বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা

আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রের পরিবর্তে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে বেশি আগ্রহী। রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সরকারের সকল অঙ্গ সংগঠনের গঠন ও কার্যকলাপ নিয়ে যে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে তাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে। রাষ্ট্র- কাঠামোর উপর রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি আচ্ছাদন। রাজনৈতিক ব্যবস্থাই রাষ্ট্রকে সচল করে রাষ্ট্রের কাজ সম্পাদন করে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও তেমনি ; রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রের আচরণ আবর্তিত হচ্ছে । রাজনৈতিক দল হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের দর্পণস্বরুপ । রাজনৈতিক দলের আচরণের উপরই নির্ভর করে একটি রাষ্ট্র কতটা সফল বা ব্যর্থ ।

রাজনৈতিক দল

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল হচ্ছে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সেই অংশ যারা একটি আদর্শ বা কিছু নীতি বা কর্মসূচির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে সংগঠিত হয়। রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হল ক্ষমতায় গিয়ে দলের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা এবং নির্বাচনি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা। রাজনৈতিক দল সকল ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকলের স্বার্থে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি। বিশ্বে এমন ও দেশ আছে যেখানে রাজণৈতিক দলের অস্তিত্ব নেই। যেমন - সৌদি আরব। সেখানে রাজপরিবার ও এর পরিষদই সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। আবার কোথাও বা আইন করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়, যেমন: ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের দেশ উগান্ডায় সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল

সুতরাং বলা যায়, রাজনৈতিক দল এমন এক জনসংগঠন যার সদস্যগণ রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।

রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য

  • সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি : রাজনৈতিক দল হচ্ছে কতগুলো নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত একটি জনসমষ্টি।
  • ক্ষমতা লাভ: রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করা ।
  • সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচি: প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের একটি আদর্শ ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকে । আদর্শের দিক থেকে কোনো দল ধর্মভিত্তিক আবার কোনো দল ধর্মনিরপেক্ষ হয়। অন্যদিকে অর্থনীতির রূপরেখা বিবেচনায়ও দল ভিন্ন হতে পারে যেমন - সমাজতান্ত্রিক দল।
  • প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নেতৃত্ব: প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকে। কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত দলের শাখা বিস্তৃত থাকে। এছাড়া প্রত্যেক দলের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি থাকে। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্বারা দল পরিচালিত হয়।
  • নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ : আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা গণতান্ত্রিক অথবা একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।। একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার চেয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচনের গুরুত্ব অধিকতর। এ সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি, প্রার্থী মনোনয়ন, নির্বাচনে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, নির্বাচনি প্রচার ও ভোট সংগ্রহ দলের এবং দলীয় কর্মীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে।

রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন রূপ

সংখ্যার ভিত্তিতে দলীয় ব্যবস্থাকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্তি করা হয়- একদলীয় ব্যবস্থা, দ্বিদলীয় ব্যবস্থা এবং বহুদলীয় ব্যবস্থা।

১. একদলীয় ব্যবস্থা : কোনো দেশে যখন সাংবিধানিকভাবে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে, তখন তাকে 'একদলীয় ব্যবস্থা' বলে। একদলীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানিতে হিটলারের 'নাৎসিদল', ইতালিতে মুসোলিনীর 'ফ্যাসিস্ট দল' এবং ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদী একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তি পূজা এবং উগ্র ধনতান্ত্রিক শোষণ-নির্যাতন চলতে থাকে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এর লক্ষ্য হলো শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা । নিচে একদলীয় ব্যবস্থার কিছু গুণ উল্লেখ করা হল:

  1. একদলীয় ব্যবস্থায় ঘন ঘন সরকার বদল হয় না। সরকার স্থিতিশীল হয়। এতে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকে এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
  2. একদলীয় ব্যবস্থায় দলীয় প্রধানই সর্বেসর্বা। কোনো প্রকার বিরোধিতা বা উপদলীয় কোন্দলকে সহ্য করা হয় না। এর ফলে দলীয় শৃঙ্খলা সুদৃঢ় হয়।
  3. কোনো ধরনের দলাদলি না থাকায় এবং একই আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হয়।
  4. একদলীয় ব্যবস্থায় কোনো প্রকার বিরোধিতা এবং জবাবদিহিতার প্রশ্ন না থাকায় সরকার জরুরি অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে
  5. একদলীয় ব্যবস্থায় শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হয়।
  6. একদলীয় ব্যবস্থায় অকারণে বিরোধিতা, হরতাল, আইনসভা বর্জন করা হয় না। এর ফলে দক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা : যখন কোনো দেশে নির্বাচনকালে প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল দেখতে পাওয়া যায়, তখন তাকে 'দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বলে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রধান দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি এবং গ্রেট ব্রিটেনে রক্ষণশীল দল ও শ্রমিক দল দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উজ্জ্বল উদাহরণ।

৩. বহুদলীয় ব্যবস্থা : একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন দুটির বেশি দল রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের লড়াইয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে, তখন তাকে 'বহুদলীয় ব্যবস্থা' বলে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় সাধারণত নির্বাচনের কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। ফলে নির্বাচনে জয় লাভের জন্য অনেক সময় সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে 'সম্মিলিত সরকার' গঠিত হয়।

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

  • নেতৃত্ব তৈরি : রাজনৈতিক দলের যিনি প্রধান নেতা তিনিই হলেন দলের নেতা। দলের নেতৃত্ব যেমন জাতীয় পর্যায়ে থাকে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও থাকে। আবার আজকে যারা স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, আগামীতে তারা জাতীয় পর্যায়ে নেতা হতে পারেন। বাংলাদেশে সরকারের প্রধানমন্ত্রী তার দলের নেতা। এই নেতা তৈরির কাজটি করে রাজনৈতিক দল ও জনগণ।
  • সরকার গঠন : রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ হচ্ছে সরকার গঠন করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সেই দলই সরকার গঠন করে।
  • জনমত গঠন : রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হচ্ছে তার আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন করা। এই জনমত গঠনে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সভা, মিছিল ও গণযোগাযোগের কর্মসূচি গ্রহণ করে।
  • রাজনৈতিক শিক্ষাদান : রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে জনগণকে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন করা। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে এবং অন্যান্য দলের কাজের সমালোচনা করে। জনগণ বিভিন্ন দলের মতামত, আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্রে পরিচালনার অনেক বিষয় জানতে পারে - এভাবে সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে ।
  • গঠনমূলক বিরোধিতা : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে এবং দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আইনসভায় বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে। সরকারের কোনো কার্যক্রম ভুল হলে বিরোধী দলের প্রধান কাজ হচ্ছে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া ।
  • সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা : একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ থাকে। তাদের স্বার্থ পরস্পর থেকে আলাদা । এই আলাদা আলাদা স্বার্থ একত্রিত করে তা একটি কর্মসূচিতে পরিণত করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ। রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন চায়। যে কোন দল ক্ষমতায় গিয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন করে । এই নীতি বাস্তবায়নের উপর সামাজিক ঐক্য নির্ভর করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বরুপ

রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির প্রাণস্বরূপ। সেই অর্থে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিকে মূলত প্রধান দু'টি দলই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ব্রিটেন যেখানে বহুদলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও তাদের ভূমিকা সক্রিয় নয়। মূলত দুটি প্রধান দল ব্রিটেনের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। উন্নত গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। সংসদীয় ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর কার্যক্রম তেমন দৃষ্টিগোচর না হলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রধান দুটি দলের ভূমিকাই সক্রিয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর্থ-সামাজিক ভিত্তিতে এবং অশান্ত রাজনীতির টানাপোড়েন বিচারে বাংলাদেশে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠার প্রবণতাই বেশি। নিচে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হল :

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয়। রোজ গার্ডেনে কর্মী সম্মেলনে এ দল গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান (যুগ্ম-সম্পাদক) জেলে থাকাকালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট উক্ত দলের কমিটি (প্রস্তুতি কমিটির পর) গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও স্বাধীকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই দলটির জন্ম। দলটি আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন। দলটির রয়েছে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং চর্চার ইতিহাস। ১৯৭১ সালে দলটির প্রধান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দলটি প্রথম সরকার পরিচালনা করে ১৯৭২-'৭৫ পর্যন্ত। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যের ধারক দলটি একদলীয় 'বাকশাল' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাপক নিন্দিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এবং দেশে সামরিক শাসন শুরু হলে বাকশাল পরিকল্পনা রহিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে দলটি ক্ষমতায় এসে পররাষ্ট্র এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আশানুরূপ সাফল্য দেখায়। তবে সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি। দলটি ২০০১ এর সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়। ২০০৮ সনের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে রাজনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয় সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮)। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সহ সকল মতের মিলন ঘটান তার রাজনীতিতে। ১৯৯১ থেকে '৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে দলটি ক্ষমতায় আসে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ রক্ষা, নারী শিক্ষাসহ কতিপয় বিষয়ে সফলতা অর্জন করলেও সন্ত্রাস নির্মূল, দুর্নীতি দমন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সহ বেশি কিছু আশানুরূপ সফলতা দেখাতে পারেনি।

জাতীয় পার্টি

লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারীর মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ১৯৮২ সালে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দীর্ঘ ৯ বছর দলটি ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকালীন রাজনৈতিক নির্যাতন, বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের দমন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটায়। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দলটির পতন ঘটলে রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বর্তমানে দলটি ত্রিধারায় বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জোটবদ্ধ সরকার গঠনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে দলটির গুরুত্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেড়ে গেছে। ২০০৮ সনের নির্বাচনে মহাজোটের শরীক দল হিসেবে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরীক দল হিসেবে অংশ নেয়। বর্তমানে সরকারি দলের অংশ হিসেবে এবং সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী

ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলটি দেশে ইসলামীক শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। দলটির তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন ও কর্মী রয়েছে। এছাড়া দলের নীতিমালা ও শৃঙ্খলা অত্যন্ত কঠোর হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তবে ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে দলটির সুসম্পর্ক না থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে দলটি ৪ দলীয় জোটের অংশ হিসেবে সরকারের অংশীদার হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন এ দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে।

বাম সংগঠন

কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, বাসদ, গণফোরাম, ন্যাপ ইত্যাদি দলগুলো বাম দল হিসেবে পরিচিত। ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দলগুলো সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে বাম দলগুলোর সমর্থন তেমন না থাকলেও আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে এখনও সংগঠনের বিস্তৃতি রয়েছে। রাজনীতিতে এদের ভূমিকা অতি নগণ্য হলেও মানবাধিকার, শ্রমজীবী মানুষের দাবী, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার জন্য দলগুলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ সোচ্চার। ২০০৮ সনের নির্বাচন অধিকাংশ বামদলগুলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট করে অংশগ্রহণ করে। এতে নিজেদের কিছুটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি আনার সুযোগ পায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরীক দল হিসেবে কিছু বাম দল অংশ নেয় এবং বর্তমানে সরকারি দলের অংশ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল

ইসলামী জোট : কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা, নারী শাসনের ঘোর বিরোধী, ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাসী এই জোট। বাংলাদেশে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কিংবা কতিপয় আলেম-ওলামা কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি ইসলামী দল রয়েছে এই জোটে। ধর্মভিত্তিক আদর্শ থাকার কারণে রাজনৈতিক মহলে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে এর দূরত্ব বজায় রয়েছে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ : এটি মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল। দেশের সীমিত অঞ্চলে এর রাজনৈতিক কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুর বৃত্তির কারণে এর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আদর্শ সুস্পষ্ট নয়। এই সংগঠনগুলো ছাড়াও দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে। তবে এদের বেশির ভাগই জাতীয় রাজনীতিতে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সম্পর্ক

সংসদীয় সরকার শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ' বিকল্প সরকার' বলা হয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দল ছাড়া গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সফল হতে পারে না। কোন কোন দেশে বহুদলীয় আবার কোন কোন দেশে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র চালু আছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের রাজনীতিতে কেবলমাত্র দুটি দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সরকারি দল এবং বিরোধীদল। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারতের মত দেশগুলির রাজনীতিতে সরকারি দল এবং একাধিক বিরোধী দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দেশের সংসদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর বলে উল্লেখ করেছেন। সুষ্ঠু সংসদীয় কাঠামোর দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাধীন, নিরপেক্ষ বক্তব্য তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। যোগ্য বিরোধী দল সংগঠিতভাবে সরকারের মিথ্যাচার, পাপাচারের বিরুদ্ধে কামান দাগাতে পারে। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হলে দেশের সরকারকে যে কোন পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্রমাগত ক্ষমাপ্রার্থনা এবং প্রায়শ্চিত্তের তাগাদা অনুভব করতে শেখায়, সক্ষম ও সংগঠিত বিরোধী দল। রাজনীতিতে নির্বাচনী লড়াইয়ে একদল জেতে একদল হারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরাই দেশের রাজনীতির প্রধান কারিগর হয়ে ওঠে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধীরা ক্ষমতা আদায়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি ও বিরোধী দলের ভূমিকা নিম্নরূপ:

  1. সহিষ্ণুতা: সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সহিঞ্চুতা, আলাপ-আলোচনা, আপস এবং সমঝোতা। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল এবং বিরোধী দলকে অবশ্যই পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিরোধী দলের মতামত হবে যৌক্তিক এবং জনগণের কল্যানের উদ্দেশ্যে। অপরদিকে সরকারি দলের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধী দলের সকল মতামতকে উপেক্ষা করা অনুচিত এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধী।
  2. গঠনমূলক সমালোচনা : সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দলের কাজকর্মের গঠনমূলক সমালোচনা বিরোধী দলের অত্যাবশ্যকীয় কাজ। বিরোধী দলের কার্যকরী বিরোধিতা সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার ক্ষেত্রে একটি নিয়ন্ত্রণ হিসেবে কাজ করে। তাই সংসদের ভিতর ও বাইরে বিরোধীদের দমন-পীড়নের পরিবর্তে ভাদের রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের সুযোগ গান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার অন্যতম পূর্বশর্ত। অন্যদিকে বিরোধীদলের বিরোধিতা যখন কেবলই বিরোধিতার জন্য হয় তখন তা গণতন্ত্রকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে।
  3. আলাপ-আলোচনা: সংসদীয় গণতন্ত্রের আবেকটি মূলমন্ত্র হল পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা। এখানে সকল রাজনৈdkক মতবিরোধকে সংসদে আলোচনা করে সমাধান করাই শোভন। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও যৌক্তিক আচরণ করতে হবে এবং সংসদে আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
  4. আপসকামী মনোভাব: সংসদীয় গণতন্ত্রে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে আপসকামী মনোভাব থাকা জরুরি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পরাপরকে ছাড় দিতে রাজি না হয় তাহলে কোন সমস্যারই সমাধান সম্ভব হবে না।
  5. সংসদকে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু করা : সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদই সকল কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। তাই সংসদকে শক্তিশালী করতে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের সংসদে সক্রিয় উপস্থিতি প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিরোধী দল থেকে স্পীকার বা ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন, স্পিকারের উপর সকল দলের আস্থা স্থাপন, স্পিকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, সদস্যদের জন্য কার্যপ্রণালী বিধি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানের ব্যবস্থা করা, পলিসি ইস্যু সংক্রান্ত বিষয়ে আলাদাভাবে আলোচনা ব্যবস্থা করা, সংসদীয় কার্যক্রমের সঙ্গে সিভিল সোসাইটিকে সংশ্লিষ্ট করা, জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে সংসদীয় কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্যের অবাধ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং সংসদের সময়ের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
  6. রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সততা: সংসদীয় গণতন্ত্রের সফলতার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গের শিষ্টাচার ও সততা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। টিআইবি'র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ এর মতে, বাংলাদেশের সংসদ এবং সাংসদরা ক্রমশ অশ্রদ্ধেয় হয়ে পড়ছেন। নির্বাচিত হয়ে অনেকেই দেশ ও জাতির প্রতি অঙ্গীকারের কথা ভুলে গেছেন। তাঁর মতে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বার্থেই সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার সম্পন্ন ও সৎ হতে হবে।
  7. নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতিষ্ঠানিক রূপদান : নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন, সংসদ ও সংবিধানের প্রতি আস্থা রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে এটাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবী। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় সংসদীয় গণতন্ত্রের এ দাবীগুলো পূরণ হয়নি। সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধী দলকে হেয় করা, কথা বলতে না দেয়া এবং যে কোন যুক্তি বা দাবি কেবল সরকারি দলের বলে প্রতিপন্ন করার সংস্কৃতি ও আমাদের দেশে চালু আছে। এগুলো থেকে সরকারি ও বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বাদ অপূর্ণই রয়ে যাবে। এজন্য রাজনৈতিক দলসমূহকে আরো বেশি উদার মনোভাবাপন্ন হতে হবে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠী যার সদস্যগণ সমজাতীয় মনোভাব এবং স্বার্থের ভিত্তিতেই পরস্পরে সাথে আবদ্ধ হন। এরা এমন এক সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠী, যা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের আচরণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এরা তাদের পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে অর্থ দিয়ে, যানবাহন দিয়ে প্রচার কাজে সাহায্য করে। তাদের পছন্দনীয় দল বা ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আইনপ্রণয়ন ও শাসন কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। প্রয়োজনবোধে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী মিটিং, মিছিল, শোভাযাত্রার সাহায্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে ।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য

  1. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যগণ বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের সমাষ্টিবিশেষ। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি স্বীকৃতিও সাধারণত থাকে না।
  2. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গঠিত হয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অজন, স্বার্থ আদায় বা স্বার্থরক্ষার জন্য বহুমুখী, ব্যাপক সামাজিক বা জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গঠিত হয় না। এমনকি জাতীয় কল্যাণের জন্য কোনো মহান উদ্দেশ্যও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর থাকে না।
  3. স্বার্থকামী গোষ্ঠী নিজেকে নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মনে করে। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী অরাজনৈতিক চরিত্র নিয়েই বেচে থাকতে চায়।
  4. স্বার্থকামী গোষ্ঠী সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠী। তাঁরা সুসংগঠিত। তাঁদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট।
  5. স্বার্থকামী গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে চায় । এর লক্ষ্য সরকারের নীতি ও অ্যচরণকে প্রভাবিত করা। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আইনসভার সদস্যগণকে প্রভাবিত করে নিজেদের অনুকূলে আইন প্রণয়ন করিয়ে নেয়, শাসন বিভাগকে প্রভাবিত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায়, পছন্দের দল-ব্যক্তিকে নির্বাচনে সহযোগিতা প্রদান করে।

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিল থাকলেও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের মধ্যে উৎপত্তি, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায় ।

  1. রাজনৈতিক দলের সামনে বৃহৎ জাতীয় কল্যাণের লক্ষ্য থাকে, যা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে না।
  2. সাংগঠনিক দিক থেকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দল অপেক্ষা দুর্বল।
  3. রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলো বাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর লক্ষ্য হলো সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকুলে প্রভাবিত করা।
  4. রাজনৈতিক দলের কাজকর্ম প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কাজকর্ম সাধারণত গোপন বা প্রকাশা।
  5. রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু চাপসষ্টিকারী গোষ্ঠী তা করে না।
  6. রাজনৈতিক দল গঠিত হয় বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও পেশার লোকজন নিয়ে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গঠিত হয় সমস্বার্থ ও সমমনোভাবাপন্ন লোকদের নিয়ে ।
  • S. E. Finer এর মতে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী Lobby Group.
  • Almond and Powel চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে বিভক্ত করেছেন ৪ ভাগে।
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে চাপ দেয় - চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • সুশীল সমাজ কাজ করে - চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে।
  • কোন বিশিষ্ট লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য কাজ করে এমন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে বলা হয় - উন্নয়নমূলক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • উন্নয়নমূলক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ উন্নয়নের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে - ওয়াচডগ হিসেবে।
  • সরকারি কাঠামারে বাইরে থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চায় - চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে - চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ হলো - এক ধরনের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অন্য নাম Attitude Group, Interest Group, Non-Political and Organized Group.

সুশীল সমাজ

সুশীল সমাজের ধারণা প্রথম পাওয়া যায় দার্শনিক জন লক, রুশোসহ আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের লেখনীতে, তবে এ বিষয় বেশি স্পষ্ট আলোচনা, পাওয়া যায় এন্টোনিও গ্রামসির লেখায়। কমিউনিস্টবিরোধী আন্দোলনের সময় এর তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়। ঐক্যবদ্ধ চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীই সুশীল সমাজের আওতাভুক্ত। এরা সরকারেও থাকে না, আবার কর্পোরেট গ্রুপেও থাকে না। এরা সরকার ও প্রাইভেট সেক্টরের মাঝামাঝি একটি গ্রুপ, এদের ধর্ম হল সরকার ও প্রাইভেট সেক্টর উভয়ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এরা সরকারকে সহযোগিতাও করতে পারে আবার সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে সরকারের ভিতও নাড়িয়ে দিতে পারে।

সুশীল সমাজের ইংরেজি প্রতিশব্দ Civil Society, বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক তাঁর Social Contract গ্রন্থে সর্বপ্রথম Civil Society প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে রাষ্ট্র ছিল নগরকেন্দ্রিক। ফলে নগরের বাসিন্দারাই ছিল নাগরিক। যার অর্থ দাঁড়ায় সিভিটাস মানে রাষ্ট্র এবং সিভিল মানে রাষ্ট্রের নাগরিক। আর সোসাইটি মানে সমাজ। সুতরাং সিভিল সোসাইটি মানে হচ্ছে নাগরিক সমাজ বা নগর সমাজ।

গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সুশীল সমাজ ধারণাটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্যয়। সুশীল সমাজ মূলত গণতান্ত্রিক চেতনাসমৃদ্ধ সমাজ। সুশীল সমাজ বলতে জনগণের যে অংশ সরাসরি রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় কিংবা এসব থেকে সরাসরি সুবিধা লাভ করে না সে অংশকেই বুঝায়। কোন দেশের সুশিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকদের চিন্তা-চেতনা ও কর্ম হয় অনেকটা নিরপেক্ষ, নির্দেশনামূলক ও উন্নয়নকামী। এরা সরকার ও বেসরকারি পুঁজিপতির চিন্তা ও কর্মের মাঝে একটা মধ্যবর্তী শ্রেণী হিসেবে অবস্থান করে। ফলে সরকারের বিপথগামীতা বা প্রাইভেট সেক্টরের অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিকতা ও বাজারমুখিতার মাঝমাঝি থেকে তারা উভয়কে চরম অবস্থানের ব্যাপারে সজাগ করে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করে। জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতিও দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অবস্থান অতটা সুদৃঢ় না হলেও দেশের আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকরণে সুশীল সমাজ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।

নবীনতর পূর্বতন