পৃথিবীর পৃষ্ঠে ভূত্বকের নিচের অংশগুলো জলে পূর্ণ রয়েছে । ভূ-পৃষ্ঠ থেকে চুইয়ে চুইয়ে এসব পানি নিচে গিয়ে সঞ্চিত হয় । তাছাড়া ভূ-পৃষ্ঠের উপরে সাগর , মহাসাগর , উপসাগর , হ্রদ , নদী-নালা , খালবিলে রয়েছে বিশাল জলরাশি । এসব নিয়েই বারিমন্ডল গঠিত । বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর ৭১ ভাগ জল এবং ২৯ ভাগ স্থল । পৃথিবীর সমগ্র বারিমন্ডলের মোট ভর ১.৪ × ১০১৮ টন, যেটা পৃথিবীর সমগ্র ভরের ০.০০০০২৩ শতাংশ। কিন্তু এ বিপুল জলরাশির মানুষের ব্যবহারযোগ্য কতটুকু? কতটুকু জল মানুষের জন্য নিরাপদ ? বারিমন্ডল নিয়ে সম্যক ধারণা নিতে হলে আমাদের জানতে হবে বারিমণ্ডলের সাগর , মহাসাগর , উপসাগর , হ্রদ , নদ-নদী এবং সকল পানির উৎস ও গতিবিধি সম্বন্ধে ।
বারিমণ্ডল কি
'Hydrosphere'-এর বাংলা প্রতিশব্দ বারিমন্ডল। 'Hydro' শব্দের অর্থ পানি এবং 'Sphere' শব্দের অর্থ ক্ষেত্র। পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে পানি; এ বিশাল জলরাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় থাকে। যেমন- কঠিন (বরফ), গ্যাসীয় (জলীয়বাষ্প) এবং তরল। বায়ুমন্ডলে পানি রয়েছে জলীয়বাষ্প হিসেবে, ভূপৃষ্ঠে রয়েছে তরল ও কঠিন অবস্থায় এবং ভূপৃষ্ঠের তলদেশে রয়েছে ভূগর্ভস্থ তরল পানি। সুতরাং বারিমন্ডল বলতে বোঝায় পৃথিবীর সকল জলরাশির অবস্থানভিত্তিক বিস্তরণ। পৃথিবীর সকল জলরাশির শতকরা ৯৭ ভাগ পানি রয়েছে সমুদ্রে (মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর)। মাত্র ৩ ভাগ পানি রয়েছে নদী, হিমবাহ, ভূগর্ভস্থ, হ্রদ, মৃত্তিকা, বায়ুমন্ডল ও জীবমন্ডলে। বারিমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭১% ভাগ দখল করে রয়েছে। এর আয়তন প্রায় -- ৩৬ কোটি ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার বা ১৩ কোটি ৯৮ লক্ষ বর্গমাইল। পৃথিবীর সমস্ত পানিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন লবণাক্ত ও মিঠা পানি। পৃথিবীর সকল মহাসাগর, সাগর ও উপসাগরের জলরাশি লবণাক্ত এবং নদী, হ্রদ ও ভূগর্ভস্থ পানি মিঠা পানির উৎস।
জলবিভাগের নাম | পরিমাণ (ঘনকিলোমিটার ৩ × ১,০০,০০০) | শতকরা হার (%) |
---|---|---|
সমুদ্র | ১৩৭০ | ৯৭.২৫ |
হিমবাহ | ২৯ | ২.০৫ |
ভূগর্ভস্থ পানি | ৯.৫ | ০.৬৮ |
হ্রদ | ০.১২৫ | ০.০১ |
মাটির আর্দ্রতা | ০.০৬৫ | ০.০০৫ |
বায়ুমণ্ডল | ০.০১৩ | ০.০০১ |
নদী | ০.০০১৭ | ০.০০০১ |
জীবমণ্ডল | ০.০০০৬ | ০.০০০০৪ |
মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর
মহাসাগর: বারিমন্ডলের উন্মুক্ত বিস্তীর্ণ বিশাল লবণাক্ত জলরাশিকে মহাসাগর (Ocean) বলে। মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণ মহাসাগর। এর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগর বৃহত্তম ও গভীরতম। পৃথিবীতে পাঁচটি মহাসাগর রয়েছে, এগুলো হলো প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণ মহাসাগর। এর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগর বৃহত্তম ও গভীরতম। আটলান্টিক মহাসাগর ভগ্ন উপকূলবিশিষ্ট এবং এটি অনেক আবদ্ধ সাগরের (Enclosed sea) সৃষ্টি করেছে। ভারত মহাসাগর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। ৬০০ দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে এন্টার্কটিকার হিমভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ মহাসাগরের অবস্থান। দক্ষিণ মহাসাগরের দক্ষিণে এন্টার্কটিকা মহাদেশ বছরের সকল সময় বরফে আচ্ছন্ন থাকে। উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে উত্তর মহাসাগর অবস্থিত এবং এর চারদিক স্থলবেষ্টিত।
মহাসাগর | আয়তন (বর্গকিলোমিটার) | গড় গভীরতা (মিটার) | অবস্থান |
---|---|---|---|
প্রশান্ত মহাসাগর | ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ | ৪,২৭০ | আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যবর্তী |
আটলান্টিক মহাসাগর | ৮ কোটি ২৪ লক্ষ | ৩,৯৩২ | আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকা |
ভারত মহাসাগর | ৭ কোটি ৩৬ লক্ষ | ৩,৯৬২ | আফ্রিকা, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া |
উত্তর মহাসাগর | ১ কোটি ৫০ লক্ষ | ৮২৪ | পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ |
দক্ষিণ মহাসাগর | ১ কোটি ৪৭ লক্ষ | ১৪৯ | এন্টার্কটিকা ও ৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী |
- পৃথিবীর বৃহত্তম ও গভীরতম মহাসাগর: প্রশান্ত মহাসাগর।
- পৃথিবীর গভীরতম স্থানঃ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (প্রশান্ত মহাসাগর) । এর গভীরতা ১১০৩৩ মিটার (৩৬১৯৯ফুট)।
- আয়তনে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মহাসাগর: দক্ষিণ মহাসাগর।
- আয়তনে পৃথিবীর বৃহত্তম সাগর: দক্ষিণ চীন সাগর।
- বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর: মেক্সিকো উপসাগর।
সাগর: মহাসাগর অপেক্ষা স্বল্প আয়তনবিশিষ্ট জলরাশিকে সাগর (Sea) বলে। যথা- ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, ক্যারিবিয়ান সাগর, জাপান সাগর ইত্যাদি ।
উপসাগর: তিনদিকে স্থলভাগ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং একদিকে জল তাকে উপসাগর (Bay) বলে। প্রায় চারদিক স্থল দ্বারা বেষ্টিত পানিরাশিকেও উপসাগর (Gulf) বলে। যথা- বঙ্গোপসাগর, পারস্য উপসাগর ও মেক্সিকো উপসাগর ইত্যাদি।
হ্রদ : চারদিকে স্থলভাগ দ্বারা বেষ্টিত জলভাগকে হ্রদ (Lake) বলে। যথা- রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তে অবস্থিত সুপিরিয়র হ্রদ ও আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদ ইত্যাদি।'
সমুদ্র তলদেশের ভূমিরূপ
ভূপৃষ্ঠের উপরের ভূমিরূপ যেমন উঁচু-নিচু তেমনি সমুদ্র তলদেশও অসমান। কারণ সমুদ্রতলে আগ্নেয়গিরি, শৈলশিরা, উচ্চভূমি ও গভীর খাত প্রভৃতি বিদ্যমান আছে। শব্দতরঙ্গের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা মাপা হয়। এ শব্দতরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে পানির মধ্য দিয়ে প্রায় ১,৪৭৫ মিটার নিচে যায় এবং আবার ফিরে আসে। ফ্যাদোমিটার (Fathometer) যন্ত্রটি দিয়ে সমুদ্রের গভীরতা মাপা হয়। সমুদ্রের তলদেশের ভূমিরূপকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা-
- মহীসোপান (Continental shelf)
- মহীঢাল (Continental slope)
- গভীর সমুদ্রের সমভূমি (Deep sea plain)
- নিমজ্জিত শৈলশিরা (Oceanic ridge)
- গভীর সমুদ্রখাত (Ocenic trench)
(১) মহীসোপান:
- পৃথিবীর মহাদেশসমূহের চারদিকে স্থলভাগের কিছু অংশ অল্প ঢালু হয়ে সমুদ্রের পানির মধ্যে নেমে গেছে। এরূপে সমুদ্রের উপকূলরেখা থেকে তলদেশ ক্রমনিম্ন নিমজ্জিত অংশকে মহীসোপান বলে।
- মহীসোপানের সমুদ্রের পানির সর্বোচ্চ গভীরতা ২০০ মিটার।
- এটি ০.১ ডিগ্রি কোণে সমুদ্র তলদেশে নিমজ্জিত থাকে।
- মহীসোপানের গড় প্রশস্ততা ৭০ কিলোমিটার।
- মহীসোপানের সবচেয়ে উপরের অংশকে উপকূলীয় ঢাল বলে।
- মহীসোপানের বিস্তৃতি সর্বত্র সমান নয়। উপকূলভাগের বন্ধুরতার উপর এর বিস্তৃতি নির্ভর করে। উপকূল যদি বিস্তৃত সমভূমি হয়, তবে মহীসোপান অধিক প্রশস্ত হয়। মহাদেশের উপকূলে পর্বত বা মালভূমি থাকলে মহীসোপান সংকীর্ণ হয়।
- ইউরোপের উত্তরে বিস্তীর্ণ সমভূমি থাকায় উত্তর মহাসাগরের মহীসোপান খুবই প্রশস্ত (প্রায় ১,২৮৭ কিলোমিটার) তবে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমে পৃথিবীর বৃহত্তম মহীসোপান অবস্থিত।
- মহীসোপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্তর অংশ উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে দেখতে পাওয়া যায়। অথচ এর পশ্চিমে উপকূল বরাবর উত্তর-দক্ষিণ ভঙ্গিল রকি পর্বত অবস্থান করায় সেখানে মহীসোপান খুবই সংকীর্ণ।
- আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ স্থান মালভূমি বলে এর পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মহীসোপান খুবই সরু। স্থলভাগের উপকূলীয় অঞ্চল নিমজ্জিত হওয়ার ফলে অথবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার তারতম্য হওয়ার কারণে মহীসোপানের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সমুদ্রতটে সমুদ্রতরঙ্গও ক্ষয়ক্রিয়ার দ্বারা মহীসোপান গঠনে সহায়তা করে থাকে।
- ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন অনুযায়ী একটি উপকূলীয় রাষ্ট্রের মহীসোপানের সীমা হবে ভিত্তি রেখা হতে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল (৬৪৭.৫ কিমি.)।
(২) মহীঢাল: মহীসোপানের শেষ সীমা থেকে ভূভাগ হঠাৎ খাড়াভাবে নেমে সমুদ্রের গভীর তলদেশের সঙ্গে মিশে যায়। এ ঢালু অংশকে মহীঢাল বলে।
- সমুদ্রে এর গভীরতা ২০০ থেকে ৩,০০০ মিটার।
- এটা অধিক খাড়া হওয়ার জন্য খুব প্রশস্ত নয়। এটি গড়ে প্রায় ১৬ থেকে ৩২ কিলোমিটার প্রশন্ত।
- মহীঢালের উপরিভাগ সমান নয়। অসংখ্য আন্তঃসাগরীয় গিরিখাত অবস্থান করায় তা খুবই বন্ধুর প্রকৃতির। এর ঢাল মৃদু হলে জীবজন্তুর দেহাবশেষ, পলি প্রভৃতির অবক্ষেপণ দেখা যায়।
(৩) গভীর সমুদ্রের সমভূমি:
- মহীঢাল শেষ হওয়ার পর থেকে সমুদ্র তলদেশে যে বিস্তৃত সমভূমি দেখা যায় তাকে গভীর সমুদ্রের সমভূমি বলে।
- এর গড় গভীরতা ৫,০০০ মিটার।
- এ অঞ্চলটি সমভূমি নামে খ্যাত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বন্ধুর। কারণ গভীর সমুদ্রের সমভূমির উপর জলমগ্ন বহু শৈলশিরাও উচ্চভূমি অবস্থান করে।
- আবার কোথাও রয়েছে নানা ধরনের আগ্নেয়গিরি। এ সমস্ত উচ্চভূমির কোনো কোনোটি আবার জলরাশির উপর দ্বীপরূপে অবস্থান করে। সমুদ্রের এ গভীর অংশে পলি মাটি, সিন্ধুমল, আগ্নেয়গিরি থেকে উত্থিত লাভা ও সূক্ষ্ম ভস্ম প্রভৃতি সঞ্চিত হয়। এ সকল সঞ্চিত পদার্থ স্তরে স্তরে জমা হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি করে।
(৪) নিমজ্জিত শৈলশিরা: সমুদ্রের অভ্যন্তরে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরি অবস্থান করছে। ঐসব আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বেরিয়ে এসে সমুদ্রগর্ভে সঞ্চিত হয়ে শৈলশিরার ন্যায় ভূমিরূপ গঠন করেছে। এগুলোই নিমজ্জিত শৈলশিরা নামে পরিচিত। নিমজ্জিত। শৈলশিরাগুলোর মধ্যে মধ্য আটলান্টিক। শৈলশিরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
(৫) গভীর সমুদ্রখাত:
- গভীর সমুদ্রের সমভূমি অঞ্চলের মাঝে মাঝে গভীর খাত দেখা যায়। এ সকল খাতকে গভীর সমুদ্রখাত বলে।
- পাশাপাশি অবস্থিত মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক প্লেট সংঘর্ষের ফলে সমুদ্রখাত প্লেট সীমানায় অবস্থিত।
- এ প্লেট সীমানায় ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি অধিক হয় বলেই এ সকল খাত সৃষ্টি হয়েছে। এ খাতগুলো অধিক প্রশস্ত না হলেও খাড়া ঢালবিশিষ্ট।
- এদের গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৪০০ মিটারের অধিক। প্রশান্ত মহাসাগরেই গভীর সমুদ্রখাতের সংখ্যা অধিক। এর অধিকাংশই পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত।
- এ সকল গভীর সমুদ্রখাতের মধ্যে গুয়াম দ্বীপের ৩২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ম্যারিয়ানা খাত (Mariana trench) সর্বাপেক্ষা গভীর। এর গভীরতা প্রায় ১০,৮৭০ মিটার এবং এটাই পৃথিবীর গভীরতম খাত।
- এছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের পোর্টোরিকো খাত (৮,৫৩৮ মিটার), ভারত মহাসাগরের শুন্ডা খাত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
জোয়ার-ভাটা
জোয়ার-ভাটা (High Tide and Low Tide): চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণ শক্তি এবং পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ শক্তি প্রভৃতির কারণে সমুদ্রের পানি নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক জায়গায় ফুলে ওঠে, আবার অন্য জায়গায় নেমে যায়। সমুদ্র এবং উপকূলবর্তী নদীর জলরাশি প্রতিদিনই কোনো একটি সময়ে ঐ জলরাশি ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে এবং কিছুক্ষণ পরে আবার তা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। জলরাশির এরকম নিয়মিত স্ফীতি বা ফুলে ওঠাকে জোয়ার বা নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে।
মহাকর্ষ (Gravitional): এ মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুকণাই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এ মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে মহাকর্ষ বলে।
জোয়ার-ভাটা সময়: সমুদ্রের একই জায়গায় প্রতিদিন দুইবার জোয়ার ও দু'বার ভাটা হয়। উপকূলে কোন একটি স্থানে পর পর দুটি জোয়ার বা পর পর দুটি ভাটার মধ্যে ব্যবধান হলো ১২ ঘণ্টা।
জোয়ার-ভাটা কারণ: জোয়ার-ভাটার প্রধান কারণ চাঁদের আকর্ষণ। প্রধানত দুটি কারণে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো- (১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব এবং (২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্রাতিগ শক্তি।
(১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব: মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি প্রতিটি জ্যোতিষ্ক পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তাই এর প্রভাবে সূর্য ও চাঁদ পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। কিন্তু পৃথিবীর উপর সূর্য অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বল বেশি হয়। কারণ সূর্যের ভর অপেক্ষা। চাঁদের ভর অনেক কম হলেও চাঁদ সূর্য অপেক্ষা পৃথিবীর অনেক নিকটে অবস্থিত। তাই সমুদ্রের জল তরল বলে চাঁদের আকর্ষণেই প্রধানত সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে ও জোয়ার হয়। সূর্যের আকর্ষণে জোয়ার তত জোড়ালো হয় না। চাঁদ ও সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থিত হলে চাঁদ ও সূর্য উভয়ের আকর্ষণে জোয়ার অত্যন্ত প্রবল হয়।
(২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্রাতিগ শক্তি: পৃথিবী নিজ মেরুরেখার চারদিকে অনবরত আবর্তন করে বলে কেন্দ্রাতিগ শক্তি বা বিকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয়। এই কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অনুই মহাকর্ষ শক্তির বিপরীত দিকে বিকর্ষিত হয় বা ছিটকে যায়। তাই পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে যেখানে মহাশক্তির প্রভাবে জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তার বিপরীত দিকে সমুদ্রের জল বিক্ষিপ্ত হয়েও জোয়ারের সৃষ্টি করে। জোয়ার ভাটা হয় আহ্নিক গতির ফলে। আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবীতে দিন-রাত সংঘটিত হয়, ভূ- পৃষ্ঠে বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের দিক পরিবর্তিত হয়, জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়, এছাড়া সময় গণনার সুবিধা হয় ।
জোয়ার-ভাটার ওপর সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ: সূর্য চন্দ্র অপেক্ষা ২ কোটি ৬০ লক্ষ গুণ বড় হলেও পৃথিবী সূর্য হতে গড়ে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু পৃথিবী থেকে চন্দ্রের গড় দূরত্ব মাত্র ৩৮.৪ লক্ষ কিলোমিটার। এ কারণেই পৃথিবীর ওপর সূর্যের আকর্ষণ শক্তি চন্দ্র অপেক্ষা অনেক কম। ফলে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারে সূর্য অপেক্ষা চন্দ্রের প্রভাব বেশি। হিসাব করে দেখা গেছে যে, জোয়ার উৎপাদনে সূর্যের ক্ষমতা চন্দ্রের ৪/৯ (নয় ভাগের চার ভাগ) ভাগ।
জোয়ারের প্রকারভেদ: জোয়ারকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন- ক) মুখ্য জোয়ার খ) গৌণ জোয়ার গ) ভরা কটাল ঘ) মরা কাটাল/লঘু স্ফীতি।
মুখ্য জোয়ার: চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে আবর্তনকালে পৃথিবীর যে অংশ চন্দ্রের নিকবর্তী হয়, সেখানে চন্দ্রের আকর্ষণ সর্বাপেক্ষা বেশি হয়। এ আকর্ষণে চারদিক হতে পানি এসে চন্দ্রের দিকে ফুলে ওঠে। এবং জোয়ার হয়। এরূপে সৃষ্ট জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার বা প্রত্যক্ষ জোয়ার বলা হয়। কোনো স্থানে একবার মুখ্য জোয়ার হওয়ার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট সময় অতিক্রম করলে পুনরায় সেখানে মুখ্য জোয়ার সৃষ্টি হয়। জোয়ারের প্রায় ৬ ঘণ্টা ১৩ মিনিট পরে ভাঁটা সংঘটিত হয়।
গৌণ জোয়ার: চন্দ্র পৃথিবীর যে পার্শ্বে আকর্ষণ করে তার বিপরীত দিকের জলরাশির ওপর মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাব কমে যায় এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তির সৃষ্টি হয়। এতে চারদিক হতে পানি ঐ স্থানে এসে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এভাবে চন্দ্রের বিপরীত দিকে যে জোয়ার হয় তাকে গৌণ জোয়ার বা পরোক্ষ জোয়ার বলে।
ভরা কটাল বা তেজ কটাল: পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিতে পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য প্রায় একই সরলরেখায় অবস্থান করে। তাই সূর্যের আকর্ষণ চন্দ্রের আকর্ষণ শক্তিকে সাহায্যে করে। ফলে এই দুই সময়ে জোয়ারের পানি খুব বেশি ফুলে উঠে। একে ভরা বা তেজ কটাল বলে। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার তিথিতে তেজ কটাল হয়।
মরা কটাল/ লঘু স্ফীতি: চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর সাথে এক সমকোণে থেকে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। তাই চন্দ্রের আকর্ষণে যেখানে জোয়ার হয় সূর্যের আকর্ষণে সেখানে ভাটা হয়। চন্দ্র পৃথিবীর নিকট থাকায় তার কার্যকরী শক্তি সূর্য অপেক্ষা বেশি। কিন্তু চন্দ্রের আকর্ষণে যে জোয়ার হয়, সূর্যের আকর্ষণে তা বেশি। জোয়ারের পানি বেশি স্ফীত হতে পারে না। ফলে মরা কটাল হয়। অষ্টমীর তিথিতে মরা কটাল হয়। একমাসে দুই বার তেজ কটাল এবং দুই বার মরা কটাল হয়ে থাকে।
মনে রাখার সূত্র: সমকোণে 'ম' আছে, মরা কটালেও 'ম' আছে। তাই চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর সাথে এক সমকোণে থাকলে হবে মরা কটাল। আর সরলরেখায় থাকলে হবে তেজ কটাল।
জোয়ার-ভাটার প্রভাব : মানবজীবনের উপর জোয়ার-ভাটার যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিশ্বের সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশসমূহে জোয়ারভাটার নিম্নের প্রভাবসমূহ লক্ষ করা যায়।
- জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে ভূখন্ড থেকে আবর্জনাসমূহ নদীর মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়।
- নদীর মোহনা পরিষ্কার থাকে। দৈনিক দুবার জোয়ার-ভাটা হওয়ার ফলে ভাটার টানে নদীর মোহনায় পলি ও আবর্জনা জমতে পারে না।
- জোয়ার-ভাটার ফলে সৃষ্ট স্রোতের সাহায্যে নদীখাত গভীর হয়।
- বহু নদীতে ভাটার স্রোতের বিপরীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ (Hydro-electric) উৎপাদন করা হয় ।
- জোয়ারের পানি নদীর মাধ্যমে সেচে সহায়তা করে এবং অনেক সময় খাল খনন করে জোয়ারের পানি আটকিয়ে সেচকার্যে ব্যবহার করা হয়।
- শীতপ্রধান দেশে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জোয়ারের সাহায্যে নদীতে প্রবেশ করে এবং এর ফলে নদীর পানি সহজে জমে না।
- জোয়ার-ভাটার ফলে নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা হয়। জোয়ারের সময় নদীর মোহনায় ও তার অভ্যন্তরে পানি অধিক হয় বলে বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজের পক্ষে নদীতে প্রবেশ করা সুবিধা হয়। আবার ভাটার টানে ঐ জাহাজ অনায়াসে সমুদ্রে নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশের দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর পতেঙ্গা ও মংলা এবং অন্যান্য উপকূলবর্তী নদীবন্দর সচল রাখতে জোয়ার-ভাটার ভূমিকা রয়েছে।
- অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ারের সময় বান ডাকার ফলে অনেক সময় নৌকা, লঞ্চ প্রভৃতি ডুবে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় জানমালের ক্ষতি হয়।
সমুদ্রস্রোত (টাইড)
সমুদ্রস্রোতের প্রধান কারণ বায়ুপ্রবাহ। বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগের পানির সঙ্গে ঘর্ষণ (Friction) তৈরি করে এবং ঘর্ষণের জন্য পানিতে ঘূর্ণন (Gyre, spiral pattern) তৈরি করে। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ করে চলাচল করে, একে সমুদ্রস্রোত বলে। সমুদ্রস্রোতকে উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- (ক) উষ্ণ স্রোত ও (খ) শীতল স্রোত
(ক) উষ্ণ স্রোত (Warm current): নিরক্ষীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় জলরাশি হালকা হয় ও হালকা জলরাশি সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহরূপে শীতল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে উষ্ণ স্রোত বলে।
(খ) শীতল স্রোত (Cold current): মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তপ্রবাহরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমন্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে শীতল স্রোত বলে।
সমুদ্রস্রোতের কারণ:
- নিয়ত বায়ুপ্রবাহ: নিয়ত বায়ুপ্রবাহই সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ। এসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোতের দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ুর প্রবাহ অনুযায়ী প্রধান সমুদ্রস্রোতগুলোর সৃষ্টি হয় ।
- পৃথিবীর আহ্নিক গতিঃ পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রজলও উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
- সমুদ্রজলের তাপমাত্রার পার্থক্য: নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমন্ডলের সমুদ্রের সমুদ্রস্রোতের উপর বায়ুপ্রবাহের প্রভাব জল বেশি উষ্ণ বলে তা জলের উপরের অংশ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহ বা বহিঃস্রোতরূপে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অল্পপ্রবাহ বা অল্পস্রোতরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমন্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এইভাবে উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
- মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফের গলন : মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফ কিছু পরিমাণ গলে গেলে জলবাশি স্ফীত হয় ও সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পরিমাণ হ্রাস পায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।
- সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য: সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য অনুসারে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়। অগভীর সমুদ্রের জল দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরে ওঠে। তখন গভীরতর অংশের শীতল জল নিচে নেমে আসে। এজন্য উর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠে গতি সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রের ১০০ মিটার নিচ থেকে গতি কমতে থাকে।
- সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পার্থক্য: সমুদ্রজলে লবণের পরিমাণ সর্বত্র সমান নয়। অধিক লবণাক্ত জল বেশি ভারী বলে তার ঘনত্বও বেশি। বেশি ঘনত্বের জল কম ঘনত্বের দিকে প্রবাহিত হয় ও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে।
- ভূখন্ডের অবস্থান: সমুদ্রস্রোতের প্রবাহপথে কোনো মহাদেশ, দ্বীপ প্রভৃতি ভূখন্ড অবস্থান করলে সমুদ্রস্রোত তাতে বাধা পেয়ে দিক ও গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় এর প্রভাবে সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
সমুদ্রস্রোতের প্রভাব
নানাবিধ দিকে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে এলাকার উপর দিয়ে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সেখানে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার জলবায়ু এবং বাণিজ্যের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যধিক।
![সমুদ্রস্রোত](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgqeV07wFNTN6b6w8y0S5oGWyyxGJ2LOx3r_1LgUW7JtlUZuc8vm3ivNjZaUyIqF1jIzvUXtObnoBj4Xy9Td1QbSrcPM3K8E5dZ1PZGsmCygnKoQHgGLvgj-rjuTQDHT-zlzAhx_DayXC00EzSAp4x57JVG-bVyRb9Qr4AnIcaMTw_d2_jr4vAFJfsfM6M/s1600-rw/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A4.webp)
প্রবাহচিত্র: সমুদ্রের উপরের (Surface) এবং নিমজ্জিত (Deep) স্রোত একসঙ্গে সঞ্চালন স্রোত (Convection current) তৈরি করে, যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের জলরাশি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়।
- উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাব: উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই শীতল অঞ্চলের উপর দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে শীতকালেও বরফ জমতে পারে না। বন্দরগুলো সারা বছর ব্যবহার করা যায়। যেমন- উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে নরওয়ে ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূল শীতকালে বরফমুক্ত থাকে, কিন্তু একই অক্ষাংশে অবস্থিত কানাডার পূর্ব উপকূলে বরফাচ্ছন্ন অবস্থা দেখা যায়।
- শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাব: শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের শীতলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন- শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলে ল্যাব্রাডর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী অঞ্চল সারা বছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। একই কারণে শীতল কামচাটকা স্রোতের প্রভাবে এশিয়ার পূর্ব উপকূলে কামচাটকা উপদ্বীপের শীতলতা বৃদ্ধি পায়।
- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর প্রভাব: সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে নৌকা, জাহাজ প্রভৃতি চলাচলের সুবিধা হয়। তবে শীতল সমুদ্রস্রোত অপেক্ষা উষ্ণ সমুদ্রস্রোতে জাহাজ ও নৌ-চলাচলের সুবিধা বেশি। উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক জাহাজ যাতায়াত করে। শীতল স্রোতের গতিপথে তীব্র শীত ও হিমশৈলের জন্য জাহাজ চলাচলের অসুবিধা দেখা যায়।
- আবহাওয়ার উপর প্রভাব: উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। এই উষ্ণ বায়ুর প্রভাবে উপকূল অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন- উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। অপরদিকে শীতল সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক বলে বৃষ্টিপাত ঘটায় না। যেমন- কখনো শীতল মরুভূমির সৃষ্টি করে। দক্ষিণ আমেরিকার আতাকামা মরুভূমি প্রভাবিত হয় শীতল পেরু স্রোত-এর জন্য।
- কুয়াশা ও ঝড়-ঝঞা সৃষ্টি: উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন অঞ্চলে অল্প স্থানব্যাপী উষ্ণতার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই অঞ্চলে ঘন কুয়াশা ও ঘূর্ণবাতের সৃষ্টির ফলে প্রবল ঝড়-ঝঞার সৃষ্টি হয়। জাহাজ ও বিমান চলাচলে অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন- উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত ও উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের মিলনের ফলে এবং এশিয়ার উপকূলে শীতল কামচাটকা স্রোত ও বেরিং স্রোত এবং উষ্ণ জাপান স্রোতের মিলনের ফলে এরূপ দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়।
- সমুদ্রে অগভীর মগ্নচড়ার সৃষ্টি: উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন স্থলে শীতল স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড় বড় হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন নুড়ি, কাকর, বালি প্রভৃতি সমুদ্রতলে সঞ্চিত হয় এবং একসময় মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে গ্যান্ড ব্যাঙ্ক, সেবল ব্যাঙ্ক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ডগার্স ব্যাঙ্ক এগুলো মগ্নচড়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
- মৎস্য ব্যবসার সুবিধা: অগভীর মগ্নচড়াগুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন (একপ্রকার অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মায় ও বংশবৃদ্ধি করে। এই প্ল্যাঙ্কটন মাছের অতি প্রিয় খাদ্য। এই মগ্নচড়াগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাছ আহরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল ও জাপান উপকূলে পৃথিবীর অধিকাংশ মাছ ধরা হয়।
- হিমশৈলের আঘাতে বিপদ: শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে যেসব হিমশৈল (Ice berg) ভেসে আসে সেগুলোর কারণে জাহাজ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। যেমন যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ প্রথম যাত্রাতেই হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।
জাহাজ চালনায় সমুদ্রস্রোতের গুরুত্ব
স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্য বন্দরে পৌছানা যায়। তাই স্বল্পতম সময়ে ও সংক্ষিপ্ত পথে জাহাজ চালাতে নাবিকেরা সমুদ্রস্রোত অনুসরণ করেন। পক্ষান্তরে স্রোতের প্রতিকূলে জাহাজ চালিয়ে যেতে অনেক বেশি সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়। আবার শীতল স্রোতের গতিপথে জাহাজ চালানো বিপজ্জনক। কারণ, শীতল স্রোতের সঙ্গে অনেক হিমশৈল ভেসে আসে। এ প্রকার হিমশৈলের সঙ্গে আঘাত লাগলে জাহাজের ক্ষতি হয় এবং জাহাজ ডুবে যায়। টাইটানিক জাহাজ এভাবেই আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল।
সমুদ্রবন্দরের জন্য সমুদ্রস্রোতের গুরুত্ব
মধ্য অক্ষাংশ ও উচ্চ অক্ষাংশের সমুদ্রের পানি শীতকালে জমে যায়। ফলে তখন ঐ সব সাগরের ওপর দিয়ে শীতকালে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করতে পারে না। কিন্তু যেখানে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়, সেখানে বন্দরগুলো শীতকালে বরফমুক্ত থাকে এবং সারা বছর জাহাজ চলাচল করতে পারে।
হিমপ্রাচীর (Cold Wall): উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে সুমেরু অঞ্চল থেকে আগত ল্যাব্রাডার স্রোতের শীতল ও গাঢ় সবুজ রঙের জল এবং উপসাগরীয় স্রোতের উষ্ণ ও গাঢ় নীল জল বেশ কিছু দূর পর্যন্ত পাশাপাশি কিন্তু বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতের মাঝে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা স্পষ্ট দেখা যায়, এই সীমারেখাকে হিমপ্রাচীর বলে। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত আটলান্টিক মহাসাগরে হিমপ্রাচীরের সীমারেখা বহুদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। বিপরীতমুখী দুই সমুদ্রস্রোতের উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য এই অঞ্চলে প্রায়ই ঘন কুয়াশা ও প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়।
উষ্ণস্রোত ও শীতল স্রোতের সংমিশ্রণ: উষ্ণস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু উষ্ণ ও অর্দ্র হয়। পক্ষান্তরে শীতল স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শীতল ও শুষ্ক হয়। এ বিপরীতধর্মী দুই বায়ুর সংমিশ্রণে মিলনস্থলে প্রায়ই কুয়াশা ও ঝড়- তুফান লেগে থাকে।
শৈবাল সাগর (Sea Moss) : উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের প্রান্ত দিয়ে বিভিন্ন স্রোত প্রবাহের ফলে পানির আবর্তের মধ্যে কোনো স্রোত থাকে না। স্রোতহীন এই পানিতে ভাসমান আগাছা ও শৈবাল সঞ্চিত হয়। একে শৈবাল সাগর বলে।