সরল দোলক

সরল দোলক সম্পর্কে জানতে আমাদের কয়েকশত বছর পিছনে ফিরে যেতে হবে । বিখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানি গ্যালিলিওর নাম অবশ্যই শুনেছেন । মূলত তার হাত ধরেই আজকের সরল দোলক । ১৫৮১ সালের একদিন গ্যালিলিও একটি গীর্জায় গিয়েছিলেন উপাসনার জন্য। তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর । গীর্জার ভেতরে হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি লণ্ঠন। ব্রোঞ্জের তৈরি সেই লণ্ঠনটি বাতাসে দুলছিল। একবার বাম দিকে, একবার ডান দিকে। অনেক্ষণ তিনি সেটা পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি উপলদ্ধি করলেন বাম দিক থেকে ডান দিকে এবং ডান দিক থেকে বাম দিকে লণ্ঠনটি যেতে একই সময় নিচ্ছে। এজন্য তিনি নিজের ল্যাবরেটরি তে একটি ভারী বস্তুকে হালকা সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে পেন্ডুলাম বা দোলক তৈরি করে ফেললেন। এভাবেই আবিস্কার হলো সরল দোলক ।

সরল দোলক

সরল দোলক: একটি ভারী আয়তনহীন বস্তুকণাকে ওজনহীন, নমনীয় ও অপ্রসারণশীল সূতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলে এটি যদি ঘর্ষণ এড়িয়ে স্বাধীনভাবে দুলতে পারে তবে তাকে সরল দোলক বলে । কিন্তু বাস্তবে এরুপ সরল দোলক পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, ভারী আয়তনহীন কোন বস্তু কিংবা সম্পূর্ণরূপে অপ্রসারণশীল, ওজনহীন ও নমনীয় সুতার অস্তিত্ব নেই। কতগুলো গাণিতিক হিসাব নিকাশের সুবিধার্থে এরূপ প্রমাণ দোলক কল্পনা করে নেওয়া হয়। সাধারণভাবে একটি হালকা সুতার সাহায্যে কোন দৃঢ় অবলম্বন থেকে একটি ভারী বস্তু ঝুলিয়ে দিলে স্বাভাবিকভাবেই এটি সোজা হয়ে ঝুলবে । সুতাসহ বস্তুটিকে সরল দোলক বলা হয় । দোলকের দোলনকাল দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য ও মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণের উপর নির্ভর করে।

সরল দোলকের অংশসমূহ

 সরল দোলক

বব: যে ভারী ও গোলাকার বস্তুটিকে সুতার সাহায্যে ঝুলিয়ে দিয়ে সরল দোলক তৈরি করা হয় সেটিই সরল দোলকের বব বা পিন্ড ।

ঝুলন বিন্দু: কোন দৃঢ় অবলম্বনের যে নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে সুতার সাহায্যে ববকে ঝোলানো হয় তাকে ঝুলন বিন্দু বলে।

কার্যকরী দৈর্ঘ্য (Functional length): ঝুলন বিন্দু থেকে ববের ভারকেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্বকে সরল দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য বা দোলক দৈর্ঘ্য বলে। একে L দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
L = l + r .
এখানে, l= সুতার দৈর্ঘ্য এবং r= ববের ব্যাসার্ধ্য

বিস্তার: সরল দোলকের সাম্যাবস্থান থেকে যে কোন এক দিকের সর্বোচ্চ দুরত্বকে বিস্তার বলে।

পূর্ণ দোলন: বব এক শেষ হতে অপর প্রান্তে গিয়ে আবার আগের প্রান্তে ফিরে আসলে তাকে পূর্ণ দোলন বলে।

দোলন কাল: একটি পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করতে সরল দোলকের যে সময় লাগে তাকে দোলনকাল বলে। একে T দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
কোন সরল দোলকের N সংখ্যক পূর্ণ দোলনের জন্য যদি t সময় লাগে তাহলে,
T = t N

কম্পাঙ্ক: এক সেকেন্ডে একটি সরল দোলক যে কয়টি পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করে তাকে তার কম্পাঙ্ক বলে। একে f দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কোন সরল দোলক t সময়ে N সংখ্যক পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করলে,
f = N t = t N [ T = t N ]

সরল দোলকের সূত্রসমূহ

১ম সূত্র বা সমকাল সূত্র: কৌণিক বিস্তার অল্প হলে এবং দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকলে কোন নির্দিষ্ট স্থানে একটি সরল দোলকের প্রতিটি দোলনের জন্য সমান সময় লাগবে।

২য় সূত্র বা দৈর্ঘ্যের সূত্র: কৌণিক বিস্তার অল্প হলে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সরল দোলকের দোলনকাল, এর কার্যকরী দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সমানুপাতিক।

৩য় সূত্র বা ত্বরণের সূত্র: কৌণিক বিস্তার অল্প হলে এবং দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকলে এর দোলনকাল অভিকর্ষজ ত্বরণের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক।

৪র্থ সূত্র বা ভরের সূত্র: কৌণিক বিস্তার অল্প হলে এবং কার্যকরী দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকলে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সরল দোলকের দোলনকাল ববের ভর, আয়তন, উপাদান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে না ।

উপরের সূত্র হতে আমরা পাই,
১. সরল দোলকের দোলনকাল কার্যকরী দৈর্ঘ্য ও অভিকর্ষজ ত্বরণের উপর নির্ভরশীল।
২. একটি সরল দোলককে পৃথিবীর কেন্দ্রে নিলে তার দোলনকাল অসীম হবে, কারণ পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্য। এক্ষেত্রে দোলকঘড়ি চলবে না।
৩. গ্রীষ্মকালে দোলকঘড়ি ধীরে চলে। কারণ, অধিক তাপমাত্রার জন্য দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য বাড়ে, ফলে দোলনকাল বাড়ে এবং ঘড়ি ধীরে চলে ।
৪. শীতকালে দোলকঘড়ি দ্রুত চলে। কারণ, কম তাপমাত্রায় দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য কমে, ফলে দোলনকাল কমে এবং ঘড়ি দ্রুত চলে ।
৫. দোলকঘড়ি বিষুবরেখা হতে মেরু অঞ্চলে নিলে ঘড়ি দ্রুত চলবে। কারণ, বিষুবরেখার চেয়ে মেরু অঞ্চলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বেশি । ফলে দোলনকাল কমবে এবং ঘড়ি দ্রুত চলবে।
৬. দোলককে পাহাড়ের উপর নিয়ে গেলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান কম বলে দোলনকাল বাড়বে।
৭. কোন সরল দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য ৯ গুণ বাড়লে দোলনকাল ৩ গুণ বাড়বে, আর মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ ৯ গুণ বাড়লে দোলনকাল ৩ গুণ কমবে।

সরল দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য ও দোলনকালের সম্পর্ক

কৌণিক বিস্তার অল্প হলে কোন নির্দিষ্ট সরল দোলকের দোলনকাল এর কার্যকরী দৈর্ঘ্য, L এর বর্গমূলের সমানুপাতে পরিবর্তিত হয়। T ∝ √L, যখন g ধ্রুব।

সরল দোলকের সুতার দৈর্ঘ্য বাড়ালে, দোলনকাল বাড়বে।
গ্রীষ্মকালে দোলক ঘড়ি ধীরে চলে: গ্রীষ্মকালে অধিক তাপমাত্রার কারণে দোলক ঘড়ির কার্যকরি দৈর্ঘ্য বাড়ে। ফলে দোলনকাল বাড়ে এবং ঘড়িটি ধীরে চলে ।
শীতকালে দোলক ঘড়ি দ্রুত চলে: শীতকালে তাপমাত্রার হ্রাস পেলে দোলক ঘড়ির কার্যকরি দৈর্ঘ্য কমে। ফলে দোলনকাল কমবে এবং ঘড়িটি দ্রুত চলে।

সরল দোলকের দোলনকালের সাথে অভিকর্ষজ ত্বরণের সম্পর্ক

কৌণিক বিস্তার অল্প হলে এবং সরল দোলকের কার্যকরি দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকলে এর দোলনকাল অভিকর্ষজ ত্বরণের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়। T ∝ L g , যখন g ধ্রুব।

মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ বাড়লে, দোলনকাল কমবে।
একটি পেন্ডুলাম ঘড়িকে বিষুবরেখা থেকে মেরুতে নিয়ে গেলে কি পরিবর্তন হবে: বিষুবরেখার চেয়ে মেরু অঞ্চলে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান বেশি। এজন্য পেন্ডুলাম ঘড়িকে বিষুবরেখা বেবোর মেরুতে নিয়ে গেলে দোলনকাল কমবে। ফলে ঘড়িটি দ্রুত চলবে।

দোলকের গতি নিয়ন্ত্রিত হয় নিচের যে সমীকরণ দ্বারা: সরল দোলকের দোলন কাল T, কার্যকরি দৈর্ঘ্য L এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ g হলে, T = 2π L g

একটি সরল দোলকের কার্যকরি দৈর্ঘ্য 9গুণ বাড়লে দোলকের দোলনকাল কতগুণ বাড়বে বা কমবে?
উত্তরঃ 3 গুণ বাড়বে। কারণ,
ধরি, কোন স্থানে একটি দোলকের দোলন কাল T 1 , কার্যকরি দৈর্ঘ্য L এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ g
T 1 = L g
কার্যকরি দৈর্ঘ্য 9 গুণ বাড়লে, পরিবর্তিত কার্যকরি দৈর্ঘ্য = 9L এবং দোলন কাল T 2 হলে
T 2 = 9L g = 3 × L g = 3 × T 1

একটি সরলদোলককে পৃথিবীর কেন্দ্রে নিলে তার দোলনকাল কত হবে: অসীম হবে। কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্য ।

কোন স্থানে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ 9গুণ বাড়লে সেখানে একটি সরল দোলকের দোলনকাল কতগুণ বাড়বে বা কমবে?
উত্তরঃ 3 গুণ কমবে। কারণ,
ধরি, কোন স্থানে একটি দোলকের দোলন কাল T 1 , কার্যকরি দৈর্ঘ্য L এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ g
T 1 = L g
মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ 9 গুণ বাড়লে, পরিবর্তিত মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ = 9g এবং দোলন কাল T 2 হলে
T 2 = L 9g = 1 3 × L g = 1 3 × T 1

নবীনতর পূর্বতন