প্রাণিজগৎ কি ? প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস | Animal world

পৃথিবীতে অসংখ্য বিচিত্র ছোট বড় প্রাণী বাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে নানারকম মিল ও অমিল। এ বৈচিত্র্যময় প্রাণিকূলে রয়েছে আণুবীক্ষণিক প্রাণী অ্যামিবা থেকে শুরু করে বিশাল আকারের তিমি। প্রাণীর বিভিন্নতা নির্ভর করে পরিবেশের বৈচিত্রের উপর। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও বাসস্থানে প্রাণিবৈচিত্র্য ভিন্ন রকম হয়। বিশাল এই প্রাণিজগৎ সম্পর্কে জানা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সহজে সুশৃঙ্খলভাবে বিশাল প্রাণিজগৎকে জানার জন্য এর বিন্যস্তকরণ প্রয়োজন, আর বিন্যস্ত করার পদ্ধতিকে শ্রেণিবিন্যাস বলে। শ্রেণিবিন্যাস প্রাণিজগৎকে জানার পথ সহজ করে দিয়েছে।

 প্রাণিজগৎ

প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস

পৃথিবীতে এ রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীর সংখ্যা আমাদের সঠিক জানা নেই। আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী আবিস্কৃত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিপুল সংখ্যক প্রাণীর পঠন ও প্রকৃতি সম্বন্দ্বে জ্ঞান অর্জনের সহজ উপায় হলো শ্রেণিবিন্যাস। প্রাণিদেহে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে মিল, অমিল ও পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তার উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর বা ধাপে সাজানো হয়। জীবজগৎকে ধাপে ধাপে বিন্যস্ত করার এই পদ্ধতিকে শ্রেণিবিন্যাস বলে। প্রয়োজনের তাগিদে বর্তমানে জীববিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা গড়ে উঠেছে। এর নাম শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা (Taxonomy) |

প্রজাতি হলো শ্রেণিবিন্যাসের সবচেয়ে নিচের ধাপ বা একক। যেমন- মানুষ, কুনোব্যাঙ, কবুতর ইত্যাদি এক একটি প্রজাতি। কোনো প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস করতে হলে সেই প্রাণীকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধাপে ধাপে সাজাতে হয়। এই সকল ধাপের প্রত্যেকটিকে যথাযথভাবে বিন্যস্ত করতে হয়। শ্রেণিবিন্যাসের ইতিহাসে অ্যারিস্টটল, জন রে ও ক্যারোলাস লিনিয়াসের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতিবিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াসকে শ্রেণিবিন্যাসের জনক বলা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম প্রজাতির বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন এবং দ্বিপদ বা দুই অংশ বিশিষ্ট নামকরণ প্রথা প্রবর্তন করেন। একটি জীবের বৈজ্ঞানিক নাম দুই অংশ বা পদবিশিষ্ট হয়। এই নামকরণকে দ্বিপদ নামকরণ বা বৈজ্ঞানিক নামকরণ বলে। যেমন- মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম - Homo sapiens। বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাটিন অথবা ইংরেজি ভাষায় লিখতে হয়।

অমেরুদণ্ডী প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস

আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসে সকল প্রাণী অ্যানিম্যালিয়া (Animalia) জগতের (kingdom) অন্তর্ভুক্ত। এই শ্রেণিবিন্যাসে পূর্বের প্রোটোজোয়া পর্বটি প্রোটিস্টা (Protista) জগতে একটি আলাদা উপজগৎ (Subkingdom) হিসেবে স্থান পেয়েছে।

অ্যানিম্যালিয়া জগতের প্রাণীদের নয়টি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এই নয়টি পর্বের প্রথম আটটি পর্বের প্রাণীরা অমেরুদণ্ডী এবং শেষ পর্বের প্রাণীরা মেরুদণ্ডী।

১. পর্ব: পরিফেরা (Porifera)

স্বভাব ও বাসস্থান: পরিফেরা পর্বের প্রাণীরা সাধারণভাবে স্পঞ্জ নামে পরিচিত। পৃথিবীর সর্বত্রই এদের পাওয়া যার। এদের অধিকাংশ প্রজাতি সামুদ্রিক। তবে কিছু কিছু প্রাণী স্বাদু পানিতে বাস করে। এরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • সরলতম বহুকোষী প্রাণী।
  • দেহপ্রাচীর অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত। এই ছিদ্রপথে পানির সাথে অক্সিজেন ও খাদ্যবস্তু প্রবেশ করে।
  • কোনো পৃথক সুগঠিত কলা, অঙ্গ ও তন্ত্র থাকে না।
  • উদাহরণ: স্পঞ্জিলা, স্কাইফা ইত্যাদি।

২. পর্ব: নিডারিয়া (Cnidaria)

এই পর্ব ইতোপূর্বে সিলেন্টারেটা নামে পরিচিত ছিল।

স্বভাব ও বাসস্থান: পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলে এই পর্বের প্রাণী দেখা যায়। এদের অধিকাংশ প্রজাতি সামুদ্রিক। তবে অনেক প্রজাতি খাল, বিল, নদী, হ্রদ, ঝরনা ইত্যাদিতে দেখা যায়। এই পর্বের প্রাণীগুলো বিচিত্র বর্ণ ও আকার-আকৃতির হয়। এদের কিছু প্রজাতি এককভাবে আবার কিছু প্রজাতি দলবদ্ধভাবে কলোনি গঠন করে বাস করে। এরা সাধারণত পানিতে ভাসমান কাঠ, পাতা বা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে - দেহকে আটকে রেখে বা মুক্তভাবে সাঁতার কাটে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • নিডারিয়া পর্বের প্রাণীরা – দ্বিভ্রুণস্তরী। দেহ দুটি ভ্রুণীয় কোষস্তর দ্বারা গঠিত। দেহের বাইরের দিকের স্তরটি এক্টোডার্ম এবং ভিতরের স্তরটি এন্ডোভার্ম।
  • দেহ গহ্বরকে সিলেন্টেরন বলে। এটা একাধারে পরিপাক ও সংবহনে অংশ নেয়।
  • এক্টোডার্মে নিডোব্লাস্ট নামে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোষ থাকে। এই কোষগুলো শিকার ধরা, আত্মরক্ষা, চলন ইত্যাদি কাজে অংশ নেয়।
  • উদাহরণ: হাইড্রা , জেলিফিস , প্রবাল কীট ইত্যাদি।
  • অমর প্রাণীর উদাহরণ: অ্যামিবা, হাইড্রা ।

হাইড্রা নামকরণের তাৎপর্য: হাইড্রা একটি বহুমস্তক বিশিষ্ট কাল্পনিক দৈত্যের নাম। দৈত্যের মাথা কাটলে তার বদলে দুই বা ততোধিক মাথা গজাত। হাইড্রা ঐ দৈত্যের মত হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে, তাই অনেক সময় বহু মাথাওয়ালা সদস্য আবির্ভূত হয়।

৩. পর্ব: প্লাটিহেলমিনথেস (Platyhelminthes)

স্বভাব ও বাসস্থান : এই পর্বের প্রাণীদের জীবনযাত্রা বেশ বৈচিত্র্যময়। এই পর্বের বহু প্রজাতি বহিঃপরজীবী বা অন্তঃপরজীবী হিসেবে অন্য জীবদেহের বাইরে বা ভিতরে তবে কিছু প্রজাতি মুক্তজীবী হিসেবে স্বাদু পানিতে আবার কিছু প্রজাতি লবণাক্ত পানিতে বাস করে। এই পর্বের কোনো কোনো প্রাণী ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বাস করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহ চ্যাপ্টা, উভলিঙ্গ ।
  • বহিঃপরজীবী বা অন্তঃপরজীবী।
  • দেহ পুরু কিউটিকল দ্বারা আবৃত।
  • দেহে চোষক ও আংটা থাকে।
  • দেহে শিখা অঙ্গ নামে বিশেষ অঙ্গ থাকে, এগুলো রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
  • পৌষ্টিকতন্ত্র অসম্পূর্ণ বা অনুপস্থিত।
  • উদাহরণ: যকৃৎ কৃমি, ফিতা কৃমি ইত্যাদি।

৪. পর্ব: নেমাটোডা (Nematoda)

অনেকে একে নেমাথেলমিনথেস বলে।

স্বভাব ও বাসস্থান: নেমাটোড পর্বের প্রাণীগুলো সুতাকৃমি বা গোলকৃমি নামে পরিচিত। এই পর্বের অনেক প্রাণী অন্তঃপরজীবী হিসেবে প্রাণীর অন্ত্র ও রক্তে বসবাস করে। এসব পরজীবী বিভিন্ন প্রাণী ও মানবদেহে বাস করে নানারকম ক্ষতি সাধন করে। তবে অনেক প্রাণীই মুক্তজীবী, যারা পানি ও মাটিতে বাস করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহ নলাকার ও পুরু ত্বক দ্বারা আবৃত।
  • পৌষ্টিকনালি সম্পূর্ণ, মুখ ও পায়ু ছিদ্র উপস্থিত।
  • শ্বসনতন্ত্র ও সংবহনতন্ত্র অনুপস্থিত।
  • সাধারণত একলিঙ্গ।
  • দেহ গহবর অনাবৃত ও প্রকৃত সিলোম নাই।
  • উদাহরণ: গোলকৃমি, কেঁচো কৃমি, ফাইলেরিয়া কৃমি ইত্যাদি।

৫. পর্ব: অ্যানেলিডা (Annelida)

স্বভাব ও বাসস্থান: পৃথিবীর প্রায় সকল নাতিশীতোষ্ণ ও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে এই পর্বের প্রাণীদের পাওয়া যায়। এদের বহু প্রজাতি স্বাদু পানিতে এবং কিছু প্রজাতি অগভীর সমুদ্রে বাস করে। এই পর্বের বহু প্রাণী সেঁতসেঁতে মাটিতে বসবাস করে। কিছু প্রজাতি পাথর ও মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসবাস করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহ নলাকার ও খন্ডায়িত।
  • নেফ্রিডিয়া নামক রেচন অঙ্গ থাকে।
  • প্রতিটি খন্ডে সিটা থাকে (জোঁকে থাকে না)। সিটা চলাচলে সহায়তা করে।
  • উদাহরণ: কেঁচো, জোঁক ইত্যাদি।

কেঁচোকে প্রাকৃতিক লাঙ্গল বলা হয় কেন: লাঙ্গলের দ্বারা মাটিকে আলগা করা হয় যাতে মাটির ভিতর বায়ু প্রবেশ করতে পারে। কেঁচো মাটিকে আলগা করে মাটির ভিতর বায়ু প্রবেশের সহায়তা করে বলে একে প্রাকৃতিক লাঙ্গল বলে।

৬. পর্ব: আর্থ্রোপোডা (Arthropoda)

স্বভাব ও বাসস্থান: এই পর্বটি প্রাণিজগতের সবচেয়ে বৃহত্তম পর্ব। এরা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র সকল পরিবেশে বাস করতে সক্ষম। এদের বহু প্রজাতি অন্তঃপরজীবী ও বহিঃপরজীবী হিসেবে বাস করে। বহু প্রাণী স্থলে, স্বাদু পানিতে ও সমুদ্রে বাস করে। এ পর্বের অনেক প্রজাতির প্রাণী ডানার সাহায্যে উড়তে পারে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত ও সন্ধিযুক্ত উপাঙ্গ বিদ্যমান।
  • মাথায় একজোড়া পুঞ্জাক্ষি ও অ্যান্টেনা থাকে।
  • নরম দেহ কাইটিন সমৃদ্ধ শক্ত আবরণী দ্বারা আবৃত।
  • দেহের রক্তপূর্ণ গহ্বর হিমোসিল নামে পরিচিত।
  • উদাহরণ: প্রজাপতি, চিংড়ি, আরশোলা, কাঁকড়া , মাছি , মৌমাছি , রেশমপোকা, রাজ কাঁকড়া , মাকড়সা ইত্যাদি।

জীবন্ত জীবাশ্ম : যে সমস্ত জীব সুদূর অতীতে উত্পত্তি লাভ করেও কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই এখনও পৃথিবীতে টিকে আছে, অথচ তাদের সমসাময়িক জীবদের অবলুপ্তি ঘটেছে, সেই সকল জীবদের জীবন্ত জীবাশ্ম বলে । ব বাংলাদেশের এমন একটি জীবন্ত জীবাশ্মের নাম হলো: রাজ কাঁকড়া । তাছাড়া Cycas (উদ্ভিদ), প্লাটিপাস ও বাংলাদেশের জীবন্ত জীবাশ্মের উদাহরণ ।

মাকড়সা অমেরুদন্ডী প্রাণী । এটি একটি আর্থ্রোপোডা পর্বের শিকারী কীট বিশেষ। এদের শরীর মাথা ও ধড় দুটি অংশে বিভক্ত, আটটি পা আছে কিন্তু ডানা নেই। মাকড়সার একটি বিশেষ গুণ হল, এরা আঠালো জাল তৈরি করে এবং সেই জালে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ ইত্যাদিকে বন্দি করে শিকার করে। অনেক রকম মাকড়সা হয়, কেউ জাল বোনে, কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে। সব মাকড়সার একজোড়া বিষগ্রন্থি আছে। মাকড়সা প্রথমে শিকারকে জালবন্দি করে, তারপর বিষাক্ত দাঁড়া দিয়ে নিহত করে। জালবোনা মাকড়সারা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন। কয়েকটি বিখ্যাত বিষাক্ত মাকড়শা হলো : টারান্টুলা (বিষ মানুষের ক্ষতি করেনা) , ব্ল্যাক উইডো মাকড়সা । মাকড়সা কে ভয় পাওয়া হলো এক ধরনের ফোবিয়া,আ্যরাকনিডাফোবিয়া।

সবচেয়ে বড় পর্ব হলো আর্থ্রোপোডা । সকল কীটপতঙ্গ ও এর অন্তর্ভুক্ত। ক্ষতিকারক পতঙ্গকে পেস্ট বলে। কয়েকটি ক্ষতিকারক পতঙ্গের নাম হলো : ধানের হলুদ মাজরা পোকা, ধানের পামরী পোকা, পাটের বিছাপোকা, পাটের চেলে পোকা। শুককীট ও পূর্ণাঙ্গ পামরী পোকা ধানপাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এতে পাতা শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। ফলে সালোকসংশ্লেষণের অভাবে ধানের ফলন কমে যায়।

কয়েকটি উপকারী পতঙ্গের নাম হলো : রেশম মথ, মৌমাছি । একটি রাণী মৌমাছি ১,০০০ বার ডিম পাড়ে । প্রতি চাকে একটি রাণী মৌমাছি এবং কয়েকটি পুরুষ মৌমাছি থাকে। স্ত্রী মৌমাছিদের মধ্যে যেগুলো বন্ধ্যা সেগুলোকে কর্মী মৌমাছি বলে । প্রত্যেকটি মৌচাকে কমপক্ষে ২০,০০০- ৮০,০০০ বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি থাকে । কর্মী মৌমাছিদের কাজ মূলত মৌচাককে পরিষ্কার রাখা, অন্য কলোনির মৌমাছিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা, শাবকদের লালন-পালন, এবং রাণীর সেবা করা। কর্মী মৌমাছি ফুল থেকে পুষ্পসার বা নেক্টার সংগ্রহ করে। মৌমাছিদের পাকস্থলীতে এ রস থেকে পানি অপসারিত হয়ে মধুতে পরিণত হয়। কর্মী মৌমাছিগুলো মধু সংগ্রহ করে সেগুলো মৌচাকে জমা করে রাখে। কর্মী মৌমাছির দেহে অবস্থিত মোম গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত পদার্থ থেকে মোম তৈরি হয়। উন্নত জাতের দুটি রেশম পোকার নাম হচ্ছে বিপুল ও সোনালী ।

৭. পর্ব: মলাস্কা (Mollusca)

স্বভাব ও বাসস্থান : এই পর্বের প্রাণীদের দেহ নরম, সাধারণত শক্ত খোলক দ্বারা আবৃত । এদের গঠন, বাসস্থান ও স্বভাব বৈচিত্র্যপূর্ণ। এরা পৃথিবীর প্রায় সকল পরিবেশে বাস করে। প্রায় সবাই সামুদ্রিক এবং সাগরের বিভিন্ন স্তরে বাস করে। কিছু কিছু প্রজাতি পাহাড়ি অঞ্চলে, বনেজঙ্গলে ও স্বাদু পানিতে বাস করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহ নরম। নরম দেহটি সাধারণত শক্ত খোলস দ্বারা আবৃত থাকে।
  • পেশিবহুল পা দিয়ে এরা চলাচল করে।
  • ফুসফুস বা ফুলকার সাহায্যে শ্বসনকার্য চালায়।
  • উদাহরণ: শামুক, ঝিনুক , অক্টোপাস ইত্যাদি।

৮. পর্ব: একাইনোডারমাটা (Echinodermata)

স্বভাব ও বাসস্থান: এই পর্বের সকল প্রাণী সামুদ্রিক। পৃথিবীর সকল মহাসাগরে এবং সকল গভীরতায় এদের বসবাস করতে দেখা যায়। এদের স্থলে বা মিঠা পানিতে পাওয়া যায় না। এরা অধিকাংশ মুক্তজীবী। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • দেহত্বক কাঁটাযুক্ত।
  • দেহ পাঁচটি সমান ভাগে বিভক্ত।
  • পানি সংবহনতন্ত্র থাকে এবং নালিপদের সাহায্যে চলাচল করে।
  • পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে অঙ্কীয় ও পৃষ্ঠদেশ নির্ণয় করা যায় কিন্তু মাথা চিহ্নিত করা যায় না।
  • উদাহরণ: তারামাছ, সমুদ্র শশা ইত্যাদি।

মেরুদন্ডী প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস

৯. পর্ব: কর্ডাটা (Chordata)

স্বভাব ও বাসস্থান : এরা পৃথিবীর সকল পরিবেশে বাস করে। এদের বহু প্রজাতি ডালায় বাস করে। জলচর কর্ডাটাদের মধ্যে বহু প্রজাতি স্বাদু পানিতে অথবা সমুদ্রে বাস করে। বহু প্রজাতি বৃক্ষবাসী, মরুবাসী, মেজুবাসী, গুহাবাসী ও খেচর। কর্ডাটা পর্বের বহু প্রাণী বহিঃপরজীবী হিসেবে অন্য প্রাণীর দেহে সংলগ্ন হয়ে জীবনযাপন করে। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল:

  • এই পর্বের প্রাণীর সারা জীবন অথবা রূপ অবস্থায় পৃষ্ঠীয়দেশ বরাবর নটোকর্ড অবস্থান করে। নটোকর্ড হলো একটি নরম, নমনীয়, দন্ডাকার, দৃঢ় ও অখন্ডায়িত অঙ্গ।
  • পৃষ্ঠদেশে একক, ফাঁপা স্নায়ুরজ্জু থাকে।
  • সারা জীবন অথবা জীবন চক্রের কোনো এক পর্যায়ে পার্শ্বীয় গলবিলীয় ফুলকা ছিদ্র থাকে।
  • উদাহরণ: মানুষ, কুনোব্যাঙ , মাছ , বাঘ , টিকটিকি , পাখি ইত্যাদি ।

এদের মধ্যে সর্বভুক প্রাণীর উদাহরণ হল আরশোলা, কুকুর, বিড়াল, মানুষ, কাক ইত্যাদি। কর্ডাটা পর্বকে তিনটি উপপর্বে ভাগ করা যায়। যথা-

ক. ইউরোকর্ডাটা (Urochordata)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • প্রাথমিক অবস্থায় ফুলকারন্ধ্র, পৃষ্ঠীয় ফাঁপা স্নায়ুরজ্জু থাকে।
  • শুধুমাত্র লার্ভা দশায় এদের লেজে নটোকর্ড থাকে।
  • উদাহরণ: Ascidia

খ. সেফালোকর্ডাটা (Cephalochordata)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • সারাজীবনই এদের দেহে নটোকর্ডের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
  • দেখতে মাছের মতো।
  • উদাহরণ: Branchiostoma

গ. ভার্টিব্রাটা (Vertebrata)

এই উপ-পর্বের প্রাণীরাই মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে পরিচিত। গঠন ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মেরুদন্ডী প্রাণীদের ৭টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।

১. শ্রেণি- সাইক্লোস্টোমাটা (Cyclostomata)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • লম্বাটে দেহ।
  • মুখছিদ্র গোলাকার এবং চোয়ালবিহীন।
  • এদের দেহে আঁইশ বা যুগ্ম পাখনা অনুপস্থিত।
  • ফুলকাছিদ্রের সাহায্যে শ্বাস নেয়।
  • উদাহরণ: Petromyzon
২. শ্রেণি- কনড্রিকথিস (Chondrichthyes)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • এ পর্বের সকল প্রাণী সমুদ্রে বাস করে।
  • কঙ্কাল তরুণাস্থিময়।
  • দেহ প্ল্যাকয়েড আঁইশ দ্বারা আবৃত, মাথার দুই পাশে ৫-৭ জোড়া ফুলকাছিদ্র থাকে।
  • কানকো থাকে না।
  • উদাহরণ: হাঙ্গর, করাত মাছ, হাতুড়ি মাছ
৩. শ্রেণি- অসটিকথিস (Osteichthyes)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • অধিকাংশই স্বাদু পানির মাছ।
  • দেহ সাইক্লোয়েড, প্যানয়েড বা টিনয়েড ধরনের আঁইশ যারা আবৃত।
  • মাথার দুই পাশে চার জোড়া ফুলকা থাকে। ফুলকাগুলো কানকো দিয়ে ঢাকা থাকে। ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়।
  • উদাহরণ: ইলিশ মাছ, সি-হর্স
৪. শ্রেণি উভচর (Amphibia)

মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে যারা জীবনের প্রথম অবস্থায় সাধারণত পানিতে থাকে এবং মাছের মতো বিশেষ ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়, পরিণত বয়সে ডাঙ্গায় বাস করে তারাই উভচর ।

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • দেহ নগ্ন, সিক্ত ও গ্রন্থিযুক্ত ।
  • লার্ভাবস্থায় ফুলকা, পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস নেয়।
  • দেহত্বক আঁইশবিহীন।
  • ত্বক নরম, পাতলা, ভেজা ও গ্রন্থিযুক্ত।
  • শীতল রক্তের প্রাণী।
  • পানিতে ডিম পাড়ে। জীবনচক্রে সাধারণত ব্যাঙাচি দশা দেখা যায়।
  • উদাহরণ: সোনাব্যাঙ, কুনোব্যাঙ
৫. শ্রেণি সরীসৃপ (Reptilia)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • বুকে ভর করে চলে।
  • ত্বক শুষ্ক ও আঁইশযুক্ত।
  • হৃদপিন্ড তিন প্রকোষ্ট বিশিষ্ট। যথাঃ দুটি অলিন্দ এবং একটি অসম্পূর্ণ ভাবে দ্বিধাবিভক্ত নিলয়। তবে কুমিরের হৃদপিন্ড চার প্রকোষ্ট বিশিষ্ট ।
  • চার পায়েই পাঁচটি করে নখরযুক্ত আঙ্গুল আছে।
  • উদাহরণ: টিকটিকি, কুমির, সাপ , কচ্ছপ ।
  • সবচেয়ে লম্বা সাপ: আনাকোন্ডা।
  • সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ: কিং কোবরা।
  • সাপ কিভাবে শুনতে পায়: জিহবার সাহায্যে।

সবচেয়ে বেশি বাঁচে কচ্ছপ। (৫০০ বছর পর্যন্ত)

৬. শ্রেণি পক্ষীফুল (Aves)

সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • দেহ পালকে আবৃত।
  • দুটি ডানা, দুটি পা ও একটি চঞ্চু আছে।
  • ফুসফুসের সাথে বায়ুথলি থাকায় সহজে উড়তে পারে।
  • উষ্ণ রক্তের প্রাণী।
  • হাড় শক্ত , হালকা ও ফাঁপা।
  • উদাহরণ: কাক, দোয়েল, হাঁস
  • সবচেয়ে ছোট পাখি: হামিং বার্ড।
  • সর্ববৃহৎ পাখি: উট পাখি।
  • সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক পাখি: অ্যালব্যাট্রোস।
  • সবচেয়ে বড় শিকারী পাখি: ক্যানডোর।
  • সবচেয়ে দ্রুতগামী পাখি: সুইফট বার্ড।
  • কোন পাখি উড়তে অক্ষম: কিউই পাখি, উট পাখি, এমু, পেঙ্গুইন।
  • কোন পাখি কখনও বাসা তৈরি করে না: কোকিল (কাকের বাসায় ডিম পাড়ে)।
  • ব্রয়লার: যে সকল মুরগী কেবল মাংস উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, তাদের ব্রয়লার বলে।
  • লেয়ার: ডিমপাড়া মুরগীকে লেয়ার বলে।
  • হাইব্রো, স্টার ব্রো, ইন্ডিয়ান রোভাব, মিনিব্রো: উন্নত জাতের ব্রয়লার মুরগী।
৭. শ্রেণি- স্তন্যপায়ী (Mammalia)

সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণী নীল তিমি । প্লাটিপাস একটি স্তন্যপায়ী জীব তবে ডিম দেয় । বাদুড় স্তন্যপায়ী প্রাণী হলে ও এটি উড়তে পারে ।এদের সাধারণ সাধারণ বৈশিষ্ট্য :

  • দেহে লোমে আবৃত এবং বহিঃকর্ণে পিনা থাকে।
  • পরিণত স্ত্রী প্রাণীতে সক্রিয় স্তনগ্রন্থি থাকে।
  • বক্ষ ও উদরের মাঝে ডায়াফ্রাম নামক পর্দা থাকে।
  • স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সন্তান প্রসব করে। তবে এর ব্যতিক্রম আছে, যেমন- প্লাটিপাস।
  • উষ্ণ রক্তের প্রাণী।
  • চোয়ালে বিভিন্ন ধরনের দাঁত থাকে।
  • শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পান করে বড় হয়।
  • হৃৎপিণ্ড চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট।
  • উদাহরণ: মানুষ, উট , বাঘ, তিমি, হাতি, বাদুড়, ডলফিন, খরগোশ, বানর, প্লাটিপাস ইত্যাদি।

বাংলাদেশের জাতীয় পশু: বাংলাদেশের জাতীয় পশু সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে সুন্দরতম ও রাজকীয় এটি। বাঘ (tiger) বিড়াল পরিবারের বৃহত্তম সদস্য। বৈজ্ঞানিক নাম প্যানথেরা ট্রাইগ্রিস (Panthera tigris)। কালো ডোরাযুক্ত হরিদ্রা বর্ণের বাঘের চোখ উজ্জ্বল, মাথা গোলাকার, শরীর ১.৪ থেকে ২.৮ মিটার এবং লেজ ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার লম্বা। প্রায় ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু বাঘ ১৮০-২৬০ কেজি হয়।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কণিকা

  • বানরের কয়টি পা: চারটি ।
  • হরিয়ানা, সিন্ধী, ফ্রিসিয়ান, হিসার কি: উন্নত জাতের গাভী।
  • কোন জাতের গাভী সবচেয়ে বেশি দুগ্ধ পাওয়া যায়: ফ্রিসিয়ান।
  • মানুষ কোন পর্বের অন্তর্ভুক্ত: Chordata.
  • মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম: Homo sapiens
  • সর্ববৃহৎ স্থলচর প্রাণী: আফ্রিকার হাতি।
  • বিশ্বের উচ্চতম প্রাণী: জিরাফ।
  • বিশ্বের দ্রুততম প্রাণী: চিতাবাঘ।
  • হাঁটুতে কান থাকে কোন প্রাণীর: ফড়িং এর।
  • খন্ডায়ন প্রাণী কোনগুলোকে বলা হয়: কেঁচো, জোঁক।
  • সর্বভুক প্রাণী কোনগুলো: তেলাপোকা, মানুষ, কাক, কুকুর।
  • শামুক ও ঝিনুকের খোলস কি দিয়ে তৈরি: কার্বনেট দিয়ে।
  • Jewels of the Sea বলা হয় কোন পর্বের প্রাণীদেরকে: নিডারিয়া পর্বভুক্ত প্রাণীদেরকে।
  • সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ: কিং কোবরা।
  • চোখ মেলে ঘুমায় কোন প্রাণী: মাছ।
  • যে প্রাণীর তিনটি হৃৎপিণ্ড আছে: হাঙর, ক্যাটল ফিশ।
  • কোন প্রাণী প্লেগ রোগের কারণ? - ইঁদুর ।
  • বিড়াল থেকে কোন রোগ সৃষ্টি হয়? - ডিপথেরিয়া ।
  • ত্রিস্তরবিশিষ্ট প্রাণী - তেলাপোকা, কেঁচো, মানুষ ইত্যাদি।
  • একটি অমর প্রাণী - হাইড্রা ।
  • মাছ ও সরীসৃপের মধ্যবর্তী অবস্থা - উভচর।
  • রক্তে হিমোগ্লোবিনযুক্ত অমেরুদণ্ডী প্রাণীর নাম- কেঁচো।
  • মাশরুম গ্রান্ড কী? - আরশোলার প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ।
  • আরশোলার হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ সংখ্যা কত? - ১৩টি।
  • কোকুন: গুটি পোকার লার্ভাগুলো রেশমের তন্তু দিয়ে নিজেদের দহটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে আবৃত করে রাখে। এই আবরণীকে কোকুন বলা হয়।
  • অ্যামপুলা: কেঁচোর শুক্রধানীর কলসীর ন্যায় অংশ।
নবীনতর পূর্বতন