মনসামঙ্গলের সংক্ষিপ্ত কাহিনী

মনসামঙ্গলের কাহিনী

কালিদহে ফুল তোলার সময়ে শিবের বিন্দু থেকে মনসার জন্ম হয়। মনসার পীড়াপীড়িতে শিব তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়িতে শিবপত্নী চণ্ডীর সঙ্গে বাধে তাঁর বিবাদ। এক পর্যায়ে বিষের প্রভাবে চণ্ডী অচেতন হয়ে পড়লে মনসা, অন্য দেবতাদের অনুরোধে, তাঁর চেতনা ফিরিয়ে আনেন। এভাবে সংসারে কোন্দল সৃষ্টি হলে মনসাকে শিব সিজুয়া পর্বতে রেখে আসেন। তারপরে, ক্ষীরোদসাগর মন্থনের সময় বিষপানে শিব অজ্ঞান হয়ে পড়লে, আবার মনসা শিবকে সুস্থ করে দেন। এ -কার্যের ফলে দেবসমাজে মনসার স্বীকৃতি ঘটে।

দেবতার সমাজে বা দেবপুরে ঠাঁই পাওয়ার জন্য প্রয়োজন মানুষের পূজালাভ। সেজন্য মনসা মানুষের পূজালাভে উদযোগী হয়। মর্তে নেমে এসে প্রথমে রাখালদের মধ্যে পূজা প্রচলন করে—অবশ্যই ভয়-ভীতি দেখিয়ে। রাখালেরা পূজা করতে গিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয় সে এলাকার ধনী কৃষক হাসন-হুসেনের সঙ্গে মনসা পক্ষ নেয় গো-রক্ষকদের। সাপের আক্রমণে 'তুডুক'দের পুরী ও লোকজন ধ্বংস হলে তারা পূজা দিয়ে নিষ্কৃতি পায়।

তাতেও মনসার পূজা সর্বত্র প্রচারিত হয়নি। সেদেশে শক্তিশালী লোক ছিলেন। বণিকপ্রধান চাঁদ সদাগর। তিনি একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন শিবের। মনসা চাঁদের কাছে পূজা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। শিবের বরে চাঁদ ছিলেন মহাজ্ঞানের অধিকারী, তাঁর বন্ধু শংকর গারড়ীর ক্ষমতা ছিল সর্পদংশনের অব্যর্থ চিকিৎসার। সেজন্য তাঁর কাছ থেকে পূজা আদায় করা সহজ কাজ ছিল না। ছলনার মাধ্যমে মনসা গারড়ীকে বধ করে এবং চাদের মহাজ্ঞান হরণ করেন। তারপরে হত্যা করেন চাঁদের ছয় পুত্রকে। তবু, সদাগর পূজা করতে স্বীকৃত হননি, বরং হেতালের লাঠির আঘাতে মনসার কাঁকাল ভেঙ্গে দেন।

পরিবারের অমঙ্গল—আশঙ্কায় কাতর-পত্নী সনকা গোপনে মনসাপূজায় ব্রতী হয়ে পুত্রবর লাভ করে, তবে মনসা জানিয়ে দেয় যে, বাসররাতে সর্পাঘাতে সে প্রাণ হারাবে। ইন্দ্রকে ধরে মনসা অনিরুদ্ধ-ঊষাকে শাপ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান; অনিরুদ্ধ লখিন্দর নামে ও উষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করে। পুত্রের জন্মের সময়ে চাঁদ সদাগর বিদেশে বাণিজ্যে ছিলেন। প্রচুর ধনরত্নসহ দেশে ফেরার সময়ে মনসার আক্রোশে সব সম্পদ ধ্বংস হয়, তিনি নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় বাড়ি ফেরেন। শত বিপর্যয়ের মুখেও কিন্তু তিনি মনসাপূজা না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। দেশে ফিরে উদযোগ নেন পুত্রের বিয়ের। উজানীনগরের সায়বেনের কন্যা বেহুলার সঙ্গে লখিন্দরের বিয়ে হয়। দেবীর অভিশাপ ও আক্রোশ মনে রেখে বেহুলা লখিন্দরের জন্য একটি লোহার ঘর নির্মাণ করা হয়- কিন্তু মনসার কারসাজিতে সেখানেও কালনাগ প্রবেশ করে লখিন্দরের প্রাণসংহার করে।

সদ্যবিধবা বেহুলা সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে স্বামীর লাশ নিয়ে নদীপথে স্বর্গে যাত্রা করে। সর্বপ্রকার বিপদ অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত, মনসার সহচরী নেতা ধোবানির সহায়তায়, স্বর্গে হাজির হয়ে নৃত্য-গীতে দেবতাদের তুষ্ট করে। দেবতাদের মধ্যস্থতায় মনসা লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেন- এমনকি বেহুলার ছয় ভাসুর নৌকাডুবিতে হত মাঝিমাল্লাসহ সদাগরের চোদ্দ ডিঙ্গা ধনরত্ত্বও ফিরিয়ে দেন। বেহুলাও প্রতিশ্রুতি দেয় শ্বশুরকে দিয়ে মনসার পূজা করানোর।

সবকিছু নিয়ে বেহুলা বাড়িতে ফিরে এলে চাঁদ সদাগর বিপাকে পড়েন। শেষপর্যন্ত, সবার অনুরোধে, বেহুলার সত্যরক্ষার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বে তিনি পূজা অনুষ্ঠানে রাজি হন, পেছন ফিরে বাঁ হাতে দেবীর পূজা করেন। চাঁদের মতে -

সিবলিঙ্গ আমি পূজি জেই হাতে।
সেই হাতে তোমারে পূজিতে না লয় চিত্তে।

এভাবে মর্তে চাঁদ কর্তৃক মনসাদেবীর পূজা প্রচারিত হয়।

শেষপর্যন্ত মনসাকে পূজা নিতে বাধ্য হলেও সে প্রেরণা এসেছে মূলত মানবিক বোধ থেকেই – চিরদুঃখিনী পুত্রবধূর সত্যরক্ষার খাতিরে এবং পুত্র-পুত্রবধূ, স্ত্রী, আত্মীয় পরিজন ও প্রজাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ থেকে। চাঁদের পরাজয় ঘটেছে - দেবতার কাছে নয়, মানুষের কাছে।

মনসা দেবীর অপর নাম ছিল কেতকা ও পদ্মাবতী। চাঁদ সওদাগরকে বলা হয় মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিবাদী চরিত্র। চাঁদ সওদাগরের বিদ্রোহ ও বেহুলার সতীত্বের জন্য মনসামঙ্গলের কাহিনী বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

নবীনতর পূর্বতন