তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাম্প্রতিক প্রবণতা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাম্প্রতিক প্রবণতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা । বিশেষ করে চ্যাট জিপিটি বাজারে আসার পর এর আলোচনা , সমালোচনা জমে উঠেছে । ভবিষ্যতে এসব প্রযুক্তি মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে নাকি প্রসারিত করবে এ নিয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে । মোদ্দাকথা হল এসব প্রযুক্তি মানুষের উপকারের জন্য তৈরি হচ্ছে এবং মানুষের কর্মক্ষেত্রকে আরো সহজ করে তুলবে । যার ফলে মানুষের কাজের গতি আরো বহুগুণে বেড়ে যাবে । ফলে সৃষ্টি হবে আরো নতুনত্ব , আরো নতুন প্রযুক্তি যা আমাদের কল্যাণার্থে ব্যবহার হবে । কাজেই এটা ভাবার কোন অবকাশ নাই যে এসব প্রযুক্তি আমাদের ক্ষতি করবে । নিচে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সাম্প্রতিক প্রবণতার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রযুক্তি সম্পর্কে তুলে ধরা হল ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence)

মানুষ যেভাবে চিন্তাভাবনা করে কৃত্রিম উপায়ে কম্পিউটারে সেভাবে চিন্তাভাবনার রূপদান করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়িাল ইন্টেলিজেন্স বলা হয় । যা সংক্ষেপে AI ( এআই ) নামে পরিচিত । ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের MIT এর Jhon McCarthy সর্বপ্রথম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটির সাথে সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে আর্টিফিসিয়িাল ইন্টেলিজেন্সের জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় প্রতিভাবান কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং (Alan Turing) কে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারিক এলাকা
  • মেশিন লার্নিং (Machine Learning): Reinforcement Learning গবেষণার মূল ভিত্তি হচ্ছে একটি যন্ত্রকে আলাদাভাবে কিছু শেখানো হয় না। মেশিনের সামনে উপস্থিত বিশদ পরিমান ডেটা থেকে একটি যন্ত্র নিজেই শিখে নেয়। প্রথম প্রথম সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে কিন্তু ঠিক মানুষের মতোই যন্ত্র ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। যেমন- Google's Language Translator.
  • এক্সপার্ট সিস্টেম (Expert System): এক্সপার্ট সিস্টেম এমন একটি সফটওয়্যার যার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে কোন জটিল সমস্যার সমাধান কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এটি মানুষের দেয়া তথ্য, যুক্তি ও ডেটাবেজের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। যেমন:
    Mycin Cadulus - চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধান করা হয়।
    Deep Blue - উদ্ভাবক IBM। দাবা খেলার বিচারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
    Mycsuma - গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা যায়।
    RI - কম্পিউটার ডিজাইনে ব্যবহৃত হয়।
    Prospector - খনিজ পদার্থ ও আকরিক অনুসন্ধানে ব্যবহৃত হয়।
  • Natural-language processing (NLP): কম্পিউটারগুলিকে মানুষের ভাষা বোঝার ব্যাখ্যা ও পরিচালনা করতে সহায়তা করে।
  • মনুষ্যবিহীন বিমান চালনায়। যেমন- মনুষ্যবিহীন ড্রোন।
  • মনুষ্যবিহীন গাড়ি চালনায়। যেমন- বৈদ্যুতিক কার কোম্পানি 'টেসলা' এর CEO এলন মাস্ক সম্পূর্ণ স্ব-নিয়ন্ত্রিত (Full Self-driving) যানবাহন উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েছেন।
  • কাস্টমার সার্ভিস প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক্সপার্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। যেমন-ভয়েস রেসপন্স, ভয়েস সার্ভার, Automated online Assistance.
  • রোবোটিক্সে। যেমন- মানবাকৃতির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সামাজিক যোগাযোগে সক্ষম নারী রোবট 'সোফিয়া'। নির্মাতা হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হ্যানসন রোবটিক্স। রোবটটিকে এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে সে মানুষের আচরণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ও শিখতে পারে। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে রোবটটিকে সৌদি আরব নাগরিকত্ব দেয়। সোফিয়া বিশ্বের প্রথম রোবট হিসেবে কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করে। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর রোবট সোফিয়া বাংলাদেশ সফরে এসেছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় C/C++, Java, MATLAB, Python, SHRDLU, CLISP, PROLOG, LISP, CLISR, R ইত্যাদি প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করা হয়।

রোবটিক্স (Robotics)

টেকনোলজির যে শাখায় রোবটের নকশা, গঠন ও কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা হয় সেই শাখাকে রোবটিক্স বলা হয়। Robotics (রোবটিক্স) শব্দটির উৎপত্তি হয় 'Robot' (রোবট) শব্দ থেকে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যে মেশিন মানুষের মত কাজ করতে পারে, তাকে বলা হয় রোবট। এটা একটি স্বনিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার পদ্ধতি। রোবোটিক্স শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন আইজ্যাক আশিমো। জাপানের মুরাতা কোম্পানির 'মুরাতা বয়', সনি কর্পোরেশনের 'আইবো', হোন্ডা কোম্পানির 'আসিমো' ইত্যাদি রোবট প্রায় মানুষের মতোই বিশেষ কোনো কাজ করতে পারে। একটি সাধারণ রোবটে নিচের উপাদান বা অংশগুলো থাকে। যথা-

  1. পাওয়ার সিস্টেম (Power System): সাধারণত লেড এসিড রিচার্জেবল ব্যাটারি দিয়ে রোবটের পাওয়ার দেওয়া হয়।
  2. অ্যাকচুয়েটর (Actuator): রোবটের হাত-পা অথবা বিশেষ ভাবে তৈরি কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া করার জন্য কতগুলো বৈদ্যুতিক মটরের সমন্বয়ে তৈরি বিশেষ ব্যবস্থা হলো অ্যাকচুয়েটর। একে রোবটের হাত ও পায়ের পেশী বলেও অভিহিত করা যায়।
  3. অনুভূতি (Sensing): অনুভূতি মানুষের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেন্সরের মাধ্যমে রোবটেও মানুষের মত অনুভূতি তৈরি করা হয়। কাজের প্রয়োজনে রোবটকে ৩৬০° কোণে ঘুরানো যায়।
  4. ম্যানিপিউলেশন বা পরিবর্তন করা (Manipulation) : রোবটের আশেপাশের বস্তুগুলোর অবস্থান পরিবর্তন বা বস্তুটিকে পরিবর্তন করার পদ্ধতিকে বলা হয় ম্যানিপিউলেশন। সাধারণত রোবটের হাত-পা এই পরিবর্তনের যাবতীয় কাজ করে থাকে।

মার্কিন রোবোটিক মহাশূন্যযান পাথ ফাইন্ডার ১৯৯৭ সালে মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করে। ২০০৩ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে দুইটি রোভার (রোবট) 'স্পিরিট' ও 'অপরচুনিটি' পাঠায়।

বায়োমেট্রিক্স (Biometrics)

বায়োমেট্রিক্স হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কোনো ব্যক্তির দেহের গঠন এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তাকে অদ্বিতীয়ভাবে চিহ্নিত বা সনাক্ত করা যায়। কম্পিউটার বিজ্ঞানে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিকে ব্যক্তি সনাক্তকরণ এবং কোনো সিস্টেমে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেহের গঠন এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যথা-

  • ক) দেহের গঠন ও শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি: ফিংগার প্রিন্ট, হ্যান্ড জিওমিট্রি, আইরিস এবং রেটিনা স্ক্যান, ফেইস রিকোগনিশন, ডিএনএ টেস্ট।
  • খ) আচরণগত বৈশিষ্ট্যের বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি: Voice recognition, Signature verification, Keystroke verification.

২০১৫ সালে বাংলাদেশে বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ) পদ্ধতিতে সিমকার্ড নিবন্ধন চালু হয়। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনে বিশ্বে পাকিস্তান প্রথম এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয়।

Face Recognition system: যে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিতে মানুষের মুখের জ্যামিতিক আকার ও গঠন পরীক্ষা করে উক্ত ব্যক্তিকে অদ্বিতীয়ভাবে সনাক্ত করা হয়, তাকে মুখমণ্ডল সনাক্তকরণ (Face Recognition) সিস্টেম বলে। দুই চোখের মধ্যকার দূরত্ব, নাকের দৈর্ঘ্য, চোয়ালের কৌণিক মাপ ইত্যাদি পরিমাপের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে সনাক্ত করা হয়। মেশিন লার্নিং এবং ভিশন (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুটি ক্ষেত্র) মুখমণ্ডল সনাক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইমেজ প্রসেসিং (এক ধরনের ভিশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে মুখের নানান রকম বৈশিষ্ট্য বের করা হয় এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে প্রাক-বিদ্যমান ডেটাবেজে থাকা ব্যক্তিদের চিত্রের সাথে তা মিল করা হয়।

জৈব তথ্যবিজ্ঞান (Bioinformatics)

জীববিজ্ঞানে তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ হলো বায়োইনফরমেটিক্স। মূলত এই বিষয়টির জন্ম হয়েছে জীববিজ্ঞানের বিশাল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করে সেগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য। বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহৃত হয় - -

  • মানব জিনোম সিকুয়েন্স করতে।
  • বিভিন্ন জটিল রোগ বিশেষত ক্যান্সারের কারণ গবেষণায়।
  • বিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে।
  • প্রোটিন সিকোয়েন্সের গঠন উপাদানের ইলেকট্রনিক ডেটাবেজ তৈরিতে ।
  • মলিকুলার মেডিসিন, জিনথেরাপি, জিন ফাইন্ডিং, ডিএনএ ম্যাপিং ও অ্যানালাইসিস, প্রোটিনের মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণে।
  • বর্জ্য নিষ্কাশনে, জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণায়, বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে, জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে। বায়োইনফরমেটিক্স-এ সফটওয়্যার টুলস হিসেবে Java, C+, XML, Python, Perl C, C++, R, SQL, CUDA, MATHLAB, Spreadsheet Analysis ইত্যাদি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহৃত হয়।

জেনেটিক ম্যাপ (Genetic Map): কোনো এলাকার (যেমন- দ্বীপ, দেশ) মানুষের ডেটার সঙ্গে ফ্যামিলি ট্রির তথ্য মিলিয়ে যে ডেটাবেস করা হয়, তাই জেনেটিক ম্যাপিং। যে ধরনের মিউটেশনের ফলে বহু পরিচিত রোগ হতে পারে, সেটা বের করতে এই ম্যাপ কাজে লাগানো যায়। কাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কোন রোগের সম্ভাবনা বেশি, তা আগে থেকে আঁচ করে তার প্রতিকারের রাস্তা করে দিতে পারে। যেমন- ধরা যাক, দেশের কোন কোন মহিলার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি তা আঙ্গুলের এক ছোঁয়াতেই জানা যাবে এই ডেটাবেস থেকে। DNA ম্যাপিং এর জন্য বায়োইনফরমেটিক্স প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

ন্যানো টেকনোলেজি (Nanotechnology)

১০-৯ মিটার (এক মিটারের একশত কোটি ভাগের এক ভাগ) কে ন্যানোমিটার বলে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার আকৃতির কোনো কিছু তৈরি করা এবং ব্যবহার করাকে ন্যানোপ্রযুক্তি বলে। এই আকৃতির কোনো কিছু তৈরি করা হলে, তাকে সাধারণভাবে ন্যানোপার্টিকেল বলে। আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফেম্যানকে ন্যানো টেকনোলজির জনক বলা হয়। ন্যানোপ্রযুক্তি দু'টি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। যথা-

  • ক) ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ (Bottom Up): এ পদ্ধতিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণবিক উপাদান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বড় কোনো জিনিস তৈরি করা হয় অর্থাৎ ন্যানো অবজেক্ট তৈরি করা হয় মলিকুলার কম্পোনেন্ট থেকে।
  • খ) বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র (Top Down): এ পদ্ধতিতে একটি বড় আকৃতির কিছু থেকে শুরু করে তাকে ভেঙ্গে ছোট করতে করতে কোনো বস্তুকে ক্ষুদ্রাকৃতির আকৃতিতে পরিণত করা হয়।

ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার :

  • কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারের ব্যবহার: প্রসেসরের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যানোমিটার স্কেলের সার্কিট। এসব সার্কিট তৈরি ও তা সুন্দরভাবে সংযোজনের জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। আধুনিক স্মার্টফোন (যেমন: Apple iPhone, Samsung Galaxy প্রভৃতি) এর উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম।
  • চিকিৎসাক্ষেত্রে: ন্যানো রোবট ব্যবহার করে বিভিন্ন অপারেশন যেমন-এনজিওপ্লাস্টি, সরাসরি রোগাক্রান্ত সেলে চিকিৎসা প্রদান করা যেমন- ন্যানোক্রায়োসার্জারি, ডায়াগনোসিস করা যেমন- এনজিওগ্রাম, কলোনোস্কোপি ইত্যাদি।
  • খাদ্যশিল্পে: খাদ্যজাত দ্রব্য প্যাকেজিং, খাদ্যের স্বাদ সংরক্ষণ ও গুণাগুণ রক্ষার্থে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • জ্বালানি ক্ষেত্রে: বিকল্প জ্বালানি যেমন- হাইড্রোজেন আয়ন থেকে ফুয়েল তৈরি, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌরকোষ তৈরিতে।
  • খেলাধুলায়: খেলাধুলার বিভিন্ন সামগ্রী যেমন-ক্রিকেট ও টেনিস বলের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য, ফুটবল বা গলফ বলের বাতাসের ভারসাম্য রক্ষার্থে।
  • প্রসাধন শিল্পে: প্রসাধনে জিঙ্ক অক্সাইডের ন্যানো পার্টিকেল যুক্ত হওয়ায় ত্বকে ক্যান্সার রোধ সম্ভব হয়েছে। সেই সাথে প্রসাধন সামগ্রী সানস্ক্রিন ও ময়েশ্চারাইজার তৈরির কাজে ব্যবহার্য রাসায়নিক পদার্থ তৈরির ক্ষেত্রে এবং অ্যান্টি-অ্যাজিং ক্রিম তৈরিতেও ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

জীন প্রকৌশল (Genetic Engineering)

জীন প্রকৌশল জৈব প্রযুক্তির একটি শাখা। একটি কোষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট জীন নিয়ে অন্য কোষে স্থাপন ও কর্মক্ষম করার ক্ষমতাকে জীন প্রকৌশল বলে। অন্যভাবে বলা যায়, নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য কোনো জীবের DNA-তে পরিবর্তন ঘটানোকে বলা হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং । জ্যাক উইলিয়ামসনকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনক বলা হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে DNA এর কাঙ্ক্ষিত অংশ ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষে, উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে, প্রাণী থেকে উদ্ভিদে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের জীবকে বলা হয়া GMO (Genetically modified organism) বা, GE (Genetically Engineered) বা, ট্রান্সজেনিক (Transgenic) ।

রিকমবিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তি (Recombinant DNA technology) : জীন প্রকৌশলগত যে টেকনোলজীর মাধ্যমে কোনো জীবের DNA তে কাঙ্ক্ষিত গাঠনিক পরিবর্তন আনা যায় (অর্থাৎ বিকমিনেন্ট DNA তৈরি করা হয়), তাকে রিকমবিনেন্ট DNA টেকনোলজী বলে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রোথ হরমোন, ইনসুলিন প্রভৃতি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। রিকমবিনেন্ট DNA টেকনোলজী অণুজীবের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। অণুজীবসমূহের মধ্যে E Coli, Agrobacterium tumefaciens প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়া ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যাকটেরিয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের কোষে মূল ক্রোমোজোম ছাড়াও তুলনামূলক ছোট। বৃত্তাকার DNA অণু থাকে। একে বলা হয় প্লাসমিড (Plasmid)। প্লাসমিডের মাধ্যমে নতুন জিন এর সন্নিবেশন এবং সন্নিবেশিত জিনকে অন্যজীবে স্থানান্তর করা যায়।

রিকমবিনেন্ট DNA প্রস্তুতি :

  1. কাঙ্ক্ষিত DNA নির্বাচন ও পৃথকীকরণ করা হয়।
  2. একটি উত্তম বাহক (যেমন- Agrobacterium tumefaciens) নির্বাচন করা হয়।
  3. সুনির্দিষ্ট রেস্ট্রিকশন এনজাইম প্রয়োগ করে কাঙ্ক্ষিত DNA এর নির্দিষ্ট অংশ খণ্ড করা হয়। খড়িত করার এ প্রক্রিয়াকে Electrophoresis বলা হয়। একই এনজাইম প্রয়োগ করে বাহক। DNA হতেও অনুরূপ খণ্ড বের করে নেওয়া হয়।
  4. ছেদনকৃত কাঙ্ক্ষিত DNA খণ্ডকে বাহক প্লাসমিড DNA তে স্থাপন করা হয়। কাঙ্কিত DNA খণ্ড প্লাসমিড DNA তে সংযুক্ত হবার ফলে রিকমবিনেন্ট DNA তৈরি হয়।
  5. পোষক নির্বাচন করে রিকমবিনেন্ট প্লাসমিড DNA পোষক দেহে প্রবেশ করানো হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উচ্চ ফলনশীল শস্য উৎপাদন, হরমোন (যেমন- ইনসুলিন) তৈরি, রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

ক্রায়োসার্জারি (Cryosurgery)

ক্রায়োসার্জারি হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে অত্যধিক শীতল তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত রোগাক্রান্ত টিস্যু/ত্বক কোষ ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির চিকিৎসায় প্রথমে সিম্যুলেটেড সফটওয়্যার দ্বারা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোর অবস্থান ও সীমানা নির্ধারণ করা হয়। আক্রান্ত কোষকে সুনির্দিষ্ট বা নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করার জন্য আল্ট্রা সাউন্ড বা MRI যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর ফলে আশেপাশে থাকা সুস্থ কোষগুলোর কোনো ক্ষতি হয় না। রোগাক্রান্ত কোষটিতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূচযুক্ত ক্রায়োপ্রোব (এক ধরনের পেন্সিলের মতো যন্ত্র) প্রবেশ করিয়ে নির্ধারিত ক্রায়োজেনিক গ্যাস প্রয়োগ করা হয়। তাপমাত্রা অত্যধিক হ্রাস পেয়ে -৪১° থেকে -১৯৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে আসার কারণে নির্বাচিত টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঐ নিম্ন তাপমাত্রায় রক্ত ও অক্সিজেন সঞ্চালন সম্ভব না হওয়ার দরুণ রোগাক্রান্ত টিউমার টিস্যুর ক্ষতিসাধন হয়। ক্রায়োসার্জারিতে টিউমারের ধরন অনুযায়ী এবং নির্দিষ্ট শীতলতায় পৌছানোর জন্য তরল নাইট্রোজেন, আর্গন, অক্সিজেন বা কার্বন-ডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এই তরল গ্যাসগুলো ক্রায়োজেনিক এজেন্ট নামে পরিচিত। এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে শরীরের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, লিভার ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, লাং ক্যান্সার, ওরাল ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা করা হয়।

আইসিটিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা

  • উৎপাদন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে Program Logic Controller (PLC) ব্যবহার করলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। আজকাল হাতের স্পর্শ ছাড়াই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি Computer Aided Manufacturing (CAM) এর মাধ্যমে কলকারখানায় পণ্যোৎপাদন চলছে। যার দরুন সময়ের অপচয় রোধসহ কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে গেছে।
  • আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের যন্ত্র, পণ্য দ্রব্য ডিজাইনিং, ড্রাফটিং, সিম্যুলেশন করার জন্য বিশেষায়িত সফটওয়‍্যার যেমন- CAD (Computer Aided Design) ইত্যাদির মাধ্যমে নিখুঁতভাবে নকশা প্রণয়ন করা হয়।
  • ব্যয়বহুল শিল্প ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম, গ্রন্থাগারের বই, গবাদি পশু, যানবাহন প্রভৃতি ট্র্যাকিংয়ের জন্য RFID (Radio-frequency identification) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। RFID প্রযুক্তিতে তাড়িতচৌম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো বস্তুতে সংযুক্ত ট্যাগকে চিহ্নিত বা ট্যাগটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। ট্যাগ (চিপ) এ ডিজিটাল ডেটা কোড করা থাকে। চিপগুলি রেডিও সংকেত প্রেরণ করে। RFID রিডার নামের একটি বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করে সহজেই ট্যাগের অবস্থান সনাক্ত করা যায়।
  • IoT (Internet of Things) হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স, সফটওয়্যার, সেন্সর, নেটওয়ার্ক সংযোগের সাথে সংযুক্ত ফিজিক্যাল ডিভাইস যা পরিবহন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অ্যাকচুয়েটর এবং অন্যান্য ডিজিটাল আইটেম নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত এবং তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম। ফলে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বিল্ডিং, হোম অটোমেশন, অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা, ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, চিকিৎসা, এনার্জি ইত্যাদি সেক্টরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ এবং তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন- একটি স্মার্ট রিস্ট ব্যান্ড পালস রেট, হার্ট বিট, স্ট্রেস লেভেল, কত সময় হাঁটাহাঁটি করা হলো এবং শারীরিক ওজন মাপার কাজ দ্রুত ও বিশ্বস্ততার সাথে করতে পারে। কেভিন অ্যাশটনকে IoT এর জনক বলা হয়।
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (Forth industrial revolution) হল তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর নির্ভর ডিজিটাল শিল্পবিপ্লব। এর ফলে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (CPS), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), স্বয়ংক্রিয় যানবাহন (Autonomous Vehicles), ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ (3-D printing), রোবোটিক্স (Robotics), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence), ন্যানোপ্রযুক্তি (Nanotechnology), জৈব প্রযুক্তি (Biotechnology), ক্লাউড কম্পিউটিং, কগনিটিভ কম্পিউটিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কম্পিউটারের সাহায্যে একটি ঘটনা বা পরিবেশের বাস্তবভিত্তিক ত্রিমাত্রিক। চিত্রায়ণ করা হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরিকৃত এমন এক ধরনের কৃত্রিম পরিবেশ যা উপস্থাপন করা হলে ব্যবহারকারীদের কাছে এটিকে বাস্তব পরিবেশ মনে হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশ তৈরির জন্য শক্তিশালী কম্পিউটারে সংবেদনশীল গ্রাফিক্স ব্যবহার করতে হয়। সাধারণ গ্রাফিক্স এবং ভার্চুয়াল গ্রাফিক্সের মধ্যে পার্থক্য হলো এখানে শব্দ এবং স্পর্শকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যবহারকারীরা যা দেখে এবং স্পর্শ করে তা বাস্তবের কাছাকাছি বোঝানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি চশমা বা হেলমেট (HMD Head Mountained Display) ছাড়াও হ্যান্ড গ্লাভস (ডেটা গ্লাভস), বুট, স্যুট ব্যবহার করা হয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটারে সংবেদনশীল। গ্রাফিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে দূর থেকে পরিচালনা করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। একে টেলিপ্রেজেন্স বলা হয়। এ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে Vizard, VRToolKit, 3d Studio Max, Maya ইত্যাদি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।

প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রভাব :

  • বিনোদন ক্ষেত্রে: ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নির্ভর কল্পকাহিনি, কার্টুন, ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ইত্যাদি মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (Augmented Reality) নামে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একটি নতুন রূপ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে, যেখানে বাস্তব জগতের সাথে ভার্চুয়াল জগতের এক ধরনের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়।
  • যানবাহন চালানো ও প্রশিক্ষণে : ফ্লাইট সিমুলেটরের মাধ্যমে বৈমানিকরা বাস্তবে আসল বিমান উড্ডয়নের পূর্বেই বিমান পরিচালনার বাস্তব জগৎকে অনুধাবন করে থাকেন। এ ছাড়াও মোটরগাড়ি, জাহাজ ইত্যাদি চালানোর প্রশিক্ষণে সংশ্লিষ্ট সিমুলেটর ও মডেলিং সফটওয়‍্যারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ- সংশ্লিষ্ট কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বাস্তবের ন্যায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে।
  • সামরিক প্রশিক্ষণে: ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে সত্যিকার যুদ্ধক্ষেত্রের আবহ তৈরি করে সৈনিকদেরকে উন্নত ও নিখুঁত প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়।
  • শিক্ষা ও গবেষণায়: বাস্তবে কোনো কাজ করার আগে কম্পিউটারে কৃত্রিমভাবে প্রয়োগ করে দেখাকে সিমুলেশান বলা হয়। জটিল অণুর আণবিক গঠন, ডিএনএ গঠন যা কোনো অবস্থাতেই বাস্তবে অবলোকন সম্ভব নয় সেগুলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পরিবেশে সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখা সম্ভব হচ্ছে।
  • চিকিৎসা ক্ষেত্রে: জটিল অপারেশন, কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন, ডিএনএ পর্যালোচনা ইত্যাদিসহ নবীন শল্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও রোগ নির্ণয়ে ব্যাপক হারে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হয়।
নবীনতর পূর্বতন