প্রাকৃতিক দূর্যোগ | Natural disaster

কোন প্রাকৃতিক/ মানবসৃষ্ট অবস্থা যখন অস্বাভাবিক, অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাকে দুর্যোগ বলে। দুর্যোগ দুই প্রকারের হতে পারে, যেমনঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিকভাবে যে দুর্যোগ সৃষ্টি হয় এবং যাতে মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না তাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural disaster) বলে । প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যাপকভাবে জীবন ও সম্পদহানি ঘটায়। যেমনঃ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় (সাইক্লোন), কালবৈশাখী ঝড়, জলোচ্ছাস, টর্নোডো, খরা, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, নদীভাঙ্গন, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, শৈত্য প্রবাহ ইত্যাদি । মানুষের অবহেলা, ভুল-ভ্রান্তি বা অভিপ্রায়ে যে দুর্যোগ হয় তাকে মানব-সৃষ্ট দুর্যোগ (man-mad disaster) বলে । । যেমনঃ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, রাসায়নিক বা আণবিক বিস্ফোরণ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, পরিবেশ দূষণ (বায়ু দূষণ, পানি দূষণ প্রভৃতি), অগ্নিকান্ড, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি।

বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ

অধিকাংশ দুর্যোগ আকস্মিক এবং অনাকাংখিতভাবে সংঘটিত হয় যার ফলশ্রুতিতে জীবনযাত্রা ও আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগুলো বহুমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর ক্ষেত্রে এ কথা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবেশ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে সাধারণতঃ বন্যা, সাইক্লোন, কালবৈশাখী, টর্নেডো, খরা ও ভূমিকম্পের প্রকোপ সবচেয়ে বেশী।

এইসব প্রাকৃতিক দূর্যোগে মানুষের বাসগৃহ, ফসল, গবাদিপশু, যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ, পানি ও খাদ্যসরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মক ধ্বংসলীলার শিকার হতে পারে।

সর্বোপরি উপদ্রুত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের উপর নেমে আসে তাৎক্ষণিক ও সদূর প্রসারী দুর্দশা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আঘাতে বা জখমে আহত হওয়া (Injuries), মৃত্যু (Death), রোগব্যধির বিস্তৃতি (Diseases) ও পঙ্গুত্ব (Disability)।

যারা কোন রকম দুর্যোগের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পান তাদের মধ্যে দেখা দেয় মানসিক যন্ত্রণা-স্বজন হারানোর শোক, বাড়িঘর-সম্বল হারানোর বেদন (Disaster Syndrome)। আহত বা রোগাক্রান্ত স্বজনদের নিয়ে দুশ্চিন্তা, খাদ্য, পানি, নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের সংকট।

প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে বন্যা বাংলাদেশে বাৎসরিক একটি দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া দেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলো (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা) সামুদ্রিক জলোচ্ছাস ও সাইক্লোনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দেশের অন্যান্য স্থান বন্যা ছাড়াও মৌসুমী ঝড়, টর্নোডো ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। নিকট অতীতের ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডোর (১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০) আঘাত বার বার আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করেছে এবং জানমালের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করেছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে 'আইলা' এবং পরবর্তীতে 'মহাসেন' নামক ঝড়ের নিষ্ঠুর, সর্বনাশী রূপ দেখে আমাদের দেশের জনগণ। শুধু সিডরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ১০,৫৯৯ কোটি টাকা। শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিক থেকে বিবেচনা করলেও বোঝা যায় যে, এইসব প্রাকৃতিক দূর্যোগ জনস্বাস্থ্যকে কতোটা বিপর্যস্ত করতে পারে। বন্যাজনিত কারণে আমাদের দেশে সাধারণতঃ পানিবাহিত রোগ (ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস), চর্মরোগ, এআরআই, হাম, চোখ ওঠা, ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ ছাড়া বন্যার সময় পানিতে ডোবা ও সাপে কাটার ঘটনাও বৃদ্ধি পায়। টর্নোডো সাধারণতঃ স্থলভাগে খুবই প্রচন্ড বেগে আকস্মিকভাবে সংঘটিত হয় বলে এতে শারীরিক আঘাত, জখম, ক্ষত এবং সেগুলো থেকে অঙ্গহানি ও একসাথে অনেক লোকের মৃত্যুও হতে পারে। শারীরিক আঘাত, জখম, জ্বলোচ্ছাসে নিখোঁজ ও প্রাণহানি এবং পরবর্তীকালে পানি বাহিত রোগ ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

ঘূর্ণিঝড়/সাইক্লোন (Cyclone)

ঘূর্ণিঝড় হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার ঝড় বা উক্ত এলাকার বায়ুমন্ডলের একটি একটি উত্তাল অবস্থা যা বাতাসের প্রচন্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত হয়। এটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের একটি। পৃথিবীর ৩০º উত্তর এবং ৩০º দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ব্যতীত পৃথিবীর বাদবাকি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরাঞ্চল যে মারাত্মক বায়ুমন্ডলীয় দুর্যোগসমূহ জন্ম দিচ্ছে তা সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে গড়ে ৮০টি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়,এর মধ্যে কিছু ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে আবার কিছু ঘূর্ণিঝড় মহাসাগরে বিলীন হয়ে যায়। নিচে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত তথ্যসমুহ তুলে ধরা হল -

ঘূর্ণিঝড়
  • সাইক্লোন শব্দটি এসেছে- গ্রিক শব্দ Kyklos (কাইক্রোস) থেকে। এর অর্থ Coil of snake (সাপের কুন্ডলী)।
  • ১৮৪৮ সালে হেনরি পিডিংস তার 'সেইলস হর্ন বুক ফর ডিল অফ স্টর্মস' প্রথম সাইক্লোন শত্রুটি ব্যাখ্যা দেন ।
  • ঘূর্ণিঝড় হলো- উষ্ণ কেন্দ্রীয় লঘু চাপ। যার চারদিকে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রচন্ডভাবে ঘুরতে থাকে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাসার্ধ সাধারণত ৫০০-৬০০ কি.মি. পর্যন্ত হতে পারে।
  • নিম্নচাপ জনিত কারণে যখন বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধিপায় এবং ঘূর্ণনের আকারে বাতাস প্রবাহিত হয় তখন তাকে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় বলে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের বেগ বাতাসে ঘন্টায় ৬৩ কি.মি. বা তার বেশি হলে তাকে সাইক্লোন বলে।
  • হালকা বাতাস ও হালকা মেঘ দিয়ে গঠিত ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র 'অয়ন (Eye)' নামে পরিচিত।
  • সাইক্লোন সৃষ্টি হয়- গভীর সমুদ্রে। উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি আঘাত হানে।
  • সাধারণত সাইক্লোন তৈরি হতে সাগরের তাপমাত্রা -২৬/২৭°C এর বেশি হতে হয়।
  • বঙ্গোপসাগরে সারা বছরে তাপমাত্রা তাকে- ২৭°C এর বেশি।
  • ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ- সাইক্লোনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
  • স্মরণকালের সবচেয়ে প্রলয়কারী দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত ১৯৭০ সালের সাইক্লোনটি ( প্রাণহানি প্রায় ৩ লাখ )।
  • বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোন আঘাত হানে- ১৯৯১ সালে (এতে প্রায় ২ লক্ষ লোক মারা যায়)।
  • ১৯৯১ সালের সাইক্লোনে বাতাসের গতিবেগ ছিল- ২২৫ কি.মি.।
  • ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতার নাম- অপারেশন মান্না
  • ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশে আসা মার্কিন টাস্ক ফোর্সের নাম- অপারেশন সি এঞ্জেল
  • ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানো যায়- সিলভার আয়োডাইড (AGI) নামক রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত হয়)। ।
  • বাংলাদেশে সাধারণত ঝড় হয়- এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্য) এবং অক্টোবর-নভেম্বরের (কার্তিক-অগ্রহায়ন) প্রথম দিকে।
  • বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় হয়- মৌসুমি বায়ু প্রবাহের পূর্বে।
  • ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং মেক্সিকো উপসাগরে (আমেরিকায়) উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড়কে বলে- হ্যারিকেন।
  • বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সাইক্লোন আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে- ১৮৪১টি।
  • ক্যাটরিনা ২০০৫ সালে সংঘটিত একটি হ্যারিকেনের নাম। এ ঝড়ে যে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হয় তাতে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অরলিন্স শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায় ।
  • সিডরের আঘাতে ১০ সহস্রাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে। আক্রান্ত হয় ৩০টি জেলার ২০০টি উপজেলা।

প্রধান ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা:

  • আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় হয়।
  • পৃথিবীর বিষুব রেখা বরাবর সাগরে সাধারণত কোনো ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না। বিষুব রেখা থেকে উত্তর ও দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরেও কোনো ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় না।
  • করিওলিস শক্তি ন্যূনতম থাকায় নিরক্ষরেখার ০ থেকে ৫ ডিগ্রির মধ্যে কোন ঘূর্ণিঝড় হয় না।
  • নিরক্ষরেখার ১০ থেকে ৩০ ডিগ্রির মধ্যে বেশি ঘূর্ণিঝড় হয়।
  • উষ্ণ মন্ডলের যে সকল সাগর ৩০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ৩০ ডিগ্রি দক্ষিনে অবস্থিত অর্থাৎ যেসব সাগর ৩০ ডিগ্রি উত্তর ও ৩০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত সেসব সাগরেই বেশি ঘূর্ণিঝড় হয়।
  • নিরক্ষরেখা কাছাকাছি উষ্ণ ও শীতল বায়ুর বিপরীতমুখী প্রবাহ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়।
  • বাংলাদেশে উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চল বলে, এখানে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বেশি হয় এবং এই প্রকার সাইক্লোন খুব ক্ষতিকর।
  • কর্কট ও মকরক্রান্তি রেখার কাছাকাছি সমুদ্রগুলোতে গ্রীষ্মকালে বা গ্রীষ্মের শেষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।
  • বাংলাদেশের দক্ষিণে ফানেলকার আকৃতির কারণে অধিক অধিক সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়।

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রধান কারণ নিম্নচাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রা। বায়ুমন্ডলের নিম্ন ও মধ্যস্তর ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ বর্ষাকালে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে ঘূর্ণিঝড় হয়। ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত এলাকায় ৩ ধরনের প্রভাব দেখা যায় যথাঃ প্রবল বাতাস , বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস । বাংলাদেশ আশ্বিন কার্তিক ও চৈত্র বৈশাখ মাসে ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। ঘূর্ণিঝড় কয়েক মিনিট থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়গুলোর বায়ুপ্রবাহের গতিবেগের উপর ভিত্তি করে এর তীব্রতা বোঝাতে “সাফির সিম্পসন হারিকেন স্কেল” নামক একটি বিশেষ স্কেল সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। দুর্যোগ হলেও ঘূর্ণিঝড় পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে।

সাইক্লোন, হারিকেন ও টাইফুনের পার্থক্য : শুনতে তিনটি পৃথক ঝড়ের নাম মনে হলেও আসলে এগুলো অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়েরই ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণভাবে ঘূর্ণিঝড়কে সাইক্লোন বা ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ও ভারতীয় অঞ্চল তথা বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় 'সাইক্লোন' হিসেবে পরিচিত। সাইক্লোনের কারণে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতে প্রচুর জানমালের ক্ষতি হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চল, মধ্য এবং পূর্ব উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, এবং মেক্সিকো উপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়কে ' হারিকেন ' বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কিউবা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হারিকেন আঘাত করে। চীন সাগর, জাপান সাগর এবং উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় ' টাইফুন '। চীন, তাইওয়ান, ফিলিপাইন ও জাপানে প্রায় প্রতি বছরই টাইফুনের কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

বিভিন্ন অঞ্চলের সাইক্লোন এর বিভিন্ন নাম
অঞ্চল নাম
দক্ষিণ এশিয়ার তথা বাংলাদেশ ও ভারতীয় অঞ্চল সাইক্লোন
চীন সাগর, জাপান সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল টাইফুন। এটি আরবি 'তুফান' শব্দ থেকে আগত ।
ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে বাগুইড/বোগিও
অস্ট্রেলিয়া উইলি উইলি
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং আটলান্টিক মহাসাগর অঞ্চলে হ্যারিকেন। হ্যারিকেন শব্দটি এসেছে হুরাকান থেকে যার অর্থ জলের দেবতা বা মায়া দেবতা ।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জোয়ান
মঙ্গল গ্রহ গ্রেট রেড স্পট
নেপচুনে ডার্ক স্পট/ wirerd's eye
  • আটলান্টিক মহাসাগর এলাকায় তথা আমেরিকার আশেপাশের ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ যখন ঘণ্টায় ১১৭ কিলোমিটারের বেশি হয় তখন জনগণকে এর ভয়াবহতা বুঝাতে হারিকেন শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
  • মতান্তরে টাইফুন শব্দটির চিনার টাই-ফেং থেকে এসেছে যার অর্থ প্রচন্ড বাতাস।
  • বিশ্বের সংঘটিত মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় এর মধ্যে লেবার ডে (১৯৩৫), বিটা (১৯৭৮), আইভান (১৯৯৭), ডারমি (২০০০), ভামেই (২০০১), চার্লি (২০০৪), ক্যাটরিনা (২০০৫), ফেলেক্সি (২০০৭), মোরা (২০১৭), ইরমা (২০১৭), ইদাই (২০১৯) সালের উল্লেখযোগ্য।

ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘূর্ণিঝড়

  • সিডর : ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ' সিডর ' প্রায় ছয় হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিল । সিংহলি শব্দ ' সিডর ' এর বাংলা অর্থ চোখ । উত্তর ভারত মহাসাগরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার।
  • নার্গিস : ঘূর্ণিঝড় নার্গিস উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি ঘূর্ণিঝড়, যা ২০০৮ সালের মে ৩ তারিখে মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে। " নার্গিস" একটি উর্দু শব্দ। এটি এক ধরনের হলুদ রঙের ফুল। এটি ইংরেজিতে " ড্যাফোডিল" নামে পরিচিত।
  • রেশমী : ঘূর্ণিঝড় রেশমী ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর আঘাত হানে । এটি আরবি শব্দ । এর অর্থ কোমল ।
  • বিজলী : ঘূর্ণিঝড় বিজলী ২০০৯ সালের ১৯ এপ্রিল আঘাত হানে ।
  • আইলা : ঘূর্ণিঝড় আইলা হলো ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টি জন্ম নেয় ২১ মে তারিখে, ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার (৫৯০ মাইল) দক্ষিণে। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫শে মে তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। আইলা একটি মালয় শব্দ । এর অর্থ 'ডলফিন' বা শুশুক জাতীয় এক ধরনের প্রাণী ।
  • ওয়ার্ড : ঘূর্ণিঝড় ওয়ার্ড ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আঘাত হানে । ওয়ার্ড একটি ওসমানি শব্দ । এর অর্থ ফুল ।
  • মহাসেন : ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে আঘাত হানে। এ ঘূর্ণিঝড়টির প্রথমে মহাসেন নামকরণ করা হলে ও স্থির থাকার কারণে পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ভিয়ারু । মহাসেন অর্থ রাজার নাম ।
  • হুদহুদ : ১২ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে সকাল ১১ টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ' হুদহুদ ' ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে আঘাত হানে। হুদহুদ আরবি শব্দ । এটি একটি পাখির নাম ।
  • কোমেন : ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই কোমেন ঘূর্ণিঝড় একযোগে মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারতের পূর্বাংশে আঘাত হানে । কোমেন একটি থাই শব্দ । এর অর্থ বিস্ফোরক ।
  • রোয়ানু : ২০১৬ সালের ২১শে মে বাংলাদেশের বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার জ্বলোচ্ছ্বাস তৈরি করে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ' রোয়ানু '। রোয়ানু মালদ্বীপের দিভেহি ভাষার শব্দ শব্দ । এর অর্থ নারিকেলের ছোবড়া ।
  • মোরা : ' ২০১৭ সালের ৩০শে মে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় 'মোরা '। মোরা থাই ভাষার শব্দ । এর অর্থ সমুদ্রের তারা ।
  • ইরমা : ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ক্যাটাগরি-৫ মাত্রার ঝড় ছিল হ্যারিকেন ইরমা । ইরমা নামের বাংলা অর্থ হচ্ছে সমগ্র ।
  • ফণী : ঘূর্ণিঝড় ফণী ২০১৯ সালের ৩ মে শুক্রবার সকালে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলে আঘাত হানে। অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওড়িশা রাজ্যে আঘাত হানা একটি শক্তিশালী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড় ' ফণীর' নাম দিয়েছে বাংলাদেশ , এর অর্থ সাপ বা ফণা তুলতে পারে এমন প্রাণী । ঘূর্ণিঝড় 'ফণী'র বাতাসের গতিবেগ বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার।
  • ইদাই : ইদাই ঘূর্ণিঝড় ২০১৯ সালের ৪ থেকে ২১শে মার্চ একযোগে মোজাম্বিক , মালাওয়ি মাদাগাস্কার ও জিম্বাবুয়েতে আঘাত হানে।
  • বুলবুল : অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় বুলবুল একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য উপকূলে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে শ্রেণি-৩ হারিকেনের সমতুল্য তীব্রতায় আঘাত করে এবং এটি বাংলাদেশের জন্য বন্যা এবং ঝড়ের তীব্র ঝুঁকির সৃষ্টি করেছিল। বুলবুল অর্থ গানের পাখি । ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুল '-এর নামকরণ করে পাকিস্তান
  • আম্পান : "বাংলাদেশে সর্বশেষ গাত হানা ঘূর্ণিঝড় হল আম্পান । সুপার সাইক্লোন আম্পান বা আমফান একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা ২০২০ সালের ২০মে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ভারতের পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশে আঘাত হানে। আম্পান অর্থ স্বাধীন চিত্ত , শক্তি ও দৃঢ়তা । ঘূর্ণিঝড় আম্পান-এর নামকরণ করে থাইল্যান্ড
  • নিসর্গ : ঘূর্ণিঝড় ' নিসর্গ 'র নামকরণ করে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা ঘূর্ণিঝড়ের নামগুলো ছিল হেলেন, চপলা, অক্ষি, ও ফণী।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা আঞ্চলিক কমিটি একেকটি ঝড়ের নামকরণ করে। যেমনঃ ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর নামকরণ করে এই সংস্থার আটটি দেশ। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং ওমান, যাদের প্যানেলকে বলা হয় WMO/ESCAP। এক সময় ঝড়গুলোকে বিভিন্ন নম্বর দিয়ে শনাক্ত করা হতো। কিন্তু সেসব নম্বর সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হতো। ফলে সেগুলোর পূর্বাভাস দেয়া, মানুষ বা নৌযানগুলোকে সতর্ক করাও কঠিন মনে হতো। এ কারণে ২০০৪ সাল থেকে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। সে সময় আটটি দেশ মিলে মোট ৬৪টি নাম প্রস্তাব করে। সেসব ঝড়ের নামের মধ্যে এখন 'আম্পান' বাদ দিলে আর পাঁচটি নাম বাকি রয়েছে। নামগুলো যথাক্রমে ভায়ু বা বায়ু , হিক্কা, কায়ার, মাহা, এবং পাউয়ান। এর আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে ঝড়ের নামকরণ করা হতো।

ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত এবং শ্রেণীবিভাগ

সমুদ্র বন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড় সংকেত ১১ টি যথাঃ

  • ১ নং সতর্ক সংকেত: সমুদ্রের কোন একটি অঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া বইছে এবং সেখানে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।
  • ২ নং দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: সমুদ্রে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে।
  • ৩ নং স্থানীয় সতর্কতা সংকেত: বন্দর দমকা হাওয়ার সম্মুখীন।
  • ৪ নং স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঝড়ের সম্মুখীন, তবে বিপদের আশঙ্কা এমন নয় যে চরম নিরাপত্তা গ্রহণ করতে হবে।
  • ৫ নং বিপদ সংকেত: অল্প বা মাঝারী ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঝড়টি বন্দরের দক্ষিণ দিক দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে।
  • ৬ নং বিপদ সংকেত: অল্প বা মাঝারী ধরনের ভূমি ঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঝড়টি বন্দরের উপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে।
  • ৭ নং বিপদ সংকেত: অল্প বা মাঝারী ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঝড়টি বন্দরের নিকট বা উপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
  • ৮ নং মহাবিপদ সংকেত: প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঘূর্ণিঝড়টি বন্দরের দক্ষিণ দিক দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে।
  • ৯ নং মহাবিপদ সংকেত: প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঘূর্ণিঝড়টি বন্দরের দক্ষিণ দিক দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে।
  • ১০ নং মহাবিপদ সংকেত: প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকবে এবং ঝড়টি বন্দরের নিকট বা উপর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে।
  • ১১ নং মহাবিপদ সংকেত: সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

সমুদ্রবন্দর এর জন্য ঘূর্ণিঝড় এর সূত্র মনে রাখা:
১ , ২ → দূরবর্তী সতর্ক হুঁশিয়ারি সংকেত
৩ , ৪ → স্থানীয় সতর্কতা হুঁশিয়ারি সংকেত
৫ , ৬ , ৭ → বিপদ সংকেত
১ , ৯ , ১০ → মহাবিপদ সংকেত
১১ নং → সতর্ক সংকেত । সতর্কবার্তা প্রদানকারীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

নদী বন্দরের জন্য ঘূর্ণিঝড় সংকেত ৪ টি যথাঃ

  • ১ নম্বর সতর্ক সংকেত
  • ২ নং হুঁশিয়ারি সংকেত
  • ৩ নং নৌ বিপদ সংকেত
  • ৪ নং নৌ মহাবিপদ সংকেত
বাতাসের তীব্রতা ও গতির ভিত্তিতে ঘূর্ণিঝড় এর শ্রেণীবিভাগ
ঘূর্ণিঝড় বাতাসের গতিবেগ কিলোমিটার /ঘন্টা
নিম্নচাপ ৫০
গভীর নিম্নচাপ ৫১ থেকে ৬১
ঘূর্ণিঝড় ৬২ থেকে ৮৮
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ৮৯ থেকে ১১৭
হারিকেনের তীব্রতা সম্পন্ন প্রবল ঘূর্ণিঝড় ১১৮ থেকে ১৭০
সুপার সাইক্লোন ১৭১ এর অধিক

Red Cross /red crescent দূর্যোগ প্রতিবেদন

  • সবচেয়ে বেশি দূর্যোগ ২০১৮ সালে- চীনে ৩১৩ টি
  • সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ- চীনে [৭৯৮ মিলিয়ন।
  • সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি - ইউএসএ [ ৫২৫ মিলিয়ন ]
  • জনসংখ্যার ক্ষতিতে বাংলাদেশ- অষ্টম [ ৩৭ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রন্থ ]

জলোচ্ছ্বাস

জলোচ্ছ্বাস শব্দটি প্রাচীন নর্স ভাষার শব্দ "বারা" থেকে প্রাচীন ইংরেজীর মাধ্যমে উদ্ভূত, যার অর্থ "তরঙ্গ" বা " ফোলা। জলোচ্ছ্বাস হলো সমুদ্রের পানি স্ফীত হয়ে উপকূলে আঘাত হানা। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে, সাধারণত ঘূর্ণিঝড়, সাগরগর্ভে ভূমিকম্প , অগ্নুৎপাত এবং সুনামির কারণে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। সুনামির ক্ষেত্রে সমুদ্রের জল সর্বোচ্চ প্রায় ৬৫ মিটার উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরো সহজভাবে বললে , ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের পানি স্ফীত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে উপকূলের কাছাকাছি যে উঁচু ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় তাকে বলে-জলোচ্ছ্বাস। ১৯৭৬ সালের ১ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল-১৩.৭২ মিটার পর্যন্ত।

জলোচ্ছ্বাস

জলোচ্ছ্বাস এর কারণ:

  1. তীব্র বায়ুতাড়িত অভিসারী সমুদ্রস্রোত।
  2. ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের চাপের অস্বাভাবিক হ্রাস।
  3. সাগরের অগভীর অংশে বা মহীসোপানে ঘূর্ণিঝড়ের আগমন।
  4. জলোচ্ছ্বাস এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত:
    • ঘূর্ণিঝড়
    • সাগরগর্ভে ভূমিকম্প
    • অগ্নুৎপাত
  5. ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সম্ভাব্য উপকূলের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথের কৌণিক অবস্থান।
  6. উপকূলের আকৃতি
  7. ভরা জোয়ার

বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে জলোচ্ছ্বাসের কারণে জীবন ও সম্পদের যে ক্ষতি হয় তার ৯০% জলোচ্ছ্বাস এর কারণে।

সময় কাল: বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) কার্তিক-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর নভেম্বর)

অঞ্চল ভিত্তিক প্রকোপ: উপকূলবর্তী এলাকা চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, কক্সবাজার, বরগুনা, ভোলা , নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা।

বিশ্বের কয়েকটি ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে:

  • পানামা (১৯৮৯)
  • জাপান (১৯৪৭)
  • ইরান (১৯৫৪)
  • বাংলাদেশ (১৯৬০, ১৯৯৮)
  • ইন্দোনেশিয়া (২০০৪)

খরা (Drought)

খরা হচ্ছে কোনো একটি অঞ্চলের পানির ঘাটতিজনিত সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিকরা টানা দুই সপ্তাহ ০.২৫ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে একে খরা আর টানা চার সপ্তাহ ০.২৫ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত না হলে সেটিকে আংশিক খরা বলে। প্রচলিত ভাষায় , দীর্ঘ সময় বৃষ্টির না হওয়ার প্রেক্ষিতে কৃষি জমিতে পানি সরবরাহের দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির ঘটনা থেকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে খরা বলে । এই সময় মাটিতে পানির পরিমাণ কমতে কমতে পানিশূন্য হয়ে যায় এবং মাটিতে গাছপালা/ শস্য জন্মাতে পারে না। একটি খরা এক মাস এমনকি এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

খরা

খরার কারণ:

  • পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব।
  • অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
  • গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমন্ডল ধীরে ধীরে রুক্ষ ও শুষ্ক হওয়ার ফলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া।
  • গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলন।
  • নদীর গতিপথ পরিবর্তন।
  • অতিরিক্ত পশুচারণ।
  • উজান থেকে পানি প্রত্যাহার (তিস্তার পানি যথাসময়ে ছেড়ে না দেওয়া)।
  • পানি সংরক্ষণের প্রক্রিয়ার অভাব।
  • সম্প্রতি বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত কমে খরার জন্য পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের মেরু অঞ্চলে সৃষ্ট এল নিনো কে দায়ী করা হচ্ছে।
  • বনভূমি হ্রাস।
  • প্রযুক্তিগত স্বল্পতা।
  • ওজোনস্তরের ক্ষয়।

প্রকারভেদ: খরাকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
• বায়ুমন্ডলীয়
• জল মন্ডলীয়
• কৃষিজ খরা

অঞ্চল ভিত্তিক প্রকোপ:
• বিশ্বের সর্বত্রই খরা আঘাত হানে, তবে আফ্রিকার দেশসমূহে এর প্রকোপ বেশি ।
• বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা খরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ । রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, বরিশাল।
• এক টানা দুই সপ্তাহ দশমিক ০.২৫ মিলিমিটার এর কম বৃষ্টিপাতই খরা।
• বাংলাদেশের ১৯৫৭ এবং ১৯৭৮ থেকে ৭৯ সালে খরা হয় ব্যাপকভাবে।

বন্যা (Flood)

বন্যা হল তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে সাধারণত শুষ্ক জমিকে নিমজ্জিত করে। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদী, জলাশয়, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাব্যতা হারিয়ে ফেলাতে অতিরিক্ত পানি সমুদ্রে যাবার আগেই জলাশয় উপচে আশেপাশের স্থল ভাগ প্লাবিত হয়ে বন্যা ঘটায় । বন্যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে ।

বন্যা

বন্যার কারণ : নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য বন্যা একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তারপর ও মানুষের দ্বারা পরিবেশের পরিবর্তন প্রায়শই বন্যার তীব্রতা ও প্রকোপ বৃদ্ধি করে, উদাহরণস্বরূপ বন উজাড় ও জলাভূমি অপসারণ, পানির গতিপথের পরিবর্তন বা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং বৃহত্তর পরিবেশগত সমস্যা যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার ঘটনা বন্যার অন্যান্য কারণের তীব্রতা বাড়ায়, ফলে আরও তীব্র বন্যা হয় এবং বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিচে বন্যার কিছু কারণ উল্লেখ করা হলঃ

  1. ভারী বর্ষণ
  2. নদী ভাঙ্গন
  3. পাহাড়ি ঢল
  4. নদ-নদীর কম ধারণ ক্ষমতা
  5. মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জোয়ারের কারণে উজানের পানি নদ-নদীর মাধ্যমে সাগরে না যাওয়া।
  6. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
  7. নদ-নদী ভরাট
  8. এমনকি ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে প্লাবিত হয়।
  9. জোয়ার ভাটা জনিত বন্যা- এ বন্যা অমাবস্যা পূর্ণিমায় হয় এবং স্বল্পস্থায়ী।

আঞ্চলিক প্রকোপ:
বিশ্বে নীল, ইয়াংসিকিয়াং, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি অববাহিকায় বন্যা বেশি হয়।
বন্যা, নদীভাঙ্গনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়- সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর জেলা।

FCDI (flood control drainage and irrigation projects): এই প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে এবং উদ্বৃত্ত পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রজেক্টের অধীনে রয়েছে গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, ডিএনডি বাঁধ প্রকল্প, কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প, উপকূলীয় বেস্টনী প্রকল্প প্রভৃতি।

বন্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য :

  • বাংলাদেশে শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা হয় ১৯৯৮ সালে।
  • বাংলাদেশে প্রলয়ংকারী বন্যা হয় ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭।
  • বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যার রেকর্ড (১৯৭১-২০০৭) অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালের বন্যায় সবচেয়ে বেশী এলাকা প্লাবিত হয়।
  • বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উচু পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চলে পাহাড়সমূহ থেকে নেমে আসা জলে সৃষ্টি হয় - আকস্মিক বন্যার
  • পার্বত্য এলাকায় দেখা দেয়- আকস্মিক বন্যা
  • যে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি- মৌসুমী বন্যা
  • বাংলাদেশের উপকূলীয় সমভূমিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী যে ধরণের বন্যা কবলিত হয় তার নাম - জলোচ্ছ্বাসজনিত বন্যা
  • ১৯৬০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে – ৮ হাজার কিলোমিটার (প্রায়)।
  • বাস্তবায়িত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প- ৩৩৮ টি।
  • বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে- ৭৪ টি।
  • বন্যা প্রতিরোধে শহরে নির্মিত বাঁধকে বলে- বেষ্টনী মূলক বাধ।
  • বন্যা নিয়ন্ত্রণ পানি নিষ্কাশন, পানি সেচের উদ্দেশ্যে সরকারের গৃহীত প্রকল্প --এফসিডিআই (১৯৬৪)
  • পুনর্বিন্যাসকৃত আবহাওয়া সতর্ক সংকেত - ৮টি।
  • নদী বন্দরের জন্য সতর্ক সংকেত - ৪টি।
  • সমুদ্র বন্দরের জন্য সতর্ক সংকেত - ১১টি

টর্নেডো / কাল বৈশাখী

টর্নেডো শব্দটি এসেছে- স্প্যানিশ শব্দ 'Tornado' থেকে যার অর্থ Thunder storm বা বজ্রঝড়। আবহাওয়াবিজ্ঞানের শব্দকোষ অনুযায়ী, টর্নেডো হল প্রচণ্ডবেগে ঘূর্ণনরত একটি বায়ুস্তম্ভ, যা ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে একটি কিউমুলিফর্ম মেঘ থেকে ঝুলন্ত বা এর নিচে থাকে । টর্নেডোর আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি দৃশ্যমান ঘনীভূত ফানেল আকৃতির হয়, যার চিকন অংশটি ভূপৃষ্ঠকে স্পর্শ করে এবং এটি প্রায়শই বজ্রমেঘ দ্বারা ঘিরে থাকে। আরো সহজভাবে বললে , লঘু বা নিম্নচাপ সৃষ্টির ফলে উষ্ণ বাতাস উপরে উঠে যায় এবং ঐ শূণ্য জায়গা পূরণের জন্য শীতল বাতাস প্রচন্ড বেগে শূন্য জায়গার দিকে ধাবিত হলে যে ধ্বংসস্তুপের সৃষ্টি হয় তাকে টর্নেডো বলে । এন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া প্রায় সর্বত্রই টর্নেডো দেখা গেলেও সবচেয়ে বেশি টর্নেডো সংঘটিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অনেক সময় দেখা যায় একটিমাত্র টর্নেডো থেকে অনেকগুলো টর্নেডো এবং মেসোসাইক্লোনের সৃষ্টি হয়। যখন একটি পৃথক মেসোসাইক্লোন থেকে একটি পৃথক টর্নেডোর সৃষ্টি হয় তখন এই প্রক্রিয়াকে সাইক্লিক টর্নেডোজেনেসিস বলে। একই টর্নেডো থেকে সৃষ্ট টর্নেডোসমূহকে বলা হয় টর্নেডো পরিবার। কখনো কখনো পৃথক একটি মেসোসাইক্লোন থেকে অনেক টর্নেডো একসাথে সৃষ্টি হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় পুরনো টর্নেডো নতুন সৃষ্ট হওয়া টর্নেডোর সাথে একীভূত হয়ে যায়। সাইক্লোনের সাথে টর্নেডোর মূল পার্থক্য হলো সাইক্লোন সৃষ্টি হয় সাগরে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে আর টর্নেডো যে কোনো স্থানেই সৃষ্টি হতে পারে ও আঘাত হানতে পারে। সাইক্লোনের মত টর্নেডো সৃষ্টির মূল কারণ - লঘু বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়া।

টর্নেডো

অধিকাংশ টর্নেডোতে বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ১৩০ মাইলের (ঘণ্টায় ১৭৭ কিমি) কাছাকাছি, ব্যাপ্তি প্রায় ২৫০ ফুট (৭৫ মিটার) এবং দ্রুত নিঃশেষ হবার আগে এটি কয়েক মাইল বা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। কিছু টর্নেডো আরো বেশি শক্তিসম্পন্ন হতে দেখা যায়; এগুলোর বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘন্টায় ৩০০ মাইল বা ৪৮০ কিমি-এর বেশি, ব্যাপ্তিতে প্রায় এক মাইল বা ১.৬ কিমি-এরও অধিক এবং ভূমির উপর দিয়ে প্রায় ১০০ কিমি-এরও অধিক দূরত্ব এগুলো অতিক্রম করতে পারে।

  • বাংলাদেশে সাধারণত টর্নেডো হয়- বৈশাখ (April-May) মাসে।
  • পূর্বাভাস ও সতর্কবাণী প্রচার করা সম্ভব নয় টর্নেডোর ক্ষেত্রে (কারণ হঠাৎ আঘাত হানে)।
  • বাংলাদেশে স্মরণকালের ভয়াবহ টর্নেডো আঘাত হানে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে; ঢাকার ডেমরা থানায় (বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ৬৪৪ km/h)।
  • কোনো স্থানের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেই স্থানে সাধারণত হয় উচ্চচাপ। কেননা সেই স্থানের - বায়ু উত্তপ্ত হয়ে ওপরে চলে যায়। আবার সেই ফাঁকা স্থান পার্শ্ববর্তী বায়ু দ্বারা পূর্ণ হয়। অন্যদিকে কমে গেলে নিম্নচাপ হয়।

টেকটনিক প্লেট

টেকটনিক প্লেট হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এটি এমন একটি তাত্ত্বিক ধারণা যাতে বিশ্বাস করা হয় পৃথিবীর উপরিতল কিছু পাতলা, অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত যারা একে অপরের দিকে চলাচল করতে সক্ষম। টেকটনিক প্লেট বিজ্ঞানের আধুনিকতম আবিষ্কার ও গবেষণার বদৌলতে এখন আর নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত একটি অনুঘটক যা পৃথিবীতে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বটিকে ব্যবহার করে ভূমিকম্প ছাড়াও আগ্নেয়গিরির উদগীরণ, পর্বত সৃষ্টি এবং সাগর-মহাসাগর সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। সর্বপ্রথম ১৯১২ সালে জার্মান আবহাওয়াবিদ আলফ্রেড ওয়েগেনারের মহীসঞ্চারণ তত্ত্ব থেকেই টেকটনিক প্লেট ধারণাটির জন্ম হয়। ওয়েগেনারের মতে, বহুকাল আগে পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশ একত্রে একটি মহাদেশ ছিল (প্যানজিয়া), কালের আবর্তে যা টেকটনিক প্লেট নামক প্লেটগুলোর নড়াচড়ায় আলাদা আলাদা মহাদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই তত্ত্বটিকে বলা হয় মহীসঞ্চারণ তত্ত্ব (কন্টিনেন্টাল ড্রিফট)। তার এই তত্ত্বটির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত করেন আধুনিকতম তত্ত্ব নিও বৈশ্বিক টেকটনিক- যা সাধারণের কাছে প্লেট টেকটনিক বা টেকটনিক প্লেট নামে সমধিক পরিচিত। তিন ধরনের পারস্পারিক প্লেট সীমানার কথা জানা যায়। যথা- সমাকেন্দ্রাভিমুখী সীমা, অপসারী সীমা এবং পরিবর্তক চুতি সীমা।

টেকটনিক প্লেটসমূহ:
ক) প্রধান টেকটনিক প্লেট: আফ্রিকার প্লেট, এন্টার্কটিকার প্লেট, ইন্দো-অস্ট্রেলীয় (ভারতীয় প্লেট এবং অস্ট্রেলীয় প্লেট), ইউরেশীয় প্লেট, উত্তর আমেরিকার প্লেট, দক্ষিণ আমেরিকার প্লেট এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট।
খ) অপ্রধান টেকটনিক প্লেট: আরব্য প্লেট, ক্যারিবীয় প্লেট, জুয়ান দে ফুকা প্লেট, কোকাস প্লেট, নাজক প্লেট, ফিলিপিনীয় প্লেট, স্কশিয়া প্লেট প্রভৃতি।

ভূমিকম্প (Earthquake)

ভূ -অভ্যন্তরে শিলাসমূহ একে অপরকে পীড়নের ফলে যে বিপুল শক্তি জমা হয় , সে বিপুল শক্তি হঠাৎ বিমুক্ত হওয়ায় ভূ -পৃষ্ঠ সাময়িক সময়ের জন্য কেঁপে ওঠে অথবা পৃথিবী পৃষ্ঠে যে ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি হয় এবং ভূ -পৃষ্ঠের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়; এইরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। এই ভূ-কম্পন কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে ১/২ মিনিট স্থায়ী হয়। তবে খুবই কমসংখ্যক কিছু ভূমিকম্প ৮-১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে । কিছু কিছু কম্পন এত দুর্বল হয় যে , তা ভূ -পৃষ্ঠ থেকে অনুভবও করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় যা ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে থাকে এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটায় । ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে ৫ থেকে ১,১২৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভূকম্পন সৃষ্টি হতে পারে। ভূঅভ্যন্তরে যেখানে শক্তি বিমুক্ত হয় তাকে কেন্দ্র বলে। সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিমি.-র মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে। কেন্দ্র থেকে লম্বালম্বিভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরিস্থ বিন্দু উপকেন্দ্র নামে পরিচিত।

ভূকম্পনের প্রকারভেদ :
কেন্দ্রের অবস্থানের গভীরতার ভিত্তিতে কেন্দ্রকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা-
ক) অগভীর (কেন্দ্র: ৬০ কি.মি.)
খ) মাঝারি (কেন্দ্র: ৬০ - ৩০০ কি.মি.)
গ) গভীর (কেন্দ্র। ৩০০ কি.মি, এর বেশি)
তবে যে সব শক্তিশালী ভূমিকম্প পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোই ছিল অগভীর শ্রেণীভূক্ত ।

ভূমিকম্পের কারণ : বেশিরভাগ ভূমিকম্পের কারণ হ‌ল ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া; কিন্তু সেটা অন্যান্য কারণেও ঘটতে পারে ; যেমন: অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস, খনিতে বিষ্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থে নিউক্লিয়ার গবেষণায় ঘটানো আণবিক পরীক্ষা থেকেও হয়ে থাকতে পারে। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করা হলঃ

  • ভিত্তিশিলা চ্যুতি বা ফাটল
  • তাপ বিকিরণ
  • আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত
  • হিমবাহের প্রভাব
  • ভূ-পাত
  • ভূ-গর্ভস্থ বাষ্প
  • ভূ-গর্ভস্থ চাপের হ্রাস
  • ভূ-পৃষ্ঠের চাপ বদ্ধি

কোথায় ভূমিকম্পের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি: প্রশান্ত মহাসাগরের বহিঃসীমানা বরাবর ভূমিকম্পের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এ অংশের জাপান, ফিলিপাইন, চিলি, অ্যালিউসিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আলাস্কা সবচেয়ে ভূকম্পন প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত।

  • ইরানের বাম নগরীতে ২০০৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে।
  • ভূ-অভ্যন্তরে দ্রুত বিপুল পরিমাণ শক্তি বিমুক্ত হওয়ায় পৃথিবী পৃষ্ঠে যে ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে বলে ভূমিকম্প।
  • ভূ-অভ্যন্তরে যেখানে শক্তি বিমুক্ত হয় তাকে বলে ভূমিকম্পের কেন্দ্র।
  • কেন্দ্র থেকে লম্বালম্বিভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরিস্থ বিন্দুকে বলে- ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র (Epicentre)
  • ভূমিকম্পের কম্পনের বেগ সর্বাপেক্ষা বেশি- উপকেন্দ্র
  • ভূ-কম্পন কেন্দ্রে অবস্থানের গভীরতার ভিত্তিতে কেন্দ্রকে ভাগ করা হয় -৩ ভাগে। যথাঃ অগভীর, মাঝারি ও গভীর।
  • ফিলিপাইন, জাপান, চিলি, অ্যালিসিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আলাস্কা ইত্যাদি দেশ বা অঞ্চল-- সবচেয়ে ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকা নামে পরিচিত।
  • ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের নাম- সিসমোগ্রাফ (ভূকম্পন লিখন যন্ত্র)।
  • ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্রের নাম- রিখটার স্কেল।
  • রিখটার স্কেল আবিষ্কৃত হয় ১৯৩৫ সালে।
  • সাধারণত রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ৫ মাত্রা অতিক্রম করলেই- জীবন ও সম্পত্তিহানীর ব্যাপক আশঙ্কা থাকে।
  • ভূমিকম্পের উৎস ও মৃদু কম্পন নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়- ভূকম্পন লিখন যন্ত্র।
  • রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপা যায়-- ১ থেকে ১০ পর্যন্ত।
  • মার্সেলি স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপা যায়- ২ থেকে ১২ পর্যন্ত।
  • ভূমিকম্পের দেশ বলা হয়-- জাপানকে।
  • বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ফলে বদলে গিয়েছে---- ব্রক্ষপুত্র নদীর গতিপথ।
  • ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে -- জাপান।

বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা:
বাংলাদেশ ইউরেশিয়ান প্লেটের ভারতীয় অংশে অবস্থিত। বাংলাদেশের ভূমিতে ফাটল আছে ১২ টি। বাংলাদেশে টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ফাটল আছে। ১৯৯৩ সাল থেকে ভূমিকম্প ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে:

  1. উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল: সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল (রিখটার স্কেল মাত্রা ৭) -কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগ।
  2. মধ্যাঞ্চল: মাঝারি ঝুঁকির অঞ্চল (রিখটার স্কেল মাত্রা ৬)। এ অঞ্চলের মধ্যে পড়ে রংপুর, রাজশাহী বিভাগ, ঢাকা বিভাগ, পদ্মার পূর্বাঞ্চল ও চট্টগ্রাম বিভাগ।
  3. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল (রিখটার স্কেল মাত্রা ৫)। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল (খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের পদ্মার পশ্চিমাঞ্চল)
বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা

১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প সংক্রান্ত রেকর্ড সংগৃহীত শুরু হয়। বাংলাদেশে মাত্র একটি ভূমিকম্প রেকর্ড কেন্দ্র বা ভূমিকম্পন মানমন্দির রয়েছে, বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ চট্টগ্রাম শহরে ১৯৫৪ সালে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। উপমহাদেশের প্রথম ভূকম্পনীয় অঞ্চলীকরণ মানচিত্র (Seismic Zoning Map) জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রণীত হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯৭২ সালে একটি ভূকম্পনীয় অঞ্চলীকরণ মানচিত্র প্রণয়ন করে।

বাংলাদেশে সংঘটিত প্রধান প্রধান ভূমিকম্পসমূহের তালিকা :
নাম তারিখ উপকেন্দ্র মাত্রা
কাছার ভূমিকম্প ১ অক্টোবর, ১৮৬৯ জৈন্তিয়া পর্বত ৭.৫
বেঙ্গল ভূমিকম্প ১৪ জুলাই, ১৮৮৫ বগুড়া চ্যুতি ৭.০
শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প ৮ জুলাই, ১৮৯১ বালিসেরা উপত্যকা ৭.৬
শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প ১৮ জুলাই, ১৯১৮ শ্রীমঙ্গল ৭.১
ধুবরি ভূমিকম্প ৩ জুলাই, ১৯৩০ ধুবরি শহর, আসাম ৭.১
বিহার-নেপাল ভূমিকম্প ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৪ দারভাঙ্গা ৮.৩
আসাম ভূমিকম্প ১৫ আগস্ট, ১৯৫০ আসামের অরুণাচল ৮.৪
সিলেট ভূমিকম্প ৫ আগস্ট, ১৯৯৭ - ৬.০০
চট্টগ্রাম ভূমিকম্প ২২ নভেম্বর, ১৯৯৭ ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত ৬.০০
মহেশখালী দ্বীপ ভূমিকম্প ২২ জুলাই, ১৯৯৯ মহেশখালী দ্বাপের পশ্চিমাঞ্চল ৫.২
নড়াইল ভূমিকম্প ৫ আগস্ট, ২০০৬ ঢাকা থেকে প্রায় ১১০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে ৪.২
মানিকগঞ্জ ভূমিকম্প ২০ মার্চ, ২০০৮ মধুপুর চুত্যি ৩.৮
চাঁদপুর ভূমিকম্প ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ চাঁদপুরের কচুয়া -
বঙ্গোপসাগর ভূমিকম্প ১১ আগস্ট, ২০০৯ উত্তর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও বার্মার সমুদ্র উপকল ৭.৫
ভূটান ভূমিকম্প ২১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভুটানের পর্বাঞ্চল -
নেপাল ভূমিকম্প ২৫ এপ্রিল , ২০১৫ নেপালের 'লামজুং জেলায় ৭.৯

নেপালের ভূমিকম্প:

  • ২৫ এপ্রিল ২০১৫ এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে হিমালয় কন্যা নেপালে।
  • এ ভূমিকম্প বাংলাদেশ, উত্তর ভারত, চীনের তিব্বত অঞ্চল এবং পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনুভূত হয়।
  • ভূমিকম্পের উৎস কাঠমাণ্ডু থেকে ৮১ কিমি, উত্তর- পশ্চিম এবং পর্যটন নগরী পোখারা হতে ৮০ কি. মি. পূর্বে অবস্থিত গান্ধাকি জোনের 'নামঞ্জুং জেলায়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৯।
  • ৮১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার এ ভূমিকম্পে ধ্বংস উপত্যকায় পরিণত হয় নেপাল। এ ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় দশ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংস হয়ে যায় দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর মধ্যে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পাওয়া কাঠমাণ্ডুর দরবার স্কয়ার এবং ১৮৩২ সালে নির্মিত ধারাহারা বা ভীমসেন টাওয়ার অন্যতম।
  • উল্লেখ্য, নেপালে সংঘটিত তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ থেকে ৭৪৫ কিমি দুরে হলেও বাংলাদেশে অনুভূত তীব্রতা ৪-৫ এর মধ্যে ছিল।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সংঘটন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ভূমিকম্প দুর্যোগ প্রতিরোধ মোকাবেলায়ে তিনটি পদক্ষেপ অনুসরণ করা যায়, যথা:
(১) প্রাক দুর্যোগে মানব বসতি সংক্রান্ত ভৌত পরিকল্পনা,
(২) দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবে ব্যবস্থাদি গ্রহণ এবং
(৩) জমিজরিপ ব্যবস্থাপনা।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

  1. ভূমিকম্প সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যপক প্রচার প্রয়োজন।
  2. সারাদেশে ভবন নির্মাণে জাতীয় 'বিল্ডিং কোড' এবং কোডের কাঠামোগত অনুসরণ বাধ্যতামূলক হবে।
  3. ঢাকা শহরে রাজউকের ভবন নির্মাণ প্ল্যান অনুমোদনের নীতিমালা যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।
  4. সারাদেশে রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে।
  5. ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃক তালিকা।
  6. ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে স্বেচ্ছাসেবক দলগঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
  7. দুর্যোগ কবলিত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য নৌবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীতে 'ডগ স্কোয়াগ' রাখা।
  8. ক্ষতিগ্রন্থ এলাকায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।
  9. বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক সিলেটে নির্মিয়মান কেন্দ্রের সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঢাকা, সিলেট, রংপুর এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা।
  10. বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর, সম্পৃক্ত সংস্থাসমূহের কেন্দ্র হিসেবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে।

সুনামি (Tsunami)

সুনামি (Tsunami) একটি জাপানি শব্দ যার অর্থ বন্দরের ঢেউ। ভূকম্পন সমুদ্র তলদেশে হলে তা পানিতে বিশাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। ভূকম্পনে সৃষ্ট এ সমুদ্র ঢেউ সুনামি নামে পরিচিত। সুনামী উপকূলীয় শহর ও অন্যান্য লোকালয়ে আকস্মিক ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সুনামির কারণে জাপানে পারমাণবিক বিপর্যয় হয়।

  • সুনামি হলো - জাপানি শব্দ ('সু' অর্থ- বন্দর এবং 'নামি' অর্থ - ঢেউ)।
  • সুনামি শব্দের অর্থ হলো -- বন্দরের ঢেউ।
  • ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় সাগরে যে বিশাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়ে জলোচ্ছ্বাস হয় তাকে বলে- সুনামি
  • সুনামির কারণ সাগরের তলদেশে প্লেট দুমড়ে যাওয়ায় সৃষ্ট ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস ও নভোজাগতিক ঘটনা ইত্যাদি।
  • অগভীর পানিতে সুনামি রূপ নেয়- জলোচ্ছ্বাসে
  • শতাব্দীর ভয়াবহ সুনামি সংঘটিত হয় - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে।
  • ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়- এশিয়া ও আফ্রিকার ১৩ টি দেশ।
  • ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামিতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি।
  • ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সুনামি জাদুঘর উন্মুক্ত করা হয় ইন্দোনেশিয়ার আচেহ-তে।
  • সুনামির ফলে ঢেউ এর গতিবেগ ঘন্টায় ৫০০-৮০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে।

বিশ্বে সুনামির সংঘটন :

  • ২০১১ সাল : জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় টাহুকু শহরে স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ৪৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৯.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র চিল টাহুকু হতে ১৩০ কিমি দূরে। এর ফলে ঐ অঞ্চলে ১০ মিটার (৩৩ ফিট) উচ্চতার সুনামিও আঘাত হানে। সরকারিভাবে ১৩,৩৩৩ জনের প্রাণহানির খবর প্রচারিত হয়, আহতের সংখ্যা বলা হয় ৪,৮৭৮, ২৮২ এবং নিখোঁজ ১৫,১৫০ জন। অন্তত ৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হাইড্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে প্লান্টটি গরম হয়ে যাওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটে।
  • ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস : ইন্দোনেশিয়ায় একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে সুনামির সতর্কতা সংকেত জারি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সতর্কসংকেত তুলে নেয়া হয়।
  • ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর : ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সুনামিতে উপকূলবর্তী ১২টিরও বেশি দেশে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই সুনামির কারণে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি। এর উৎপত্তিস্থল ইন্দোনেশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ সুমাত্রায়। শতাব্দীর ভয়াবহ এই সুনামির ঢেউয়ের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০০-৮০০ কিমি।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

আগ্নেয়গিরি হলো বিশেষ ধরনের পাহাড় যার ভেতর দিয়ে ভূ-অভ্যন্তর থেকে 'ম্যাগমা ' নামক উত্তপ্ত ও গলিত পাথর, ছাই এবং গ্যাসের মিশ্রণ বেরিয়ে আসতে পারে। এটি একটি ভৌগোলিক প্রক্রিয়া। কোনো কোনো ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে ভূগর্ভস্থ গরম বাতাস, জলীয় বাষ্প (৫০-৬০%) , হাইড্রোজেন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার বা গন্ধকের বাষ্প , গলিত শিলা, কাদা, ছাই ইত্যাদি প্রবল বেগে বেরিয়ে আসে। নির্গত এই সকল পদার্থ ভূপৃষ্ঠের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে যার কিছুটা ফাটলের চারপাশে এসে ধীরে ধীরে জমা হয়ে মোচাকৃতি আকার ধারণ করে। তখন একে " আগ্নেয়গিরি " বলে। আগ্নেয়গিরি থেকে ভূগর্ভস্থ পদার্থের নির্গমনকে বলা হয় অগ্ন্যুৎপাত। আগ্নেয়গিরির বহিঃস্থ যে মুখ বা নির্গমনপথ দিয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে, তাকে জ্বালামুখ বলে। প্রতি বছর প্রায় ৬০টি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে। ভূ-অভ্যন্তরের তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বের হওয়া প্রচণ্ড উত্তাপ অশ্মমণ্ডলীয় শিলার নিম্নভাগ গলিয়ে ম্যাগমার সৃষ্টি করে। ভূঅভ্যন্তরের এ গলিত শিলা অশ্মমন্ডলের ফাটল বা দুর্বল অংশ ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে উদগিরণ হয়। এ উদগিরিত পদার্থকে লাভা বলে। লাভার উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হওয়াকে অগ্ন্যুৎপাত বলে। আগ্নেয়গিরির উদগিরণ শেষে জ্বালামুখ ধসে পড়ে যে গর্তের সৃষ্টি করে তাকে ক্যালডেরা বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যের ক্রেটারহৃদ একটি ক্যালডেরা

আগ্নেয়গিরির প্রকারভেদ

উদ্গীরণ ক্ৰিয়ার ওপর নিৰ্ভর করে আগ্নেয়গিরিকে প্ৰধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয় যথাঃ

  1. জীবন্ত আগ্নেয়গিরি
  2. সুপ্ত আগ্নেয়গিরি
  3. মৃত আগ্নেয়গিরি

১. জীবন্ত আগ্নেয়গিরি: যে আগ্নেয়গিরি থেকে মাঝে মাঝে বা সবসময় অগ্ন্যুৎপাত হয়, তাকে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি বলে। ইহা দুই প্রকার যথাঃ ক) সবিরাম আগ্নেয়গিরি ও খ) অবিরাম আগ্নেয়গিরি

  • সবিরাম আগ্নেয়গিরি: যে আগ্নেয়গিরি থেকে মাঝে মাঝে অগ্ন্যুৎপাত হয়, তাকে সবিরাম আগ্নেয়গিরি বলে। যেমনঃ ইতালির ভিসুভিয়াস।
  • অবিরাম আগ্নেয়গিরি: যে আগ্নেয়গিরি থেকে সবসময় অগ্ন্যুৎপাত হয়, তাকে অবিরাম আগ্নেয়গিরি বলে। যেমনঃ ক্যালিফোর্নিয়ার লাসেনপিক।

২. সুপ্ত আগ্নেয়গিরি : যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বহুদিন যাবৎ বন্ধ আছে কিন্তু যে কোন সময় অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে পারে, তাকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলে। যেমনঃ জাপানের ফুজিয়ামা।

৩. মৃত আগ্নেয়গিরি : যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বহুদিন যাবৎ বন্ধ আছে এবং ভবিষ্যতেও কোনরূপ অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই, তাকে মৃত আগ্নেয়গিরি বলে। যেমনঃ ইরানের কোহিসুলতান, আইসল্যান্ডের হ্যাকলা ইত্যাদি।

আগ্নেয়গিরির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :

  • আগ্নেয়জাত ভূমি উর্বর হয় ।
  • সব আগ্নেয়গিরি মহাদেশ ও সমুদ্র সীমানা বরাবর বরাবর অবস্থিত ।
  • প্রধান আগ্নেয়গিরি বলয়টি প্রশান্ত মহাসাগরের নিউজিল্যান্ড থেকে শুরু হয়ে ফিলিপাইন, জাপান, আলাস্কা ও উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে যা আগ্নেয় মেখলা (Fiery ring) বা 'আগুনের আংটি' নামে পরিচিত ।
  • সাগর গর্ভে নির্গত লাভা স্তূপীকৃত হয়ে যে দ্বীপের সৃষ্টি করে, তাকে আগ্নেয় দ্বীপ বলে। যেমনঃ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ।
  • লাভা গঠিত মালভূমিকে আগ্নেয় মালভূমি বলে যেমনঃ ভারতের দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণমৃত্তিকাময় মালভূমি।
  • লাভা গঠিত হ্রদকে আগ্নেয় হ্রদ বলে। যেমনঃ আলাস্কার মাউন্ট আতাকমা, নিকারাগুয়ার কোসেগায়না এবং অ্যারিজোনা ও নেভাদা উল্লেখযোগ্য।
  • লাভা গঠিত সমভূমিকে আগ্নেয় সমভূমি বলে। যেমন- উত্তর আমেরিকার স্নেক নদীর লাভা সমভূমি।
  • স্ট্রাম্বোলি আগ্নেয়গিরিকে ভূমধ্যসাগরের আলোকস্তম্ভ বলা হয়।

জীবন্ত আগ্নেয়গিরির নাম

  • ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি - সর্বশেষ অগ্নুৎপাত ১৯৪৪ সালে;
  • জাপানের সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরি- ছয় বছর ধরে নিয়মিত অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে;
  • কঙ্গোর নিইরাগঙ্গো আগ্নেয়গিরি- ২০০২ সালে শেষ অগ্নুৎপাত ঘটে;
  • হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মউনা লোওয়া আগ্নেয়গিরি - এটি থেকে প্রায় সারা বছরই লাভার উদগীরণ হয়;
  • গুয়াতেমালার সান্তা মারিয়া আগ্নেয়গিরি - ১৯০২ সালে সর্বশেষ অগ্নুৎপাত হয়;
  • ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট সিনাবুং আগ্নেয়গিরি - ২০২১ সালের মার্চ মাসে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে; যদিও পূর্বাভাস থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নগন্য।
  • গুয়াতেমালার ফুয়েগো আগ্নেয়গিরি - ২০১৮ সালের জুন মাসে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটে;

হিমবাহ

পর্বতসমূহের বরফ জমতে জমতে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যখন পর্বতসমূহ অতিরিক্ত বরফ ধারণ করতে পারে না। ফলে বরফ পর্বত প্রাচীর বেয়ে নিচে নেমে আসে এবং দুর্যোগ সৃষ্টি করে। হিমবাহের বরফ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে ধূলি মেঘের সৃষ্টি করে। হিমবাহ এক ধরনের চলন্ত বরফ স্তুপ বা নদী। হিমবাহের গতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার এর বেশি হয় এবং এক কোটি টন পর্যন্ত বরফ প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে। হিমবাহের কোন অংশ অত্যন্ত দ্রুত পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসলে তাকে হিমানী সম্প্রপাত (Avalanche) বলে। ভারতের উত্তরে কারাকোরাম পর্বতমালাতে অবস্থিত ' গ্রেট বালটারো ' পৃথিবীর দীর্ঘতম হিমবাহ। এর দৈর্ঘ্য ৫৮ কিমি।

বিশ্বের হিমবাহ
হিমবাহ অবস্থান
সিয়াচেন হিমবাহ কাশ্মীর , ভারত
গঙ্গোত্রী হিমবাহ উত্তরকাশী জেলা , উত্তরখন্ড , ভারত

আর্সেনিক

আর্সেনিক হলো একটি ধাতব মৌলিক পদার্থ যা পানিতে দ্রবীভূত থাকলে সেই পানি ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক। এটি একটি অর্ধধাতু বা উপধাতু। আর্সেনিকের বহুরূপ বিদ্যমান। কিন্তু শুধু ধূসর রঙের আর্সেনিকেরই ধাতব ধর্ম রয়েছে। তাই , শিল্পক্ষেত্রে শুধু এই রূপটিই গুরুত্বপূর্ণ।

  • প্রতীক: As
  • পারমাণবিক সংখ্যা: ৩৩
  • আর্সেনিকের তিনটি রূপ আছে : আলফা , বিটা , গামা
  • বর্ণ: লালচে হলুদ ধূসর বর্ণের
  • এটি পানিতে সহজে দ্রবণীয়। ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরের ১০০ মিটার উচ্চস্তরের মধ্যে প্রধানত আর্সেনিকের কেন্দ্রীভবন ঘটে।
  • বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৬১টি জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
  • WHO এর মতে পানিতে ০.০১ ppm আর্সেনিকের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য।
  • বাংলাদেশের প্রতি লিটারে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য ০.০৫ মিলিগ্রাম যদিও WHO এর মতে তা ০.০১ মিলিগ্রাম।
  • বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণীয় মাত্রায় পাওয়া গেছে এমন এলাকাসমূহ প্রধানত দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল (লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর), দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল (কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর) এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশে (নবাবগঞ্জ) সীমাবদ্ধ, যা গঙ্গা ব-দ্বীপ সমভূমির অন্তর্ভুক্ত।
  • আঞ্চলিক প্রভাব: বাংলাদেশসহ ভারত, যুক্তরাষ্ট্র জাপান, সুইডেন, ভিয়েতনাম, চীন।

নদীভাঙন

নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি স্থানীয় ও পুনঃসংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদী যত পরিণত পর্যায়ে এগোতে থাকে (যেমন- তিন প্রমত্ত নদী। গঙ্গা, বহ্মপুত্র ও মেঘনার ক্ষেত্রে ঘটেছে) ততই সেগুলি মন্থর ও বিসর্পিল (meander) অথবা বিনুনি (braid) আকৃতির হয়ে থাকে। নদীর এ দোলন নদীতীরের ব্যাপক ভাঙন সংঘটিত করে। প্রতিবৎসর এদেশের লক্ষ লক্ষ অধিবাসী নদীভাঙনের শিকার হয়। মাঠের শস্য, ক্ষেত ও বসতভিটার ভূমি বিলীন হয়ে যায় নদীভাঙনের মাধ্যমে। বন্যা মৌসুমে দেশের উল্লেখযোগ্য নদীতে পাড়ের ভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপ অনুযায়ী দেশের ১৬টি নদীতে ২৫৪টি স্থানে উল্লেখযোগ্য নদীভাঙন লক্ষ্য করা গেছে। হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশের সর্বমোট প্লাবনভূমির প্রায় ৫% ভূমি প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের কবলে পড়ছে। পাবর্ত্য অঞ্চলের নদীসমূহের সাধারণত নিম্নক্ষয় হয়। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ার শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা প্রতি বছর ব্যাপক ভাঙনের কবলে পতিত হয়।

  • নদীভাঙন বেশি হয়- বর্ষাকালে।
  • বাংলাদেশে নদীভাঙন হয় - ১০০টি উপজেলায়।
  • প্রতি বছর নদী ভাঙলে ক্ষতি হয়- ২০০ কোটি টাকা।
  • নদী শিকস্তি- নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত জনগণ।
  • নদী পয়স্তি - নদীর চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ।
  • নদীভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রন্থ জেলা- সিরাজগঞ্জ ও চাঁদপুর।
  • প্রতিবছর বাংলাদেশে ভাঙ্গন প্রবণতা দেখা যায় প্রায় ৪০ টি নদীতে

মৃত্তিকা ক্ষয়

মৃত্তিকা ক্ষয় পৃষ্ঠ মৃত্তিকার ভৌত অপসারণ। বিভিন্ন প্রকার এজেন্ট, যেমন-বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা পরিলেখের উপর ও মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানি, বাতাসের বেগ এবং অভিকর্ষীয় টান দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে থাকে। ভূতাত্ত্বিক এবং ত্বরিত (accelerated) ক্ষয় দ্বারা বৈসাদৃশ্যমূলক মৃত্তিকা অপসারণকে বুঝায়। ভূ- তাত্ত্বিক অন্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা মানুষের প্রভাব ব্যতীত প্রাকৃতিক পরিবেশে ভূমির ক্ষয়সাধন করে। এটি একটি ধীর গতিসম্পন্ন ও গঠনমূলক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে পানি দ্বারা ক্ষয়ের মাধ্যমে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক বিস্তৃত মৃত্তিকা অবনয়ন ঘটে, যা দেশের ২৫ শতাংশ কৃষিভূমিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকারের মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে। যেমন- পরতে পরতে ভূমিক্ষয় (Sheet Erosion), জলনালিকা (Rill) ও নালায় (Gully Erosion) ভূমিধ্বস, নদীতটীয় ভূমিক্ষয়, উপকূলীয় ভূমিক্ষয়। দেশের প্রায় ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর পাহাড়ি এলাকায় ত্বরিত মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BARI) রামগতি স্টেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতি বছর মোট মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ ২.০ থেকে ৪.৭ টন/ হেক্টর। মৃত্তিকা ক্ষয় ব্যবস্থাপনা কতকগুলো মতবাদের ওপর ভিত্তিশীল:
(ক) ত্বরিত ভূমিক্ষয় রোধ করতে অত্যধিক ক্ষয়যোগ্য বা সংবেদশীল মৃত্তিকাকে অবশ্যই সুরক্ষা করতে হবে।
(খ) সুপ্ত উৎপাদনশীল মৃত্তিকা উর্বরতা অব্যাহত রাখতে যথাযথভাবে মৃত্তিকাকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে এবং
(গ) ক্ষয়ে যাওয়া মৃত্তিকাকে অবশ্যই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং একই সঙ্গে এসব মৃত্তিকার অবনয়নকে নিবারিত করতে হবে।

ভূমিধ্বস

ভূমিধ্বস (Landslide) বাংলাদেশের দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় একটি সাধারণ ঘটনা, বিশেষত বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট উভয় ভাবে ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটে। খাড়া পাহাড়ি ঢালে ঝুম চাষ এবং অন্যান্য চাষাবাদ পদ্ধতির প্রভাব, ভূমিধ্বস সংঘটনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাহাড় কর্তন ভূমিধ্বসের অপর একটি প্রধান কারণ। 1997 সালে জিআইএস (Geographical Information System) পদ্ধতি ব্যবহার করে খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় ১৬০টি ভূমিধ্বসপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়।

ভূমিধ্বসের কাললিপি :

  • ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামে বৃষ্টিজনিত ভূমিধ্বসে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটে।
  • ২০১০ সালের ১৫ জুন ভূমিধ্বস এবং বন্যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে কমপক্ষে ৫৩ জনের প্রাণহানি ২০১০ ঘটে।
  • ২০০৯ সালের ১৮ মে বৃষ্টিজনিত ভূমিধ্বসে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারে ৬ জনের প্রাণহানি ঘটে ।
  • ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে বৃষ্টিজনিত ভূমিধ্বসে অন্তত ১২২ জনের প্রাণহানি ঘটে।
  • ২০০৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রামে ৫.৯ মাত্রীর ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে কক্সবাজারে ৬ জনের প্রাণহানি ঘটে ।
  • ১৯৯ সালের ১১ ও ১৩ আগস্ট যথাক্রমে বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও চট্টগ্রামে দুটি বড় ভূমিধ্বসে ১৭ ব্যাক্তি নিহত হয়।

ভূমিধ্বসের প্রকার, কারণ ও প্রকৃতি

বাংলাদেশে ভূমিধ্বস সংঘটনের প্রকৃতি ও প্রক্রিয়াদি সমূহ হচ্ছে :

  1. পার্শ্বিক সমর্থনের (lateral support) অপসারণ, যার মধ্যে রয়েছে
    (ক) পাহাড়ি নদী কর্তৃক পার্শ্বক্ষয়,
    (খ) পূর্ববর্তী ঢাল বিচলন, যেমন- স্থলন (slum), যা নতুন ঢালের সৃষ্টি করে,
    (গ) মানুষ কর্তৃক ঢালের পরিবর্তন, যেমন- পাহাড় কাটা, গর্ত করা বা খাল খনন:
  2. ঢালে ওজন বৃদ্ধি, যার মধ্যে রয়েছে-
    (ক) বৃষ্টির পানি জমা,
    (খ) গাছপালার বৃদ্ধি,
    (গ) কৃত্রিমভাবে শিলা বা গণ্ডশিলা নির্মাণ,
    (ঘ) ভবনাদি ও অন্যান্য কাঠামোর ভর,
    (ঙ) ছিদ্রযুক্ত পাইপ লাইন, পয়ঃপ্রণালী, খাল ও জলাধারের নিঃসারিত পানির ওজন।
  3. ভূমিকম্প,
  4. ভূ-অভ্যন্তরস্থ প্রচন্ড শক্তির কারণে পাহাড়সমূহের আঞ্চলিকভাবে একদিকে কাত হওয়া:
  5. ভূনিম্নস্থ সমর্থনের (underlying support) অপসারণ, যার মধ্যে রয়েছে-
    (ক) উজানভাগের পাহাড়ি নদীর স্রোতের দ্বারা নদীখাতের ক্ষয় এবং নদী ও তরঙ্গের দ্বারা কর্তন,
    (খ) কর্দমশিলার স্ফীতি এবং
  6. জুমচাষ।

অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ওপরের আলোচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও আরো অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- শৈতপ্রবাহ , লবণাক্ততা , হিমঝড় , বজ্রপাত , এল নিনো , লা নিনো , উষ্ঞপ্রবাহ ইত্যাদি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে থাকে । নিচে সেগুলো তুলে ধরা হল :

শৈতপ্রবাহ

শৈত্যপ্রবাহ অনেক সময় আমাদের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এর ফলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। শৈত্য প্রবাহ একটি আবহাওয়া সংক্রান্ত শব্দগুচ্ছ যা দ্বারা কোনো স্থানের বায়ুর তাপমাত্রার নিম্নগামীতাকে নির্দেশ করে থাকে। ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বাতাসের তাপমাত্রা দ্রুততার সাথে নেমে যাওয়াকেই শৈত্য প্রবাহ বলা হয়।

লবণাক্ততা

  • সাধারণভাবে মাটি ও পানিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে মাটি বা পানির লবণাক্ততা বলে।
  • সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মহাদেশীয় ভূ-ভাগ ও মিঠা পানিতে প্রবেশের মাধ্যমে এই দুর্যোগের সৃষ্টি হয় ।
  • লবণাক্ততার ফলে ভূমি উর্বরতা হারায়। ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রন্ত হয়। ফলবান বৃক্ষ আম, জাম, নারিকেল, মেহগনি প্রভৃতি ফলবান বৃক্ষের মৃত্যু ঘটায়।
  • মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হয়।
  • সমুদ্র তীরবর্তী ভূ-ভাগের দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।
  • আঞ্চলিক প্রকোপ : বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সমূয়।

হিমঝড়

  • হিমঝাড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে শীতপ্রধান দেশে আঘাত হানে। হিমঝড়ে তাপমাত্রা কম এবং বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে ।
  • গতিবেগ: ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বা তার অধিক।
  • তাপমাত্রা: ২৫° সেলসিয়াস বা ১৩" ফারেনহাইট।
  • স্থায়িত্ব : ৪ ঘন্টা
  • আঞ্চলিক প্রকোপ: যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় সবচেয়ে বেশি হয়।

বজ্রপাত

  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি (১৭ ই মে ২০১৬) বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর আগে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল ১২ টি।
  • বজ্রপাত দেশের ১৩তম প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
  • ২০১৭ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে।
  • বর্তমান বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশে।

এল নিনো এবং লা নিনা

  • এ শব্দ দুটো স্পেনের ভাষা থেকে আগত। এল নিনো শব্দের অর্থ বালক, লা নিনা শব্দের অর্থ বালিকা।
  • এই দুটো দুর্যোগ শীতল ও উষ্ণ বায়ু প্রবাহের পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন। এল নিনো উষ্ণ পর্যায় এবং লা নিনা শীতল পর্যায়।
  • লা নিনার সময় সমুদ্রে অনেক মাছ পাওয়া যায়। কেননা এ সময় সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা জলজ প্রাণীদের উপযোগী থাকে।
  • বিষুবরেখার অপরপাশ থেকে নেমে আসা উষ্ণ পানির স্রোতের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্ত করার জন্য ইকুয়েটর ও পেরুর জেলেরা এল নিনো শব্দের ব্যবহারের প্রচলন করে।

উষ্ণ প্রবাহ

  • সাধারণত গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে উষ্ণ প্রবাহ বলে। যা মানুষকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে এবং এই অবস্থা পাঁচ দিন বা তার বেশি সময় বিদ্যমান থাকে।
  • ২০০৩ সালে সৃষ্ট উষ্ণ প্রবাহের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
  • বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উষ্ণ প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে।

হাওড়ে মানবিক বিপর্যয়

  • সুনামগঞ্জে ভারী বর্ষণ শুরু হয় ২৭ মার্চ ২০১৭ থেকে। সেই সাথে সীমান্তের উপর থেকে নেমে আসে ব্যাপক পাহাড়ি ঢল। ঢলের পানিতে ভরে যায় সুনামগঞ্জের ছোট-বড় সব নদী। সেই ঢলের পানির তোড়ে একের পর এক ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায় এবং তলিয়ে যায় বোরো ধান।
  • সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হাওড়াঞ্চল ভারত থেকে নেমে আসা অতি বৃষ্টির ঢলে ভয়ানক দুর্গত হয়ে পড়ে। সুনামগঞ্জের পাশেই ভারতের মেঘালয় সীমান্ত অবস্থিত।
  • হাওড়ে ফসল চাষ শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে। সুনামগঞ্জের ফসলহানি ঘটে ছোট-বড় ১৫৪ টি হাওড়ে।
  • সুনামগঞ্জে আবাদ হয়েছিল মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে, তার মধ্যে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর তলিয়ে যায়। মোট ৬টি জেলায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির বোরো ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  • বন্যায় ৬টি জেলায় ৬২টি উপজেলায় ৫১৮টি ইউনিয়নের ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ অতি বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল।
  • হাওড়বেষ্টিত জেলা মোট সাতটি। এগুলো হলো সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নবীনতর পূর্বতন