ দুর্গম একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দিল্লী বাহিনী একডালা দুর্গ জয় করতে না পেরে সন্ধি করে দিল্লী ফিরে যান। তিনি ত্রিপুরার রাজা রত্ন-ফাকে 'মাণিক্য' উপাধি দেন এবং সেই থেকে ত্রিপুরার রাজাগণ 'মাণিক্য' উপাধি ধারণ করে আসছে।

সুলতান সিকান্দার শাহ (১৩৫৭-১৩৯৩)

ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহ মালদহের বড় পান্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ করেন ১৩৫৮ সালে। গৌড়ের কোতওয়ালী দরজা তাঁর অমরকীর্তি। তার শাসনামলে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা জয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। সোনারগাঁওয়ের প্রাক্তন শাসক ফখরুদ্দিন মোবারক শাহর জামাতা পারস্য বংশোদ্ভূত ব্যক্তি জাফর খান ফারস বাংলা থেকে পালিয়ে দিল্লী পৌছান। ফিরোজ শাহ তাকে বাংলার ন্যায়সঙ্গত শাসক বলে ঘোষণা করেন। তার প্ররোচণায় ১৩৫৯ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৪৭০ হস্তী ও বড় আকারের পদাতিক বাহিনীর বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। পিতার মত সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ প্রাসাদ অবরোধ করেন। শেষপর্যন্ত ফিরোজ শাহ বাংলা থেকে তার বাহিনী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন এবং সিকান্দার শাহর সাথে সন্ধি করেন।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ (১৩৯৩-১৪১১)

এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন-আজম-শাহ। আজম শাহ বাংলা ভাষার পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর সময়ে প্রথম বাঙালি কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর কাব্য 'ইউসুফ জোলেখা' রচনা করেন। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তাঁর পত্রালাপ হত। একবার তিনি কবি হাফিজকে বাংলাদেশে আসার দাওয়াত জানালে প্রতুত্তরে কবি হাফিজ একটি সুন্দর কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেন। আজম শাহ চীনের সম্রাট ইউঙলোর সাথে রাজদূত বিনিময় করেন। তাঁর রাজত্বকালে চীনা পরিব্রাজক মাহুয়ান বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর আমলে বিখ্যাত মুসলিম সাধক শেখ নূরুদ্দীন কুত্ ব-উল আলম ইসলাম প্রচার করেন। বর্তমানে সোনারগাঁয়ে গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার রয়েছে।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)

বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। তিনি ২৬ বছর শাসন করেন। তাঁর শাসনামলকে বাংলার স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। হুসেন শাহের আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। হুসাইন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। তাঁর শাসনামলে বাংলা সাহিত্যের চরম উন্নতি হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করেছিলেন। বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, যশোরাজ খান প্রমুখ সাহিত্যিকগণ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। হুসেন শাহী আমলে বাংলা গজল ও সুফী সাহিত্যের সৃষ্টি হয় । হুসাইন শাহের সময় স্থাপত্য শিল্পেরও খুব উন্নতি হয়। তাঁর শাসনামলে গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ ও গুমতিদ্বার নির্মিত হয়।

  • হুসেইন শাহের সেনাপতি - পরাগল খান ও ছুটি খান।
  • 'বাংলাদেশের আকবর'- হুসেইন শাহ।
  • হিন্দু প্রজাগণ তাকে 'নৃপতি তিলক' ও 'জগৎ ভূষণ' উপাধি করেন।
  • চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম শাসন বিস্তার।

নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ (১৫১৯-১৫৩৩)

নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র। তিনি তার পিতার অনুসৃত নীতি বজায় রাখেন। শাসনের প্রথমদিকে নতুন অঞ্চল জয় করে সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করলেও ১৫২৬ সালের পর তাকে মোগলদের সাথে ঘাঘরার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহ এর সময় বাংলা সালতানাত তার সোনালী যুগে পৌছে। গৌড়ের বিখ্যাত বড় সোনা মসজিদ (বারদুয়ারি মসজিদ) এবং কদম রসুল ভবন সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহের অমরকীর্তি। তাঁর সময়ে কবি শ্রীধর 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রচনা করেন।

গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ( ১৫৩৩-১৫৩৮)

হোসেন শাহি রাজবংশ এবং বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ । তার শাসনামলে ১৫৩৪ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রাম আসে। অন্যায় আচরণের অভিযোগে তাদের বন্দি করে গৌড়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সুলতান তাদের বিবেচনা করে চট্টগ্রাম ও হুগলিতে কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেন। এ থেকে পর্তুগিজদের সাথে তার মিত্রতা হয় । পর্তুগিজরা শেরশাহের সাথে যুদ্ধের সময় তাকে সহযোগিতা করেছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি । ১৫৩৮ সালে গিয়াসউদ্দিন শের শাহ সুরি কর্তৃক গৌড় অবরোধের সময় আহত হয়ে মারা যান এবং বাংলায় স্বাধীন সুলতানী যুগের অবসান হয়।

বিভিন্ন শাসনামলে বাংলার রাজধানী

বিভিন্ন পরিব্রাজকের বাংলায় আগমন

পরিব্রাজক শব্দের অর্থঃ
১. বিচরণ তপস্বী
২. অনবরত পর্যটনকারী ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী
৩. পর্যটক

মেগাস্থিনিস (৩৫০ খ্রি.পূ- ২৯০খ্রি. পৃ)

মেগাস্থিনিস (Megasthenes) প্রাচীন গ্রিসের একজন পর্যটক এবং ভূগোলবিদ। তিনি এশিয়া মাইনরে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিক সেনাপতি সেলিউকাস খ্রিষ্টপূর্ব ৩০২ অব্দে তাকে দূত হিসেবে প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি কয়েক বছর এদেশে অবস্থান করে মৌর্য শাসন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা ' ইন্ডিকা ' নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।

ফা-হিয়েন (৩৩৭ খ্রি.- ৪২২খ্রি.)

ফা-হিয়েন (Faxian Fa-Hsien) প্রাচীন চৈনিক তীর্থযাত্রী। তিনি মধ্য এশিয়া, ভারত এবং শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন এবং তার ভ্রমণবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের ফাহিয়েন নামক একজন চীনা পর্যটক ভারতে আসেন। তিনি ১০ বছর ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন। ফা-হিয়েন তার ভারতে অবস্থানকালে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্য 'ফো- কুয়ো-কিং' বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

হিউয়েন সাঙ্গ (৬০২ খ্রি. - ৬৬৪ খ্রি.)

হিউয়েন সাঙ (Xuanzang) ছিলেন বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, পন্ডিত, পর্যটক এবং অনুবাদক। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। হর্ষবর্ধনের দরবারে তিনি আটবছর কাটান। মহাস্থরিব শীলভদ্র (৫২৯-৬৫৪ খ্র) বৌদ্ধ শাস্ত্রের একজন শাস্ত্রজ্ঞ এবং দার্শনিক ছিলেন। তিনি নালন্দা মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যক্ষ ছিলেন। হিউয়েন সাঙ ২২ বছর ধরে শীলভদ্রের কাছে যাবতীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি 'সিদ্ধি' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নালন্দা ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত একটি প্রাচীন উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র। প্রাচীন নালন্দা মহাবিহার বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে ৫৫ কিমি, দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। খ্রিষ্টীয় ৪২৭ অব্দ থেকে ১১৯৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নালন্দা ছিল একটি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র। এই মহাবিহারকে ইতিহাসের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম মনে করা হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল গুপ্ত সম্রাট শত্রুাদিত্যের (অপর নাম কুমার গুপ্ত, রাজত্বকাল ৪১৫- ৪৫৫ অব্দ) রাজত্বকালে। ১১৯৩ সালে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস করে ফেলেন।

ইবনে বতুতা (১৩০৪ খ্রি.- ১৩৬৯ খ্রি.)

ইবনে বতুতা (Ibn Battuta) ছিলেন সুন্নি মুসলিম পর্যটক এবং বিচারক। তিনি ১৩০৪ হয়ে আছেন। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে আগমন করেন। সুলতানের সাথে পরিচয় ঘটলে তিনি এই পরিব্রাজককে কাজীর পদে নিযুক্ত করেন। ইবনে বতুতা অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ৮ বছরকাল উক্ত পদে বহাল ছিলেন। অতঃপর সুলতানের বিরাগভাজন হয়ে কারারুদ্ধ হন। সুলতান এই বিদেশী পর্যটকের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। ইবনে বতুতা ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে (১৩৪৫- ৪৬ খ্রিস্টাব্দে) বাংলায় আসেন।

সিমা কিয়ান (Sima Qian)

সিমা কিয়ানকে (১৩৫ খ্রি.পূ- ৮৬খ্রি.পৃ) চৈনিক ইতিহাস লিখনধারার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার সর্বশ্রেষ্ঠ 'প্রধান ঐতিহাসিক দলিল' যা চৈনিকদের শিজি নামে অধিক পরিচিত।

মা-হুয়ান

ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে মা-চুয়ান নামক একজন চীনা পর্যটক বাংলাদেশে আগমন করেন। তাঁর বিবরণ হতে জানা যায়, এদেশের সৃদ্ধ বা ও রেশম শিল্প বিখ্যাত ছিল। গাছের ছাল হতে মসৃণ কাগজ তৈরি হতো। লোকেরা। রৌপ্য মুদ্রা দ্বারা কেনাবেচা করত।

বিভিন্ন পরিব্রাজকের তথ্য
পরিব্রাজক বাংলায় পৃষ্ঠপোষকতাকারী সম্রাট/যার আমলে বাংলায় আসেন অন্যান্য তথ্য
১. মেগাস্থিনিম (গ্রীক দূত)
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০২ অব্দে
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত • ইন্ডিকা গ্রন্থে ভারতবর্ষের পরিস্থিতির বিবরণ দেন
২. ফা হিয়েন (চীনা পর্যটক)
৩৮০-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত • তিনি বাংলার প্রথম চৈনিক পরিব্রাজক
• বৌদ্ধ ধর্ম ধর্মপ্রচারক
৩. হিউয়েন সাং (চীনা পর্যটক)
৬৩০-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ
হর্ষবর্ধন • তিনি হর্ষবর্ধনের রাজধানী পাটলিপুত্রের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর অধ্যায়ন করেন।
৪. ইবনে বতুতা (মরক্কোর পর্যটক)
১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ (ভারতে আগমন)
১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দ (বাংলায় আগমন)
দিল্লীর সুলতানঃ মোহাম্মদ বিন তুঘলক
বাংলার সুলতানঃ ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ
• তিনি বাংলাকে দোযখপুর নিয়ামত বা ধনসম্পদ পূর্ণ নরক বলেছেন।
• তার রচিত বই কিতাবুল রেহেলা।
৫. মা-হুয়ান (চীনা পর্যটক)
১৪১৩ - ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দ
গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ • তার বর্ণনা অনুযায়ী এদেশে সুক্ষ্ন বস্ত্র ও রেশম শিল্প বিখ্যাত ছিল।
৬. রালফ ফিচ (ইংল্যান্ড)
১৫৮৪ - ১৫৮৮
সম্রাট আকবর এবং বাংলার ঈসা খান
৭. নিকোল দ্য কস্টি (ইতালি)
১৪৩০-১৪৪০

বারভূঁইয়াদের ইতিহাস

সম্রাট আকবর পুরো বাংলার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদাররা মুঘলদের অধীনতা মেনে নেয়নি। জমিদারগণ তাদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ বারভূঁইয়া নামে পরিচিত। এ বার বলতে বার জনের সংখ্যা বুঝায় না। ধারণা করা হয়, অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদার বোঝাতেই বার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমদিকে বারভূইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান / বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভূইয়া ছিলেন ঈসা খান । তিনি বাংলার রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁও এর পত্তন করেছিলেন। সম্রাট আকবরের সেনাপতিরা ঈসা খান ও অন্যান্য জমিদারের বহুবার যুদ্ধ করেছেন কিন্তু বারভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁকে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।

ঈসা খাঁর মৃত্যুর পর বার ভূইয়াদের নেতা হন ঈসা খাঁর পুত্র মুসাখান। এদিকে আকবরের মৃত্যু হলে মুঘল সম্রাট হন জাহাঙ্গীর। তাঁর আমলেই বাংলার বারভূইয়াদের চূড়ান্তভাবে দমন করা সম্ভব হয়। এ সাফল্যের দাবিদার সুবেদার ইসলাম খান। তিনি বারভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানদের পরান্ত। করেন। ফলে অন্যান্য জমিদারগণ আত্মসমর্পণ করে। এভাবে বাংলায় বারভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে। এগার সিন্ধুর দুর্গ ঈসা খানের নামবিজড়িত মধ্যযুগীর একটি দুর্গ। এটি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার অধীনে এগারোসিন্ধুর গ্রামে অবস্থিত। এগারোসিন্ধু শব্দটি এখানে এগারোটি নদী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ দুর্গটি এ নামে পরিচিত হওয়ার কারণ হলো এক সময়। এটি অনেকগুলো নদীর (বানর, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, গিয়র সুন্দা ইত্যাদি) সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল।

১৫৯৯ সালে ঈশা খাঁ প্রাণত্যাগ করলে তার পুত্র মুসা খাঁ সোনারগাঁয়ের প্রভু হলেন। ১৬০২ সালে রাজা মানসিংহ এক নৌযুদ্ধে মুসা খাঁকে পরাজিত করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৮ সালে শেখ আলাউদ্দিন ইসলাম খান চিশতীকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। ১৬০৯ সালে তিনি সোনারগাঁয়ের মুসা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। ফলে সোনারগাঁয়ের পতন হয়। ১৬১০ সালে ইসলাম খান বাংলার রাজধানী বিহারের রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং নামকরণ করেন 'জাহাঙ্গীরনগর'। ১৬১২ সালে ময়মনসিংহের খাজা ওসমানকে পরাজয়ের মাধ্যমে ইসলাম খান সমগ্র বাংলা মুঘল শাসনাধীনে আনেন।

প্রতাপ আদিত্য: উনি ছিলেন ষোড়শ শতকের বাংলার একজন বিখ্যাত ভূঁইয়া বা জমিদার (বারো ভূঁইয় দের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ও প্রতাপশালী)। ইনি ছিলেন যশোরের রাজা। বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও বরিশাল জেলার অন্তর্গত বৃহত্তর অংশ তার রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলে ধুমঘাট ছিল তার রাজ্যের রাজধানী।১৬০৯ সালে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁর নিকট প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন।

বার ভূঁইয়াদের নাম
নাম অঞ্চল
ঈসা খাঁ, মুসা খাঁ, জুমা খাঁ খিজিরপুর, ঢাকা
মহারাজা প্রতাপাদিত্য খুলনা-যশোর
ফজলগাজী, বাহাদুর গাজী ভাওয়াল, গাজীপুর
কন্দপ নারায়ণ, রামচন্দ্র রায় চন্দ্রদ্বীপ, বাকেরগঞ্জ
লক্ষণমাণিক্য, অনন্ত মাণিক্য ভুলুয়া, নোয়াখালী
চাঁদ গাজী, জুনা গাজী মানিকগঞ্জ
চাঁদ রায়, কেদার রায় শ্রীপুর, গাজীপুর
হামিদুর রহমান বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর
পীতাম্বর রায়, রামচন্দ্র রায় পুঠিয়া, রাজশাহী
গণেশ রায়, প্রথম রায় দিনাজপুর
মুকুন্দরাম, রঘুনাথ ভূষণা, ফরিদপুর
কংস নারায়ণ তাহিরপুর, নাটোর

বাংলায় মুঘল শাসন

বাংলায় মুঘল বিজয়ের সূত্রপাত ঘটে সম্রাট হুমায়ুনের রাজত্বকালে। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট হুমায়ুন বাংলায় প্রবেশ করেন এবং গৌড় অধিকার করেন। তিনি গৌড় নগরীর চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এর নামকরণ করেন 'জান্নাতাবাদ'। বাংলায় ৮মাস অবস্থান করে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করলে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসা নামক স্থানে শেরশাহ তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করে। চৌসারের যুদ্ধে (১৫৩৯ সাল) পরাজিত হয়ে হুমায়ুন কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে দিল্লি পৌঁছেন। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের সেনাপতি খান-ই-জাহান কুলী বেগ কররানী বংশের শেষ সুলতান দাউদ খান কররানীকে রাজমহলের যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুবাহ হলো মুঘল সাম্রাজ্যের প্রদেশ। সুবা বাংলার অর্ন্তগত ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা। সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলায় মুঘল শাসনের সূত্রপাত হলেও সমগ্র বাংলার ওপর মুঘল আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। বারো ভূঁইয়াদের দমনের পর সমগ্র বাংলায় মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্যতম কৃতিত্ব। সুবাদারি ও নবাবি এ দু পর্বে বাংলায় মুঘল শাসনকাল অতিবাহিত হয়। বাংলা ছিল মুঘলদের অন্যতম সুবা। সতেরো শতকের প্রথম দিক থেকে আঠারো শতকের শুরু পর্যন্ত ছিল সুবাদারি শাসনের স্বর্ণযুগ । সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর দিল্লির দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময়ে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে বাংলার সুবাদারগণ প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন । মুঘল আমলের এই যুগ ‘ নবাবি আমল ’ নামে পরিচিত ।

বাংলায় সুবেদারী শাসন

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি বাংলা অধিকারের জন্য সুবাদার হিসেবে ইসলাম খান চিশতীকে প্রেরণ করেন । তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম মুঘল সুবাদার। ইসলাম খান বাংলার বার ভূঁইয়াদের দমন করেন এবং ১৬১২ সালে সমগ্র বাংলা মুঘলদের শাসনে আনয়ন করেন । ১৬১০ সালে ইসলাম খান রাজধানী বিহারের রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং নামকরণ করেন ' জাহাঙ্গীরনগর '। ইসলাম খান সমগ্র বাংলার প্রথম সুবাদার ।

ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩)

  • বারভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় সুবেদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
  • সুবেদার ইসলাম খানই বাংলার রাজধানী হিসাবে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন করেন। তিনি ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। তিনি সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর
  • তিনি 'ধোলাইখাল' খনন করেন।
  • সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের প্রথম ইংরেজ দূত ক্যাপ্টেন হকিন্স। ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে ১৬০৮ সালে আগমন করেন।

কাসিম খান জুয়িনী (১৬২৮ - ১৬৩২)

  • এসময় পর্তুগিজদের অত্যাচারের মাত্রা চরমে উঠলে সম্রাট শাহজাহান তাদেরকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশে বাংলার সুবাদার কাসিম খান পতুর্গিজদের হুগলি থেকে উচ্ছেদ করেন।

শাহ সুজা

  • তিনি ইংরেজদের বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ দেন।
  • ঢাকার চকবাজারের 'বড় কাটরা' নির্মাণ করেন। ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক অট্টালিকার নাম বড় কাটরা। ১৬৬৪ সালে বাংলার সুবাদার মুহাম্মদ সুজা এ অট্টালিকা নির্মাণ করেন। বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি তার পরিবারের বসবাসের জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি বাড়ি নির্মাণের আদেশ দেন। তার আদেশে চকবাজারে প্রকৌশলী আবুল কাশেম এ বাড়িটি নির্মাণ করেন।
  • ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান থেকে ইংরেজরা বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কুঠি নির্মাণের অনুমতি লাভ করে।

মীরজুমলা (১৬৬০-১৬৬৩)

  • ঢাকা গেট নির্মাণ করেন।
  • তিনি আসাম যুদ্ধে যে কামান ব্যবহার করেন তা বর্তমানে ওসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত আছে।
  • মীরজুমলা ১৬৬১ সালে ১ নভেম্বর ১২ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৩২৩টি জাহাজ ও নৌকার বহর নিয়ে আসাম আক্রমণ করেন।

শায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৭৮ এবং ১৬৭৯-১৬৮৮)

  • সুবেদার শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপ দখল করেন। তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ। তিনি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন।
  • সুবেদার শায়েস্তা খান স্থাপত্য শিল্পের জন্য বিশেষ বিখ্যাত। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এই যুগকে বাংলায় মোগলদের স্বর্ণযুগ বলা হয়। ঢাকায় শায়েস্তা খান নির্মিত কীর্তিগুলো হল-ঢাকার চকবাজারের ছোট কাটরা, লালবাগের কেল্লা, চক মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ।
  • লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে শায়েস্তা খানের কন্যা পরি বিবির সমাধি অবস্থিত।
  • শায়েস্তা খানের কন্যা পরি বিবির আসল নাম ইরান দুখত। ১৬৮৪ সালে পরীবিবির মৃত্যু হলে লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরেই শায়েস্তা খান তার সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।
  • মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খান পর্তুগীজদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করেন।

বাংলার নবাবী আমল

সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর থেকে ব্রিটিশ শাসনের শুরু পর্যন্ত সময়কে ইতিহাসে বাংলার নবাবী আমল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । এ সময় বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খান , আলীবর্দী খান

নবাব মুর্শিদকুলি খান (১৭১৭-১৭২৭)

তিনি ব্রাহ্মণের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। হাজী শফী নামক এক ব্যক্তি তাঁকে ক্রয় করে নাম দেন মুহম্মদ হাদী। তিনি হলেন বাংলার প্রথম নবাব। তাঁর আমল থেকে বাংলায় নবাবী আমল শুরু হয়। প্রথমে তিনি হায়দ্রাবাদের দেওয়ান ছিলেন। ১৭০০ সালে তিনি বাংলার দেওয়ানী লাভ করেন। তিনি ১৭০২ সালে মুর্শিদকুলি খান উপাধি পান। ১৭১৭ সালে তিনি বাংলার স্থায়ী সুবাদার নিযুক্ত হন এবং বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করে নাম রাখেন 'মুর্শিদাবাদ'। তাঁর শাসনামল থেকে বাংলায় নবাবী শাসন শুরু হয়।

সুজাউদ্দিন মুহম্মদ খান ( ১৭২৭ - ১৭৩৯ )

নবাব মুর্শিদকুলি খানের কোন পুত্রসন্তান না থাকায় মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার নবাব হন। নিজ স্ত্রীর (মুর্শিদ কুলী খাঁর কন্যার) বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও অমাত্যদের সমর্থনে তিনি নবাবী লাভ করেন। সুজাউদ্দিন এদেশে সুশাসনের জন্য বিখ্যাত। সুজাউদ্দিনের সময়ে এদেশে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যেত। সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খানের রাজত্বকালে ১৭৪০ সালে বিহারের শাসনকর্তা আলীবর্দী খান বাংলা দখল করেন।

নবাব আলীবর্দী খান (১৭৪০-'৫৬)

প্রথম জীবনে নবাব আলীবর্দী খান মির্জা মুহম্মদ আলী নামে পরিচিত ছিলেন । বাংলার নবাব সরফরাজ খানের অযোগ্যতার সুযোগে তিনি বাংলা দখল করেন। তিনি প্রথম স্বাধীন নবাব। দিল্লীর দুর্বলতার সুযোগে তিনি স্বাধীনভাবে নবাবী পরিচালনা করেন। তিনি মারাঠাদের আক্রমণ হতে বাংলার জনগণকে রক্ষা করেন। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকারীরা ’বর্গী’ নামে পরিচিত ছিল । ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মারা গেলে তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ( ১৭৫৬ - ১৭৫৭ খ্রিঃ )

সিরাজউদ্দৌলা ১৭৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম যইনুদ্দীন এবং মাতার নাম আমিনা। মাতামহ নবাবের মৃত্যু হলে মাত্র তেইশ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে তিনি সিংহাসন লাভ করেন । ১৭৫৬ সালের জুন মাসে তিনি ইংরেজদের কাসিমবাজার দুর্গ অধিকার করেন। একই মাসে তিনি কলকাতা জয় করে নাম রাখেন 'আলীনগর' । ১৭৫৬ সালের অক্টোবরে 'মনিহারী যুদ্ধে' শওকত জংকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি পূর্ণিয়া অধিকার করেন । ১৭৫৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ইংরেজদের সাথে আলীনগরের সন্ধি করেন। দেশী অমাত্য ও নবাব বিরোধীদের ষড়যন্ত্রে এবং মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব পরাজিত হন।। পলায়নকালে পাটনার পথে রাজমহলের নিকট শুদ্ধ হয়ে মুর্শিদাবাদে আনীত হন। ২ জুলাই, ১৭৫১ মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে সিরাজউদ্দৌলা তাঁর এক সময়ের আশ্রিত মোহাম্মদী বেগের হাতে নিহত হন। তিনি মাত্র এক বছর আড়াই মাস বাংলার নবাব ছিলেন। তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবার। পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং এটি ভারতের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করে। একই সাথে বাংলায় মধ্যযুগের শাসনের সমাপ্তি হয়। তবে ইংরেজদের বাংলার শাসনভার গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মধ্যযুগের রেশ আরো কিছুদিন টিকে ছিল।

মীরজাফর

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মীরজাফর বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন নামমাত্র নবাব। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হাতে । বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের ভিত মজবুত করে লর্ড ক্লাইভ দেশে ফিরে গেলে নতুন গভর্নর নিযুক্ত হন লর্ড ভেন্সিট্যান্স । প্রতিশ্রুত অর্থ না দিতে পারায় তিনি ১৭৬০ সালে মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে বাংলার নবাবী দান করেন।

মীর কাসিম

তিনি ১৭৬০ থেকে ১৭৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। স্বাধীনচেতা মীর কাসিমের সাথে নানা বিষয়ে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব বাধে। তিনি প্রশাসনকে ইংরেজ প্রভাবমুক্ত করতে রাজধানী মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও মীর কাশিম 'বক্সারের যুদ্ধে' ১৭৬৪ সালে ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন। মীর কাশিমের নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী ইংরেজদের কাছে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। পলাশীর যুদ্ধান্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশে ইংরেজদের প্রভুত্ব স্থাপিত হয়। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে মিত্র শক্তির পরাজয়ের ফলে উপমহাদেশের সার্বভৌম শক্তি পদানত হয়। মীর কাশিমের সাথে যুদ্ধে জয়ের পর ইংরেজরা অনেক সুবিধার বিনিময়ে মীরজাফরকে দ্বিতীয়বারের মত বাংলার সিংহাসনে বসান ।

নজমুদ্দৌলা

১৭৬৫ সালে মীরজাফরের মৃত্যু হলে তার অল্পবয়সী পুত্র নজমুদ্দৌলাকে ইংরেজরা বাংলার মসনদ দান করে। নবাবের আড়ালে এ সময় ইংরেজদের নিযুক্ত 'নায়েব-ই-নাজিম উপাধি ধারী রেজা খান' নামক একজন অমাত্য ছিলেন বাংলার প্রকৃত শাসনকর্তা।

লর্ড ক্লাইভ

লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয়বারের মত বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হলে বাংলায় সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন চালুর ব্যবস্থা করেন। ১৭৬৫ সালে দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানী ইংরেজদের প্রদান করেন । বাংলার নবাবকে বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইংরেজরা বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবে নায়েব-ই-নাজিম নিয়োগের ক্ষমতা এবং রাজব আদায়ের ক্ষমতা গ্রহণ করে ইংরেজরা বাংলায় প্রকৃত শাসন কায়েম করেন। পরবর্তীতে ইংরেজরা বাংলার নবাবের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লোপ করে বাংলায় ইংরেজ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে।

أحدث أقدم