ব্যাকটেরিয়া | Bacteria

ব্যাকটেরিয়া হলো আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত, অসবুজ, এককোষী অণুবীক্ষণিক জীব। ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রথম অণুজীব। ১৬৭৫ সালে এ্যান্টনি ভ্যন লিউয়েন হুক প্রথম ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন। জীবজগতে এরা সর্বাপেক্ষা সরল, ক্ষুদ্রতম। ১টি ব্যাকটেরিয়া ১টি কোষ দ্বারা গঠিত। ব্যাকটেরিয়া মাটি, জল,আম্লিক উষ্ণ ঝরনা,তেজস্ক্রিয় বর্জ্য এবং ভূত্বকের গভীর জীবমণ্ডলে বাস করে। ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদ ও প্রাণীর সাথে মিথোজীবী ও পরজীবী সংসর্গেও বাস করে। বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া এখন ও চিহ্নিত হয়নি । মাইক্রোবায়োলজির যে শাখায় ব্যাকটেরিয়া নিয়ে অধ্যয়ন করা হয় তাকে ব্যাকটেরিওলজি বলে।

 ব্যাকটেরিয়া

প্রকারভেদ

ব্যাকটেরিয়া কোষ গোলাকার, দণ্ডাকার, কমা আকার, প্যাঁচানো ইত্যাদি নানা ধরণের হতে পারে। দেহের আকার আকৃতির ভিত্তিতে ব্যাকটেরিয়া সাত প্রকার ৷ যথা:

  • ক) কক্কাস : কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়া কোষের আকৃতি গোলাকার। এরা কক্কাস ব্যাকটেরিয়া। এরা এককভাবে অথবা দলবেঁধে থাকতে পারে, যেমন- নিউমোনিয়া রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া।
  • খ) ব্যাসিলাস : এরা দেখতে লম্বা দণ্ডের ন্যায়। ধনুষ্টংকার, রক্তামাশয় ইত্যাদি রোগ এরা সৃষ্টি করে।
  • গ) কমা : এরা বাঁকা দণ্ডের ন্যায় আকৃতির ব্যাকটেরিয়া। মানুষের কলেরা রোগের ব্যাকটেরিয়া এ ধরনের।
  • ঘ) স্পাইরিলাম: এ ধরণের ব্যাকটোরিয়ার আকৃতি প্যাচানো।
  • ঙ) স্টিলেট বা তারকাকার : এরা দেখতে অনেকটা তারার ন্যায় ।
  • চ) বর্গাকৃতির : এদের গঠন চার বাহুবিশিষ্ট ।
  • ছ) বহুরূপী : এরা সুনির্দিষ্ট আকার বিহীন ।

রঞ্জনের ভিত্তিতে ব্যাকটেরিয়া দুই প্রকার ৷ যথা:

  • ক) গ্রাম পজিটিভ : যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ক্রিস্টাল ভায়োলেট রং ধরে রাখে সে সমস্ত ব্যাকটেরিয়াকে গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া বলে ।
  • খ) গ্রাম নেগেটিভ : যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ক্রিস্টাল ভায়োলেট রং ধরে ধরে রাখতে পারে না সে সমস্ত ব্যাকটেরিয়াকে গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া বলে ।

ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্য

  • এরা এককোষীয় এবং আণুবীক্ষণিক ।
  • এরা আদিকোষ/ প্রাককেন্দ্রিক (Prokaryotic).
  • এরা পরজীবী, মৃতজীবী বা স্বনির্ভর হতে পারে।
  • সাধারণত দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়ায় এরা বংশ বৃদ্ধি করে।
  • ফায ভাইরাসের প্রতি এরা খুবই সংবেদনশীল ।
  • এদের অধিকাংশই খনিজ লবণ জারিত করে শক্তি সংগ্রহ করে ।
  • কতক ব্যাকটেরিয়া অবায়বীয় অর্থাৎ অক্সিজেন থাকলে বাঁচতে পারে না। কতক সুবিধাবাদী অবায়বীয় অর্থাৎ অক্সিজেনের উপস্থিতিতেও বাঁচতে পারে । কতক বাধ্যতামূলক বায়বীয় অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না ।
  • ব্যাকটেরিয়া প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এন্ডোস্পোর বা অন্তরেণু গঠন করে । এ অবস্থায় এরা ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে ।
  • মানুষের দেহে যতগুলো কোষ আছে, এর থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০-১০০ গুণ বেশি
  • যেসব অণুজীব রোগ সৃষ্টি করে তাদের বলা হয় প্যাথজোনিক।
  • প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া: যে সকল ব্যাকরেটিয়া রোগ সৃষ্টি করে, তাদেরকে প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া বলা হয়।
  • অ্যারোবিক ব্যাকটেরিয়া: যে সকল ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের উপস্থিতি ছাড়া বাচতে পারে না, তাদের অ্যারোবিক ব্যাকটেরিয়া বলে।
  • অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়া: যে সকল ব্যক্টেরিয়া বায়ুর উপস্থিতি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে, তাদের অ্যানারোবিক ব্যাকটেরিয়া বলে।
  • ফেকালটেটিভ ব্যাকটেরিয়া: যে সকল ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের উপস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কিন্তু অক্সিজেনের উপস্থিতি ছাড়াও বাঁচতে পারে, তাদের ফ্যাকালটেটিভ ব্যাকটেরিয়া বলে।
  • প্রাণিদেহে জীবাণুজাত বিষ নিষ্ক্রিয়কারী রাসায়নিক পদার্থের নাম অ্যান্টিবডি।
  • নিষ্পিষ্ট মসলায় লবণ মিশিয়ে অনেকদিন রাখা যায় কেন: লবণ পচনকারী জীবাণুর বংশ বিস্তার রোধ করে।

ব্যাকটেরিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

  1. চামড়া শিল্পে: চামড়া থেকে লোম ছাড়ানোর কাজে Bacillus-এর বিভিন্ন প্রজাতি ব্যবহৃত হয়।
  2. দুগ্ধ শিল্পে: যেমন দুধ থেকে দই তৈরি করে থাকে Lactobacillus এবং Streptococcus নামক ব্যাকটেরিয়া।
  3. অ্যালকোহল ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ।
  4. অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে: যেমন- Bacillus subtlis থেকে সাবটিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়।
  5. ভ্যাক্সিন তৈরি: B.C.G., D.PT. টিটেনাস টক্সয়েড (TT) ইত্যাদি ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হয়।
  6. ইনসুলিন তৈরিতে: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে ইনসুলিন অল্প সময়ে ও অল্প ব্যয়ে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
  7. বায়োগ্যাস উৎপাদনে: ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতায় আবর্জনা ও গোবর থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়।
  8. মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (M.S.G.) বা টেস্টিং সল্ট তৈরিতে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হয়।
  9. পাট গাছ থেকে আঁশ ছাড়ানো: পাট গাছ থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। পাট গাছ থেকে এ আঁশ সংগ্রহে ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশ সংগ্রহ করতে সাহায্য করে Clostridium pectinovorum নামক ব্যাকটেরিয়া ।
  10. ব্যাকটেরিয়া জীন প্রকৌশলের মূল ভিত্তি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য পাওয়ার জন্য জীনগত পরিবর্তনের কাজে ব্যাকটেরিয়াকে ব্যবহার করা হয় ।
  11. একমাত্র ব্যাকটেরিয়াই প্রকৃতি থেকে মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।
  12. মৃত জীবদেহ ও আর্বজনা পঁচাতে ব্যাকটেরিয়া সাহায্য করে।

ব্যবহার

  • অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরীতে : ব্যাকটেরিয়া হতে সাবটিলিন, পলিমিক্সিন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হয় ।
  • ব্যাকটেরিয়া হতে যেসব প্রতিষেধক/ টীকা /ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়:
    প্রতিষেধক
    রোগ ভ্যাকসিনের নাম
    যক্ষ্মা B.C.G
    ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, হেপাটাইটিস-বি, Haemophylus influenzae ঘটিত মেনিনজাইটিস Pentavaccine
    ধনুষ্টংকার T.T
    টাইফয়েড টাইফয়েড ভ্যাকসিন
    Polio Polio
  • Oral Polio Vaccine কোন ধরনের: Live attenuated, Subunit ও Toxoid.
  • যক্ষ্মার টিকা: যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে দেয়া হয় বিসিজি (Bacillus Calmatte Guerin) টিকা। অন্যদিকে ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি ও টিটেনাসের প্রতিষেধক হিসেবে ডিপিটি (DPT) টিকা দেয়া হয়। আর টিটি (Tetanus Toxoid) প্রতিষেধক টিকা দেয়া হয় টিটেনাস রোগ থেকে রক্ষার জন্য।
  • ইপিআই কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগের সংখ্যা বর্তমানে ১০টি যথা: যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস বি, পোলিও মাইলাইটিস, হাম, নিউমোনিয়া, রুবেলা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি (২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী)। নিউমোনিয়া ও রুবেলা ২০১০ থেকে শুরু হয়েছে।
  • আমাদের অগ্রে যে ব্যাকটেরিয়া থাকে: Escherichia coli.
  • চা, তামাক, কফি প্রক্রিয়াকরণে কোন অণুজীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে: ব্যাকটেরিয়া।
  • পাট হতে আশ ছড়াতে, চামড়া হতে লোম ছড়াতে, দুধ হতে মাখন, দই, পনির তৈরিতে কোন অণুজীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে: ব্যাকটেরিয়া।
  • সমুদ্রের পানিতে ভাসমান তেল কিভাবে অপসারণ করা হয়: তেল খাদক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে।
  • কোন ব্যাকটেরিয়া ভিনেগার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়: Acetobacter xylinum
  • কোন ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটিক এসিড প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়: Bacillus lacticacidi
  • কোন ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিটোন প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়: Clostridium acetobutylicum
  • নাইট্রোজেন নিয়ে নাইট্রোজেন যৌগ গঠন করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে: Azotobacter, Pseudomonas, Clostridium.
  • শীম জাতীয় উদ্ভিদে কোন ধরণের ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেনকে নাইট্রেটে পরিণত করে: Rhizobium

ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টরোগ

  • ব্যাকটেরিয়া প্রাণিদেহে কি কি রোগ সৃষ্টি করে: গরু মহিষের যক্ষ্মা, ভেড়ার অ্যানথ্রাক্স, ইদুরের প্লেগ এবং মুরগীর কলেরা রোগ ইত্যাদি।
  • ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদের কি কি রোগ সৃষ্টি করে: গমের টুন্ডুরোগ, ধানের ব্রাইট, আখের আঠাঝড়া রোগ, টম্যাটোর ক্যাংকার, আলুর পচা রোগ, ভূট্টার বোটা পচা রোগ ইত্যাদি।
  • ব্যাকটেরিয়া মানুষের কি কি রোগ সৃষ্টি করে:
    রোগ ব্যাকটেরিয়া রোগ বিস্তারের মাধ্যম
    যক্ষ্মা Mycobacterium tuberculosis বায়ু
    নিউমোনিয়া Streptococcus pneumoniae বায়ু
    ডিপথেরিয়া Corynebacterium diptheriae বায়ু
    হুপিংকাশি Bordetella pertussis বায়ু
    মেনিনজাইটিস Neisseria meningitidis বায়ু
    গনোরিয়া Neisseria gonorrhoeae যৌন
    সিফিলিস Treponema pallidum যৌন
    টাইফয়েড Salmonella typhi খাদ্য, পানি
    প্যারাটাইফয়েড Salmonella paratyphi খাদ্য, পানি
    কলেরা Vibrio cholerae খাদ্য, পানি
    রক্ত আমাশয় Shigella dysenteriae খাদ্য, পানি
    কুষ্ঠ / লেপ্রোসি Mycobacterium leprae দীর্ঘদিন রোগীর সংস্পর্শে
    ধনুস্টংকার Clostirdium tetani ক্ষতস্থান দিয়ে
    প্লেগ Yersenia pestis ইঁদুর
    Leishmaniasis (কালাজ্বর)
    Pertusis(হুপিংকফ)
    Tuberculosis
  • নিউমোনিয়া: ফুসফুসের প্রদাহকে নিউমোনিয়া বলে।
  • নিউমোনিয়ার কারণ:
    ক) ব্যাকটেরিয়া: স্টেপটোকক্কাস, স্টেফাইলোকক্কাস ইত্যাদি।
    খ) ভাইরাস: ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি।
    গ) কৃমি: গোলকৃমি।
  • ডিপথেরিয়া রোগে দেহের কোন অংশ আক্রান্ত হয়: গলা।
  • কুষ্ঠরোগের লক্ষণ: ত্বকে বিশেষ ধরনের ক্ষতে ব্যথাহীনতা।
  • নানা প্রকার টাটকা ও সংরক্ষিত খাদ্য দ্রব্যের পচন ঘটায়: ব্যাকটেরিয়া।
  • দুধ দহনের পর বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা টক হয়ে যায় কেন: দুধের ল্যাক্টোজ থাকে। দুধের ব্যাক্টোরিয়া ল্যাক্টোজকে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত করে। ফলে দুধ টক হয়।
  • লাইভ ভ্যাকসিন:
    ১. হাম/মিসেল্স
    ২. মাম্পস
    ৩. রুবেলা
    ৪. যক্ষা (টিউবারকুলোসিস/ টিবি)
    ৫. টাইফয়েড
    ৬. ভ্যারিসেলা (বসন্ত)
    ৭. পোলিও
    ৮. ইয়োলো ফিভার / পীত জ্বর
    ৯. ইনফ্লুয়েঞ্জা

রক্ত আমাশয়ের জীবাণুর নাম: রক্ত আমাশয়ের প্রধান কারণ হলো এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যার নাম শিগেলা যা দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। রক্ত আমাশয়ের লক্ষণ হলো-পেটে তীব্র মোচড় দিয়ে ব্যথা হওয়া, অল্প অল্প করে বার বার পায়খানা, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া এবং মলদ্বারে তীব্র ব্যাথা হওয়া।

পাস্তুরায়ন: দুধকে জীবানুমুক্ত করার প্রক্রিয়াকে পাস্তুরায়ন বলে। এ প্রক্রিয়ায় দুধকে ৩ মিনিট ধরে ১৪০০-১৫০° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে হঠাৎ ৫০° ফারেনহাইট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনলে দুধ জীবাণুমুক্ত হয়। তাপমাত্রা ৫০° সেলসিয়াস এর নিচে রাখলে অন্তত দুদিন দুধ ভাল থাকে। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর এ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারকের নামানুসারে এ পদ্ধতির নামকরণ করা হয়েছে 'পাস্তুরায়ন'।

নবীনতর পূর্বতন