কম্পিউটারের ইতিহাস , বিবর্তন ও প্রজন্ম

Computer শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। কম্পিউট (Compute) শব্দ থেকে Computer কথাটির উৎপত্তি। কম্পিউটার (Computer) শব্দের অর্থ গণনাকারী। অর্থাৎ কম্পিউটার শব্দের আভিধানিক অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। শুরুতে কম্পিউটারের পরিচয় ছিল গণনা যন্ত্রের। কিন্তু এখন আর কম্পিউটারকে গণনা যন্ত্র বলা যায় না। কম্পিউটার এমন একটি যন্ত্র যা তথ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপন করে। কম্পিউটারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আধুনিক কম্পিউটারের জনক হলেন চার্লস ব্যাবেজ। তিনি যুক্তরাজ্যের অধিবাসী। তিনি প্রথম আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা প্রদান করেন। চার্লস ব্যাবেজ ১৮১২ সালে বেল ল্যাবরেটরিতে লগারিদম হিসাবসহ গাণিতিক হিসাবের জন্য 'ডিফারেন্স ইঞ্জিন' এবং ১৮৩৩ সালে 'অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন' উদ্ভাবন করেন। পরবর্তীতে ব্যাবেজের চিন্তাভাবনার বাস্তবায়ন ঘটান হাওয়ার্ড আইকেন। হাওয়ার্ড আইকেন প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটারের আবিষ্কারক। হাওয়ার্ড আইকেন, কনরাড জুস, ভন নিউম্যান প্রভৃতি ব্যক্তিগণ কম্পিউটার আধুনিকায়নে অবদান রাখেন।

আধুনিক কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য

  1. দ্রুত গতি (High Speed): কম্পিউটার অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কাজ করে। কম্পিউটারের এই দ্রুতগতিসম্পন্ন হিসাবের কাজকে মিলিসেকেন্ড, মাইক্রোসেকেন্ড, ন্যানোসেকেন্ড এবং পিকোসেকেন্ড ইত্যাদি সময়ের একক হিসেবে ভাগ করা যায়।
    ১ মিলি সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ ( ১০-৩ সেকেন্ড ) ।
    ১ মাইক্রো সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ ( ১০-৬ সেকেন্ড ) ।
    ১ ন্যানো সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের একশত কোটি ভাগের এক ভাগ ( ১০-৯ সেকেন্ড ) ।
    ১ পিকো সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের একলক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ ( ১০-১২ সেকেন্ড ) ।
    কোন কম্পিউটারের একটি সাধারণ যোগ করতে যদি ৫০ ন্যানো সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে ১ সেকেন্ডে এরূপ ২ কোটি যোগ করতে পারবে ।
  2. নির্ভুলতা (Correctness)
  3. সূক্ষ্মতা (Accuracy)
  4. বিশ্বাসযোগ্যতা (Reliability)
  5. ক্লান্তিহীনতা (Dilligence): পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করতে কম্পিউটারের উৎসাহ, মনোযোগ এবং সহিষ্ণুতার একটুও ঘাটতি হয় না। কম্পিউটার প্রোগ্রামে, একই নির্দেশনা বার বার সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াকে লুপিং (Looping) বলে।
  6. স্মৃতিশক্তি (Memory)
  7. স্বয়ংক্রিয়তা (Automation)
  8. বহুমুখিতা (Versatility)
  9. যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত (Logical Decision)
  10. অসীম জীবনীশক্তি (Endless Life)
  11. নির্বোধ কিন্তু বিশ্বস্থ যন্ত্র : কম্পিউটার অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে অনেক বড় এবং জটিল হিসাব-নিকাশের কাজ নির্ভুলভাবে করতে পারলেও কম্পিউটারের নিজের কোন বুদ্ধি নেই। কম্পিউটার নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে কোন কাজ করতে পারে না। মানুষের তৈরি করে দেওয়া নির্দেশমালা অনুসরণ করেই কম্পিউটার সব রকমের কাজ সম্পন্ন করে।

কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস

গণনার কাজে সহায়তার জন্য প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিক কৌশল প্রচলিত থাকলেও অ্যাবাকাস নামক একটি প্রাচীন গণনার যন্ত্রকেই কম্পিউটারের ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়।

অ্যাবাকাস (Abacus) : অ্যাবাকাস প্রাচীনতম গণনা যন্ত্র, যা একটি ফ্রেমে সাজানো গুটির স্থান পরিবর্তন করে গণনা করার কাজ পরিচালিত করে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে অ্যাবাকাসের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল চীনে বলে জানা যায়। গুটিগুলো সঞ্চালন করে অ্যাবাকাসের সাহায্যে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ প্রভৃতি কাজ করা যেত । চীনে অ্যাবাকাসকে বলা হয় সুয়ানপান। (Suanpan), জাপানে সরোবান (Soroban) এবং রাশিয়াতে বলা হয় স্কেটিয়া (Sketia)।

অ্যাবাকাস

নেপিয়ারের অস্থি বা দন্ড (Napier's bones or rods) : স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার (John Napier) ১৬১৪ সালে লগারিদম (Logarithm) এর সারণি আবিষ্কার করেন। এর তিন বছর পর তিনিই দাগকাটা এবং সংখ্যা বসানো দন্ড ব্যবহার করে সংখ্যাভিত্তিক গণনাযন্ত্র আবিষ্কার করেন। এসব দণ্ড নেপিয়ারের অস্থি নামে পরিচিত। এই আবিষ্কার গুণ, ভাগ, বর্গ, বর্গমূল নিরূপণের কাজ অনেক সহজ করে দেয়।

নেপিয়ারের অস্থি বা দন্ড

স্লাইড রুল : নেপিয়ারের লগারিদমের সারণী ব্যবহার করে উইলিয়াম অটরেড ১৬৩০ সালে প্রথম বৃত্তাকার স্লাইড রুল আবিষ্কার করেন।

স্লাইড রুল

প্যাস্কালেন (Pascalene) : ১৬৪২ সালে ফরাসি ব্রেইজ প্যাস্কেল (Blaise Pascal) একটি গণনা যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি এ যন্ত্রে গিয়ারের সাহায্যে চাকা চালানোর পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন যুগের সূচনা করেন।

প্যাস্কালেন

যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর (Calculator) : ১৬৭১ সালে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড ভন লিবনিজ (Gottfried Von Leibnitz) সিলিন্ডার আকৃতিবিশিষ্ট গিয়ার ব্যবহার করে একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। এটি বিশ্বের প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর। 'Stepped Reckoner' নামে পরিচিত এই হিসাবযন্ত্রটির সাহায্যে পৌনঃপুনিক যোগ, গুণ এবং ভাগ করা যেত। ১৮২০ সালে ফ্রান্সের টমাস দ্য কলমার লিবনিজের যন্ত্রের অনুরূপ 'টমাস এরিথোমিটার' নামক যন্ত্র তৈরি করেন। এটি ছিল সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক হস্তচালিত ক্যালকুলেটর ।

ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine) : ১৭৮৬ সালে জার্মানির মুলার 'ডিফারেন্স ইঞ্জিন' নামে পরিচিত একটি ক্যালকুলেটর বা গণনা যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। এর প্রায় দুই যুগ পর ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক চার্লস ব্যাবেজ (Charls Babbage) আরো উন্নত ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Differenc Engine) বা বিয়োগ ফলভিত্তিক গণনার যন্ত্র উদ্ভাবনের পরিকল্পনা করেন চার্লস ব্যাবেজ ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, দার্শনিক, আবিষ্কারক এবং যন্ত্র প্রকৌশলী। ১৮১৩ সালে তিনি ডিফারেন্স ইঞ্জিনকে উন্নত করার জন্য রয়েল সোসাইটি থেকে অনুদান পান। কিন্তু সেই সময়ে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে মেশিনটি তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে এবং রয়েল সোসাইটি অনুদান বন্ধ করে দেন। ১৮৩৩ সালে ব্যাবেজ 'অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিন' নামে অপর একটি যন্ত্র তৈরি করার পরিকল্পনা করেন এবং নকশা তৈরি করেন। ব্যাবেজের এ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিনের পরিকল্পনায় আধুনিক কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যাবেজ আধুনিক কম্পিউটারের মতোই তাঁর মেশিনে গাণিতিক ইউনিট (Arithmetic Unit), স্মৃতি (Memory), নিয়ন্ত্রণ ইউনিট, ইনপুট/আউটপুট (Input/Output) চিহ্নিত করেন। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্র সেই সময় সাফল্যের সাথে কাজ করতে পারেনি। তবে ১৯৯১ সালে তাঁর ডিজাইন থেকেই সফলভাবে কর্মক্ষম একটি যন্ত্র তৈরি করা হয়। ব্যাবেজকে অনেকে 'কম্পিউটারের জনক' আবার অনেকে 'আধুনিক কম্পিউটারের জনক' বলে থাকেন।

এ্যানালাইটিক ইঞ্জিনে সাধারণ এসেম্বলি ভাষায় (Assembly Language) প্রোগ্রাম করার ব্যবস্থা ছিল এবং সফটওয়্যার দরকার হতো। এ সফটওয়্যার তৈরির জন্য ব্যাবেজ বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা এ্যাডা অগাস্টা ল্যাভলেসকে নিয়োগ দেন। অ্যাডা লাভলেসকে "প্রোগ্রামিং ধারণার প্রবর্তক হিসেবে সম্মানিত করা হয়। ১৮৪২ সালে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাবেজ তাঁর ইঞ্জিন সম্পর্কে বক্তব্য দেন। অ্যাডা সে সময় ব্যাবেজের সহায়তায় পুরো বক্তব্যে ইঞ্জিনের কাজের ধারাটি বর্ণনা করেন। কাজের ধারা বর্ণনার সময় তিনি এটি ধাপ অনুসারে ক্রমাঙ্কিত করেন। অ্যাডার মৃত্যুর ১০০ বছর পর ১৯৫৩ সালে সেই নোট আবারো প্রকাশিত হলে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, অ্যাডা আসলে অ্যালগরিদম প্রোগ্রামিংয়ের ধারণাটাই প্রকাশ করেছিলেন। প্রোগ্রামিং ভাষা 'এ্যাডা' তাঁরই নামানুসারে নামকরণ করা হয়।

পাঞ্চকার্ড (Punched Card) : পাঞ্চকার্ড হলো এক প্রকারের শক্ত কাগজের তৈরি কার্ড, যা এর উপরের ছিদ্রের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ভিত্তিতে ডিজিটাল তথ্য প্রকাশ করে। ইউনিট রেকর্ড যন্ত্রে তথ্য ইনপুট, প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো এই কার্ড। হারম্যান হলিরিথ প্রথম এই কার্ডে ডেটা সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। হারম্যান হলিরিথ কর্তৃক এই কার্ড প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে বলে একে হলিরিথ কার্ডও বলে। ১৮০১ সালে বস্তুশিল্পে নকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঞ্চকার্ডের ব্যবহার শুরু হয়। ফ্রান্সের জোসেফ মেরি জেকার্ড (Joseph Marie Jacquard) বস্ত্রশিল্পে পাঞ্চকার্ড ব্যবহার শুরু করেন।

টেবুলেটিং মেশিন (Tabulating Machine) : ১৮৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড. হারম্যান হলিরিথ (Dr. Herman Hollerith) নামের একজন পরিসংখ্যানবিদ সেন্সাস মেশিন বা টেবুলেটিং মেশিন নামে একটি গণনা যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রে তিনি পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করে ১৮৯০ সালের শুমারি মাত্র তিন বছরে শেষ করেন ।

টুরিং মেশিন (Turing Machine) : ইংরেজ গণিতবিদ অ্যালান মাথিসন টুরিং ১৯৩৬ সালে টুরিং মেশিন এর মাধ্যমে গণনা এবং অ্যালগোরিদম এর ধারণার প্রবর্তন করেন। টুরিংকে তাত্ত্বিক কম্পিউটার প্রকৌশল (Theoretical computer science) এর জনক বলা হয়।

ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটার (Electro-Mechanical Computer) : যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত কম্পিউটারকে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটার বলা হয়। ১৯৩৭ সালে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. হাওয়ার্ড এইচ আইকেন (Dr. Howard Aeiken) ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল টেকনিক ব্যবহার করে চার্লস ব্যাবেজের অ্যানালাইটিক ইঞ্জিনের মতো একটি যন্ত্র তৈরি করার পরিকল্পনা করেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। ১৯৪৪ সালে হাওয়ার্ড আইকেন পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটার তৈরি করেন। কম্পিউটারটিতে কোনো ভ্যাকুয়াম ভালভ ব্যবহার করেন নি। কম্পিউটারটি সম্পূর্ণভাবে তড়িৎযান্ত্রিক রিলের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করেছিলেন। এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম স্বয়ংক্রিয় গণনাযন্ত্র। আইবিএম Automatic Sequence Controlled Calculator (ASCC) যন্ত্রটির নামকরণ করেন মার্ক-১। মূলত Mark-I ছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও আইবিএম কোম্পানির যৌথ উদ্যোগের একটি ফসল।

ইলেকট্রনিক কম্পিউটার (Electro Computer) : ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেইট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন এটানাসফ (John Atanasoff) এবং তাঁর ছাত্র ক্লিফোর্ড বেরি (Clifford Berry) ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে একটি ইলেকট্রনিক কম্পিউটার নির্মাণ করেন। উদ্ভাবকের নামানুসারে কম্পিউটারটিকে এবিসি বলা হয়। এতে তথ্য সংরক্ষণের জন্য মেমরি হিসেবে ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়।

১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জন মাউসলি এবং তাঁর এক ছাত্র প্রেসপার একটি যৌথভাবে ENIAC নামক একটি গণনা যন্ত্র তৈরি করেন। এটি পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বা সফল ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার। এর ওজন ছিল ৩০ টন । ১৯৪৫ সালে হাঙ্গেরীয় গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান (John Van Neuman) কম্পিউটার যন্ত্রের জন্য বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহার এবং যন্ত্রের অভ্যন্তরেই উপাত্ত ও নির্বাহ সংকেত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তাঁর এ ধারণা সংরক্ষিত প্রোগ্রাম (Stored Program) নামে খ্যাত। ভন নিউম্যানের তত্ত্বকে ব্যবহার করে ১৯৪৬ সালের মধ্যে ড. জন মউসলি এবং তার ছাত্র প্রেসপার একার্ট EDVAC (Electronic Descrete Variable Automatic Computer) নামে অপর একটি কম্পিউটার তৈরি করেন। এই কম্পিউটারে প্রোগ্রাম সংরক্ষণ এবং রক্ষিত প্রোগ্রাম পুনর্বার নির্বাহের ব্যবস্থা ছিল।

১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মরিস উইলকিস (Prof. Moaurice Wilkes) এর নেতৃত্বাধীন একদল বিজ্ঞানী নিউম্যানের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে EDSAC তৈরি করেন। এতে ডেটা সংরক্ষণের জন্য প্রথম Mercury Delay Lines মেমোরি ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে এডস্যাক (EDSAC) প্রথম সংরক্ষিত প্রোগ্রামবিশিষ্ট ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার। জন মাউসলি ও প্রেসপার একার্ট ১৯৫১ সালে UNIVAC তৈরি করেন। ইউনিভ্যাক ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার এবং এ যন্ত্রেই সর্বপ্রথম চুম্বক-ফিতা ব্যবহার করা হয়েছিল।

কম্পিউটার জাদুঘর : যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত Computer History Museum বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার জাদুঘর। ১৯৯৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

কম্পিউটারের বিবর্তন ও প্রজন্ম

কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের ক্রমবিবর্তন বলতে মূলত কম্পিউটারের প্রজন্ম বা জেনারেশনকেই বোঝায়। কম্পিউটার জেনারেশন বা প্রজন্ম বলতে এর প্রযুক্তিগত বিবর্তনকেই বোঝানো হয়ে থাকে।

প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার / First Generation Computer (১৯৪২-১৯৫৯ খ্রি.) : প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের সার্কিটে বায়ুশূন্য টিউব বা ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো। কম্পিউটারগুলো আকৃতিতে বড় থাকার কারণে সহজে বহনযোগ্য ছিল না। কম্পিউটারে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হতো এবং প্রচুর তাপ উৎপন্ন হতো। পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে ইনপুট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এসব কম্পিউটারের ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। এ প্রজন্মের কম্পিউটারে প্রোগ্রামের জন্য মেশিন ও অ্যাসেম্বলি ভাষা ব্যবহার করা হতো। উদাহরণ: Mark I, UNIVAC, ENIAC, EDSAC, IBM 650, IBM 704 ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার / Second Generation Computer (১৯৬০-১৯৬৪ খ্রি.) : দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরিতে জন বারডিন (John Bardeen), উইলিয়াম শকলে (William Shockley) এবং ওয়াল্টার ব্রাটেইন (Walter Brattain) ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করেন। দুটি অর্ধপরিবাহী ডায়োডকে পাশাপাশি যুক্ত করে একটি অর্ধপরিবাহী ট্রায়োড তৈরি করা হয়। একে ট্রানজিস্টর বলে। ট্রানজিস্টর তৈরিতে অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) হিসেবে সিলিকন বা জার্মেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। ট্রানজিস্টর মূলত এমপ্লিফায়ার (বিবর্ধক) হিসেবে কাজ হয়। ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনিক্সে বিপ্লব শুরু হয়। টিউবের তুলনায় ট্রানজিস্টর আকারে ছোট, বিদ্যুৎ খরচ কম, দামে সস্তা এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো আকৃতিতে ছোট, দ্রুতগতি ও অধিক নির্ভরযোগ্য ছিল। দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে সর্বপ্রথম উচ্চস্তরের ভাষা (যেমন- COBOL, FORTRAN) এর ব্যবহার শুরু হয়। আবার ম্যাগনেটিক কোর মেমরি এবং উচ্চগতিসম্পন্ন ইনপুট আউটপুট ব্যবস্থাও এ প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: IBM 1401, ট্রানজিস্টর CDC 1604, RCA 301, RCA 501, BCR 300, GE 200, Honey well 200, IBM 1620 ইত্যাদি।

তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার / Third Generation Computer (১৯৬৫-৭০ খ্রি.) : ১৯৫৮ সালে রবার্ট নইসি (Robert Noyce) এবং জ্যাক কিলবি (Jack Kilby) সমন্বিত বর্তনী (Integrated Circuit) সংক্ষেপে IC আবিষ্কার করে ইলেকট্রনিক জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। মাইক্রোইলেকট্রনিক্সের অগ্রযাত্রা মূলত তখন থেকে শুরু হয়। একটি মাত্র IC- তে অনেকগুলো ট্রানজিস্টর, রেজিস্টার, ক্যাপাসিটর এবং অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে একটি ক্ষুদ্র সিলিকন পাতের ওপর স্থাপন করা থাকে। ফলে কম্পিউটারের আকার আরো ছোট হয়ে আসে, দাম কমে যায়, বিদ্যুৎ খরচ কমে যায়, কাজের গতি ও নির্ভরশীলতা বহুগুণে বেড়ে যায়। তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে SSI (Small-Scale Integration), MSI (Medium-Scale Integration) ধরনের ব্যবহৃত হতো। IC চিপ দিয়ে তৈরি প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার IBM system 360। তৃতীয় প্রজন্ম থেকেই অর্ধপরিবাহী স্মৃতির ব্যবহার, কম্পিউটারের সাথে ভিডিও ডিসপ্লে ইউনিট (যেমন-মনিটর), উচ্চগতির লাইন প্রিন্টারসহ অন্যান্য পেরিফেরাস ডিভাইসের ব্যবহার শুরু হয়। উদাহরণ: IBM-360, PDP-8, PDP II ।

চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটার / Fourth Generation Computer (১৯৭১ খ্রি. - বর্তমান) : চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করে তৈরি করা হতো। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে IC (Integrated Circuit)-এর দ্রুত উন্নয়নের ফলে LSI (Large Scale Integration) এবং VLSI (Very Large Scale Integration) চিপের আবির্ভাব ঘটে। ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নতির সঙ্গে কম্পিউটারের কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ অংশ বা প্রসেসরের সকল উপাদানকে একটি মাত্র সিলিকন চিপের মধ্যে একীভূত করা সম্ভব হয়। এই চিপকে মাইক্রোপ্রসেসর বলা হয়। মূলত মাইক্রোপ্রসেসর হলো সিলিকনের তৈরি এক ধরনের VLSI চিপ। যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেল কর্পোরেশন ড. টেড হফ (Dr. Ted Hoff) এর তত্ত্বাবধানে ১৯৭১ সালে প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করে যার নাম ইনটেল - ৪০০৪। ইনটেল ৪০০৪ ই ছিল বাণিজ্যিকভাবে প্রাপ্ত বিশ্বের প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর। মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহারের ফলে কম্পিউটারের আকার আরো ছোট হয়ে যায়, দাম কমে যায় এবং বিদ্যুৎ খরচ কমে যায়। কম্পিউটারে উন্নত মেমরির তথা ম্যাগনেটিক বাবল মেমরির ব্যবহার শুরু হয়। Windows, DOS অপারেটিং সিস্টেম দুটির ব্যবহার এ প্রজন্ম থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৮১ সালে IBM কোম্পানি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রথম মাইক্রোকম্পিউটার তৈরি করা শুরু করে। ডেটা স্টোরেজ (সিডি, ডিভিভি প্রভৃতি) এবং সহযোগী যন্ত্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। IBM-3033, IBM -4341, TRS -40, Pentium Series পিসি ইত্যাদি এ প্রজন্মের কম্পিউটার।

পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার / Fifth Generation Computer (ভবিষ্যৎ) : সাধারণত ২০০১ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের কম্পিউটারগুলোকে পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার বিবেচনা করা হয়। মূলত পঞ্চম প্রজন্ম বলতে প্রকৃত অর্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই বোঝায়। এ প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো মানুষের ভাষায় কথা বলা ও মানুষের কথা বুঝতে পারার ক্ষমতাও থাকবে। অর্থাৎ এগুলো হবে বুদ্ধিমান কম্পিউটার। পঞ্চম প্রজন্ম VLSI প্রযুক্তিকে অতিক্রম করে UVLSI (Ultra Very Large Scale Integration) প্রযুক্তিতে অবস্থান করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) এবং রোবোটিক প্রযুক্তির চরম বিকাশ ঘটবে। কণ্ঠস্বর সনাক্তকরণ এবং বিশ্বের সকল ভাষায় কম্পিউটিং এর সম্প্রসারণ ঘটবে।

নবীনতর পূর্বতন