ব্রিটিশ শাসন আমল | British rule period

ব্রিটিশ শাসন আমল বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ব্রিটিশ শাসনের সময়কালকে বোঝায়। এই শাসনব্যবস্থার শুরু হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে । তাই ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর ফলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে । প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন এবং পরে ব্রিটিশ রাজের সরাসরি শাসন, যা একশ নব্বই বছর বহাল ছিল । ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রকাশনা, কর্ম- পেশা ও বৃত্তি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্ক প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। নানা ধরনের নিষ্পেষণ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে 'ভেদনীতি' অনুসরণ করে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকলেও অবশেষে রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে এর পরিসমাপ্তি ঘটে।

উপমহাদেশে ও বাংলায় ইউরোপীয়দের আগমন

পর্তুগিজদের আগমন : পর্তুগালের লোকদের পর্তুগিজ বলে। উপমহাদেশে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে পর্তুগিজরা। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে কেরালার কোচিন নামক স্থানে সর্বপ্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ভারতে পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোর প্রথম গভর্নর ছিলেন আলবুকার্ক। বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে প্রথম এসেছিল পর্তুগিজরা ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে। পর্তুগিজগণ বাংলাদেশে ফিরিঙ্গি (ফারসি শব্দ) নামে পরিচিত। ১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। পর্তুগিজদের অধীনে চট্টগ্রামের সমৃদ্ধি ঘটে এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়ে 'পোর্টো গ্রান্ডে' বা বিশাল বন্দর নামে পরিচিত হয়। শেরশাহ ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের চট্টগ্রাম হতে বিতাড়িত করেন। ১৫৮১-১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ সময়ে চট্টগ্রাম আরাকানদের অধীনে ছিল। বাণিজ্যের চেয়ে পর্তুগিজদের মধ্যে জলদস্যুতার বিষয়টি প্রবল ছিল। এ সময় বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে আরাকান জলদস্যু (মগ) এবং পতুর্গিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আরাকান ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের একসাথে 'হার্মাদ' বলা হতো। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে বাংলার সুবাদার কাসিম খান জুয়িনী পর্তুগিজদের হুগলি থেকে উচ্ছেদ করেন। ১৬৬৬ সালে মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের চট্টগ্রাম হতে বিতাড়িত করেন। শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করে এর নাম রাখেন 'ইসলামাবাদ'।

ওলন্দাজদের আগমন : হল্যান্ডের (নেদারল্যান্ডের) অধিবাসীদের ডাচ বা ওলন্দাজ বলে। ডাচরা 'ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ১৬০২ সালে এই উপমহাদেশে আসে। ইংরেজদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা এদেশ থেকে চলে যায়।

দিনেমারদের আগমন : ডেনমার্কের লোকদের বলা হয় ডেনিশ বা দিনেমার। তারা এদেশে বাণিজ্য করার জন্য 'ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করে। কিন্তু তারা বাণিজ্যে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।

ইংরেজদের আগমন : ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথ এবং দিল্লির সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য করার জন্য ২১৮ জন ইংরেজ বণিকদের প্রচেষ্টায় ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে 'ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠিত হয়। ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের উদ্দেশ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন। ক্যাপ্টেন হকিন্সের আবেদনক্রমে সম্রাট জাহাঙ্গীর সুরাটে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি দেন। ১৬১২ সালে ইংরেজরা উপমহাদেশের প্রথম কুঠি স্থাপন করে সুরাটে। ১৬১৫ খ্রি. প্রথম ইংরেজ দূত হিসেবে স্যার টমাস রো সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আগমন করেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৬৩৩ সালে হরিহরপুরে তারা এ কুঠি নির্মাণ করে। দীর্ঘকাল পরে ১৬৫১ সালে হুগলী শহরে তারা দ্বিতীয় কুঠি নির্মাণ করে। ইংরেজরা ১৬৫৮ সালে কাশিম বাজারে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। ১৬৯০ সালে কোম্পানির এজেন্ট জব চার্নক সুতানটি গ্রামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। পরে কলকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম কিনে নগরটিকে আরও বড় করা হয়। এভাবে হুগলি নদীর তীরে গড়ে উঠে বিখ্যাত কলকাতা শহর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কলকাতায় ইংল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামের নামানুসারে 'ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ' (নির্মাণকাল: ১৬৯৬ - ১৭০২ খ্রি.) নির্মিত হয়।

ফরাসিদের আগমন : ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ফরাসিগণ সর্বশেষে উপমহাদেশে আগমন করেন। ফরাসিগণ কালক্রমে সুরাট, মসলিপট্টম, পণ্ডিচেরী, চন্দনগর (পশ্চিমবঙ্গ), কাসিমবাজার, কালিকটে শক্তিশালী বাণিজ্য কুঠি গড়ে তোলে। কিন্তু বন্দীবাসের যুদ্ধ (১৭৬০ খ্রি.) এ ইংরেজদের নিকট পরাজিত হলে উপমহাদেশে ফরাসি প্রভাব ও প্রতিপত্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা

১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁরই দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের অল্পকাল পরেই ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চরম বিরোধ দেখা দেয়। এর কারণের মধ্যে ছিল: প্রথমত, নবাবের অনুমতি ছাড়াই ইংরেজদের দ্বারা দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা খনন, দ্বিতীয়ত, কোম্পানির কর্মচারীদের নবাব প্রদত্ত বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধার যথেচ্ছা ব্যবহার ও সরকারি রাজস্বের বিপুল ক্ষতিসাধন এবং তৃতীয়ত, ইংরেজদের কলকাতা জমিদারিকে 'সার্বভৌম অঞ্চল' হিসেবে গণ্য করা এবং নবাবের প্রতি অনুগত নয় এমন ব্যক্তিদেরকে আশ্রয় দান। এ নিয়ে নবাবের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর কয়েক দফা সংঘর্ষ এবং শান্তিচুক্তি হয়। বস্তুত কোম্পানির কর্মচারীরা পূর্ব থেকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ব্যবসা বিস্তারে মন স্থির করে। এর সঙ্গে মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদের দ্বন্দ্ব-ষড়যন্ত্র যুক্ত হয়। নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে তাঁর নিকট আত্মীয় ঘষেটি বেগম, শওকত জঙ্গ, অত্যন্ত প্রভাব ও বিত্তশালী জগৎশেঠ, উমি চাঁদ, সামরিক কর্মকর্তা মীর জাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ প্রমুখ ছিলেন। এরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মুর্শিদাবাদের কাছে পলাশির প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের চূড়ান্ত যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে নবাবের সৈন্যদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অংশগ্রহণ করে। প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের ইঙ্গিতে অধিকাংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে। পরাজয় ঘটে নবাব সিরাজউদ্দৌলার। বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে। এরপর মীর জাফরসহ আরও কয়েকজন নবাব বাংলার মসনদে আসীন হলেও তারা ছিলেন কার্যত ইংরেজদের হাতের পুতুল। তা সত্ত্বেও নবাব মীর কাসিমের সঙ্গে ১৭৬৪ সালে ইংরেজদের যুদ্ধ বাধে। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দিউয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র আইনগত অধিকার লাভ করে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে নবাবি শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অব্যাহত থাকে এবং ভারতের অন্যত্র তা বিস্তার লাভ করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ও দ্বৈত শাসন (১৭৬৫-১৭৭২ খ্রি.)

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লী দখল না করে দিল্লীর সম্রাটের নিকট হতে ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। প্রকৃতপক্ষে দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা খাজনার বিনিময়ে বাংলার মুঘল অধিকার ইংরেজদের নিকট বিক্রয় করে। লর্ড ক্লাইভ বাংলার নবাবের প্রকৃত শাসনক্ষমতা লোপ করে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। সম্রাটের সাথে ক্লাইভের এ চুক্তি এলাহাবাদের সন্ধি (আগস্ট, ১৭৬৫ খ্রি.) নামে পরিচিত। বাংলার নেজামত (বিচার ও শাসন) ক্ষমতা নবাবের হাতে এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর ন্যস্ত হয়। ইতিহাসে এটি 'দ্বৈতশাসন' (Dual Government) নামে পরিচিত। দ্বৈতশাসন এবং ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচার, উৎপীড়ন ও শোষণের ফলে বাংলার জনসাধারণের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে পড়ে। দ্বৈত শাসনের চরম ব্যর্থতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে এ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে প্রত্যক্ষভাবে রাজস্ব শাসনের দায়িত্ব হাতে নেয়।

লর্ড ক্লাইভ (১৭৬৫-১৭৬৭)

বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর লর্ড ক্লাইভ বাংলার প্রকৃত প্রভু হয়ে বসেন। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমের পরাজয়ের পর লর্ড ক্লাইভ বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন।

দ্বৈত শাসন : ক্ষমতালোভী নবাব বংশধর ও অনুচরদের তুষ্ট রেখে কোম্পানীর আয় বৃদ্ধির জন্য লর্ড ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রচলন করেন। এ নীতি অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ও দেশরক্ষার ভার কোম্পানির হাতে রাখা হয় এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা নবারের হাতে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থা হতে নবাবের কর্তৃত্ব খর্ব করা হয় এবং জনগণের উপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের ফলে জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব হিসেবে পরবর্তীতে বাংলায় 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ' সংঘটিত হয়। লর্ড ক্লাইভ বাংলার প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর। গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর ১৭৬৭ সালে তিনি বীরবেশে দেশে ফিরে যান।

লর্ড ক্লাইভের আত্মহত্যা : ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। আর উত্থান ঘটে লর্ড ক্লাইভ তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের । পলাশীর যুদ্ধের দশ বছর পর ক্লাইভ ইংল্যান্ড ফিরে যান। কিন্তু ভারতে রেখে যান, ঘুষ, দুর্নীতি, আত্মসাৎ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, দুর্বত্তায়ন এবং অপরাজনীতির এক জঘন্য ইতিহাস। তার দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট তার দুর্নীতির তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়। তদন্ত বন্ধ করতে তার অনুরোধ সত্ত্বেও চলতে থাকে তদন্ত। লর্ড ক্লাইভ অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

গভর্নর কার্টিয়ার (১৭৬১-১৭৭২)

১৭৬৯ সালে কার্টিয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। এ সময়ে সমগ্র বাংলায় দ্বৈত শাসনের প্রভাব পড়তে থাকে । দ্বৈত শাসনের প্রভাবে জনগণ ব্যাপক অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে ফসল নষ্ট হয়ে গেলে বাংলায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সমগ্র দেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করে। বাংলা ১১৭৬ সালের (ইংরেজি ১৭৭০ সালে) এই দুর্ভিক্ষ ইতিহাসে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' বা মহাদুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' এর সময় বাংলার গভর্নর ছিলেন কার্টিয়ার।

বাংলার গভর্নর জেনারেলের শাসন (১৭৭৩-১৮৩৩ খ্রি.)

দ্বৈত শাসনের নানা কুফল এবং নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রেগুলেটিং অ্যাক্ট-১৭৭৩ ( নিয়ামক আইন-১৭৭৩ ) পাস করে এবং গভর্নর পদকে গভর্নর জেনারেল পদে উন্নীত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল পদে উন্নীত করেন । ওয়ারেন হেস্টিং-এর শাসনামলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্টের দোষত্রুটি দূর করে ১৭৮৪ সালে ভারত শাসন আইন পাস করে। আইনটি প্রণয়নকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইলিয়াম পিট। ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত পিটের ভারত শাসন আইন কার্যকর ছিল।

ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭৩ - ১৭৮৫ খ্রি.)

১৭৭২ সালে তিনি বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। কোম্পানির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি প্রথমেই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। তিনি মারাঠা, নিয়াম ও হায়দার আলীর শক্তির বিরুদ্ধে ইংরেজদের শক্তি সমুন্নত রাখেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের প্রথম সূচনা করেন ।

রাজস্ব বোর্ড গঠন : কোম্পানির রাজস্ব আদায়ে গতি সৃষ্টি এবং রাজস্ব উদ্বৃত্ত দেখানোর জন্য তিনি রাজন বোর্ড গঠন করেন। উপমহাদেশে তিনি প্রথম রাজস্ব বোর্ড গঠন করেন। তিনি মুঘল সম্রাটের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদান বন্ধ করে দেন। তিনি বাংলার নবাবের বৃত্তি অর্ধেক করে দেন। প্রজাসাধারণের উপর জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় জোরদার করেন এবং ১৭৭৪ সালের মধ্যে কোম্পানির রাজস্ব উদ্বৃত্ত দেখাতে সক্ষম হলেন।

পাঁচশালা বন্দোবস্ত : রাজকোষের শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যে হেস্টিংস ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করেন । এটি ‘পাঁচশালা বন্দোবস্ত ’নামে পরিচিত ছিল ।

লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৮৬-১৭৯৩)

১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লর্ড কর্নওয়ালিসকে বাংলার গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করেন। তিনি মারাঠা, নিয়াম ও টিপু সুলতানের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হন।

দশশালা পরিকল্পনা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা : রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং স্থায়ী অনুরক্ত শ্রেণী সৃষ্টির মানসে তিনি ১৭৬১ সালে দশশালা ভূমি বন্দোবস্ত প্রথা চালু করেন। ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ তিনি দশশালা বন্দোবস্তকে 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' ঘোষণা করেন।। নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য তিনি 'সূর্যাস্ত আইন' বলবৎ করেন । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে দিতে অসমর্থ হলে কোম্পানী জমিদারি নিলামে বিক্রি করতো। এটিই সূর্যাস্ত আইন।

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস : তিনি সরকারি কর্মচারীদের জন্য যে বিধিবিধান চালু করেন পরবর্তীকালে তা 'ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস' নামে প্রচলিত হয়।

লর্ড ওয়েলেসলী (১৭৯৮-১৮০৫)

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে উগ্র প্রচেষ্টার জন্য তিনি সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বড়লাট।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি : "অধীনতামূলক মিত্রতা' নীতি প্রবর্তন করে তিনি হায়দ্রাবাদের নিযাম ও পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাওকে বশীভূত করেন। অধীনতামূলক নীতির মাধ্যমে তিনি তাঞ্জোর, সুরাট, কর্নাটক, ও অযোধ্যার স্বাধীনতা হরণ করেন।

টিপু সুলতানের সংগ্রাম : এ সময় মহীশূর (অধুনা ভারতের কর্ণাটক রাজ্য) এর শাসনকর্তা ছিলেন টিপু সুলতান। টিপু অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কোম্পানির সঙ্গে কয়েক দফা যুদ্ধ হয়। চতুর্থ মহীশূরের যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রি.) এ টিপু পরাজিত ও নিহত হলে মহীশূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। টিপুর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন লর্ড ওয়েলেসলির ভ্রাতা আর্থার ওয়েলেসলি। টিপু বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে নিহত হন। এভাবে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি বিনষ্ট করে তিনি ব্রিটিশকে উপমহাদেশে প্রধান শক্তিতে পরিণত করেন।

লর্ড হেস্টিং (১৮১৩-১৮২৩)

প্রায় দশ বছর তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে বিভিন্ন গোত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তার শাসনামলে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি ২০টি দুর্গ দখল করেন। তিনি মারাঠা শক্তি সম্পূর্ণ ধধ্বংস করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেন। এ সময়ে রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় 'হিন্দু কলেজ' প্রতিষ্ঠা করেন ।

ভারতের গভর্নর জেনারেলের শাসন (১৮৩৩ - ১৮৫৮ খ্রি.)

১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট গভর্নর-জেনারেল এবং ফোর্ট উইলিয়ামের কাউন্সিলকে গভর্নর-জেনারেল এবং কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার সাথে প্রতিস্থাপন করে। অর্থাৎ ১৮৩৩ সালে বড়লাটের পদবী 'বাংলার গভর্নর জেনারেল' এর পরিবর্তে 'ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল' করা হয়।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-১৮৩৫)

তিনি বড়লাট হয়ে এসে ভারতে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা। করেন। বেন্টিং-এর শাসনামল উপমহাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সংস্কারের জন্য বিখ্যাত। সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনি ভারতীয়দের জন্য 'সাব জজ' ও 'মুন্সেফ' পদ সৃষ্টি করেন। রাজা রামমোহন ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহায়তায় ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি 'সতীদাহ প্রথা’ বাতিল করেন। ১৮৩৫ সালে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সালে তিনি। 'ম্যাকলে শিক্ষানীতি' প্রণয়ন করেন। যদিও পরবর্তীকালে এটিকে কেরানী তৈরির প্রজেক্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তার শাসনামলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্পষ্টভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করে।

লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-১৮৪৮)

ভারতবর্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষত রেল যোগাযোগে তিনি ব্যাপক অবদান রাখেন। মূলত রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য ব্রিটিশরা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায়। তিনি শিখদের যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং এক কোটি টাকা জরিমানা আদায়ের জন্য গোলাপ সিং নামে এক ব্যক্তির নিকট ৭৫ লক্ষ টাকায় জম্মু ও কাশ্মীর বিক্রয় করেন। সেই থেকে ভারত বিভাগ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরে ব্রিটিশ শাসনাধীন বিশেষ শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা ভোগ করছিল।

লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-১৮৫৬ খ্রি.)

সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। স্বত্ব বিলোপ নীতির প্রয়োগ করে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটান। ১৮৫০ সালে তিনি উপমহাদেশের প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন (কলকাতা হতে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত) স্থাপন করেন।

  • স্বত্ব বিলোপ নীতি : তিনি স্বত্ব বিলোপ নীতির কঠোর প্রয়োগ করেন। এর মাধ্যমে তিনি সাঁতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর রাজ্য ব্রিটিশদের অধীনে আনেন। তার উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে দেশীয় বিভিন্ন গোত্র ও আঞ্চলিক শক্তি ইংরেজদের উচ্ছেদ করার সংকল্প করতে থাকেন যা পরবর্তীতে সিপাহী বিপ্লবের দিকে ভারতবর্ষকে ঠেলে দেয়।
  • রেল যোগাযোগ চালু : ১৮৫৩ সালে তিনি উপমহাদেশে প্রথম রেল যোগাযোগ চালু করেন।
  • ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা : তিনি টেলিগ্রাফ ও ডাকটিকিটের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিঠিপত্র আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করেন।
  • বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহায়তায় ১৮৫৪ সালে তিনি বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন করেন। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়।

ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়ের শাসন (১৮৫৮ - ১৯৪৭ খ্রি.)

সিপাহি বিদ্রোহের পর ২ আগস্ট, ১৮৫৮ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত শাসন আইন পাশ হয়। সরকার ভারতের শাসনভার ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার হস্তে অর্পণ করেন। ইংল্যান্ডের মহারানির প্রতিনিধি অর্থাৎ রাজপ্রতিনিধি হিসাবে গভর্নর জেনারেলকে বড়লাট (Viceroy) উপাধি দেওয়া হয়। এর ফলে ভারতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন (১৭৫৭-১৮৫৮ খ্রি.) এর অবসান ঘটে।

লর্ড ক্যানিং (১৮৫৬ - ৬২ খ্রি.)

ভারতবর্ষের প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হন। উপমহাদেশে তিনিই প্রথম পুলিশ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি পুলিশ আইন, ১৮৬১ প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক পুলিশ ব্যবস্থা চালু করেন। বাংলাদেশের পুলিশ এখনও এই আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৮৬১ সালে তিনি উপমহাদেশে প্রথম কাগজের মুদ্রা চালু করেন। জমিদারদের হাত থেকে রায়তদের রক্ষার্থে ক্যানিং বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন চালু করেন।

লর্ড মেয়ো (১৮৬৯-৭২)

ভারতবর্ষে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৮৭২ সালে লর্ড মেয়োর শাসনামলে। লর্ড মেয়ো আদমশুমারি ছাড়াও কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

লর্ড লিটন (১৮৭৬-৮০)

  • তিনি একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ছিলেন।
  • অস্ত্র আইন (The Arms Act): তিনি ১৮৭৮ সালে অস্ত্র আইন পাস করে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করেন।
  • সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act): তিনি ১৮৭৮ সালে সংবাদপত্র আইন পাস করে দেশীয় ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন।

লর্ড রিপন (১৮৮০-৮৪)

  • সংবাদপত্রগুলোর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান: তিনি সংবাদপত্র আইন রহিত করে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন।
  • হান্টার কমিশন (Hunter Commision): তিনি ১৮৮২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কারের জন্য হান্টার কমিশন গঠন করেন।
  • ইলবার্ট বিল: লর্ড রিপন 'ইলবার্ট বিল' প্রণয়ন করে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা প্রদান করেন। কিন্তু ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের মধ্য তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
  • বেঙ্গল মিনিসিপাল অ্যাক্ট (Bengal Municipal Act): লর্ড রিপনের সেরা কীর্তি বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট আইন প্রণয়ন। এর মাধ্যমে তিনি স্থানীয় সরকার কাঠামো তৈরি করেন। অর্থাৎ তিনি ভারতে প্রথম স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক।
  • ফ্যাক্টরি আইন: লর্ড রিপন শ্রমিক কল্যাণের জন্য ১৮৮১ সালে 'ফ্যাক্টরি আইন' পাস করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এ আইনের দ্বারা শিল্প শ্রমিকদের দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার নিয়ম চালু করা হয় এবং শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করেন।

লর্ড কার্জন (১৮৯৯ - ১৯০৫ খ্রি.)

১৯০৫ সালে ১৬ অক্টোবর বাংলা প্রদেশকে দুইভাগে ভাগ করেন। এ ঘটনা বঙ্গভঙ্গ (Partition of Bengal) নামে পরিচিত। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে বাংলা প্রদেশ গঠিত ছিল। এটি ছিল তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। প্রদেশটির প্রশাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। বঙ্গভঙ্গের ফলে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম বাংলা প্রদেশ যার রাজধানী ছিল কলকাতা। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হয় 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ যার রাজধানী ছিল ঢাকা। পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন ব্যামফিল্ড ফুলার । 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের রিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। তিনি কলকাতায় ভারতের বৃহত্তম গ্রন্থাগার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করে । মর্লি-মিন্টু সংস্কার আইন (১৯০৯): এ মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। বাংলা এ পর্যন্ত ২ বার বিভক্ত হয়। যথা-
১. ১৯০৫ সালে (বঙ্গভঙ্গের ফলে)
২. ১৯৪৭ সালে (ভারত বিভাগের ফলে)

লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৯১০-১৬)

বঙ্গভঙ্গ রদ: 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের রিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে 'রাখিবন্ধন' অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাঙালির ঐক্যের আহবান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ 'বাংলার মাটি, বাংলার জল' গানটি রচনা করেন।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের মুখে ১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে রাজা পঞ্চম জর্জ 'বঙ্গভঙ্গ' রদ করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের সুপারিশ করেন ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ (দ্বিতীয়)। ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে একত্রিত করে কলকাতাকে রাজধানী করে 'বেঙ্গল প্রদেশ' সৃষ্টি করা হয়

রাজধানী কলকাতা হতে দিল্লীতে স্থানান্তর: বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানদের মধ্য চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। মুসলমানদের খুশি করার জন্য ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে হস্তান্তর করা হয়।

লর্ড চেমসফোর্ড (১৯১৬-২১)

মন্টেও-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন (১৯১৯): এটি ভারত শাসন আইন নামেও পরিচিত। এই আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রে দুইকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ছিল কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল বড়লাটের হাতে। প্রাদেশিক দ্বৈতশাসন নীতি কার্যকর ছিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছিল গভর্নরের হাতে। ফলে জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অপূর্ণই থেকে যায়।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন (১৯৪৭ খ্রি.)

লর্ড মাউন্টব্যাটেন (১৯৪৭ খ্রি.) ছিলেন ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় (বড়লাট)। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষকে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সরকারি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এবং স্যার সিরিল জন র‍্যাডক্লিফকে সীমানা নির্ধারণকারী কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭' প্রণীত হয়। এ সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লিমেন্ট এটলি। র‍্যাডক্লিফ ভারত বিভাগ, নতুন দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এবং আন্তর্জাতিক সীমা নির্দেশ করে তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন। মাউন্ট ব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের হাতে এবং ১৫ আগস্ট ভারতীয় গণপরিষদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জন্ম নেয় ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র। র‍্যাডক্লিফের নেতৃত্বাধীন কমিশন সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ সমাপ্ত করে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট। তাঁর নামানুসারে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তরেখার নামকরণ করা হয় র‍্যাডক্লিক লাইন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন স্বাধীন ভারেতের প্রথম গভর্নর জেনারেল। এখানে উল্লেখ্য যে, অবিভক্ত বাংলার শেষ গভর্নর ছিলেন স্যার ফ্রেডরিক জন বারোজ।

সহজে মনে রাখার জন্য
শাসক অবদান
লর্ড ক্লাইভ • দ্বৈত শাসন
ওয়ারেন হেস্টিংস • দ্বৈত শাসন রহিত
লর্ড কর্নওয়ালিস • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
লর্ড ওয়েলসলি • অধীনতা মূলক মিত্রতা
লর্ড বেন্টিংক • সতীদাহ প্রথা রহিত
লর্ড মেয়ো • আদমশুমারী
লর্ড লিটন • অস্ত্র আইন, সংবাদ পত্র
লর্ড কার্জন • বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)
লর্ড হার্ডিঞ্জ • বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১)
লর্ড চেমসফোর্ড • ভারত শাসন আইন
লর্ড মাউন্ট ব্যাটন • ভারত বিভাগ
লর্ড ডালহৌসি • রেল যোগাযোগ, বিধাব বিবাহ রহিত, স্বত্ব বিলোপনীতি
লর্ড ক্যানিং • সিপাহী বিদ্রোহ, মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার, পুলিশ ব্যবস্থা প্রবর্তন
লর্ড রিপন • হান্টার কমিশন, বেঙ্গল মিনিসিপাল অ্যাক্ট, ফ্যাক্টরী আইন
নবীনতর পূর্বতন