স্নায়ুতন্ত্র | Nervous System

বহুকোষী জীবের দেহে টিস্যু, অঙ্গ ও তন্ত্র ইত্যাদির ভিন্ন ভিন্ন গঠন পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে অগণিত কোষের বিচিত্র কর্মকান্ড। এই কর্মকান্ডের সাথে যোগসূত্র রচনা করা এবং পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য জীবদেহে দ্রুত যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। যেমন- কারো দুঃখে তোমার কান্না পায়, কারো খুশিতে তুমি খুশি হও, পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তোমার আনন্দ হয়। এই কাজগুলো ঘটে বিভিন্ন উদ্দীপকের কার্যকারিতার ফলে। দেহের বিভিন্ন অংশের উদ্দীপনা বহন করা, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের সমন্বয় সাধন করা ও পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রাখা স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান কাজ। প্রাণিদেহের যে তন্ত্র দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সংযোগ রক্ষা করে, বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলীর সমন্বয় সাধন করে এবং উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে উপযুক্ত প্রতিবেদন সৃষ্টি করার মাধ্যমে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে তাকে স্নায়ুতন্ত্র বলে। স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান অংশ হলো মস্তিষ্ক। উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পরিগণিত হয়। মস্তিষ্ক অসংখ্য বিশেষ কোষ দ্বারা গঠিত। এরা নিউরন বা স্নায়ুকোষ নামে পরিচিত। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে। স্নায়ু কোষের এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ক্ষয় পেতে থাকে ।

 স্নায়ুতন্ত্র

স্নায়ুকোষ বা নিউরন

স্নায়ুকোষ বা নিউরন

নারভাস সিস্টেমের স্ট্রাকচারাল এবং ফাংশনাল ইউনিটকে নিউরন বলে অথবা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও কার্যকরী একককে স্নায়ুকোষ বা নিউরন বলে। নিউরন মানবদেহের দীর্ঘতম কোষ। নিউরন দুইটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। যথা- ১. কোষদেহ এবং ২. প্রলম্বিত অংশ।

১. কোষদেহ: কোষদেহ নিউরনের প্রধান অংশ। কোষদেহ বিভিন্ন আকৃতির হয় যেমন- গোলাকার, ডিম্বাকার বা নক্ষত্রাকার। কোষদেহ কোষ আবরণী, সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস দ্বারা গঠিত। এই কোষে সেন্ট্রিওল থাকে না। তাই এরা অন্যান্য কোষের মতো বিভাজিত হয় না।

২. প্রলম্বিত অংশ: কোষদেহ থেকে উৎপন্ন শাখা-প্রশাখাকে প্রলম্বিত অংশ বলে। প্রলম্বিত অংশ দুই প্রকার। যথা- ক) অ্যাক্সন এবং খ) ডেনড্রন।

ক) অ্যাক্সন: কোষদেহ থেকে উৎপন্ন লম্বা সুতার মতো অংশকে অ্যাক্সন বলে। অ্যাক্সনের যে প্রান্তে কোষদেহ থাকে তার বিপরীত প্রান্ত থেকে শাখা বের হয়। সাধারণত একটি নিউরনে একটি মাত্র অ্যাক্সন থাকে।

খ) ডেনড্রন: কোষদেহের চারদিক থেকে উৎপন্ন শাখাগুলোকে ডেনড্রন বলে। এগুলো বেশি লম্বা হয় না। ডেনড্রন থেকে সৃষ্ট শাখাগুলোকে ডেনড্রাইট বলে। এদের দ্বারা স্নায়ুতাড়না নিউরনের দেহের দিকে পরিবাহিত হয়। একটি স্নায়ুকোষের অ্যাক্সন অন্য একটি স্নায়ুকোষের ডেনড্রাইটের সাথে মিলিত হওয়ার স্থানকে সিন্যাপস বলে। সিন্যাপসের মাধ্যমেই স্নায়ুতাড়না এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে পরিবাহিত হয়। উদ্দীপনা বহন করা, প্রাণিদেহের ভিতরের ও বাইরের পরিবেশের সাথে সংযোগ রক্ষা করা, প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে কাজের সমন্বয় সাধন করা, মস্তিষ্কে স্মৃতিধারণ করা, চিন্তা করা ও বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দেওয়া ও পরিচালনা করা নিউরনের কাজ।

স্নায়ুতন্ত্রের শ্রেণীবিন্যাস

স্নায়ুতন্ত্রের শ্রেণীবিন্যাস

সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র । কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয় যেমন- মস্তিষ্ক (brain) ও সুষুম্না কাণ্ড (spinal cord) । প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ও আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা- ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র । ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্রকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা- করোটিক স্নায়ু ও সুষমা স্নায়ু । যা উপরের চিত্রে দেখানো হয়েছে ।

কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র

কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অংশ হলো মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জু বা সুষুম্না কাণ্ড । মস্তিষ্ক হলো সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রের চালক। মানুষের মস্তিষ্ক করোটির মধ্যে সুরক্ষিত। মস্তিষ্ক মেনিনজেস নামক পর্দা দ্বারা আবৃত। মানুষের মস্তিষ্কের ওজন ১.৩৬ কেজি এবং আয়তন ১৫০০ সিঃসিঃ । মানুষের মস্তিষ্কের প্রধান অংশ তিনটি। যথা- (ক) গুরুমস্তিষ্ক (খ) মধ্যমস্তিষ্ক (গ) পশ্চাৎ বা লঘুমস্তিষ্ক।

(ক) গুরুমস্তিষ্ক : মস্তিষ্কের প্রধান অংশ হলো গুরুমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম। এটা ডান ও বাম খণ্ডে বিভক্ত। এদের ডান ও বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার বলে। মানব মস্তিষ্কে সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার অধিকতর উন্নত ও সুগঠিত। এই দুইখণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে স্নায়ুতন্তু দ্বারা সংযুক্ত। এর উপরিভাগ ঢেউ তোলা ও ধূসর বর্ণের। দেখতে ধূসর বর্ণের হওয়ায় একে ধূসর পদার্থ বা গ্রে ম্যাটার বলে। গুরুমস্তিষ্কের অন্তঃস্তরে কেবলমাত্র স্নায়ুতন্তু থাকে। স্নায়ুতন্তুর রং সাদা। তাই মস্তিষ্কের ভিতরের স্তরের নাম শ্বেত পদার্থ বা হোয়াইট ম্যাটার। শ্বেত পদার্থের ভিতর দিয়ে স্নায়ুতন্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। ধূসর পদার্থের কয়েকটি স্তরে বিশেষ আকারে স্নায়ুকোষ দেখা যায়। এই স্নায়ুকোষগুলো গুরুমস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে গুচ্ছ বেঁধে স্নায়ুকেন্দ্র সৃষ্টি করে। এগুলো বিশেষ বিশেষ কর্মকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, চিন্তা-চেতনা, স্মৃতি, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও পেশি চালনার ক্রিয়াকেন্দ্র গুরুমস্তিষ্কে অবস্থিত।

মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশের নাম সেরিব্রাম (মস্তিষ্কের ওজনের ৮০%) । সেরিব্রামের কাজ হলো স্মৃতি, মেধা ও যুক্তি প্রকাশের প্রধান কেন্দ্র এবং ঐচ্ছিক কাজ নিয়ন্ত্রণ । সেরিব্রামের নিচের অংশ হলো- থ্যালামাস ও হাইপোথ্যালামাস। এগুলো ধূসর পদার্থের পুঞ্জ। ক্রোধ, লজ্জা, গরম, শীত, নিদ্রা, তাপ সংরক্ষণ ও চলন এই অংশের কাজ।

(খ) মধ্যমস্তিষ্ক : গুরুমস্তিষ্ক ও পনস-এর মাঝখানে মধ্যমস্তিষ্ক অবস্থিত। মধ্যমস্তিষ্ক দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির সাথেও সম্পর্কযুক্ত।

(গ) পশ্চাৎ বা লঘুমস্তিষ্ক : লঘুমস্তিষ্ক গুরুমস্তিষ্কের নিচে ও পশ্চাতে অবস্থিত। এটা গুরুমস্তিষ্কের চেয়ে আকারে ছোট। দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা পশ্চাৎ বা লঘুমস্তিষ্কের প্রধান কাজ। এছাড়া লঘুমস্তিষ্ক কথা বলা ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে। এর তিনটি অংশ-

সেরিবেলাম: পনসের বিপরীতদিকে অবস্থিত খন্ডাংশটি হলো সেরিবেলাম। এটা অনেকটা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। সেরিবেলাম ডান ও বাম দু'অংশে বিভক্ত। সেরিবেলামের কাজ হলো দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা ও দেহের ঐচ্ছিক কাজের সমন্বয় সাধন করা ।

পনস: পনস লঘুমস্তিষ্কের সামনে ও নিচে অবস্থিত। একে মস্তিষ্কের যোজক বলা হয়। এটা গুরুমস্তিষ্ক, লঘুমস্তিষ্ক ও মধ্যমস্তিষ্ককে সুষুম্নাশীর্ষকের সাথে সংযোজিত করে।

মেডুলা বা সুষুম্নাশীর্ষক : এটা মস্তিষ্কের নিচের অংশ। সুষুম্নাশীর্ষক পনসের নিম্নভাগ থেকে মেরুরজ্জুর উপরিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ এটা মস্তিষ্ককে মেরুরজ্জুর সাথে সংযোজিত করে। এ জন্য সুষুম্নাশীর্ষককে মস্তিষ্কের বোঁটা বলা হয়। মস্তিষ্কের এ অংশ হৃৎস্পন্দন, খাদ্যগ্রহণ ও শ্বসন ইত্যাদি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।

মেরুরজ্জু বা সুষুম্নাকাণ্ড : মেরুরজ্জু করোটির পিছনে অবস্থিত ফোরামেন ম্যাগনাম (Foramen magnum) নামক ছিদ্র থেকে কটিদেশের কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত। মেরুরজ্জু বা সুষুম্নাকাণ্ড মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতরের ছিদ্রপথে সুরক্ষিত থাকে। মেরুরজ্জুতে শ্বেত পদার্থ এবং ধূসর পদার্থ থাকে। তবে এদের অবস্থান মস্তিক্ষের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ শ্বেত পদার্থ থাকে বাইরে আর ভিতরে থাকে ধূসর পদার্থ। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে মেরুরজ্জু থেকে 31 জোড়া মেরুরজ্জীয় স্নায়ু (Spinal nerves) বের হয়। এসব ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের স্নায়ু। এসব স্নায়ু মিশ্র প্রকৃতির। এটা প্রায় ৪৫ সেমি ( ১৭.৭২ ইঞ্চি) প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে দীর্ঘ এবং প্রায় ৪৩ সেমি ( ১৬.৯৩ ইঞ্চি) প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে দীর্ঘ। মেরুদন্ডের কর্ডের ব্যাস থেকে ১৩ মিমি (১/২ ইঞ্চি) সার্ভিকাল এবং কটিদেশীয় অঞ্চলে থেকে ৬.৪ মিমি (১/৪ ইঞ্চি) বক্ষঃ অঞ্চলে। সুষমাকাণ্ডের ওজন ৩০ গ্রাম।

প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র

মস্তিষ্ক থেকে 12 জোড়া এবং মেরুমজ্জা বা সুষুম্নাকান্ড থেকে 31 জোড়া স্নায়ু বের হয়ে আসে এবং সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শাখায় বিভক্ত হয়ে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোকে একত্রে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র বলে। মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন করোটিক স্নায়ু চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, দাঁত, মুখমণ্ডল, হৃৎপিন্ড, পাকস্থলী প্রভৃতি অঙ্গের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। মেরুরজ্জু থেকে উদ্ভুত স্নায়ুগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালনা করে এবং দেহের বাকি অংশ থেকে যাবতীয় অনুভূতি মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়। এর মূল কাজ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যোগসূত্র স্থাপন করা, যা মূলত মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডের সাথে শরীরের বাকি অংশের যোগাযোগ স্থাপনকে নির্দেশ করে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের মূল পার্থক্যটি হচ্ছে এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের মতো কশেরুকার হাড় বা খুলি বা ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার দ্বারা সুরক্ষিত নয়, যার ফলে এটি প্রতিবিষ ও দুর্ঘটনার মতো সমস্যা থেকে ততোটা ঝুঁকিমুক্ত নয়।

প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত — সোম্যাটিক বা ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র। সোম্যাটিক স্নায়ুতন্ত্র ঐচ্ছিক নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত এবং এটি মস্তিষ্ক থেকে শেষ প্রান্তের কোনো অঙ্গের (যেমন: পেশী) সাথে সিগনাল আদান-প্রদান করে। সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্রও সোম্যাটিক স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশ কারণ এটি স্বাদ ও স্পর্শের (হালকা ও ভারীসহ সকল প্রকার স্পর্শ) মতো বিভিন্ন অনুভূতি মেরুরজ্জু ও মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়।

সোম্যাটিক স্নায়ুতন্ত্র দুটি অংশ নিয়ে গঠিত:

  • সুষুমা স্নায়ু : এগুলো হচ্ছে প্রান্তীয় স্নায়ু তা সংবেদনশীলতার তথ্য (সেনসরি ইনফরমেশন) সুষুম্নাকাণ্ডের দিকে ও মোটর নির্দেশনা সুষুম্নাকাণ্ড থেকে বাইরের দিকে বহন করে। মানুষের সুষমা স্নায়ু ৩১ জোড়া।
  • করোটিকা স্নায়ু : এগুলো হচ্ছে সেই স্নায়ুতন্তু যা ব্রেইনস্টেমের থেকে ও শরীরের অন্যন্য অংশ থেকে ব্রেইনস্টেমের দিকে তথ্য পরিবহন করে। বহনকৃত তথ্য বা অনুভূতির গন্ধ, দৃষ্টি, চোখ, চোখের পেশী, মুখ, স্বাদ, কান, ঘাড়, কাঁধ এবং জিহ্বা অন্তর্ভুক্ত। মানুষের করোটিক স্নায়ু ১২ জোড়া।

স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র : যেসব অঙ্গের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলো স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। দেহের ভিতরের অঙ্গগুলো, যেমন: হৃৎপিণ্ড, অন্ত্র, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদির কাজ স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব তন্ত্রের কার্যকারিতার উপর মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জুর প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকায় এরা অনেকটা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে আপন কর্তব্য সম্পাদন করে।

হাইপোথ্যালামাসের কাজ:

অগ্রমস্তিষ্কের প্রধান অংশের একটি হচ্ছে হাইপোথ্যালামাস। এটি থ্যালামাসের ঠিক নিচে অবস্থিত এবং গ্রে ম্যাটার নির্মিত। এটি এটি সূক্ষ্ম অংশের সাহায্যে পিটুইটারি গ্রন্থির সাথে সংযুক্ত। এর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোঃ

  • দেহে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা
  • স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে কাজ করা
  • ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘাম, ঘুম, রাগ, পীড়ন, ভালো লাগা, ঘৃণা, উদ্বেগ প্রভৃতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা।
  • অটিজম: স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যার একটি বিস্তৃত রূপকে অটিজম বলে।
  • ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু - সর্বাপেক্ষা বৃহৎ স্নায়ু।
  • ভেগাস স্নায়ু - সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত ও ক্ষুধার্ত স্নায়ু।
  • ফেসিয়াল স্নায়ু – স্বাদ গ্রহণকারী স্নায়ু।
  • অলফ্যাক্টরী স্নায়ু - ঘ্রাণ গ্রহণকারী স্নায়ু।
  • অডিটরী স্নায়ু - শ্রবণ ও ভারসাম্য রক্ষাকারী স্নায়ু।

স্নায়ুতন্ত্রের রোগ

স্ট্রোক: স্ট্রোক হল মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালনের ত্রুটি জনিত একটি রোগ। মস্তিস্কের ধমনী ছিড়ে যাওয়া বা রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া হল স্ট্রোক। স্ট্রোক রোগটি মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কিত। স্ট্রোকের কারণ দুটি, যথা: মস্তিষ্কের ধমনী ছিড়ে রক্তপাত হওয়া এবং রক্ত প্রবাহজনিত বাধা। স্ট্রোক হলে রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন রোগীর দেহের এক পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে, বা কোন অঙ্গহানী হতে পারে। স্ট্রোকের কারণে তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।

স্ট্রোকের কারণ: স্ট্রোকের কারণ দুইটি। যথাঃ

  • মস্তিষ্কের ধমনী ছিড়ে রক্তপাত হওয়া
  • মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহজনিত বাধা।

কি কি কারণে স্ট্রোক হতে পারে:

  • হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ
  • রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে
  • ধূমপানের কারণে
  • ডায়াবেটিস থাকলে
  • অ্যালকোহল পান করলে
  • বংশগত কারণে
  • মানসিক চাপে

স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর উপায় কি?

  • অধিক চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা
  • অ্যালকোহল পান না করা
  • ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণ করা
  • শারীরিক পরিশ্রম করা
  • দুশ্চিন্তা না করা
  • ধূমপান না করা
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা

স্ট্রোকের উপসর্গ/লক্ষণসমূহ:

  • রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন রোগীর দেহের একপাশ পক্ষাঘাতগ্রন্থ (Paralysis) হয়ে যায়।
  • এ রোগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
  • চোখে ঝাপসা দেখা ও কথা বলতে সমস্যা অনুভব করা
  • হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্নতা হওয়া বা চলতে ফিরতে সমস্যা অনুভব করা

প্যারালাইসিস (Paralysis) : শরীরের কোনো অংশের ঐচ্ছিক মাংসপেশি ইচ্ছামতো নাড়াতে পারার ক্ষমতা নষ্ট হওয়াকে প্যারালাইসিস বলে। সাধারণত মস্তিষ্কের কোনো অংশের ক্ষতির কারণে ঐ অংশের সংবেদন গ্রহণকারী পেশিগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। একজনের আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ প্যারালাইসিস হতে পারে, ফলে শরীরের একপাশে কোনো অঙ্গ অথবা উভয় পাশের অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হয়, যেমন, দুই হাত ও পায়ের প্যারালাইসিস।

কারণ: প্যারালাইসিস সাধারণত স্ট্রোকের কারণে হয়। এছাড়া মেরুদণ্ডের বা ঘাড়ের সুষুম্নাকাণ্ড আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্যারালাইসিস হতে পারে। স্নায়ু রোগ, সুষুম্নাকাণ্ডের কিংবা কশেরুকার ক্ষয় রোগও প্যারালাইসিসের কারণ হতে পারে।

এপিলেপসি (Epilepsy) : এপিলেপসি মস্তিষ্কের একটি রোগ, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খিঁচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই রোগকে মৃগী রোগও বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিঁচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আগুন বা পানির সাথে এপিলেন্সির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু রোগাক্রান্ত অবস্থায় কোথাও পড়ে গেলে রোগী নিজ শক্তিতে উঠতে পারে না। এই কারণে এসব রোগীকে জলাশয় বা আগুন কিংবা অন্যান্য বিপজ্জনক বস্তু বা স্থান থেকে দূরে রাখতে হয়।

এপিলেপসির মূল কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের মৃগী রোগ দেখা দেয়। মাথায় আঘাতের কারণে ম্যানিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস, জন্মগত মস্তিষ্কের বিকৃতি, টিউমার ইত্যাদি কারণেও এপিলেপসির উপসর্গ দেখা দেয়। এপিলেপসি যেকোনো বয়সে হতে পারে। কোনো কোনো এপিলেপসির কোনো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নেই, আবার কোনোটা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এপিলেপসির ধরন নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

পারকিনসন রোগ (Parkinson's disease) : পারকিনসন রোগ মস্তিষ্কের এমন এক অবস্থা, যেখানে হাতে ও পায়ের কাঁপুনি হয় এবং আক্রান্ত রোগীর নড়াচড়া, হাঁটাহাঁটি করতে সমস্যা হয়। এ রোগ সাধারণত 50 বছর বয়সের পরে হয়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে যুবক-যুবতীদেরও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগটি তার বংশে রয়েছে বলে ধরা হয়।

স্নায়ুকোষ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে থাকে, যার একটি হলো ডোপামিন। ডোপামিন শরীরের পেশির নড়াচড়ায় সাহায্য করে। পারকিনসন রোগাক্রান্ত রোগীর মস্তিক্ষে ডোপামিন তৈরির কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডোপামিন ছাড়া ঐ স্নায়ু কোষগুলো পেশি কোষগুলোতে সংবেদন পাঠাতে পারে না। ফলে মাংসপেশি তার কার্যকারিতা হারায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারকিনসনের কারণে রোগীর মাংসপেশি আরও অকার্যকর হয়ে উঠে, ফলে রোগীর চলাফেরা, লেখালেখি ইত্যাদি কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

পারকিনসন রোগ সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকট রূপে দেখা দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগী হালকা হাত বা পা কাঁপা অবস্থায় থাকে। ফলে চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। এছাড়াও চোখের পাতার কাঁপুনি, কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া, সোজাসুজি হাঁটার সমস্যা, কথা বলার সময় মুখের বাচনভঙ্গি না আসা অর্থাৎ মুখ অনড় থাকা মাংসপেশিতে টান পড়া বা ব্যথা হওয়া, নড়াচড়ায় কষ্ট হওয়া, যেমন চেয়ার থেকে উঠা কিংবা হাঁটতে শুরু করার সময় অসুবিধে হওয়া- এই ধরনের নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি গ্রহণ, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করার মাধ্যমে রোগী অনেকটা সুস্থ থাকে।

নবীনতর পূর্বতন