মূল্যবোধ কি? এর উৎপত্তি , বৈশিষ্ট্য , শ্রেণিবিভাগ এবং উপাদানসমূহ

মূল্যবোধ হলো - মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। মূল্যবোধ হলো অকৃত্রিম ও অর্জিত আপোষহীন নীতি যা দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এটি জীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে এবং ব্যক্তি ও সমাজের যথাযথ সম্পর্ক নির্ণয় করে। সমাজের সদস্যদের আচরণগত ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করে, অখন্ডতা ও সংহতি বজায় রেখে উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌছতে সাহায্য করে মূল্যবোধ। মূল্যবোধের উপাদান হলো নীতি, মান ও বিশ্বাস। এসব উপাদান ব্যক্তি, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের অবস্থায় স্পষ্ট করে; ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ, ন্যায়পরায়ণতা ও নৈতিকতার বিচার করে এবং নৈতিক অধিকারের ভিত্তিতে কাজের দিক নির্দেশনা প্রদান করে। স্থান, কাল পাত্রভেদে মূল্যবোধ বিভিন্ন রূপ হয়। মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মূল্যবোধের ও পরিবর্তন ঘটে।

 মূল্যবোধ

মূল্যবোধের সংজ্ঞা

সহজ ভাবে বলা যায়, ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের যে ধারণা তার নামই মূল্যবোধ। যে গুণের মাধ্যমে মানুষ 'ভুল' ও 'শুদ্ধ' এর পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারে তাই মূল্যবোধ। দৈনন্দিন ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সমস্ত নীতিমালা দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়, তার সমষ্টিকে মূল্যবোধ বলে। সামাজিক মূল্যবোধ সমাজজীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে এবং সমাজের যথাযথ সম্পর্ক নির্ণয় করে।

  • স্টুয়ার্ট, সি.ডড বলেন- "মূল্যবোধ হলো ঐ সমস্ত রীতি-নীতির সমষ্টি যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।"
  • ,এম. আর উইলিয়াম এর মতে- "মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। যার আদর্শে মানুষের ব্যবহার ও রীতি-নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সমাজে মানুষের কাজের ভাল-মন্দ বিচার করা হয়।'
  • এইচ, ডি, স্টেইন বলেন- "জনসাধারণ যার সম্বন্ধে আগ্রহশীল, যা তারা কামনা করে, যাকে তারা অত্যাবশ্যক বলে মনে করে, যার প্রতি সকলের অগাধ শ্রদ্ধা আছে এবং যা সম্পাদনের মাধ্যমে তারা আনন্দ উপভোগ করে তাকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।"
  • নিকোলাস রেসার এর মতে- "সামাজিক মূল্যবোধ হলো সেই সব গুণাবলি যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে মূল্যবান মনে করে আনন্দিত হয়।"

মোটকথা, মূল্যবোধ হলো সামাজিক শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি মানবিক সুকুমার বৃত্তির সমষ্টি।

মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য

  • সামাজিক মাপকাঠি: মানুষের কর্মকাণ্ডের ভালো-মন্দ বিচার করার ভিত্তিই হচ্ছে মূল্যবোধ। মূল্যবোধ মানুষের আচার-ব্যবহার, ধ্যান-ধারণা, চাল-চলন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার মাপকাঠি স্বরূপ।
  • যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন: মূল্যবোধ সমাজের মানুষকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। একই রীতি-নীতি, আচার- অনুষ্ঠান ও আদর্শের ভিত্তিতে সমাজের সকলে পরস্পর মিলিত ও সংঘবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করে।
  • নৈতিক প্রাধান্য: মূল্যবোধ আইন নয়। এর বিরোধিতা বেআইনি নয়। এটা মূলত একপ্রকার সামাজিক নৈতিকতা। মূল্যবোধের প্রতি সমাজে বসবাসকারী মানুষের শ্রদ্ধাবোধ আছে বলে মানুষ এটা মনে করে।
  • বিভিন্নতা: মূল্যবোধ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, দেশ জাতি, সমাজ ও প্রকৃতিভেদে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয় এবং স্থান, কাল, পাত্রভেদে মূল্যবোধের পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যেমন- পাশ্চাত্য দেশে মেয়েরা যে পোশাক পরে আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য সে পোশাক সমাজ কর্তৃক গ্রহণযোগ্য নয়।
  • বৈচিত্রময়তা ও আপেক্ষিকতা: মূল্যবোধ বৈচিত্রময় ও আপেক্ষিক। আজ যা মূল্যবোধ বলে পরিগণিত, কাল তা সেভাবে বিবেচ্য নাও হতে পারে।
  • পরিবর্তনশীলতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা: মূল্যবোধের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর পরিবর্তনশীলতা। সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজ অনুসৃত মূল্যবোধগুলোরও পরিবর্তন সাধিত হয়। অতীতের অনেক মূল্যবোধ বর্তমানে আমাদের কাছে অর্থহীন। যেমন- বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা। আবার বর্তমানের অনেক মূল্যবোধ ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। মূল্যবোধ নৈর্ব্যক্তিক।

মূল্যবোধের শ্রেণিবিভাগ

মূল্যবোধের স্তর ও অবস্থাভেদে একে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।

ব্যক্তিগত মূল্যবোধ: ব্যক্তিগত মূল্যবোধ হলো ব্যক্তির গুণ যা পরস্পরকে এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবেশকে প্রভাবিত করে।

নৈতিক মূল্যবোধ : নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তিকে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নির্ধারণে দিক-নির্দেশনা দেয়। নৈতিক মূল্যবোধ সমাজের ভিত। যার ওপর সমাজ মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজে কেউ কাউকে সহযেগিতা, শ্রদ্ধা ও মান্য করে না এবং শৃঙ্খলা থাকে না। বিশৃঙ্খল পরিবেশে মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হয়। নৈতিকতা সমৃদ্ধ জাতি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।

সামাজিক মূল্যবোধ: সমাজ জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যে সকল নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। সামাজিক মূল্যবোধ সামাজিক উন্নয়নের মানদণ্ড। সামাজিক ন্যায়বিচার, বড়দের সম্মান করা, দানশীলতা, শ্রমের মর্যাদা, সহমর্মিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, নীতি ও ঔচিত্যবোধ ইত্যাদি সমাজকে বিকশিত করে এবং সমাজকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলে।

রাজনৈতিক মূল্যবোধ: রাজনৈতিক মূল্যবোধ সুশাসনের মানদণ্ড। মূল্যবোধের প্রভাবে সহনশীলত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা, নাগরিক সচেতনতা এবং সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণকামিতা উজ্জীবিত হয় এবং নাগরিক জীবনের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ: সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাতির পরিচয়ের মানদণ্ড। উন্নত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রভাবে কোন জাতি বিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করে এবং সম্মানিত হয়। অপরপক্ষে অপসংস্কৃতির কারণে কোনো জাতির পরিচয় অন্ধকারে তলিয়ে যায়।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ : মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। একটি গণতান্তিক রাষ্ট্রে যেসব চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নির্বাচনি রায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা, সরকারকে নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ করতে দেয়া এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার গঠন ও পরিবর্তনে বিশ্বাসী করে তোলে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিককে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয়স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রাষ্ট্র , সরকার ও গোষ্ঠী কর্তৃক স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পরমতসহিষ্ণুতা । অন্যের মতকে সম্মান করাকে বলে পরমতসহিষ্ণুতা। যেকোনো বিষয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন মত থাকতে পারে। অধিকাংশ মানুষ যে মতটি সঠিক মনে করেন সেটিই গ্রহণ করা উচিত। এ প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্র বলে।

মূল্যবোধের ভিত্তি বা উপাদানসমূহ

  • ১) আইনের শাসন
  • ২) নীতি ও ঔচিত্যবোধ
  • ৩) সামাজিক ন্যায়বিচার
  • ৪) শ্রমের মর্যাদা
  • ৫) শৃঙ্খলাবোধ
  • ৬) সহমর্মিতা
  • ৭) সহনশীলতা
  • ৮) সরকার ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখিতা
  • ৯) নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ এবং
  • ১০) স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।

সহনশীলতা : মূল্যবোধ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সহনশীলতা। সহনশীলতা অন্যের মতামতকে ধৈর্য ধরে শ্রবণ এবং গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার যোগ্যতা তৈরি করে। উত্তেজনা প্রশমিত করে সুখী ও সুন্দর সমাজ গঠনে সাহায্য করে সহনশীলতা। যে দেশের মানুষ যত সহনশীল সে দেশ তত সুশৃঙ্খল এবং উন্নত ।

মূল্যবোধ এবং সুশাসনের সম্পর্ক

মুল্যবোধ ও সুশাসন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একে অপরের সহায়ক। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের বিকল্প নেই ।

সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলাবোধের উন্মেষ: মূল্যবোধ সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলাবোধের উন্মেষ ঘটায়। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ রক্ষা পায়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যক্তিস্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। সমাজজীবনে অগ্রগতির প্রধান সোপান হলো শৃঙ্খলাবোধ। শৃঙ্খলাবোধ মানবিক মূল্যবোধগুলোকে সুদৃঢ় করে সমাজজীবনকে উন্নতি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সামাজিক ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলাবোধ সুশাসনের ও বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োজনীয় উপাদান । যে সমাজ বা রাষ্ট্রে মূল্যবোধের এ উপাদান অনুপস্থিত সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: আইনের শাসন মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তি তার সামাজিক মর্যাদা খুঁজে পাবে এবং অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। আইনের শাসন সুশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও আবশ্যকীয় উপাদান। আইনের শাসন না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।

সামাজিক ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: মূল্যবোধ সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে এবং সমাজজীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে।

নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা: মূল্যবোধ মানুষের নৈতিক গুণাবলি জাগ্রত ও বিকশিত করে।

কর্তব্যবোধ জাগ্রত করা: কর্তব্যবোধ মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। কর্তব্যবোধ না থাকলে সুশাসন ও প্রতিষ্ঠিত হয় না। এজন্যই নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধকে নাগরিকের অন্যতম গুণ বলা হয়।

সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখিতা: সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখিতাকে মূল্যবোধের যেমন উপাদান মনে করা হয় তেমনি তা সুশাসনের ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান বা বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়।

জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে: জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাকে যেমন সুশাসনের বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয় তেমনি তা মূল্যবোধেরও আবশ্যকীয় উপাদান মনে করা হয়।

মূল্যবোধের উৎপত্তি ও বিকাশ

মূল্যবোধ হলো মানুষের ভিতরের নৈতিক গুণাবলী। মানুষের আচরণ তার নৈতিক গুণাবলি বা মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় । মানুষ পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ থেকে মূল্যবোধের শিক্ষা পায়। মানুষের নৈতিক জীবন ও নৈতিকতার মূল ভিত্তি হল পরিবার থেকে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ। জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ যে নৈতিক মূল্যবোধ লালন ও অনুসরণ করে তার উৎস হলো পরিবার।

  • শিশুর মূল্যবোধ শিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হলো পরিবার।
  • মূল্যবোধের প্রধানতম প্রাতিষ্ঠানিক উৎস শিক্ষালয়।
  • গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো সামাজিক ন্যায়বিচার।
  • সামাজিক ন্যায় বিচারের মূলকথা হলো আইনের চোখে সকলের সাম্যতা।
  • মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিকাশে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাব বিস্তার করে- ধর্ম।
  • সংগঠন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে কিছু লিখিত বা অলিখিত নিয়ম-কানুন থাকে, যেগুলো ব্যক্তির মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
  • কোনটি সমাজের জন্য ভালো এবং কোনটি মন্দ মানুষকে তার নির্দেশনা দান করে আইন।
  • নাগরিকের অধিকারকে সংরক্ষণ করে আইনের শাসন।
  • মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ ছাড়া।
  • বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।
  • সামাজিক মূল্যবোধের প্রধান উৎসসমূহ হলো প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, ধ্যান ধারণা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি।
  • নৈতিক মূল্যবোধের প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রধান উৎস হলো ধর্ম। মানুষ ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনে, কাজ-কর্ম করার ক্ষেত্রে, খাদ্য গ্রহণে, পোশার পরিচ্ছেদে, কোথায় কী আচরণ করবে ধর্ম তার দিক নির্দেশনা ও শিক্ষা দেয়।
  • মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবনে মূল্যবোধ গঠনের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে সংবিধান।
  • সভা-সমিতি, সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মধ্যে মূল্যবোধ জাত হয় ।

মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং পরিণতি

মূল্যবোধের অভাব বা অনুপস্থিতিকে বলা হয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটলে সমাজে এর অনেক বিরূপ প্রভাব পড়ে। যা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খল দেখা দেয়। ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। মূল্যবোধ একটি দেশের নৈতিক শক্তি এর অভাবে অতীতে অনেক জাতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। এর অনুপস্থিতি পরিবার, সামাজ ও বাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তা নষ্ট করে ফেলে। তাছাড়া এর অভাবজনিত কারণে মানুষ আত্মাপরিচয় বিস্মৃত হয় এবং নিজের আত্ম মর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলে, ফলে জাতি দিক ভ্রান্ত হয়। মূল্যবোধে অবক্ষয়ের মাধ্যমে একটা দেশ ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে পারে, ধ্বংসের অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে যেতে পারে , পৃথিবীর সভ্য দেশের মানচিত্র থেকে। আবার অবস্থার উন্নতির মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারে একটা আধুনিক সভ্য ও উন্নত জাতি ও রাষ্ট্রে। দারিদ্র, জনসংখ্যার আধিক্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি অশিক্ষা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক কারণ, অসম বণ্টন ব্যবস্থা, পারিবারিক কারণ, প্রেমে ব্যর্থতা, সঙ্গদোষ অনুকরণ, চলচ্চিত্র ও স্যাটেলাইট চ্যানেল, সেশনজট, ভৌগলিক কারণ সহ প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশে জনগণের মূল্যবোধের অভাব ঘটেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় এমন একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি যা সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে এর প্রভাব লক্ষণীয়। মূল্যবোধের অভাবে মানুষের নৈতিকতা ও ঔচিত্যবোধের বিলুপ্তি ঘটে যা সমাজের প্রভূত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মূল্যবোধের অভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পায়। যেমন- ইভ-টিজিং পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি। ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে মানুষের মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয় এব বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে।

আমাদের জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতীয় সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও অবনতির ফলে জনজীবন আজ অতিষ্ট। অফিস আদালত সর্বত্রই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারণা যত বেশি উন্নত, সে সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি উন্নত ও প্রগতিশীল। যে চিন্তা ভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি।

বাংলাদেশের জনগণই নয়, বিদেশি পাতা গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক সংগঠনগুলোও এই সমস্যার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং এর হ্রাসকল্পে তারা সরকারকে উপদেশ ও চাপ দুটোই প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এর উন্নতি তো দূরের কথা, দিন দিন এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এর পরিমাণ তুলনামূলক যথেষ্ট কম ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর এই সামাজিক অবক্ষয় চরমভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আজও এ ধারা ধীরে ধীরে বেগবান হচ্ছে। দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে স্বাধীনতা উত্তর কালে একাধিক কারণে বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধের পূর্ণ অবক্ষয় ঘটেছে-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সাম্প্রতিক কালে এর ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতা জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারাকে ব্যাহত করছে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে এ সমস্যার প্রতিকার খুবই জরুরি।

মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে করণীয়

সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর যথেষ্ট নজর দিতে হবে। সহায় সম্বলহীন লোকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বেকারদের বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে উৎপাদনমুখী করে নিয়োগ করতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, মূল্যবোধ বৃদ্ধি করার জন্য গ্রাম উন্নয়ন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি হ্রাস, বেকারত্ব হ্রাস, রাজনৈতিক অঙ্গীকার, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি ঘটাতে পারলে আমাদের সমাজের মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। তাছাড়া সম্পদের সুষম বন্টন, সাংস্কৃতিক অবাধ প্রসার রোধ এই মূল্যবোধ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। সংস্কৃতি তথা বিনোদনের নামে স্যাটেলাইটের কিছু চ্যানেল আমাদের যুব সমাজ থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত সবার মধ্যে যৌন উদ্দীপনা তথা বিকৃতির সৃষ্টি করছে যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণসহ মারাত্মক সামাজিক অপরাধ সমূহ। এক হিসাবে জানা গেছে, ডিশ এন্টেনা আমদানির পর ধর্ষণের পরিমাণ আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেছে। তাই নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষামূলক এবং সপরিবারে দেখার মতো চ্যানেল রেখে বাকি চ্যানেল বন্ধের ব্যাপারে সরকারকে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। পিতা মাতাকে সন্তান সন্ততির ব্যাপারে আরো বেশি খেয়াল রাখতে হবে। সন্তান সন্ততি যেন পাড়ার বখাটে ছেলেমেয়েদের সাথে না মেশে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ সন্তানদের গতিবিধির ওপর পিতামাতার কড়া নজর রাখতে হবে। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বোধ জাগ্রত করতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের বিবেকের রক্ষাকবচ।

শিক্ষা

শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই শিক্ষা লাভের ধরনও ভিন্ন হয়। বাংলায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে 'শাস' ধাতু থেকে যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা ।

Education শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে- ল্যাটিন শব্দ Educare বা Educere অথবা Educatium থেকে।

  • Educare শব্দের অর্থ হলো- প্রতিপালন বা পরিচর্যা করা, Educere শব্দের অর্থ হলো- নিষ্কাশন করা এবং Educatium শব্দের অর্থ হলো- শিক্ষাদানের কাজ করা।
  • শিক্ষা শব্দের আরেকটি প্রতিশব্দ হলো- 'বিদ্যা' যার অর্থ জ্ঞান আহরণ, কৌশল আয়ত্তকরণ বা কৌশলগত দক্ষতার প্রণয়ন।
  • রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- "শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।"
  • সক্রেটিসের ভাষায়- "শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ"
  • পৃথিবীর প্রথম শিক্ষা গুরু বলা হয়- সক্রেটিসকে।
  • 'সু-অভ্যাস গঠনের নামই শিক্ষা'- রুশো।
  • 'পরিপূর্ণ জীবন বিকাশই হলো শিক্ষা'- হার্বাট স্পেনসার।
  • "শিক্ষা হচ্ছে দেহ, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ ও সুষম বিকাশ"- মহাত্মা গান্ধী।
  • "শরীর ও আত্মার সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনই শিক্ষার লক্ষ্য"- প্লেটো।
  • 'শিশুর নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী দেহ মনের পরিপূর্ণ ও সার্বিক বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষা'- প্লেটো।
  • "শিশুর সুপ্ত ব্যক্তিত্বকে জাগ্রত ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করাই শিক্ষার লক্ষ্য"- মন্টেসরি।
  • "শিক্ষা সে প্রক্রিয়া যার শেষ কথা মানুষের মুক্তি"- উপনিষদের বাণী।
  • শিশুর প্রথম শিক্ষালয় - পরিবার।
  • শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যসমূহ জ্ঞানার্জন, বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন, সুনাগরিক গড়ে তোলা, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিকাশ সাধন, চরিত্র গঠন, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণ ইত্যাদি।

শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন।

শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

  • ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়।
  • শিক্ষার চরম ও পরম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আদর্শ জীবনের অধিকারী তথা মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলা। যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমেই সামাজিক জীবনে মানবিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। যার মাধ্যমে মানুষের জীবনে নানাবিধ উন্নতি সাধিত হয়।
  • সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা শব্দটি- মানুষের কর্মোপযোগী জ্ঞান ও কলাকৌশল অর্জনের প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে।
  • ব্যাপক অর্থে মানুষকে শুধু জীবনমুখী কর্মদক্ষতা বা কর্মকৌশল দানই নয় বরং মানব জীবনের সবদিকের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ বা আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে তোলাই হচ্ছে শিক্ষা।
  • আধুনিক ধারণা অনুযায়ী শিক্ষা হলো- সার্বজনীন আচরণের কাঙ্খিত, বাঞ্ছিত এবং স্থায়ী পরিবর্তন।
  • শিক্ষাকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা।
  • স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইতাদি প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক ভাবে যে শিক্ষা প্রদান করা হয় তা-ই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা।
  • জন্ম থেকে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত মানুষ বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা অর্জন করে তা হলো- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ।
  • কর্মজীবনে বা অন্যকোন ক্ষেত্রে মানুষ বিশেষ দক্ষতা বা কর্মকৌশল অর্জনে যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা।
  • মানুষ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি ক্ষণে শিক্ষা অর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।

মূল্যবোধ শিক্ষা

মূল্যবোধ শিক্ষা হচ্ছে শিষ্টাচার, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ ও সৌজন্যবোধ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির শিক্ষা।

  • শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধ বা জীবনাদর্শ সমন্বয়ে যে শিক্ষার ধারণা উদ্ভব তাই- মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের মধ্যে সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের ধারণা জাগ্রত করে।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির বোধ জাগ্রত করে।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের- নৈতিকতাবোধের উন্নয়ন ঘটে।
  • ব্যক্তির মধ্যে মানবীয় মমত্ববোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ইত্যাদি মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে জাগ্রত হয়।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা নয় বরং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতেই মূল্যবোধ শিক্ষার উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
  • মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে- মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
  • প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বিভিন্ন সংগঠন এবং সংস্থা মূল্যবোধ শিক্ষা প্রদান করতে পারে।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার ধারণাটি প্রধানত- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ।
  • মানুষ স্বভাবতই আবেগপ্রবণ, তাই মূল্যবোধ শিক্ষার উপায় হিসেবে ব্যক্তির আবেগিক প্রবণতাকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে হয়।
  • মূল্যবোধ শিক্ষামানুষের মধ্যে সত্য, সুন্দর, ভাব ইত্যাদি যথার্থ উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার নির্ধারকসমূহ হলো- সামাজিক রীতিনীতি, আইন, ঐতিহ্য, ইতিহাস, প্রথা, বিশ্বাস ইত্যাদি।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে- ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে যেসব মৌলিক গুণাবলীর বিকাশ সাধিত হয় সেগুলো হলো- আত্মমর্যাদাবোধ, সত্যবাদিতা, অহিংসা, কঠোর শ্রম, সাম্য, ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিকবোধ, সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ, সাহস, দেশপ্রেম, সহযোগিতা, দায়িত্বশীলতা, সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, উৎপাদনশীলতা ও কাম্য জনসংখ্যার ধারণা ইত্যাদি।
  • ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থাকে নানামুখী সংকট ও অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই মূল্যবোধ শিক্ষার ধারণার উদ্ভব।

মূল্যবোধ শিক্ষার গুরুত্ব

মূল্যবোধ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ ও বাষ্ট্র এর সুফল লাভ করে। আবার মূল্যবোধের অভাবে রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হয়। যে শিক্ষার মাধ্যমে ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকৃত, মমত্বপূর্ণ, মানবীয়, আদর্শিক ও কাঙ্খিত আচরণ অনুশীলনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাই হলো মূল্যবোধ শিক্ষা। ব্যক্তির মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধ দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ইতাদি মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে জাগ্রত হয়। মূল্যবোধের শিক্ষা মানুষের মধ্যে নৈতিক ও ঔচিত্যবোধের বিকাশ ঘটায় বা মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ উচিত অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। যাব ফলে ব্যক্তি নিজের ভালো বা মঙ্গল করার চেষ্টা করে। মূল্যবোধ শিক্ষা আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা নয় বরং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতেই মূল্যবোধ শিক্ষার উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বিভিন্ন সংগঠন এবং সংস্থা মূল্যবোধ শিক্ষা প্রদান করতে পারে। মূল্যবোধ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে যে সব মৌলিক গুণাবলীর বিকাশ সাধিত হয় সেগুলো আত্মমর্যাদাবোধ, সত্যবাদিতা, অহিংসা, কঠোর শ্রম, সাম্য, ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিকবোধ, সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ, সাহস, দেশপ্রেম, সহযোগীতা, দায়িত্বশীলতা, সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, উৎপাদনশীলতা, কাম্য জনসংখ্যার ধারণা ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অন্যতম রক্ষাকবচ ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠা করে মূল্যবোধ। মূল্যবোধের শিক্ষা মানুষের সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে, যা তাদেরকে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে সাহায্যে করে। আইনের শাসন মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে ও রাষ্ট্রে সুশাসন বিরাজ করে। মূল্যবোধের উপস্থিতি সরকার ও রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমুখী করে। জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মূল্যবোধের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় যা সুশাসনের জন্য অপরিহার্য।

মূল্যবোধ শিক্ষার উদ্দেশ্য

আধুনিক শিক্ষা চিন্তাবিদদের মতে, মূল্যবোধ শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হবে ব্যক্তির মধ্যে নৈতিকতার নিরিখে এমন সব গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা যা তাদেরকে সৎ, সাহসী ও আদর্শ নাগরিক হতে সাহায্য করবে। মূল্যবোধ শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো নিচে দেওয়া হলো-

  • একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে- মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • সামগ্রিক শিক্ষার লক্ষ্যেরই একটি অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে- মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • প্রচলিত শিক্ষার আদর্শিক লক্ষ্যের একটি প্রধান দিক হলো- মূল্যবোধ শিক্ষা।
  • ব্যক্তির মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির মনোভাব জাগ্রত হয়- মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে ।
  • মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি মূল্যবোধ।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার প্রধানতম লক্ষ্য- সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা।
  • ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হতে সাহায্য করা- মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
  • মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, স্বদেশের প্রতি, পরিবেশের প্রতি, সকল ধর্মের প্রতি সঠিক ও যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে।
  • চিন্তা, কর্মে ও অভ্যাসে ব্যক্তিকে উদার, সহনশীল করা এবং ধর্ম, ভাষা ও জাত-পাতের ঊর্ধ্বে তাদের বুদ্ধির মুক্তিলাভে সাহায্য করা- মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

মূল্যবোধ শিক্ষার উপাদানগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠা

মূল্যবোধের শিক্ষা মানুষ প্রতিনিয়তই গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া ও বিভিন্ন উপায়ে মূল্যবোধ শিক্ষার উপাদানগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যায়। যেমন-

  • ১) মূল্যবোধের শিক্ষা অন্তরে পোষণ ও মূল্যবোধকে পুরস্কৃত করা।
  • ২) চিন্তার স্বাধীনতা ও বাছাইয়ের ক্ষমতা প্রদান।
  • ৩) পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, বিদ্যালয়ের শিক্ষক সম-স্থানীয় ব্যক্তি এবং প্রতিবেশীদের সাথে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে।
  • ৪) ইতিবাচক চিন্তা করা।
  • ৫) সহাবস্থানের শিক্ষা লাভ করা।
  • ৬) মানব মর্যাদাকে সম্মান করা ।
  • ৭) সত্যবাদিতার শিক্ষা প্রদান করা ।
  • ৮) সমাজের বৃহত্তম ক্ষেত্রে যোগাযোগ করে। যেমন- গণমাধ্যম ও কর্মস্থান।
  • ৯) বুদ্ধিবৃত্তির চিন্তার উন্নতি করা।
  • ১০) সম্প্রদায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
  • ১১) পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করা।
  • ১২) শিক্ষা ও নৈতিকতা গল্পের মাধ্যমে মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করা।
  • ১৩) নিজের এবং অন্যদের ব্যক্তিগত আচরণের পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করা ।

মূল্যবোধ শিক্ষা ও সুশাসনের সম্পর্ক

মূল্যবোধ শিক্ষার সাথে সুশাসনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সমাজ জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড যেসব নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে মূল্যবোধ বলে। এগুলো নিম্নরূপ-

  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সুশাসনের অন্যতম উপাদান, আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিয়ামর শক্তি হিসেবে কাজ করে- মূল্যবোধ শিক্ষা ।
  • জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাকে যেমন সুশাসনের বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা হয় তেমনি তা মূল্যবোধেরও আবশ্যকীয় উপাদান মনে করা হয়।
  • কর্তব্যবোধ মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান, কর্তব্যবোধ না থাকলে সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হয় না। এজন্যই সচেতনতা ও কর্তব্যবোধকে নাগরিকের অন্যতম গুণ বলা হয়।
  • সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সার্থক জীবন যাপনের নিশ্চয়তার বিধান করা- মূল্যবোধ ও সুশাসন উভয়েরই লক্ষ্য।
  • রাষ্ট্রনায়কদের মূল্যবোধের অভাব থাকলে কখনো সম্ভব হয় না- সুশাসন প্রতিষ্ঠা।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের নৈতিক গুণাবলী জাগ্রত ও বিকশিত করতে সাহায্য করে। আর নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা ছাড়া সুশাসন কাল্পনিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
  • সুশাসন ও মূল্যবোধ শিক্ষার ধারণা উভয়ই- মানবজাতির জন্য ইতিবাচক।
  • সরকার ও রাষ্ট্রীয় জনকল্যাণমুখীতা উভয়ই মূল্যবোধ ও সুশাসনের উপাদান।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা ও সুশাসনের ধারণা পরস্পরের সম্পূরক।
  • মূল্যবোধের যথার্থ উপস্থিতি ব্যতিরেকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় সুশাসন।
  • মূল্যবোধ শিক্ষা ব্যক্তিকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে সুশাসনে ভিতকে- মজবুত করে ।
  • বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মূল্যবোধ শিক্ষার।
  • আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবনে যে অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে তা থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করতে পারে- মূল্যবোধ শিক্ষা।

জাতীয় উন্নয়নে মূল্যবোধ শিক্ষা ও সুশাসনের প্রভাব

জাতীয় উন্নয়নে মূল্যবোধ শিক্ষা ও সুশাসনের প্রভাবগুলো নিম্নরূপ-

  • ১) মূল্যবোধ সুশাসন জাতীয় জীবনে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে।
  • ২) সামাজিক বৈষম্য দূর করে।
  • ৩) মূল্যবোধ ও সুশাসন সামাজিক উন্নয়নের মানদণ্ড।
  • ৪) মূল্যবোধ মানুষের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে উন্নত করে।
  • ৫) মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি ও টেকসই জীবনযাত্রার উন্নতিতে ভূমিকা রাখে।
  • ৬) শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
  • ৭) পারস্পরিক সম্পর্ক, আচরণ, পছন্দ ও স্ব-চেতনাকে আকার প্রদান করে। ইতিবাচক মূল্যবোধ ইতিবাচক কার্যফল প্রদান করে।
  • ৮) পরিবার, সামাজ, জাতি এবং পৃথিবীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতার বোধ আত্মস্থ করতে সাহায্য করে।
  • ৯) মূল্যবোধ ও সুশাসন জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, জাতীয় সংহতি সমাজের উন্নতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে।
  • ১০) রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে।
  • ১১) শিশু ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে।
  • ১২) শিক্ষার্থীদের সফল পেশাজীবন পছন্দ করতে সাহায্য করে।
  • ১৩) মূল্যবোধ মানুষের সফলতার স্বপ্নের নোঙ্গর হিসেবে কাজ করে।
  • ১৪) মূল্যবোধ ও সুশাসনের প্রভাব জাতীয় জীবনে সহনশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।

মূল্যবোধ গঠনে সংস্কৃতি ও সভ্যতা

সংস্কৃতি (Culture) : সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Culture'। মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে, যেসব জিনিস ব্যবহার করে, যেসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, সব নিয়েই তার সংস্কৃতি। খাদ্য, বাসস্থান, তৈজসপত্র, যানবাহন, পোশাক, অলঙ্কার, উৎসব, গীতিবাদ্য, ভাষা-সাহিত্য, ধর্মীয় রীতি-নীতি, সঙ্গীত, নৃত্য সবই তার সংস্কৃতির অংশ। সংস্কৃতি হলো সার্বিক জীবন প্রণালি। সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, নীতি-প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমন্বয়ই হলো সংস্কৃতি। মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ তার সংস্কৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংস্কৃতি মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত আচরণটি শেখায়, তাই সংস্কৃতিই মূল্যবোধের চালিকা শক্তি।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : সংস্কৃতির মধ্যে আছে যেমন সামগ্রিকতার মানবাধিকার, তেমনি আছে তার কৃতিত্বময়তার দিক। যে জাতি জীবিত আছে, সে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে, জীবন্ত সংস্কৃতির বহমান রূপান্তর। যে জাতির ক্রমবিবর্তন নেই তার সংস্কৃতি মৃত, সে জাতিও মৃত। কারণ সংস্কৃতির মধ্যেই নিয়ত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় সমগ্র জাতির প্রাণের স্পন্দন।

ক্রমবর্ধনশীল আধুনিক প্রযুক্তির ফলে শহরাঞ্চলের প্রতি ঘরে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক জায়গায়ই এখন সহজলভ্য ডিশ এন্টেনার সংযোগ। রিমোট কন্ট্রোলের বাটন চেপে সেকেন্ডের মধ্যে নানা দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি অনুষ্ঠান অবলোকন করতে পারছে অজোপাড়া গাঁয়ের সাধারণ মানুষ। এতে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে দেশের মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্র যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মানুষের জ্ঞানের পরিধি। উল্টোদিকে, এক শ্রেণির অত্যাধুনিক (Ulttra Modern) মানুষের জীবন ধারণেও এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। আজ বাংলাদেশে আমরা বহিঃসংস্কৃতির আগ্রাসন ও প্রসারণ দেখতে পাই। এখানে আকাশ সংস্কৃতির বিকাশের মাধমে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা। সংস্কৃতির বিশ্বায়নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বহিঃসংস্কৃতির আগ্রাসন দেখা দেয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাথে নিয়মিত খাপ খাওয়ানোর দৌড়ে অংশ নিতে গিয়ে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বহিঃসংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ থুবড়ে পড়েছে ঐ সব বহিঃসংস্কৃতির কাছে।

শান্তির সংস্কৃতি : শান্তির সংস্কৃতি ধারণাটি সুনির্দিষ্টভাবে প্রথম মূর্তরূপ লাভ করে আইভরি কোস্টের এক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে। ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত মনোজগতে শান্তি (International congress on peace in the minds of men) শীর্ষক এই সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায়-ইউনেস্কোর প্রতি নিম্নোক্ত আহবান জানানো হয়। জীবন স্বাধীন, তা ন্যায়, সংহতি, সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার নারী পুরুষের ক্ষমতা প্রভৃতি সর্বজনীন মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে শান্তির সংস্কৃতি বিকাশ।

সভ্যতা : সভ্যতা বলতে মানব সমাজের একটি উন্নত পর্যায়কে বোঝায়। হেনরি মর্গান বলেন- মানব সমাজ বিবর্তিত হয়ে বর্তমান (সভ্যতা) রূপ ধারণ করেছে। সভ্যতা হলো, মানুষের বস্তুগত ও চিন্তা- গবেষণাগত ক্রিয়াকলাপের ফলাফল যা নির্দিষ্ট একটা সময়ের মাঝে কোনো একটি সমাজ তার আবিষ্কার ও অগ্রগতির মাধ্যমে প্রকাশ করে। সমাজ নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ কিছু মৌলিক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত, যা ছাড়া তার ধ্বংস অনিবার্য। পৃথিবীতে অতীতে যেমন বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান হয়েছিল সেসব জাতির বিশেষ গুণাবলীর জন্য, তেমনি নৈতিকতা ও সামাজিক চরম অবক্ষয়ের কারণে সেসব সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই সমাজকে সভ্যতার অন্যতম প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নবীনতর পূর্বতন