এই মহাবিশ্বের সকল বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ সেটাই মহাকর্ষ কল । এই মহাকর্ষ বলের কারণে গ্যালাক্সির ভেতরে নক্ষত্ররা ঘুরপাক খায় কিংবা সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ঘোরে , পৃথিবীকে ঘুরে চাঁদ ঘোরে । পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যখন আমাদের উপর কাজ করে তখন সেটাকে আমরা বলি অভিকর্ষ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বল। এই অভিকর্ষ বল আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে , অর্থাৎ নিচের দিকে টেনে ধরে রেখেছে । যার জন্য আমরা পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ি না এবং আমাদের ওজনের অস্তিত্ব অনুভব করি । পদার্থ বিজ্ঞানের একটি চমকপ্রদ বল হচ্ছে মহাকর্ষ বল । ভর আছে সেরকম যেকোনো বস্তু অন্য বস্তুকে মহাকর্ষ বল দিয়ে আকর্ষণ করে । আমরা এই টিউটরিয়ালে মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বল নিয়ে আলোচনা করব । আলোচনার সুবিধার্থে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো ও উঠে আসবে ।
![শক্তির রূপান্তরের উদাহরণ](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjUT_r9UBjxMJnKTm3732J5E1H7nL_Zqsi1DkccspVevvwjILjcGa2S7A6wri-8fphaqB8LoVFZsiQGxCWZo99cWI2VOXV5WVZezZrOmTGH0DmdF2sneY_apQU5OX3rzogwBPmseLaarCt65afPcgQR2N5fJFz4ZDkD_eyWCEiJlS0CaUjWb87WJVm2D34/s1600-rw/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%20%E0%A6%93%20%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7.webp)
মহাকর্ষ কি
মহাবিশ্বের যে কোন দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে মহাকর্ষ বলে। আরো সহজভাবে বললে এই সৃষ্টিজগতের যে সকল বস্তুর ভর আছে তারা পরস্পরকে একটা নির্দিষ্ট বলে আকর্ষণ করে আর সেটাই হচ্ছে মহাকর্ষ বল । বস্তুর ভর হচ্ছে মোট পদার্থের পরিমাণ । যেমন- একটি আমগাছে অনেকগুলো আম আছে । আমগুলোর ভর নিশ্চয়ই আছে । কোন বস্তুর ভর না থাকলে সেটা কোন আকর্ষণ করবে না । এই আমগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করছে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে । অথবা চন্দ্র ও সূর্যের মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ বল ; পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে যে আকর্ষণ বল সেটা মহাকর্ষ বল । তাছাড়া গ্রহগুলো নক্ষত্রের আকর্ষণে নক্ষত্রের চারদিকে ঘোরে সেটা ও মহাকর্ষ বল ।
অভিকর্ষ কি
আমরা একটু আগে জেনেছি দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তা মহাকর্ষ বল নামে পরিচিত । কিন্তু দুটি বস্তুর মধ্যে একটি যদি পৃথিবী হয় এবং পৃথিবী যদি ঐ বস্তুটিকে আকর্ষণ করে তখন সেটাকে আর মহাকর্ষ বল বলে না । সেটাকে বলা হয় অভিকর্ষ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বল । অর্থাৎ অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বলের একটি অংশ মাত্র । আরো সহজভাবে বললে , পৃথিবী ও তার নিকটস্থ বস্তুর মধ্যে পৃথিবী তার নিজ কেন্দ্রের দিকে যে বলে ঐ বস্তুটিকে আকর্ষণ করে তাকে অভিকর্ষ বা মধ্যাকর্ষণ বলে। মূলত: অভিকর্ষ বল কোন বস্তুকে পৃথিবী তার নিজ কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে তাই অভিকর্ষ হল বস্তুর উপর কেন্দ্রমুখী বল। এই কারণে কোন বস্তুকে উপরে ছুড়ে দিলে সেটা আবার মাটিতে এসে পড়ে । এখানে পৃথিবী একটা বিরাট চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে । যতদূর পর্যন্ত পৃথিবীর এই আকর্ষণ বল বিদ্যমান ততদূর থেকেই কোনো বস্তুকে তার নিজ কেন্দ্রের দিকে টেনে আনে । এই অভিকর্ষ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণেই পৃথিবীর ঘূর্ণনকালীন সময়ে ও আমরা ছিটকে পড়ি না , পৃথিবী আমাদেরকে চুম্বকের ন্যায় ধরে রাখে । পাহাড়ে ওঠার সময় পৃথিবী আমাদের নিজের কেন্দ্রের দিকে যে আকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তা অভিকর্ষ বল । পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সাথে আবর্তিত হচ্ছে কেন্দ্ৰীয় আকর্ষণ তথা অভিকর্ষ বলের কারণে।
নক্ষত্রের গ্রহসমূহ তার চারদিকে ঘুরে: গ্রহ ও নক্ষত্রের আকর্ষণের জন্য ।
পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে আমরা ছিটকিয়ে পড়ি না: মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য।
বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সঙ্গে আবর্তিত হয়: মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য।
মহাকর্ষ সূত্র / মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্রের আবিষ্কারক: নিউটন ।
মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ এর মধ্যে পার্থক্য
মহাকর্ষ | অভিকর্ষ |
---|---|
এ মহাজাগতিক দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে মহাকর্ষ বল বলে । | কিন্তু দুটি বস্তুর মধ্যে একটি যদি পৃথিবী হয় তখন সেটাকে আর মহাকর্ষ বল বলে না । তখন সেটাকে বলে অভিকর্ষ বল । সহজ কথায় কোনো বস্তুর উপর পৃথিবীর আকর্ষণকেই অভিকর্ষ বল বলে । |
সব মহাকর্ষ বল অভিকর্ষ নয়। | অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বলের একটি অংশ । |
মহাকর্ষ বলের আকর্ষণ শক্তি কম। | অভিকর্ষ বলের আকর্ষণ শক্তি তুলানামূলক বেশি। |
মহাকর্ষ হলো বস্তুর উপর উর্দ্ধমুখী বল। | অভিকর্ষ হল বস্তুর উপর কেন্দ্রমুখী বল। |
মহাকর্ষীয় বলের মান ভর ও দূরত্বের উপর নির্ভর করে। | অভিকর্ষজ ত্বরণ ভরের উপর নির্ভর করে না। |
মহাকর্ষ বল না থাকলে সৌরজগত থেকে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ ছিটকে পড়ত । | অভিকর্ষ বল না থাকলে আমরা পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়তাম । |
মহাকর্ষ বলকে F = G . হিসাবে প্রকাশ করা যায়। যেখানে G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। | অভিকর্ষণ বলকে F = Mg হিসাবে প্রকাশ করা যায়। যেখানে g = অভিকর্ষজ ত্বরণ। |
উদাহরণ : চন্দ্র ও সূর্যের মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ বল । | উদাহরণ : চন্দ্র ও পৃথিবীর মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ বল । |
মহাকর্ষীয় বলের মান অসীম | পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষ বলের মান শূন্য |
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র
মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে।
এই আকর্ষণ বলের মান বস্তুকণাদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বল বস্তুদ্বয়ের সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।
যদি m1 ও m2 দুটি বস্তুকণার মধ্যবর্তী দূরত্ব d হয় এবং m1 ও m2
এর মধ্যকার আকর্ষণ বল F হলে মহাকর্ষ সূত্রানুসারে,
F = G .
এখানে G হল মহাকর্ষীয় ধ্রুবক।
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক : একক (1kg) ভরের দুটি বস্তুকণা একক (1 মিটার) দূরত্বে অবস্থান করে যে বল দ্বারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে তাকে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (G) বলে।
এর মান 6.673× অর্থাৎ, 1 kg ভরের দুটি বস্তুকে 1 মিটার দূরে স্থাপন করলে এরা 6.673× নিউটন বল দ্বারা পরস্পরকে আকর্ষণ করবে।
অভিকর্ষজ ত্বরণ / মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ
বস্তুতে অভিকর্ষ বল বা পৃথিবীর আকর্ষণ কর্তৃক যে ত্বরণ উৎপন্ন হয় তাই অভিকর্ষজ ত্বরণ। একে g দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যদি পৃথিবীর ভর M, মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G এবং পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্ব d হয় তবে
অভিকর্ষজ ত্বরণ g =
এখানে লক্ষণীয় যে, G এবং M ধ্রুবক, [ পৃথিবীর ভর M এবং G এর মান নির্দিষ্ট ]।
সুতরাং অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান d এর উপর নির্ভরশীল।
আবার পৃথিবীর কেন্দ্র হতে ভূপৃষ্ঠে স্থাপিত কোন বস্তুর দূরত্ব পৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান। সেক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে স্থাপিত কোন বস্তুর ক্ষেত্রে g এর মান পৃথিবীর ব্যাসার্ধের উপর নির্ভর করে। আমরা জানি-
(i) পৃথিবী সম্পূর্ণ গোল নয়, এর মেরু অঞ্চল সামান্য চাপা অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্র হতে মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R এর মান কম অর্থাৎ g এর মান বেশি। |
(ii) পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বিষুব অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R এর মান বেশি অর্থাৎ 'g' এর মান কম ।
এই 'g' এর মানের তারতম্যের কারণে স্থানভেদে বস্তুর ওজনে ভিন্নতা দেখা যায়।
অঞ্চল | g এর মান |
---|---|
মেরু অঞ্চল | |
বিষুব অঞ্চল | |
ক্রান্তীয় অঞ্চল |
মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ ভূ-পৃষ্ঠে সবচেয়ে বেশি। ভূ-পৃষ্ঠের সব জায়গায় এ আকর্ষণ বলের মান এক নয় । মেরু অঞ্চলে এ আকর্ষণ বলের মান সর্বাধিক, বিষুব অঞ্চলে সবচেয়ে কম। ভূ-কেন্দ্রে এর মান শূন্য। ভূ- পৃষ্ঠ থেকে উপরে বা নিচে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ভূ-পৃষ্ঠের অভিকর্ষজ ত্বরণের মানের থেকে কম। অভিকর্ষজ ত্বরণ এর আদর্শমান হল . হিসেবের সুবিধার জন্য এই আদর্শমান ধরা হয় বা .
অভিকর্ষজ ত্বরণের মান: ভূ-পৃষ্ঠে বিভিন্ন স্থানে g এর মান বিভিন্ন বলে 45° অক্ষাংশে সমুদ্র সমতলে g এর মানকে আদর্শ মান ধরা হয়। g এর আদর্শ মান হচ্ছে 9.81 মিটার/ সেকেন্ড।
পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান কত: শূন্য (০ মি./সে.)।
অভিকর্ষজ ত্বরণ সর্বোচ্চ কোথায়: ভূ-পৃষ্ঠে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় বা নীচে নামা যায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান তত কমতে থাকে ।
ভূ-পৃষ্ঠের কোথায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সবচেয়ে কম: বিষুবীয় অঞ্চলে ।
বিষুবীয় অঞ্চলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সর্বনিম্ন, কারণ --
[ক] বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সবচেয়ে বেশি।
[খ] বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি সবচেয়ে বেশি।
ভূ-পৃষ্ঠের কোথায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সবচেয়ে বেশি: মেরু অঞ্চলে।
মেরু অঞ্চলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সর্বোচ্চ, কারণ --
[ক] মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সবচেয়ে কম ।
[খ] মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।