ভূগোল ও পরিবেশ - বিসিএস প্রস্তুতি

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন মানুষ বাস করে তেমনি তার চারপাশে রয়েছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ। ভূগোল পরিবেশের সকল বিষয়কে নিয়ে আলোচনা করে। ভূগোলকে একদিকে যেমন প্রকৃতির বিজ্ঞান বলা হয়, তেমনি অন্যদিকে একে পরিবেশ ও সমাজের বিজ্ঞানও বলা হয়। এই টিউটরিয়ালে আমরা ভূগোল ও পরিবেশের ধারণা, মানচিত্র , পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন , ভূ-ত্বক , শিলা ও খনিজ , ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন , পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন , পর্বত , মালভূমি এবং সমভূমি নিয়ে আলোচনা করব।

ভূগোল ও পরিবেশ

ভূগোলের ধারণা

ইংরেজী 'Geography' শব্দটি থেকে ভূগোল শব্দটি এসেছে। প্রাচীন গ্রিসের ভূগোলবিদ ইরাটেসথেনিস প্রথম 'Geography' শব্দ ব্যবহার করেন। Geography = Geo ("ভূ" বা পৃথিবী) + graphy (বর্ণনা)। সুতরাং 'Geography' শব্দটির অর্থ পৃথিবীর বর্ণনা। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির বিজ্ঞান একাডেমির মতে, পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপব্যবস্থাগুলো কীভাবে সংগঠিত এবং এসব প্রাকৃতিক বিষয় বা অবয়বের সঙ্গে মানুষ নিজেকে কীভাবে বিন্যস্ত করে তার ব্যাখ্যা খোঁজে ভূগোল।

ভূগোলের পরিধি: নানান রকম বিষয় যেমন- ভূমিরূপবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, সমুদ্রবিদ্যা, মৃত্তিকাবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি ভূগোল বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অধ্যাপক ডাডলি স্ট্যাম্প এর মতে- "পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের বর্ণনাই হল ভূগোল" । অধ্যাপক কার্ল রিটার ভূগোলকে বলেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞান।

ভূগোলের শাখা: ভূগোলের দুটি প্রধান শাখা হলো- প্রাকৃতিক ভূগোল এবং মানবিক ভূগোল। পৃথিবীর ভূমিরূপ, এর গঠন প্রক্রিয়া, বায়ুমন্ডল, বারিমন্ডল, জলবায়ু ইত্যাদি প্রাকৃতিক ভূগোলের আলোচ্য বিষয়। অর্থনৈতিক ভূগোল, জনসংখ্যা ভূগোল, আঞ্চলিক ভূগোল, রাজনৈতিক ভূগোল, সংখ্যাতাত্ত্বিক ভূগোল, পরিবহন ভূগোল, নগর ভূগোল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মানবিক ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।

পরিবেশের ধারণা

মানুষ যেখানেই বাস করুক তাকে ঘিরে একটি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিরাজমান। প্রকৃতির সকল দান মিলেমিশে তৈরি হয় পরিবেশ। নদী, নালা, সাগর, মহাসাগর, পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল, ঘর, বাড়ি, রাস্তাঘাট, উদ্ভিদ, প্রাণী, পানি, মাটি ও বায়ু নিয়ে গড়ে ওঠে পরিবেশ। কোনো জীবের চারপাশের সকল জীব ও জড় উপাদানের সর্বসমেত প্রভাব ও সংঘটিত ঘটনা হলো ঐ জীবের পরিবেশ। পরিবেশ বিজ্ঞানী আর্মসের (Arms) মতে, জীবসম্প্রদায়ের পারিপার্শ্বিক জৈব ও প্রাকৃতিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে।

পার্ক (CC Park) বলেছেন, পরিবেশ বলতে স্থান ও কালের কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে মানুষকে ঘিরে থাকা সকল অবস্থার যোগফল বোঝায়। স্থান ও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবেশও পরিবর্তিত হয়। যেমন শুরুতে মাটি, পানি, বায়ু, উদ্ভিদ, প্রাণী নিয়ে ছিল মানুষের পরিবেশ। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন ধরনের পরিবেশ ।

পরিবেশের উপাদান (Elements of environment): পরিবেশের উপাদান দুই প্রকার যেমন জড় উপাদান ও জীব উপাদান। যাদের জীবন আছে, যারা খাবার খায়, যাদের বৃদ্ধি আছে, জন্ম আছে, মৃত্যু আছে তাদের বলে জীব। গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী হলো জীব। এরা পরিবেশের জীব উপাদান। জীবদের নিয়ে পড়া পরিবেশ হলো জীব পরিবেশ। মাটি, পানি, বায়ু, পাহাড়, পর্বত, নদী, সাগর, আলো, উষ্ণতা, আর্দ্রতা হলো পরিবেশের জড় উপাদান। এই জড় উপাদান নিয়ে গড়া পরিবেশ হলো জড় পরিবেশ।

মানচিত্র

ল্যাটিন' 'mappa' থেকে ইংরেজি map শব্দটি এসেছে যার বাংলা অর্থ মানচিত্র। মানচিত্র হলো নির্দিষ্ট ছেলে অক্ষরেখা বা দ্রাঘিমারেখা সহ কোন সমতল ক্ষেত্রের উপর পৃথিবী বা এর অংশবিশেষ এর প্রতিরুপ।

  • প্রথম মানচিত্র তৈরি হয় মিশরে তিন হাজার বছর পূর্বে
  • প্রাচীনতম মানচিত্র পাওয়া যায় ব্যাবিলনের গাথুর শহরের ধ্বংসাবশেষে।
  • পৃথিবীর মানচিত্র প্রথম অংকন করেন গ্রীকরা।
  • বাংলাদেশের মানচিত্র প্রথম আঁকেন জেমস রেনেল
মানচিত্রের প্রকারভেদ
স্কেল অনুসারে: বিষয়বস্তু হিসেবে:
• বৃহৎ স্কেল এর মানচিত্র (১: ১০,০০০) • গুণগত মানচিত্র
• ক্ষুদ্র স্কেল এর মানচিত্র • পরিমাণগত মানচিত্র

বড় স্কেলের মানচিত্রের মধ্যে বিস্তারিতভাবে কোনো একটি স্থানের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ করা হয়। কার্যের উপর ভিত্তি করে মানচিত্রকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-১) প্রাকৃতিক মানচিত্র ও ২) সাংস্কৃতিক মানচিত্র।

মানচিত্রে জিপিএস ও জিআইএস (GPS & GIS Maps): বর্তমানে মানচিত্র তৈরি, পঠন এবং ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে আধুনিক ব্যবহার হচ্ছে জিপিএস এবং জিআইএস। জিপিএস এর ইংরেজি হলো Global Positioning System (GPS) জিপিএস দ্বারা যেসব কাজ করা যায় তা হলো: জিপিএস দ্বারা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, উচ্চতা ও দূরত্ব জানা যায় এছাড়া ঐ স্থানের দিক, তারিখ ও সময় জানা যায়। জমির সীমানা চিহ্নিত করা এবং দুর্যোগকালীন সময়ে এটি অধিক কার্যকর।

জিআইএস (Geographical Information System): ভৌগোলিক তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থাকে সংক্ষেপে জিআইএস বলে। এটি কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ ব্যবস্থা যার মধ্য দিয়ে ভৌগোলিক তথ্যগুলোর সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্থানিক ও পারিসরিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ, মানচিত্রায়ণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। ১৯৬৪ সালে কানাডায় সর্বপ্রথম এই কৌশলের ব্যবহার আরম্ভ হয়। ১৯৮০ সালের দিকে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বর্তমানে ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, পানি গবেষণা, আঞ্চলিক গবেষণা, নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা, জনসংখ্যা বিশ্লেষণ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ প্রভৃতি বহুবিধ কাজে জিআইএস ব্যবহার হচ্ছে।

আইসোহাইট (Isoliyet) বা সমবর্ষণ রেখা : ভূ-পৃষ্ঠের একই পরিমাণ বৃষ্টিপাত বিশিষ্ট স্থানসমূহকে যখন মানচিত্রে রেখা দ্বারা সংযুক্ত করা হয় তখন তাকে বলা হয় সমবর্ষণ রেখা এবং যে মানচিত্রে এ রেখাগুলো দেখানো হয় তাকে সমবর্ষণ রেখা মানচিত্র বলে। সমবর্ষণ রেখা দ্বারা কোনো স্থানের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের উপাত্ত ইঞ্চিতে প্রকাশ করা হয়। আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা সমবর্ষণ রেখার মাধ্যমে দৈনিক বৃষ্টিপাতের পরিমাপের সাথে বিভিন্ন বছরের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাপের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেন। সমতাপ সম্পন্ন স্থান সমূহকে যোগ করতে ব্যবহৃত হয় আইসোথার্ম অন্যদিকে সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানের সম লবণাক্ততা নির্দেশ করতে মানচিত্রে ব্যবহৃত রেখার নাম আইসোহ্যালাইন।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন

জন্মের সময় পৃথিবী ছিল এক উত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড। এই গ্যাসপিন্ড ক্রমে ক্রমে শীতল হয়ে ঘনীভূত হয়। এ সময় এর উপর যে আস্তরণ পড়ে তা হলো ভূত্বক।

ভূ-ত্বক: ভূপৃষ্ঠে শিলার যে কঠিন বহিরাবরণ দেখা যায়, তা-ই ভূত্বক। ভূত্বকের পুরুত্ব খুবই কম; গড়ে ২০ কিমি। ভূত্বক মহাদেশের তলদেশে গড়ে ৩৫ কিমি এবং সমুদ্র তলদেশে তা গড়ে মাত্র ৫ কিমি পুরু। ভূগর্ভের রয়েছে তিনটি স্তর। অশ্মমন্ডল, গুরুমণ্ডল ও কেন্দ্রমন্ডল।

অশ্মমন্ডল (Lithosphere): ভূত্বক ও গুরুমন্ডলের। উর্ধ্বাংশ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু এ স্তরকে একত্রে শিলামণ্ডল বা অশ্মমন্ডল বলে। অশ্মমন্ডল = ভূত্বক + গুরুমন্ডলের উর্ধ্বাংশ ১০০ কিমি।

গুরুমন্ডল (Barlysphere): অশ্মমন্ডলের নিচে প্রায় ২,৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরুমন্ডলকে গুরুমন্ডল বলে। গুরুমণ্ডল মূলত ব্যাসল্ট (Basalt) শিলা দ্বারা গঠিত। এ অংশে বয়েছে সিলিকা, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, কার্বন ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ। গুরুমন্ডল দুই ভাগে বিভক্ত যথাঃ
(ক) ঊর্ধ্ব গুরুমন্ডল যা ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই মন্ডল প্রধানত লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ সিলিকেট খনিজ দ্বারা গঠিত।
(খ) নিম্ন গুরুমন্ডল প্রধানত আয়রন অক্সাইড, ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং সিলিকন ডাইঅক্সাইড সমৃদ্ধ খনিজ দ্বারা গঠিত।

কেন্দ্রমন্ডল (Centrosphere): গুরুমন্ডলের ঠিক পরে রয়েছে কেন্দ্রমণ্ডল। গুরুমন্ডলের নিচ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত এই মন্ডল বিস্তৃত। এ স্তর প্রায় ৩,৪৮৬ কিলোমিটার পুরু। ভূকম্পন তরঙ্গের সাহায্যে জানা গেছে যে, কেন্দ্র মন্ডলের একটি তরল বহিরাবরণ আছে, যা প্রায় ২,২৭০ কিলোমিটার পুরু এবং একটি কঠিন অগ্রভাগ আছে, যা ১,২১৬ কিলোমিটার পুরু। বিজ্ঞানীগণ বিশ্বাস করেন যে, কেন্দ্র মন্ডলের উপাদানগুলোর মধ্যে লোহা, নিকেল, পারদ ও সিসা রয়েছে। তবে প্রধান উপাদান হলো নিকেল ও লোহা ।

ভূ-ত্বক

  • ভূত্বক : ভূপৃষ্ঠে শিলার যে কঠিন বহিরাবরণ দেখা যায় তাই ভূত্বক।
  • ভূত্বক-এর পুরুত্ব: ভূত্বকের পুরুত্ব খুবই কম। গড়ে ২০ কি:মি:। ভূত্বক মহাদেশের তলদেশে গড়ে ৩৫ কি:মি: এবং সমুদ্র তলদেশে তা গড়ে মাত্র ৫ কি:মি: পুরু।
  • ভূত্বকের প্রধান উপাদান: অক্সিজেন (৪২.৭%)
  • ভূ-পৃষ্ঠ থেকে গর্ত করে নিচে যেতে থাকলে তাপ ও চাপ উভয়ই বাড়বে।
  • কেন্দ্রমণ্ডলের চাপ পৃথিবী পৃষ্ঠের বায়ুচাপের চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ বেশি।
  • কেন্দ্রমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ৩,০০০° থেকে ৫,০০০° সেলিসিয়াস।
ভূত্বকের উপাদান
উপাদান শতকরা
o, অক্সিজেন ৪২.৭%
Si, সিলিকন ২৭.৭%
Al, অ্যালুমিনিয়াম ৮.১%
Fe, আয়রন ৫.১%
Ca, ক্যালসিয়াম ৩.৭%
Na, সোডিয়াম ২.৮%
K, পটাসিয়াম ২.৬%
Mg, ম্যাগনেসিয়াম ২.১%
জেনে রাখা ভালঃ
স্তরের নাম পরিচিত দ্বারা গঠিত হয়
সিয়াল (Sial) মহাদেশীয় ভূত্বক সিলিকন (Si) ও অ্যালুমিনিয়াম (AI)
সিমা (Sima) সমুদ্র তলদেশের ভূত্বক সিলিকন (Si) এবং ম্যাগনেসিয়াম (Mg)
মোহোবিচ্ছেদ ভূত্বক ও গুরুমন্ডলের মাঝে একটি অত্যন্ত পাতলা স্তর আছে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার ভূ-বিজ্ঞানী মাহোরোভিসিক ১৯০৯ সালে ভূত্বক ও গুরুমন্ডল পৃথককারী এ স্তরটি আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে এ স্তরটি মোহোবিচ্ছেদ নামে পরিচিত।
নিফে (NiFe) কেন্দ্র মন্ডলের প্রধান উপাদান লোহা (Fe) ও নিকেল (Ni)

শিলা ও খনিজ

ভূত্বক যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি তার সাধারণ নাম শিলা। পৃথিবীতে কার্যরত বিভিন্নভাবে ভূমিরূপ প্রক্রিয়া শিলা ও খনিজের ধরন দ্বারা প্রভাবিত হয়।

খনিজ (Mineral) : কতকগুলো মৌলিক উপাদান প্রাকৃতিক উপায়ে মিলিত হয়ে যে যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি করে, তাকে খনিজ বলে। খনিজ সাধারণত দুই বা ততোধিক মৌলের সমন্বয়ে গঠিত। তবে কিছু কিছু খনিজ একটি মাত্র মৌল দ্বারাও গঠিত হতে পারে। একটি মাত্র মৌল দিয়ে গঠিত খনিজ হচ্ছে হীরা, সোনা, তামা, রুপা, পারদ ও গন্ধক। সবচেয়ে কঠিন খনিজ হীরা এবং সবচেয়ে নরম খনিজ ট্যালক।

শিলা (Rock) : শিলা এক বা একাধিক খনিজের মিশ্রণ। শিলা গঠনকারী প্রতিটি খনিজের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। যদিও বেশির ভাগ শিলাই একাধিক খনিজ দ্বারা গঠিত হয়। সে ক্ষেত্রে খনিজ এবং শিলা একই পদার্থ। যেমন- ক্যালসাইট একটি খনিজ এবং শিলা হিসেবে এটি চুনাপাথর নামে পরিচিত।

শিলার প্রকারভেদ: উৎপত্তি অনুযায়ী ভূত্বকের শিলা তিন ধরনের। যথা-

  • ১) আগ্নেয় শিলা,
  • ২) পাললিক শিলা ও
  • ৩) রূপান্তরিত শিলা

আগ্নেয় শিলা (Igneous Rock)

পৃথিবীর শুরু থেকে যে সব শিলা উত্তপ্ত গলিত অবস্থা হতে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে কঠিন হয়েছে, তাই আগ্নেয় শিলা। Igneous অর্থ আগুন। অগ্নিময় অবস্থা হতে এ শিলার সৃষ্টি হয়েছিল বলে একে আগ্নেয় শিলা বলে। আগ্নেয় শিলার অন্য নাম প্রাথমিক শিলা, অন্তরীভূত শিলা। আগ্নেয় শিলার অ্যান্ডেসাইট, ব্যাথোলিথ, ল্যাকোলিথ, ডাইক, সিল প্রভৃতি। এই শিলায় জীবাশ্ম নেই। এই শিলার বৈশিষ্ট্য হলো-

  • (ক) স্ফটিকার
  • (খ) অন্তরীভূত
  • (গ) কঠিন ও কম ভঙ্গুর
  • (ঘ) জীবাশ্ম দেখা যায় না এবং
  • (ঙ) অপেক্ষাকৃত ভারী।

আগ্নেয় শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) বহিঃজ আগ্নেয় শিলা (Extrusive Igneous Rock) ও (২) অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা (Intrusive Igneous Rock)

আগ্নেয় শিলার উদাহরণ:
বহিঃজ আগ্নেয় শিলা অন্ত:জ আগ্নেয় শিলা
ব্যাসল্ট , রায়োলাইট , অ্যান্ডিসাইট গ্রানাইট, গ্যাব্রো, ডলোবাইট, ল্যাকোলিথ, ব্যাথোলিখ, ডাইক, সিল
এদের দানা সূক্ষ্ম ও রং গাঢ় এদের দানা স্থুল এবং রং হালকা

পাললিক শিলা (Sedimentary Rock)

পলি সঞ্চিত হয়ে যে শিলা গঠন করে তা পাললিক শিলা। এ শিলায় পলি সাধারণত স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয় বলে একে স্তরীভূত শিলাও বলে।

পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য : পাললিক শিলা স্তরীভূত নরম ও হালকা, সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এর মধ্যে পাললিক জীবাশ্ম দেখা যায়। পাললিক শিলায় ছিদ্র দেখা যায়।

পাললিক শিলার উদাহরণ: চুনাপাথর, কয়লা, নুড়িপাথর, বেলেপাথর, পলিপাথর, কর্দমপাথর, চক, কোকিনা, লবণ, ডোলোমাইট, জিপসাম, ডায়াটম প্রভৃতি।

পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য :

  • স্তরায়ন
  • তরঙ্গ ছাপ
  • জীবাশ্মের উপস্থিতি
  • কর্দম ফাটল

জীবাশ্ম (Fossil): পাললিক শিলাস্তরের মধ্যে নানাবিধ সামুদ্রিক জীবজন্তুর কঙ্কাল ও উদ্ভিদের দেহাবশেষ প্রস্তরীভূত অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। প্রস্তরীভূত প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবদেহকে জীবাশ্ম বলে। জীবাশ্ম সম্পর্কিত বিজ্ঞানকে ফসিওলজি বলে।

রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rock)

কোন শিলায় তাপ, চাপ ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে এর খনিজ উপাদান ও বুনটের পরিবর্তন হয়ে যে নতুন শিলার সৃষ্টি হয় তাকে রূপান্তরিত শিলা বলে। আগ্নেয় বা পাললিক শিলা হতে পরিবর্তনের মাধ্যমে রূপান্তরিত শিলার সৃষ্টি হয়। প্রধান রূপান্তরিত শিলা হলো:

  • ১) নিস : গ্রানাইট থেকে নিস এর সৃষ্টি হয়।
  • ২) শ্লেট : শেল, কাদা থেকে প্লেট এর সৃষ্টি হয়।
  • ৩) মার্বেল : চুনাপাথর বা ডোলোমাইট থেকে সৃষ্টি হয়।
  • ৪) কায়ার্টাজাইট : কোয়ার্টজ, বেলেপাথর থেকে সৃষ্টি হয়।
  • ৫) গ্রাফাইট : কয়লা থেকে সৃষ্টি হয়।

শিলা ও খনিজের ধর্ম কিসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়: খনিজের ধর্ম এর গঠনকারী মৌলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরদিকে শিলার ধর্ম এর গঠনকারী খনিজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

  • পাললিক শিলা ভূপৃষ্ঠের মোট আয়তনের ৫%, তবে মহাদেশীয় ভূ-ত্বকের আয়তনের ৭৫% ।
  • পাললিক শিলার অপর নাম স্তরীভূত শিলা।
  • কয়লা ও খনিজ তেলকে বলে জৈব শিলা।
  • জীবাশ্ম দেখা যায়- পাললিক শিলায়।
  • স্ফটিক যুক্ত কঠিন শিলা- রূপান্তরিত শিলা।
  • ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয় রূপান্তরিত শিলা।

ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তন

ভূমিপৃষ্ঠের পরিবর্তন: ভূ-পৃষ্ঠ সর্বদা পরিবর্তনশীল। যে সমস্ত কার্যাবলির কারণে প্রাকৃতিকভাবে ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে ভূ-প্রক্রিয়া বলে ।

ভূ-প্রক্রিয়া

ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- আকস্মিক পরিবর্তন ও ধীর পরিবর্তন ।

আকস্মিক পরিবর্তন: পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ এখনও উত্তপ্ত ও গলিত অবস্থায় রয়েছে। এসব উত্তপ্ত বস্তুর মধ্যে তাপ ও চাপের পার্থক্য হলে ভূ-ত্বকে যে আলোড়ন ঘটে তাকে ভূ-আলোড়ন বলে। এ ভূ- আলোড়নের ফলেই ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ পরিবর্তন হয়ে থাকে। বিভিন্ন ভূমিরূপ গঠনকারী শক্তির প্রভাবে ভূগর্ভে সর্বদা নানারূপ পরিবর্তন হচ্ছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূ-কম্পন, পৃথিবীর অভ্যন্তরের সংকোচন, ভূ-গর্ভের তাপ ও অন্যান্য প্রচন্ড শক্তির ফলে ভূপৃষ্ঠে হঠাৎ যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তাকে আকস্মিক পরিবর্তন বলে। এরূপ পরিবর্তন খুব বেশি স্থান জুড়ে হয় না। আকস্মিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় প্রধানত ভূমিকম্প, সুনামি ও আগ্নেয়গিরি দ্বারা।

ধীর পরিবর্তন: ধীর পরিবর্তন হলো আকস্মিক পরিবর্তনের একেবারেই বিপরীত অবস্থা। অনেকগুলো প্রাকৃতিক শক্তি যেমন- সূর্যতাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, নদী, হিমবাহ প্রভৃতি দ্বারা যে পরিবর্তন ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় তাকে ধীর পরিবর্তন বলে। এই ধীর পরিবর্তন বিশাল এলাকা জুড়ে হয়ে থাকে। যেসব প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে ক্ষয়ীভবনের মধ্য দিয়ে ধীর পরিবর্তন সংঘটিত হয় তাদের মধ্যে বায়ু, বৃষ্টিপাত, নদী, হিমবাহ প্রভৃতি প্রধান। এদের ক্ষয়কার্য নিম্নে আলোচিত হলো:

বায়ুর কাজ: বায়ুতে থাকা অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয়বাষ্প রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলার বিচ্ছেদ ও ক্ষয়সাধন করে। বায়ুর ক্ষয়কার্য মরুভূমিতে অধিক দেখা যায়।

বৃষ্টির কাজ: বৃষ্টির পানি ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় ভূপৃষ্ঠকে ব্যাপকভাবে ক্ষয় করে। প্রবাহিত হওয়ার সময় পানি শিলাকে আংশিকভাবে ক্ষয় ও আলগা করে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাকে প্রসারিত করে।

হিমবাহের কাজ: হিমবাহের দ্বারাও ভূ-পৃষ্ঠের কোনো কোনো অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষয় হয়ে থাকে।

নদীর কাজ: যেসব প্রাকৃতিক শক্তি ভূপৃষ্ঠের নিয়ত ধীর পরিবর্তন করছে তাদের মধ্যে নদীর কাজ অন্যতম। নদী যখন পর্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন স্রোতের আঘাতে বাহিত নুড়ি, কর্দম প্রভৃতির ঘর্ষণে নদীগর্ত ও পার্শ্বক্ষয় হয়। পার্বত্য অবস্থায় নদীর স্রোতের বেগ বেশি থাকে। এতে নদী নিচের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং কোনো সঞ্চয় হতে পারে না। যখন নদী সমভূমিতে আসে তখন নদী ক্ষয় এবং সঞ্চয় দুটোই করে।

উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গতিপথের আয়তন, গভীরতা, ঢাল, স্রোতের বেগ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে নদীর গতিপথকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • (ক) উর্ধ্বগতিঃ উর্ধ্বগতি হলো নদীর প্রাথমিক অবস্থা। পর্বতের যে স্থান থেকে নদীর উৎপত্তি হয়েছে সেখান থেকে সমভূমিতে পৌছানো পর্যন্ত অংশকে নদীর উর্ধ্বগতি বলে। এ অবস্থায় মূলত ক্ষয়সাধন হয়
  • (খ) মধ্যগতি: পার্বত্য অঞ্চল পার হয়ে নদী যখন সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন এর প্রবাহকে মধ্যগতি বলে। এ অবস্থায় নদীর সঞ্চয় কাজের মাধমে প্লাবন সমভূমি তৈরী হয়।
  • (গ) নিম্নগতি: নদীর জীবনচক্রের শেষ পর্যায় হলো নিম্নগতি। এ অবস্থায় স্রোত একেবারে কমে যায়। নিম্নক্ষয় বন্ধ ও পার্শ্বক্ষয় হয় অল্প পরিমাণে নদী উপত্যকা খুব চওড়া ও অগভীর হয়। স্রোতের বেগ কমে যাওয়ায় পানিবাহিত বালুকণা, কাদা নদীগর্ভে ও মোহনায় সঞ্চিত হয়।

নদী দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ : নদী দুইভাবে ভূমিরূপের সৃষ্টি করে। একটি হলো এর ক্ষয়কার্য ও অপরটি হলো এর সঞ্চয়কার্য। নিম্নে নদীর ক্ষয়জাত ও সঞ্চয়জ্যত ভূমিরূপ বর্ণনা করা হলো।

নদীর ক্ষয়জাত ভূমিরূপ

১) "ভি" আকৃতির উপত্যকা ('V' Shaped Valley): উর্ধ্বগতি অবস্থায় নদীর স্রোতের বেগ প্রবল দ্বারা গঠিত হলেও মাঝে মাঝে নরম শিলাও থাকে। নদীখাতে পার্শ্ব অপেক্ষা নিম্নদিকের শিলা বেশি। কোমল বলে পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় বেশি হয়। এভাবে ক্রমশ ক্ষয়ের ফলে নদী উপত্যকা অনেকটা ইংরেজি "V" আকৃতির হয়। তাই একে "V" আকৃতির উপত্যকা বলে।

ভি আকৃতির উপত্যকা

২) 'ইউ' আকৃতির উপত্যকা ('U' Shaped Valley): উর্ধ্বগতি অবস্থা শেষ করে নদী যখন মধ্যগতিতে সমভূমিতে এসে পড়ে তখন নদী তার নিম্নক্ষয়ের চেয়ে পার্শ্বক্ষয় বেশি করে। ফলে নদী উপত্যকা ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে এবং কোনো কোনো স্থানে ইংরেজি'U' অক্ষরের মতো হয়। এ ধরনের নদী উপত্যকাকে 'ইউ' আকৃতির উপত্যকা বলে।

ইউ আকৃতির উপত্যকা

৩) গিরিখাত ও ক্যানিয়ন (Gorge and Canyon): উর্ধ্বগতি অবস্থায় নদীর প্রবল স্রোত খাড়া পর্বতগাত্র বেয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এতে ভূপৃষ্ঠ ক্ষয় হয় এবং ভূত্বক থেকে শিলাখন্ড ভেঙে পড়ে। শিলাগুলো পরস্পরের সঙ্গে এবং নদীখাতের সঙ্গে সংঘর্ষে মসৃণ হয়ে অনেক দূর চলে যায়। সব পাথরের সংঘর্ষে নদীর খাত গভীর ও সংকীর্ণ হতে থাকে। নদীর দুপাশের ভূমি ক্ষয় কম হলে বা না হলে এসব খাত খুব গভীর ও সংকীর্ণ হতে থাকে। এক পর্যায়ে এসব খাত খুব গভীর হয়। তখন এরূপ খাতকে গিরিসংকট বা গিরিখাত বলে। সিন্ধু নদের গিরিখাতটি প্রায় ৫১৮ মিটার গভীর। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ গিরিখাত। নদী যখন শুষ্ক অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং সেখানে যদি কোমল শিলার স্তর থাকে তাহলে গিরিখাতগুলো অত্যন্ত সংকীর্ণ ও গভীর হয়। এরূপ গিরিখাতকে ক্যানিয়ন বলে। উত্তর আমেরিকার কলোরাডো নদীর গিরিখাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (Grand Canyon) পৃথিবী বিখ্যাত। এটি ১৩৭-১৫৭ মিটার বিস্তৃত, প্রায় ২.৪ কিলোমিটার গভীর ও ৪৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ ।

গিরিখাত ও ক্যানিয়ন

৪) জলপ্রপাত (Waterfall): উর্ধ্বগতি অবস্থায় নদীর পানি যদি পর্যায়ক্রমে কঠিন শিলা ও নরম শিলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তাহলে কোমল শিলাস্তরটিকে বেশি পরিমাণে ক্ষয় করে ফেলে। এর ফলে নরম শিলাস্তরের তুলনায় কঠিন শিলাস্তর অনেক উপরে অবস্থান করে এবং পানি খাড়াভাবে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এরূপ পানির পতনকে জলপ্রপাত বলে। উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স নদীর বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাত এরূপে গঠিত হয়েছে।

জলপ্রপাত

নদীর সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ

১. পলল কোণ ও পলল পাখা (Alluvial Cone and Alluvial Fan): পার্বত্য কোনো অঞ্চল থেকে হঠাৎ করে কোনো নদী যখন সমভূমিতে পতিত হয়, তখন শিলাচূর্ণ, পলিমাটি প্রভৃতি পাহাড়ের পাদদেশে সমভূমিতে সঞ্চিত হয়ে ত্রিকোণ ও হাতপাখার ন্যায় ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়। এ কারণে এরূপ পলভূমিকে পলল কোণ বা পলল পাখা বলে।

পলল কোণ ও পলল পাখা

যেসব অঞ্চলে মাটি অধিক পানি শোষণ করতে পারে। সেসব অঞ্চলে পানি শোষণের ফলে শিলাচূর্ণ অধিক দূরত্বে যেতে পারে না এবং সেসব অঞ্চলের সঞ্চয় প্রশস্ত না হয়ে কোণাকৃতি হয়। একে পলল কোণ বলে।

পানি বেশি শোষণ করতে না পারলে শিলাচূর্ণ বিস্তৃত হয়ে হাতপাখার ন্যায় ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়। এরূপ পললভূমিকে পলল পাখা বলে। হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীর গতিপথে এরূপ ভূখণ্ড দেখতে পাওয়া যায়।

২. পাদদেশীয় পলল সমভূমি (Peidmont Alluvial Plain): অনেক সময় পাহাড়িয়া নদী পাদদেশে পলি সঞ্চয় করতে করতে একটা সময় পাহাড়ের পাদদেশে নতুন বিশাল সমভূমি গড়ে তোলে। এ ধরনের সমভূমিকে পাদদেশীয় পলল সমভূমি বলে। বাংলাদেশের তিস্তা, আত্রাই, করতোয়া সংলগ্ন রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ স্থানই পলল সমভূমি নামে পরিচিত। এসব নদী উত্তরের হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে সহজেই পাহাড় থেকে পলল বহন করে এ অঞ্চলে সঞ্চয় করে পাদদেশীয় পললভূমি গঠন করেছে।

পাদদেশীয় পলল সমভূমি

পাদদেশীয় পলল সমভূমি

৩. প্লাবন সমভূমি (Flood Plain): বর্ষাকালে বিশেষ করে পানি বৃদ্ধির কারণে নদীর উভয়কূল প্লাবিত করে তখন তাকে প্লাবন বা বন্যা বলে। বন্যা শেষে নদীর দুপাশের ভূমিতে খুব পুরু স্তর কাদা, পলি দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে অনেকদিন পলি জমতে জমতে যে বিস্তৃত সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে প্লাবন সমভূমি বলে। সমভূমি বলা হলেও এর কোথাও কোথাও সামান্য উঁচু-নিচু দেখা যায়। কয়েকটি জেলা ব্যতীত মোটামুটি সমগ্র বাংলাদেশই পদ্মা, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি নদীবিধৌত প্লাবন সমভূমি। প্লাবন সমভূমির মধ্যে অনেক ধরনের সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো- (ক) অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ, (খ) বালুচর এবং (গ) প্রাকৃতিক বাঁধ।

প্লাবন সমভূমি

৪. ব-দ্বীপ সমভূমি (Delta Plain): নদী যখন মোহনার কাছাকাছি আসে তখন তার স্রোতের বেগ একেবারেই কমে যায়। এতে বালি ও কাদা তলানিরূপে সঞ্চিত হয়। নদীর স্রোতটান যদি কোনো সাগরে এসে পতিত হয় তাহলে ঐ সমস্ত বালি, কাদা নদীর মুখে জমে নদীমুখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে এর স্তর সাগরের পানির উচ্চতার উপরে উঠে যায়। তখন নদী বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে এই চরাভূমিকে বেষ্টন করে সাগরে পতিত হয়। ত্রিকোণাকার এই নতুন সমতলভূমিকে ব-দ্বীপ সমভূমি বলে।

এটি দেখতে মাত্রাহীন বাংলা 'ব' এর মতো এবং গ্রিক শব্দ 'ডেল্টা'র মতো তাই এর বাংলা নাম ব-দ্বীপ এবং ইংরেজি নাম 'Delta' হয়েছে। হুগলি নদী থেকে পূর্ব দিকে মেঘনার সীমানা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে সমস্ত দক্ষিণাংশ গঙ্গা ও পদ্মা নদীর বিখ্যাত ব-দ্বীপ অঞ্চল।

  • ভূপ্রক্রিয়া: যে সমস্ত কার্যাবলির কারণে প্রাকৃতিকভাবে ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে ভূপ্রক্রিয়া বলে।
  • কোন ভূপ্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠে আকস্মিক পরিবর্তন আনে: ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত।
  • কোন ভূপ্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠে ধীর পরিবর্তন আনে: নগ্নীভবন, অবক্ষেপণ।
  • কোন ভূপ্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠে ধীর ও আকস্মিক উভয় পরিবর্তন আনতে পারে: ভূ-আলোড়ন।
  • নদীর অধিক বিস্তৃত মোহনাকে খাঁড়ি বলে।
  • অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায় প্লাবন সমভূমিতে।
  • উত্তর আমেরিকার কলোরাডো নদীর গিরিখাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।
  • দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি -- দোয়াব।
  • দুই / ততোধিক নদীর মিলনস্থল-নদী সংগম।
  • জলপ্রপাত নদীর ক্ষয়জাত ভূমিরূপ।

পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন

ভৌগোলিক দিক দিয়ে বিচার করলে পৃথিবীর সমগ্র ভূমিরূপকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-(১) পর্বত, (২) মালভূমি এবং (৩) সমভূমি।

পর্বত (Mountains)

১. পর্বত (Mountains): সমুদ্রতল থেকে অন্তত ১০০০ মিটারের বেশি উঁচু সুবিস্তৃত ও খাড়া ঢালবিশিষ্ট শিলাস্তূপকে পর্বত বলে। সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মিটার উঁচু স্বল্প বিস্তৃত শিলাস্তূপকে পাহাড় বলে। পর্বতের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার মিটার হতে পারে। পর্বতের ভূপ্রকৃতি বন্ধুর, ঢাল খুব খাড়া এবং সাধারণত চূড়াবিশিষ্ট হয়। কোনো কোনো পর্বত বিচ্ছিন্নবভাবে অবস্থান করে। যেমন- পূর্ব আফ্রিকার কিলিমানজারো। আবার কিছু পর্বত অনেকগুলো পৃথক শৃঙ্গসহ ব্যাপক এলাকা জুড়ে অবস্থান করে। যেমন- হিমালয় পর্বতমালা।

পর্বতের প্রকারভেদ: উৎপত্তিগত বৈশিষ্ট্য ও গঠনপ্রকৃতির ভিত্তিতে পর্বত প্রধানত চার প্রকার। যথা-

  • (ক) ভঙ্গিল পর্বত (Fold Mountains)
  • (খ) আগ্নেয় পর্বত (Volcanic Mountains)
  • (গ) চাতি-রূপ পর্বত (Fault-Block Mountains)
  • (ঘ) ল্যাকোলিথ পর্বত (Lacolith Mountains)

(ক) ভঙ্গিল পর্বত: ভঙ্গ বা ভাঁজ থেকে ভঙ্গিল শব্দটির উৎপত্তি। কোমল পাললিক শিলায় ভাঁজ পড়ে যে পর্বত গঠিত হয়েছে তাকে ভঙ্গিল পর্বত বলে। এশিয়ার হিমালয়, ইউরোপের আল্পস, উত্তর আমেরিকার রকি, দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বত ভঙ্গিল পর্বতের উদাহরণ। ভঙ্গিল পর্বতের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাজ। সমুদ্র তলদেশের বিস্তারিত অবনমিত স্থানে দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরিমাণ পলি এসে জমা হয়। এর চাপে অবনমিত স্থান আরও নিচে নেমে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে ভূ-আলোড়ন বা ভূমিকম্পের ফলে এবং পার্শ্ববর্তী সুদৃঢ় ভূমিখন্ডের প্রবল পার্শ্বচাপের কারণে উর্ধ্বভাঁজ ও নিম্নভাজের সৃষ্টি হয়। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ সমস্ত উর্ধ্ব ও অধঃভাজ সংবলিত ভূমিরূপ মিলেই ভঙ্গিল পর্বত গঠিত হয়।

ভঙ্গিল পর্বত

(খ) আগ্নেয় পর্বত: আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্‌গিরিত পদার্থ সঞ্চিত ও জমাট বেঁধে আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি হয়। একে সঞ্চিত পর্বতও বলে। এই পর্বত সাধারণত মোচাকৃতির (Conical) হয়ে থাকে। আগ্নেয় পর্বতের উদাহরণ হলো ইতালির ভিসুভিয়াস, কেনিয়ার কিলিমানজারো, জাপানের ফুজিয়ামা এবং ফিলিপাইনের পিনাটুবো পর্বত ।

আগ্নেয় পর্বত

(গ) চ্যুতি-স্তূপ পর্বত: ভূআলোড়নের সময় ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে প্রসারণ এবং সংকোচনের সৃষ্টি হয়। এই প্রসারণ এবং সংকোচনের জন্য ভূত্বকে উপত্যক ফাটলের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এ ফাটল বরাবর ভূত্বক ক্রমে স্থানচ্যুত হয়। ভূগোলের ভাষায় একে চ্যুতি বলে। ভূত্বকের এ স্থানচ্যুতি কোথাও উপরের দিকে হয়, আবার কোথাও নিচের দিকে হয়। চ্যুতির ফলে উঁচু হওয়া অংশকে স্তূপ পর্বত বলে। ভারতের বিন্ধ্যা ও সাতপুরা পর্বত, জার্মানির ব্ল‍্যাক ফরেস্ট, পাকিস্তানের লবণ পর্বত স্তূপ পর্বতের উদাহরণ।

চ্যুতি-স্তূপ পর্বত

(ঘ) ল্যাকোলিথ পর্বত: পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে গলিত শিলা বা ম্যাগমা বিভিন্ন গ্যাসের দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে ভূপৃষ্ঠে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কোনো সময় বাধা পেয়ে এগুলো ভূপৃষ্ঠের উপরে না এসে ভূত্বকের নিচে একস্থানে জমাট বাঁধে। উর্ধ্বমুখী চাপের কারণে স্ফীত হয়ে ভূত্বকের অংশবিশেষ গম্বুজ আকার ধারণ করে। এভাবে সৃষ্ট পর্বতকে ল্যাকেলিথ পর্বত বলে। ঢাল সামান্য খাড়া স্বপ্ন অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত। এ পর্বতের কোনো শৃঙ্গ থাকে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি পর্বত এর উদাহরণ।

ল্যাকোলিথ পর্বত

মালভূমি (Plateaus)

পর্বত থেকে নিচু কিন্তু সমভূমি থেকে উচু খাড়া ঢালযুক্ত ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ সমতলভূমিকে মালভূমি বলে। মালভূমির উচ্চতা শত মিটার থেকে কয়েক হাজার মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর বৃহত্তম মালভূমির উচ্চতা ২ ৪,২৭০ থেকে ৫,১৯০ মিটার।

অবস্থানের ভিত্তিতে মালভূমি তিন ধরনের। যথা-

  • (ক) পর্বতমধ্যবর্তী মালভূমি (Intermontane Plateau)
  • (খ) পাদদেশীয় মালভূমি (Piedmont Plateau) ও
  • (গ) মহাদেশীয় মালভূমি (Continental Plateau)।

(ক) পর্বতমধ্যবর্তী মালভূমি: এই মালভূমি পর্বতবেষ্টিত থাকে। তিব্বত মালভূমি একটি পর্বতমধ্যবর্তী মালভূমি যার উত্তরে কুনলুন ও দক্ষিণে হিমালয় পর্বত এবং পূর্ব-পশ্চিমেও পর্বত ঘিরে আছে। দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো এবং এশিয়ার মঙ্গোলিয়া ও তারিম এ ধরনের মালভূমি।

পর্বত মধ্যবর্তী মালভূমি

(খ) পাদদেশীয় মালভূমি: উচ্চ পর্বত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এর পাদদেশে তলানি জমে যে মালভূমির সৃষ্টি হয় তাকে পাদদেশীয় মালভূমি বলে। উত্তর আমেরিকার কলোরাডো এবং দক্ষিণ আমেরিকার পাতাগোনিয়া পাদদেশীয় মালভূমি।

পাদদেশীয় মালভূমি

(গ) মহাদেশীয় মালভূমিঃ সাগর বা নিম্নভূমি পরিবেষ্টিত বিস্তীর্ণ উচ্চভূমিকে মহাদেশীয় মালভূমি বলে। এ ধরনের মালভূমির সঙ্গে পর্বতের কোনো সংযোগ না। স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, গ্রিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকা এবং ভারতীয় উপদ্বীপ এর অন্যতম উদাহরণ ।

সমভূমি (Plains)

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প উচু মৃদু ঢালবিশিষ্ট সুবিস্তৃত ভূমিকে সমভূমি বলে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন নদী, হিমবাহ ও বায়ুর ক্ষয় ও সঞ্চয় ক্রিয়ার ফলে সমভূমির সৃষ্টি হয়। মৃদু ঢাল ও স্বল্প বন্ধুরতার জন্য সমভূমি কৃষিকাজ, বসবাস, রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য খুবই উপযোগী। তাই সমভূমিতে সবচেয়ে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে।

সমভূমির উৎপত্তির ধরনের ভিত্তিতে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ক্ষয়জাত সমভূমি ও সঞ্চয়জাত সমভূমি।

সমভূমি

ক্ষয়জাত সমভূমি: বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির যেমন নদীপ্রবাহ, বায়ুপ্রবাহ এবং হিমবাহের ক্ষয়ক্রিয়ার ফলে কোনো উচ্চভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্ষয়জাত সমভূমির সৃষ্টি হয়। অ্যাপালেশিয়ান পাদদেশীয় সমভূমি, ইউরোপের ফিনল্যান্ড ও সাইবেরিয়া সমভূমি এ ধরনের ক্ষয়জাত সমভূমি। বাংলাদেশের মধুপুরের চত্বর ও বরেন্দ্রভূমি দুইটি ক্ষয়জাত সমভূমির উদাহরণ।

সঞ্চয়জাত সমভূমি: নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা পলি, বালুকণা, ধূলিকণা কোনো নিম্ন অঞ্চলে সঞ্চিত হয়ে কালক্রমে যে সমভূমি সৃষ্টি হয় তাকে সঞ্চয়জাত সমভূমি বলে। এ ধরনের সঞ্চয়জাত সমভূমি পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত যে কোনো অবস্থানে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- নদীর পলি অবক্ষেপণের মাধ্যমে সৃষ্ট প্লাবন সমভূমি, নদীর মোহনার কাছাকাছি এসে নদী সঞ্চায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট ব-দ্বীপ সমভূমি, শীতপ্রধান এলাকায় হিমবাহের গ্রাবরেখা দ্বারা সঞ্চয়কৃত পলি থেকে গড়ে ওঠা হিমবাহ সমভূমি।

  • বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপের কত ভাগ পার্বত্যময়, মালভূমি এবং সমভূমির অন্তর্গত? উত্তরঃ পার্বত্যময় ১৮%, মালভূমি ২৪%, সমভূমি ৫৮%
  • পর্বত কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য কি? উত্তরঃ ভূপৃষ্ঠের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সুউচ্চ শিলাস্তুপকে পর্বত বলে। অধিক উচ্চতা ও খাড়া ঢাল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
  • বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছে এমন একটি পর্বতের উদাহরণ দাও: পূর্ব আফ্রিকার কিলিমানজারো।
  • কোন মালভূমিকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়: পামীর।
নবীনতর পূর্বতন