উদ্ভিদের ফুল থেকে ফল এবং ফল থেকে বীজ হয়। বীজ থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। এভাবে একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যৌন জননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। তাই ফুল উদ্ভিদের যৌন জননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের আশেপাশে বহু ফুল ফুটে থাকে। এগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে কোন ফুলে মোট পাঁচটি অংশ যেমন- পুষ্পাক্ষ বা পুষ্পপত্রাধার , বৃতি, দল বা পাপড়ি বা দলমণ্ডল , পুংকেশর ও গর্ভকেশর আছে । যদি কোন ফুলে পাঁচটি অংশ থাকে তবে ফুলগুলো সম্পূর্ণ ফুল। যেমন- ধুতুরা, জবা ইত্যাদি। আর যদি কোনো কোনোটিতে এই পাঁচটি অংশের মধ্যে একটি বা দুটি অংশ না থাকে তবে ফুলগুলো অসম্পূর্ণ ফুল। যেমন- লাউ, কুমড়া, শসা, ঝিঙ্গা ইত্যাদি। কখনো কখনো ফুলে এই পাঁচটি অংশ ছাড়াও বৃতির নিচে একটি অতিরিক্ত অংশ থাকে। একে উপবৃতি বলে। জবা ফুলে এমন উপবৃতি দেখা যায়। জবা ফুলের স্ত্রীস্তবকে পাঁচটি গর্ভপত্র থাকে । আবার কোনো কোনো ফুলে বৃন্ত থাকে। এগুলো সবৃন্তক ফুল এবং যে ফুলগুলোয় বৃন্ত থাকে না সেগুলো অবৃন্তক ফুল । যে ফুলে শুধুমাত্র পুংস্তবক বা স্ত্রীস্তবক আছে, তাকে একলিঙ্গ ফুল বলে। যেমন- লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা ইত্যাদি । যে ফুলে পুংস্তবক এবং স্ত্রীস্তবক উভয়ই আছে তাকে উভলিঙ্গ ফুল বলে। যেমন- ধুতুরা, জবা, সরিষা ইত্যাদি। সর্বাপেক্ষা বৃহৎ মুকুল রয়েছে বাঁধা কপিতে । যখন ফুলের প্রতিটি স্তবকের বিভিন্ন অংশের আকার, আকৃতি ও বর্ণ একই ধরনের, ঐ ফুলকে সমাঙ্গ ফুল বলে। যেমন- জবা, ধুতুরা, রজনীগন্ধা ইত্যাদি। যখন ফুলের প্রতিটি স্তবকের বিভিন্ন অংশের আকার, আকৃতি ও বর্ণ ভিন্ন ধরনের হয়, তাকে অসমাঙ্গ ফুল বলে। যেমন- মটর, তুলসী ইত্যাদি। পুষ্পপত্র বিন্যাস তিন প্রকার। গাঁদা ফুল অন্ধকারে অংকুরিত হয় । সাধারণত ফলের ৩ টি অংশ যথাঃ বহিঃত্বক, মধ্যত্বক এবং অন্তঃত্বক। স্যালিক এসিড কোন ফলে পাওয়া যায় না ।
ফুলের বিভিন্ন অংশ
![একটি আদর্শ ফুলের বিভিন্ন অংশ](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiHeuJ8qWLs6Grt1zgE0B61fLkv0FV2nTlT8A-rAss7y_NffidIUn0hM5Ni7G0wC06TKTDcrBKpFwGpy01bsgWu-D-5V8z7DTF57JST7Urq4M2KahJ-xXwW8lShKbR7bJZZ6vuQX-BgF5hdVQPEQJO2dTTofyPp5ryvV8NtvP_FX5U9_tvNN6rtePXZWJA/s1600-rw/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF_%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B6_%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8_%E0%A6%85%E0%A6%82%E0%A6%B6.webp)
বৃতি: ফুলের সবচেয়ে বাইরের স্তবককে বৃতি বলে। সাধারণত এরা সবুজ রঙের হয়। বৃতি খণ্ডিত না হলে সেটি যুক্ত বৃতি, কিন্তু যখন এটি খণ্ডিত হয় তখন বিযুক্ত বৃতি বলে। এর প্রতি খণ্ডকে বৃত্যাংশ বলে। বৃতি ফুলের অন্য অংশগুলোকে বিশেষত কুঁড়ি অবস্থায় রোদ, বৃষ্টি ও পোকা-মাকড় থেকে রক্ষা করে।
দলমণ্ডল: এটি বাইরের দিক থেকে দ্বিতীয় স্তবক। কতগুলো পাপড়ি মিলে দলমণ্ডল গঠন করে। এর প্রতিটি অংশকে পাপড়ি বা দলাংশ বলে। পাপড়িগুলো পরস্পর যুক্ত (যেমন-ধূতরা) অথবা পৃথক (যেমন-জবা) থাকতে পারে। এরা বিভিন্ন রঙের হয়। দলমণ্ডল রঙিন হওয়ায় পোকা-মাকড় ও পশুপাখি আকর্ষণ করে এবং পরাগায়ন নিশ্চিত করে। এরা ফুলের অন্য অংশগুলোকে রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে।
পুংস্তবক বা পুংকেশর: এটি ফুলের তৃতীয় স্তবক। এই স্তবকের প্রতিটি অংশকে পুংকেশর বলে। পুংকেশরের দন্ডের মতো অংশকে পুংদন্ড এবং শীর্ষের থলির মতো অংশকে পরাগধানী বলে। পরাগধানীর মধ্যে পরাগরেণু উৎপন্ন হয়। পরাগরেণু থেকে পুং জননকোষ উৎপন্ন হয়। এরা সরাসরি জনন কাজে অংশগ্রহণ করে।
স্ত্রীস্তবক বা গর্ভকেশর: এটি ফুলের চতুর্থ স্তবক। এক বা একাধিক গর্ভপত্র নিয়ে একটি স্ত্রীস্তবক গঠিত হয়। একের অধিক গর্ভপত্র সম্পূর্ণভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকলে তাকে যুক্তগর্ভপত্রী, আর আলাদা থাকলে বিযুক্তগর্ভপত্রী বলে। একটি গর্ভপত্রের তিনটি অংশ, যথা- গর্ভাশয়, গর্ভদণ্ড ও গর্ভমুন্ড। গর্ভাশয়ের ভিতরে ডিম্বক সাজানো থাকে। ডিম্বকে স্ত্রী জননকোষ বা ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। এরা পুংস্তবকের মতো সরাসরি জনন কাজে অংশগ্রহণ করে। বৃতি ও দলমণ্ডলকে ফুলের সাহায্যকারী স্তবক এবং পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে অত্যাবশ্যকীয় স্তবক বলে।
পুষ্পমঞ্জরি : কান্ডের শীর্ষমুকুল বা কাক্ষিক মুকুল থেকে উৎপন্ন একটি শাখায় ফুলগুলো বিশেষ একটি নিয়মে সাজানো থাকে। ফুলসহ এই শাখাকে পুষ্পমঞ্জরি বলে। পরাগায়নের জন্য এর গুরুত্ব খুব বেশি। এ শাখার বৃদ্ধি অসীম হলে অনিয়ত পুষ্পমঞ্জরি ও বৃদ্ধি সসীম হলে তাকে নিয়ত পুষ্পমঞ্জরি বলে।
ফলের উৎপত্তি
আমরা ফল বলতে সাধারণত আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, আঙুর, আপেল, পেয়ারা, সফেদা ইত্যাদি সুমিষ্ট ফলগুলোকে বুঝি। এগুলো পেকে গেলে রান্না ছাড়াই খাওয়া যায়। লাউ, কুমড়া, ঝিঙা, পটল ইত্যাদি সবজি হিসেবে খাওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো সবই ফল। নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া শেষ হলেই ফল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া গর্ভাশয়ে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তার কারণে ধীরে ধীরে গর্ভাশয়টি ফলে পরিণত হয়। এর ডিম্বকগুলো বীজে রুপান্তরিত হয়। নিষিক্তকরণের পর গর্ভাশয় এককভাবে অথবা ফুলের অন্যান্য অংশসহ পরিপুষ্ট হয়ে যে অঙ্গ গঠন করে তাকে ফল বলে।
শুধু গর্ভাশয় ফলে পরিণত হলে তাকে প্রকৃত ফল বলে, যেমন- আম, কাঁঠাল। গর্ভাশয় ছাড়া ফুলের অন্যান্য অংশ পুষ্ট হয়ে যখন ফলে পরিণত হয় তখন তাকে অপ্রকৃত ফল বলে, যেমন-আপেল, চালতা ইত্যাদি। প্রকৃত ও অপ্রকৃত ফলকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- সরল ফল, গুচ্ছ ফল ও যৌগিক ফল।
১) সরল ফল: ফুলের একটি মাত্র গর্ভাশয় থেকে যে ফলের উৎপত্তি তাকে সরল ফল বলে, যেমন- আম। এরা রসাল বা শুষ্ক হতে পারে। সরল ফল দুই প্রকার।
রসাল ফল: যে ফলের ফলত্বক পুরু এবং রসাল তাকে রসাল ফল বলে। এ ধরনের ফল পাকলে ফলত্বক ফেটে যায় না। যেমন- আম, জাম, কলা ইত্যাদি।
নীরস ফল : যে ফলের ফলত্বক পাতলা এবং পরিপক্ক হলে ত্বক শুকিয়ে ফেটে যায় তাকে নীরস ফল বলে। যেমন-শিম, ঢেঁড়স, সরিষা ইত্যাদি।
২) গুচ্ছ ফল: একটি ফুলে যখন অনেকগুলো গর্ভাশয় থাকে এবং প্রতিটি গর্ভাশয় ফলে পরিণত হয়ে একটি বোঁটার উপর গুচ্ছাকারে থাকে তখন তাকে গুচ্ছ ফল বলে, যেমন- চম্পা, নয়নতারা, আকন্দ, আতা, শরীফা ইত্যাদি।
৩) যৌগিক ফল: একটি মঞ্জরির সম্পূর্ণ অংশ যখন একটি ফলে পরিণত হয় তখন তাকে যৌগিক ফল বলে, যেমন- আনারস, কাঁঠাল ইত্যাদি ।
আদর্শ ফল : আদর্শ ফলের তিনটি অংশ -বহিঃত্বক, মধ্যত্বক ও অন্তঃত্বক। যেমন - লিচু। পৃথিবীতে সর্বাধিক উৎপাদিত হয় কলা। পাকা কলায় অ্যামাইল অ্যাসিটেট থাকে। সবচেয়ে সুস্বাদু ফল হল আম। ফল পাকার জন্য দায়ী ইথিলিন, হলুদ রংয়ের জন্য কার্যকর জ্যান্থোফিল, সবুজ রঙের জন্য ক্লোরোফিল।
সব ফুল থেকে ফল হয় না কেন?
ফুলের পরাগধানী থেকে পরাগরেণু বা পুংরেণু ফুলের গর্ভমুণ্ড হয়ে গর্ভাশয়ে পৌঁছায় এবং সেখানে ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে পরবর্তীতে ফল সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এ পুরো প্রক্রিয়াটি কোন কারণে বাধাগ্রস্ত হলে ফল সৃষ্টি হয় না। অনেক সময় গর্ভমুণ্ডের শুষ্কতার জন্য পরাগরেণু অংকুরিত হয় না। আবার পরাগনালী কখনো এত ছোট হয় যে,
তা ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না - এ রকম নানা কারণে ফুল হলেও গাছে ফল হয় না।
পারথেনোর্কাপী ফলোৎপাদন : সাধারণ অবস্থায় উদ্ভিদের ফলের উৎপত্তি পরাগযোগ ও নিষেকের মাধ্যমে ঘটে। কিন্তু অক্সিন প্রয়োগে পরাগযোগ ব্যতীত ফল উৎপাদন করা যায়। পরাগযোগ ব্যতীত বীজহীন ফল উৎপাদন করাকে পারথেনোর্কাপী বা বীজহীন ফলোৎপাদন বলা হয়। অক্সিন প্রয়োগে শশা, আঙ্গুর, টমেটো প্রভৃতি ফল উৎপাদন করা সম্ভব।
ফটোপিরিওডিজম
ফটোপিরিওডিজম: উদ্ভিদের ফুল ধারণের উপর দিবালোকের দৈর্ঘ্যের প্রভাবকে ফটোপিরিওডিজম বলে। অ্যালার্ড ( Allard) ১৯২০ সালে উদ্ভিদের পুষ্প ধারনের উপর ভিত্তি করে এই নামকরণ করেন । ফটোপিরিওডিজমের উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে । যথা--
ছোট দিনের উদ্ভিদ: দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হলে এ ধরনের উদ্ভিদে ফুল ফোটে। যেমন- সয়াবিন, আলু, ইক্ষু, কসমস, শিম, ডালিয়া, তামাক, চন্দ্রমল্লিকা, রোপা আমন, পাট। এদের দীর্ঘরাত্রির উদ্ভিদও বলা হয়।
বড়দিনের উদ্ভিদ: দিনের দৈর্ঘ্য বড় হলে এ জাতীয় ফুল ফোটে। যেমন- ঝিঙ্গা, লেটুস, পালংশাক, আফিম, যব। এদের ছোট রাত্রির উদ্ভিদও বলা হয়।
দিন নিরপেক্ষ উদ্ভিদ: দিনের আলোর সময় সীমার উপর উদ্ভিদের ফুল ধারণ নির্ভর করেনা। যেমন- সূর্যমূখী, টমেটো, শসা, কার্পাস, আউস ধান।
ভার্নালাইজেশন
যে প্রক্রিয়ার দ্বারা বীজ বপনের আগে প্রয়োজনমত নিম্ন বা উচ্চতাপ প্রয়োগ করে স্বাভাবিক সময়কালের পূর্বে উদ্ভিদের ফুল ধরানো হয় তাকে ভার্নালাইজেশন বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে এক দেশের উদ্ভিদকে স্বাভাবিকভাবে অন্য দেশের ভিন্ন আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে জন্মানো সম্ভবপর নয়। কিন্তু ভার্নালাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কোন উদ্ভিদকে যে কোন আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপযোগী করে যেকোন স্থানে জন্মানো যেতে পারে।